‘কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যুম তোঁয়ারে’
Published: 19th, April 2025 GMT
২০১২ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে অসুস্থ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরপরই আমাকে ফোন করেছিলেন শিল্পী এমএন আখতার। বারবার বলছিলেন, তার অসুস্থতার খবর যেন মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। আমি প্রায় সব পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে খবরটা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।
২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিক, সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকায় ‘সুরসম্রাট এমএন আখতারের চোখে জল’ শিরোনামে আমার একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। সেই সংবাদ দেওয়ার জন্য ওইদিন দুপুর ১২টার দিকে এমএন আখতার চাচাকে ফোন করি। তিনি বললেন, ‘নাসির আমি এখনই পত্রিকা আনিয়ে নিচ্ছি, তুমি দ্রুত মেডিকেলে চলে আস, আমাকে দেখে যাও।’ তার আধ ঘণ্টা পর আমি চাচাকে দেখার জন্য হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছিলাম। তখনই চাচার ছোট ছেলে রানার ফোন এলো। রানা হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। বললেন, ‘আজকের পত্রিকায় ছাপা হওয়া আপনার লেখাটা বাবা পড়তে চেয়েছিলেন। আমাকে পত্রিকা আনতে বলেছিলেন। চকবাজার থেকে পত্রিকা নিয়ে হাসপাতালে এসে দেখি বাবা নেই, বাবাকে হারিয়ে ফেলেছি আমরা।’ আমি নির্বাক হয়ে গেলাম, বড় আফসোস হতে লাগল– আমার লেখাটা পড়তে পারলেন না চাচা, শেষবারের মতো একটু দেখাও হলো না!
মৃত্যুর আধা ঘণ্টা আগেও তিনি ফোনালাপে অভিমানী কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘নাসির চট্টগ্রামের গানে আরেকজন এমএন আখতার আসবে না, আমি মরলে সেটা বুঝবে তোমরা। আজ আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছি, কেউ দুই লাইন সংবাদ প্রচার করছে না। মরলে সবাই লাইন ধরবে।’ অভিমানী এই শিল্পীর প্রয়াণের পর সে কথাই সত্য হয়েছিল। আসলেই আমরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিতে জানি না।
এমএন আখতার চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের অমর শিল্পী শুধু নন, তিনি কথা আর সুরের এক আশ্চর্য জাদুকর, হ্যামিলিয়নের সেই বাঁশিওয়ালার মতো যার সুরে মেতে উঠে মানুষ, নেচে উঠে প্রকৃতি।
আমার মনে হয় আঞ্চলিক গানে প্রধানত তিনটি ধারা রয়েছে। একটি ধারায় বাংলার চিরায়ত কথা ও সুরের গান, যা সোঁদামাটির গন্ধে ভেজা। আরেকটি জীবনমুখী আঞ্চলিক গান, যেটার উদ্ভব আশি ও নব্বইয়ের দশকে। মাঝখানের ধারাটি হলো যে গানে চট্টগ্রামের মানুষগুলোর প্রেমাবেগের সহজ-সরল প্রকাশ আছে। আমি বোঝাতে চাই আঞ্চলিক গানে প্রেমের অমিয়ধারা সবসময়ই ছিল, কিন্তু আশির দশকে এ গানে যুক্ত হয়েছে তালত বোন-তালত ভাইয়ের প্রেম, বকশির হাটের পানে ঠোঁট লাল করে সুন্দর মুখের সন্ধান করার মতো মিষ্টি কাহিনি (ও পরানর তালত ভাই/চিডি দিলাম পত্র দিলাম/ নঅ আইলা কিল্লাই.
এমএন আখতার একাধারে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। তার আরেকটি বড় কীর্তি আঞ্চলিক নাটক লেখা ও মঞ্চায়ন।
গানের পাখি সাবিনা ইয়াসমিনের শরীরে বাসা বেঁধেছে ঘাতকব্যাধি। ঢাকার একটি নামকরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, উন্নত চিকিৎসার জন্য শিগগিরই সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হবে।
চট্টগ্রামে বসে খবরটা শুনলেন এমএন অখতার। আশি ছুঁই ছুঁই বয়সে বাসে চড়ে রওনা দিলেন রাজধানীর উদ্দেশে। রাজধানীর রাজপথ বেড়িয়ে, অনেক অলিগলি পেরিয়ে হাজির হলেন সেই হাসপাতালের ফটকে। হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে মানুষের ঢল, সবাই একপলক দেখতে চান গানের রানীকে। কিন্তু নিরাপত্তার দেয়াল পেরিয়ে সাবিনার নাগাল পাওয়া আর হাতে চাঁদ পাওয়া প্রায় সমান কথা।
সবাই থমকে দাঁড়ায়, কিন্তু বয়সী লোকটা সামনে যেতে চান। অবশেষে অনেক কষ্টে পৌঁছে গেলেন সাবিনার কেবিনের সামনে। কিন্তু কেবিনের ভেতরে ঢোকার সাধ্য কার! তিনি যতই বলেন ‘আমি চট্টগ্রামের প্রবীণ শিল্পী এমএন আখতার। সাবিনা আমাকে চেনে। বিদেশ যাওয়ার আগে তাকে আমি একনজর দেখতে চাই। আপনারা তাকে আমার কথা বলুন।’ কে শোনে কার কথা!
এমএন আখতার এবার পকেট হাতড়ে কাগজে মোড়ানো পুরোনো একটি গ্রামোফোন রেকর্ড বের করলেন, একজন সেবিকাকে ডেকে বললেন, ‘৭৭ সালে আমি সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে গান গেয়েছি, এই দেখ রেকর্ড, তার প্রমাণ।’ সেবিকা এবার বিষয়টাকে গুরুত্ব দিলেন এবং দেখলেন গ্রামোফোন রেকর্ডের গায়ে দ্বৈত গানের শিল্পী হিসেবে সাবিনা ইয়াসমিন ও এমএন আখতারের নাম লেখা আছে।
সেবিকার প্রতি অশীতিপর বৃদ্ধের শেষ অনুরোধ ‘তুমি সাবিনাকে গিয়ে এই রেকর্ডটা দেখাও আর বল চট্টগ্রাম থেকে এমএন আখতার এসেছে।’ সেবিকা কথা না বাড়িয়ে তাই করলেন। মিনিট খানেক পরই ঘটল ঘটনাটা, অসুস্থ শরীর নিয়ে পড়িমরি করে ছুটে আসলেন উচ্ছল সাবিনা, এমএন আখতারকে গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরলেন, হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় বরণ করে নিয়ে গেলেন কেবিনে। আর এতক্ষণ যারা বৃদ্ধ লোকটাকে পাত্তাই দিচ্ছিলেন না, তাদের চেহারাটা তখন দেখার মতো!
কেবিনে এম এন আখতারকে পাশে বসালেন সাবিনা, আর্দ্র গলায় বললেন, ‘আখতার ভাই, সেই ৭৭ সালে গাওয়া গানের রেকর্ড আপনি এখনো রেখে দিয়েছেন? আপনার সাথে গান করার স্মৃতি আমি কখনোই ভুলব না।’
১৯৭৭ সালে বের হওয়া সেই গ্রামোফোন রেকর্ডে সাবিনা ইয়াসমিনের সাথে দ্বৈতকণ্ঠে কোন গানটি গেয়েছিলেন এম এন আখতার? কানে কানে বলি, সেই গানটি, চিরসবুজ আঞ্চলিক গান, ‘কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যম তোঁয়ারে/সিনার লগে বাঁধি রাই্যখম তোঁয়ারে ও ননাইরে...।’
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার। বেশিরভাগ শ্রোতা এমনকি আঞ্চলিক গানের অনেক সমঝদার ও বোদ্ধা লোককেও বলতে শুনি, ‘কইলজার ভিতর গাথি রাইখ্যম...’ শ্যামসুন্দর বৈঞ্চব আর শেফালী ঘোষের গান। না ‘কইলজার ভিতর..’ গানটি আজ থেকে ৪৮ বছর আগে গেয়েছিলেন এম এন আখতার আর সাবিনা ইয়াসমিন। চার দশক ধরে সেই গান প্রতিটি মানুষের মনে প্রেমের ফল্গুধারা বইয়ে দেয়। একযুগ আগে দ্বৈত গানটিকে রিমিক্স করে একক কণ্ঠে গেয়েছেন ক্লোজআপ ওয়ান তারকা সালমা। গানটি নতুন করে তুমুল জনপ্রিয় হয়। বলতে গেলে সালমার মাধ্যমে গানটির নবজাগরণ হয়েছে, যদিও সালমার গানে কিছুটা বিকৃতি ছিল। সে প্রসঙ্গ পরে।
এম এন আখতারের গানুগুলোর সুর আর কথায় অন্যরকম রোমান্স আছে তা আগেই বলেছি। শেফালী ঘোষ আর শ্যামসুন্দর বৈঞ্চবের অনেক কালজয়ী গানের স্রষ্টা তিনি। এম এন আখতার ও ঊমা খানের কণ্ঠে অসম্ভব জনপ্রিয় গান ‘বাছুরে, জি জি জি...। গানটি এখনো প্রতিটি মানুষের মনকে রাঙিয়ে দেয়। পাশাপাশি আবদুল গফুর হালীর লেখা ও শ্যাম-শেফালীর গাওয়া ‘বানুরে জি জি জি...’ গানটিও এখনো তুমুল জনপ্রিয়।
‘বরই ফুলর থামি/আর একখান গোলবাহার/যদি পাইতাম আই পিনতাম/আয়না ধরি চাইতাম আঁরে কেন কেন লায়...।’ রমণীর মনো-সরোবরের কতটা গভীরে গেলে এ ধরনের কথা লেখা যায়, তা তো কোনো দিন জিঙ্গেস করা হয়নি শিল্পীকে। তবে এটা তো জানা কথা, ‘তুমি যে আমার জীবনের উপহার/কী করে তোমায় আমি ভুলব...’ শেফালীর কণ্ঠে এমন গান তো কেবল এম এন আখতারই তুলে দিয়েছেন। চলচ্চিত্রে গাওয়া এই গান চট্টগ্রামের মানুষ কি কখনো ভুলতে পারবে? এই গান আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ববীণায় বাজছে।
কিন্তু আমাদের একজন এম এন আখতার আছেন, তাকে আমরা কতটা মূল্যায়ন করেছি? তার সৃষ্টি নিয়ে কেন নষ্টামি হয়? আর এসবের প্রতিবাদে কেন শিল্পীকে মিডিয়ার দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিতে হয়েছিল? এ প্রসঙ্গে বলার আগে শিল্পী সম্পর্কে আরও কিছু জানা দরকার।
এম এন আখতার ব্যক্তিগত আলাপে আমাকে বলেন, ‘গান লিখতে আমার কোনো ক্লান্তি নেই, খাতা-পত্রের বালাই নেই। হাঁটতে হাঁটতে গান বাঁধতাম। তাৎক্ষণিক সুর বসিয়ে বেতারে গাইতাম। ১৯৬২ সালে যখন শিল্পী বাছাই হয় সে সময় চট্টগ্রাম বেতারের প্রথম দিনের প্রথম আধুনিক গানের শিল্পী আমি।’ বলেছিলেন এম এন আখতার। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বেতারের প্রথম শ্রেণীর গীতিকার, সুরকার, শিল্পী, নাট্যকার ও সঙ্গীত পরিচালক।
এম এন আখতারের গান গেয়েছেন শেফালী ঘোষ, সাবিনা ইয়াসমিন, সুবীর নন্দী, আবিদা সুলতানা, অঞ্জু ঘোষ, কান্তা নন্দী, উমা খান, সেলিম নিজামী, রবী চৌধুরী রন্টি, মুনসহ অনেকে। এম এন আখতারের কথা ও সুরে পাকিস্তানের শিল্পী মুন্নি বেগম গেয়েছেন ‘ন যাইওম আঁই যাইতাম ন, লাল মিয়ার বাড়ি/ ইতা আঁর লয় হতা কয় চোগ মারি মারি..।’
রাউজানের গ্রামের বাড়ি মোহাম্মদপুর থেকে সাম্পানে চড়ে শহরে আসতেন ছোট্ট এম এন আখতার। এই সাম্পান নিয়ে ১৯৭১ সালে তিনি লিখেন ‘ছাম্মান অলা কেঁ কোরত/ক্যানে যাইয়ম বরবুরত/বব্বুর জামাই থিয়াই রইয়ে ঘাড়ার দুয়ারত...।’
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় চুড়িওয়ালা, সোনার কলসী, নাতিন জামাই, কানের ফুল, লট্টন কইতর, রাঙ্গাবালির চরে, বৈশাখী মেলাসহ অনেক নাটক লিখেছেন। তাঁর সর্বশেষ রচিত হাসির নাটক ‘রসিক দাদুর স্কুলে মানুষ গড়ার কল’। ‘চুড়িওয়ালা’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন পরে বেদের মেয়ে জোছনা-খ্যাত অঞ্জু ঘোষ। সেই নাটকেরই সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ছিল ‘কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যাম তোঁয়ারে...।’
আঞ্চলিক নাটক মঞ্চস্থ করতে গিয়ে এম এন আখতার চট্টগ্রামের একদল সংস্কৃতি-কর্মীর বাধার মুখে পড়েছিলেন। বলা হয়েছিল আঞ্চলিক নাটকে অশ্লীলতা আছে। তখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিলেন সাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই। ১৯৭৭ সালের ১ জুলাই হাসনাত সাহেব ‘চুড়িওয়ালা’ নাটক সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত গীতিনাট্য ‘চুড়িওয়ালা’ প্রকাশভঙ্গিতে সহজ ও সরল কিন্তু এর আবেদন মানুষের মনের গভীরে। কেননা ‘চুড়িওয়ালা’ সাধারণ মানুষের প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসার জয়গানে মুখরিত। এইসব শ্বাশ্বত মানবিক অনভূতির আবেদন দেশকালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বকালের মানুষের কাছে সমান।’ পরে অবশ্য প্রতিবাদকারীর দল পিছু হটেছিল এবং চট্টগ্রামের মুসলিম হল ও আগ্রাবাদ স্কুলে ‘চুড়িওয়ালা’ নাটক দেখার জন্য মানুষের ঢল নেমেছিল।
সুন্দর মুখের সন্ধানে যিনি লিখেছেন ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম...’ সেই শিল্পী এম এন আখতার জীবনে অনেক ‘অসুন্দর মুখ’ দেখেছেন, অসুন্দর আচরণের মুখোমুখি হয়েছেন। বিশেষ করে শেষ জীবনে এসে।
২০০৭ সালে ‘কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যম তোঁয়ারে...’ গানটি ক্লোজআপ ওয়ান তারকা সালমা গাওয়ার পর নতুন করে বেশ জনপ্রিয় হয়। দ্বৈতকণ্ঠের এই গানটিকে ভেঙ্গেচুরে নতুন কথা বসিয়ে সালমাকে দিয়ে গাওয়ানো হলেও এ জন্য এম এন আখতারের কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। গানটির একটি অন্তরায় ‘সুন্দর সুন্দর কিসতা হইয়ুম নঅ হুনাইয়ুম কেউরে ও ননাইরে...’ এর স্থানে সালমাকে দিয়ে গাওয়ানো হলো-‘সুন্দর সুন্দর গান শুনাইয়ুম নিশীথ জাগিয়ারে ও ননাইরে...।’ ইত্যাদি। ওই ঘটনায় এম এন আখতার খুব মন খারাপ করে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার গানটা তো কুড়িয়ে পাওয়া গান নয়, তারা আমার সৃষ্টিকে বিকলাঙ্গ করার অধিকার পেল কোথায়?’–জীবদ্দশায় এম এন আখতার এই প্রশ্নের উত্তর পাননি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করা গেলে এম এন আখতারদের মতো কিংবদন্তীদের সত্যিকারের সম্মান জানানো হবে, আঞ্চলিক গানের বিশুদ্ধ চর্চা হবে–এটাই প্রত্যাশা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বল ছ ল ন জনপ র য় ল ন এম র জন য স ন দর র কর ড ক ন টক বলল ন প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
ঋণ নেওয়ার আগে যে ১০টি বিষয় অবশ্যই জানা উচিত
নানা কারণে আপনার ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। অনেক সময় মানুষ ব্যক্তিগত ঋণ, গৃহঋণ নেয়। আবার গাড়ি কেনার জন্যও অনেকে ঋণ নেন। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেও ঋণ নেওয়া হয়।
কিন্তু অনেকেই ঋণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু মৌলিক শব্দ সম্পর্কে জানেন না। ব্যাংকের কর্মকর্তারা যখন এসব শব্দ বলেন, তখন অনেক কিছুই বোঝেন না ঋণ নিতে ইচ্ছুক গ্রাহকেরা। ফলে নিয়মকানুন না জেনেই ঋণ নেন। এতে নানা অপ্রত্যাশিত ঝামেলা তৈরি হয়। তাই ঋণ নেওয়ার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোঝা খুব দরকার।
১. আসল টাকা (প্রিন্সিপাল)
আপনি যে পরিমাণ টাকা ঋণ নিচ্ছেন, সেটিই আসল। এর ওপরই সুদ ধরা হয়। কিস্তি পরিশোধের সঙ্গে আসল ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
২. সুদের হার (ইন্টারেস্ট রেট)
ঋণ নেওয়ার আগে সবচেয়ে ভাবতে হয় সুদের হার নিয়ে। সুদের হার বেশি হলে খরচ বেড়ে যায়। ঋণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সুদের হার। এটি স্থিরও হতে পারে, আবার বাজারদরের ওপর নির্ভর করে বাড়তে-কমতেও পারে।
৩. মাসিক কিস্তি (ইএমআই)
ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ বাবদ প্রতি মাসে যে নির্দিষ্ট টাকা আপনাকে দিতে হবে। সেটি হলো ইএমআই বা ঋণের কিস্তি।
৪. ঋণের মেয়াদ
কত বছরের মধ্যে ঋণ শোধ করতে হবে, সেটিই হলো ঋণের মেয়াদ। মেয়াদ বেশি হলে কিস্তি ছোট হয়। কিন্তু মোট সুদের টাকা বেড়ে যায়। ছোট মেয়াদে কিস্তি বড় হয়। কিন্তু মোট সুদের টাকা কমে।
৫. অ্যানুয়াল পারসেন্টেজ রেট (এপিআর)
শুধু সুদ ও আসল নয়, বরং ঋণের সব খরচ (যেমন ফি, চার্জ) মিলিয়ে আসল ব্যয় কত হবে, তার হিসাব হলো অ্যানুয়াল পারসেন্টেজ রেট (এপিআর)। এটিই প্রকৃত খরচ বোঝায়।
৬. আগাম পরিশোধ (প্রিপেমেন্ট)
ঋণের বোঝা কমাতে অনেকে ঋণের সুদ ও আসলের টাকা আগেই শোধ করে দিতে চান। এতে সুদের খরচ কমে যায়।
৭. প্রসেসিং ফি
আপনি ঋণের জন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করলেন। কিন্তু ঋণ আবেদন মঞ্জুর থেকে শুরু করে ছাড় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কিছু মাশুল দিতে হয়। এটিই প্রসেসিং ফি। এটি কখনো ঋণের টাকা থেকে কেটে নেওয়া হয়, আবার কখনো আলাদা দিতে হয়।
৮. স্থগিতকাল (মোরাটোরিয়াম)
বিশেষ পরিস্থিতিতে কিছুদিনের জন্য কিস্তি বন্ধ রাখার সুযোগকেই বলে স্থগিতকাল। তবে এই সময়েও সুদ জমতে থাকে। অনেক সময় ঋণ পরিশোধের জন্য বিশেষ কিস্তি ভাগও করে দেওয়া হয়।
৯. জামানত (কোলেটারাল)
ঋণের নিরাপত্তা হিসেবে আপনার সম্পদ (যেমন বাড়ি, সোনা, জমি) ব্যাংকে বন্ধক রাখা হয়। কিস্তি না দিলে ব্যাংক ওই সম্পদ বিক্রি করে টাকা তুলে নেয়।
১০. লোন-টু-ভ্যালু রেশিও
আপনি যত টাকা ঋণ নিচ্ছেন আর জামানতের মূল্য কত—এই অনুপাতকে বলে লোন টু ভ্যালু রেশিও (এলটিভি)। এর অনুপাত যত কম হয়, ব্যাংকের ঝুঁকি তত কম।