বাংলাদেশে কেন ন্যায়পাল নিয়োগ প্রয়োজন
Published: 22nd, April 2025 GMT
ন্যায়পাল বা লোকপাল বা ‘ওম্বুডসপারসন’ বিভিন্ন দেশে সাংবিধানিক বা বিশেষ আইনে নিয়োগপ্রাপ্ত স্বাধীন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা। সংবিধানে বা বিশেষ আইনে ন্যায়পালকে তাঁর কাজ বা দায়িত্ব পালনে জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা ও ক্ষমতা দেওয়া হয়ে থাকে। অধিকাংশ দেশে ন্যায়পাল আইনসভার অধীন প্রতিষ্ঠান। তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য সংসদের কাছে দায়ী থাকেন এবং সেখানে বার্ষিক প্রতিবেদন দাখিল করেন। ন্যায়পালের নিয়োগও সংসদের ওপরে বর্তায়।
২.
ন্যায়পাল মূলত সরকারি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জনসাধারণের উত্থাপিত অনিয়ম, হয়রানি, দীর্ঘসূত্রতা, ভোগান্তি ও দুর্ভোগ সম্পর্কিত যে কোনো অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশের মাধ্যমে সরকারি সেবার মানোন্নয়ন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করেন। কোনো নাগরিক যদি সরকারি দপ্তরে সেবা পেতে হয়রানি বা অনিয়মের সম্মুখীন হন, সেগুলো তদন্ত করে প্রতিকারের ব্যবস্থাই ন্যায়পালের দায়িত্ব।
সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এবং সরকারি কর্মিবাহিনীর কাজের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রতিষ্ঠান ন্যায়পাল। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আমলাতান্ত্রিক আচরণ, অনিয়ম, হয়রানি, অবিচার, বাড়াবাড়ি, কর্ম সম্পাদনে অহেতুক বিলম্ব এবং নানাবিধ দুর্ভোগ প্রশমন করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই ন্যায়পালের মূল দায়িত্ব। বিশেষ করে গরিব, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সহজেই ন্যায়পালের কাছে অভিযোগ পেশ করার সুযোগ রয়েছে। সরকারি খাতের বেশি জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা এবং মৌলিক সেবাগুলো দক্ষতার সঙ্গে প্রতিপালনে ন্যায়পাল কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন।
৩.
ন্যায়পালের প্রতিষ্ঠানটি তিন ধরনের কাজের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত: ক. প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যক্তি সাধারণের অভিযোগের সুরাহা; খ. জনপ্রশাসনের মানোন্নয়নে কাঠামোগত সমস্যা সমাধানের প্রয়াস; গ. সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা।
ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠানটি অভিযোগের তদন্ত করে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে। ফলে এতে স্বার্থের সংঘাত থাকে না। ন্যায়পাল তাঁর দায়িত্ব পালনে যে কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বা অন্য যে কোনো ব্যক্তিকে শুনানির জন্য সমন জারি বা যে কোনো তথ্য-উপাত্ত বা দলিল প্রদানে বাধ্য করতে পারেন। তবে নাগরিকদের অভিযোগ ও দুর্ভোগ নিয়ে ন্যায়পালের ক্ষমতা তদন্ত, শুনানি, মধ্যস্থতা, সুপারিশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর সুপারিশ প্রতিপালন সরকারের জন্য বাধ্যতামূলকও নয়। অধিকাংশ দেশেই ন্যায়পাল অভিযোগের ভিত্তিতে আইনগত বা বিচারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন না।
৪.
বিশ্বে প্রথম ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সুইডেনে ১৮০৯ সালে; এশিয়ায় প্রথম চীন ও ভিয়েতনামে চল্লিশের দশকে। ষাটের দশক থেকে কমনওয়েলথ ও অন্যান্য দেশে প্রতিষ্ঠানটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠিত হয় যথাক্রমে ১৯৬২, ১৯৬৭, ১৯৬৮ ও ১৯৭৭ সালে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন ১৯৬৬ সালে কেন্দ্রে লোকপাল এবং প্রদেশে লোকায়ুক্ত নিয়োগের সুপারিশ করে। ইতোমধ্যে ভারতের ১৬টি প্রদেশে লোকায়ুক্ত নিযুক্ত হলেও কেন্দ্রে এখনও লোকপাল নিয়োগ হয়নি। ২০১৩ সালে লোকপাল নিয়োগের আইন ভারতের সংসদে অনুমোদিত হয়েছিল। তবে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা (চিফ পার্লামেন্টারি কমিশনার), থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, হংকংসহ এশিয়ার প্রায় সব দেশে ন্যায়পালের দপ্তর রয়েছে।
৫.
বিভিন্ন দেশে ন্যায়পালের দুটি মডেল রয়েছে। কমনওয়েলথভুক্ত অধিকাংশ দেশে ন্যায়পাল মূলত সেবাপ্রার্থীদের প্রতি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর আচরণ যেমন– পক্ষপাতিত্ব, অহেতুক বিলম্ব, হয়রানি, আমলাতান্ত্রিক বাড়াবাড়ি ও দুর্ভোগ সৃষ্টির অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিকারের সুপারিশ করেন। অথবা শুনানি বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে জনগণের দুর্ভোগ লাঘব ও সেবার মানোন্নয়নে চেষ্টা করেন। বাংলাদেশে ১৯৮০ সালে ন্যায়পাল নিয়োগে প্রণীত আইনটিও এ মডেলের অন্তর্ভুক্ত। তবে কিছু দেশে ভিন্ন মডেল রয়েছে, যেমন কোরিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। সেখানে ন্যায়পাল প্রধানত দুর্নীতি দমন সংস্থা হিসেবে কাজ করেন। প্রথম গ্রুপের দেশগুলোতে দুর্নীতি দমন কমিশন ও ন্যায়পাল ব্যবস্থা দুই-ই রয়েছে।
৬.
কোনো কোনো দেশে, যেমন কানাডা ও যুক্তরাজ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান তথা পৌরসভাগুলোতেও ন্যায়পালের দপ্তর রয়েছে। আবার কোনো কোনো দেশে বিশেষায়িত ন্যায়পালের দপ্তর রয়েছে। যেমন অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে রয়েছেন ‘চিলড্রেন কমিশনার’ এবং সুইডেনে রয়েছেন ‘চিলড্রেন ন্যায়পাল’। বাংলাদেশেও ২০০৫ সালে এমন বিশেষায়িত ন্যায়পালের দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আয়কর বিভাগে, যা ২০১০ সালে বিলুপ্ত হয়। আবার আজারবাইজান, কিরগিজস্তান এবং উজবেকিস্তানের মতো দেশে ন্যায়পালের দপ্তর জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা হিসেবে কাজ করে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নেও ন্যায়পালের দপ্তর রয়েছে। তারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ তদন্ত করে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে। ব্র্যাকের মতো অনেক বৃহৎ এনজিওতে ন্যায়পালের দপ্তর রয়েছে।
৭.
বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে দেশে ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান রয়েছে। এ জন্য ১৯৮০ সালে বিশেষ আইনও প্রণীত হয়েছিল। বিভিন্ন সরকারের উচ্চমহল থেকে ন্যায়পালের দপ্তর প্রতিষ্ঠার ঘোষণা এলেও তা কখনও কার্যকর হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনও অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে জাতীয় ন্যায়পাল নিয়োগের সুপারিশ করেছে। বিভিন্ন সরকার ও রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারণী দলিলেও ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা এসেছে অনেকবার। কিন্তু রাষ্ট্রের বয়স ৫৪ হলেও ন্যায়পাল নিয়োগের কাজটি অসম্পন্ন থাকা দুর্ভাগ্যজনক।
কেউ কেউ ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়পালের দপ্তর প্রতিষ্ঠার আবশ্যিকতা নেই মনে করেন। কিন্তু এ দুটি প্রতিষ্ঠান কি পরস্পরের বিকল্প? তাদের দায়িত্ব কতটা সম্পূরক বা পরিপূরক? দুদকের ২০০৪ সাল এবং ন্যায়পালের ১৯৮০ সালের আইন পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, দুটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ও পৃথক কর্মপরিধি রয়েছে। সংক্ষেপে দুর্নীতি দমন কমিশন মূলত আর্থিক দুর্নীতির বিচার ও প্রতিরোধের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। অপরদিকে ন্যায়পাল সরকারি দপ্তরে সেবাপ্রত্যাশীর ভোগান্তি বা হয়রানির প্রতিকারে দায়িত্বপ্রাপ্ত। সুতরাং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এ দুই প্রতিষ্ঠানের কাজ সম্পূরক বা পরিপূরক হলেও কাজের ক্ষেত্র সম্পূর্ণ পৃথক।
৮.
দেশে ন্যায়পালের দপ্তর এতদিনেও প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণে সরকারি সেবাপ্রার্থীর হয়রানির যেমন উপশম হচ্ছে না, তেমনি সেবা প্রদানকারী সরকারি দপ্তরের জবাবদিহি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠাও বিলম্বিত হচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, দেশের নাগরিকরা দুর্নীতি দমন কমিশনে যে সংখ্যায় অভিযোগ জানান, তার ৯০ শতাংশ অভিযোগ ‘দুদক’-এর তপশিলভুক্ত দুর্নীতি সম্পর্কিত নয়। সে কারণে ‘দুদক’ এসব অভিযোগ আমলে নিতে পারে না। পেনশন পরিশোধে হয়রানি, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, সামাজিক নিরাপত্তার অধীন বিভিন্ন ভাতা প্রদানে অনিয়ম, রিলিফের চাল চুরি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগে অহেতুক বিলম্ব বা ঘুষ চাওয়া, স্কুলে অতিরিক্ত ফি আদায়, সরকারি চাকরি নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্ব– নাগরিকদের এ জাতীয় হাজারো অভিযোগ দুদকের এখতিয়ারভুক্ত নয়।
উল্লেখ করা যেতে পারে, দুদক ২০১৪ সালে ১২ হাজার ৫০০টি, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৪১৫টি, ২০১৬ সালে ১২ হাজার ৯৯০টি এবং ২০১৭ সালে ১৭ হাজার ৯৯৩টি লিখিত অভিযোগ পেয়েছিল; কিন্তু যথাক্রমে মাত্র ১৫, ১৩, ১২ ও ৭ শতাংশ অভিযোগ আমলে নিতে পেরেছিল। কারণ প্রাপ্ত অভিযোগের সিংহভাগই দুদকের তপশিলভুক্ত দুর্নীতি সম্পর্কিত ছিল না। অভিযোগের অধিকাংশই ছিল নাগরিক সেবাপ্রাপ্তিতে হযরানি সম্পর্কিত, যা মূলত ন্যায়পালের এখতিয়ারভুক্ত। সুতরাং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তী সরকারের অঙ্গীকারের আলোকে দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ প্রত্যাশা করে, অচিরেই দেশে জাতীয় ন্যায়পাল নিয়োগ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে।
ফিরোজ আহমেদ: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক কর্মকর্তা; সদস্য, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন
firozlxp@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র স প র শ কর তদন ত কর কর মকর ত ত হয় ছ ল সরক র র ব যবস থ র জন য জনপ র ন নয়ন হয়র ন
এছাড়াও পড়ুন:
বিলাসবহুল প্রমোদতরিতে খুন, এরপর...
গল্প যখন জাহাজের রহস্যময় খুন, তখন সবার আগে মাথায় আসে ১৯৭৮ সালের ‘ডেথ অন দ্য নাইল’-এর কথা। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য লাস্ট অব শিলা’ সিনেমাটিও এগিয়ে থাকবে এদিক দিয়ে।
তবে রুথ ওয়ারের উপন্যাসভক্তদের জন্য নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি হতে পারত এমনই এক অভিজ্ঞতা। রুথের উপন্যাস ‘দ্য ওমেন ইন কেবিন ১০’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নেটফ্লিক্সে এসেছে একই নামের নতুন সিনেমা। তবে সাইমন স্টোন পরিচালিত সিনেমাটির শুরুটা আশা জাগানিয়া হলেও শেষপর্যন্ত রোমাঞ্চ ধরে রাখতে পারেনি।
লন্ডনের এক খ্যাতিমান অনুসন্ধানী সাংবাদিক লরা ব্ল্যাকলক (কিরা নাইটলি)। তিনি একটি হাইপ্রোফাইল অ্যাসাইনমেন্টের কাজ করছিলেন। কিন্তু তাঁর সোর্সকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার জন্য তিনি কাজে ফিরে এসেও ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় তিনি হঠাৎই তিন দিনের সমুদ্রযাত্রার আমন্ত্রণ পান। নরওয়েজীয় এক বিলিয়নিয়ার দম্পতি অ্যান লিংস্টাড (লিসা লোভেন কংসলি) ও তাঁর স্বামী রিচার্ডের (গাই পিয়ার্স) দাতব্য সংস্থার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কাভার করার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। কাজ ও ছুটি কাটানোর এমন দারুণ সুযোগ লুফে নেন লরা।
‘দ্য ওমেন ইন কেবিন ১০’ –এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স