ছন্দের পথে হাঁটা নিঃসঙ্গ এক হাটুরে কবি
Published: 30th, April 2025 GMT
‘মুখে আল্লাহ বলো ভাই সকলে ওরে মুসলমান,
হিন্দু ভাইরা বলো সবাই কৃষ্ণ ভগবান।
ইমান আনো দেলে সবাই মিলে হিন্দু-মুসলমান,
মুসলমানে জপো সবাই নবীর পাক কোরআন।
পড়ো নামাজ রোজা পাইবা মজা পরকালে গিয়া,
মিছে মায়ায় ভবের মাঝে রইলা সব ভুলিয়া।'
এভাবে সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের জন্য ধর্ম, নীতিকথা আর নানা সুখ-দুঃখের বিষয় গ্রাম্য কবিতায় তুলে ধরেছেন মো.
সম্প্রতি আজগর আলীর বাড়ির আঙিনায় বসে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, নব্বই দশকের আগের কথা। তখন প্রযুক্তির এতটা বিকাশ ঘটেনি। সে সময়ে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে কিছু স্বভাবকবি দীর্ঘ কবিতা লিখতেন। সুরে সুরে এসব কবিতা পথচলতি মানুষকে ও হাটবাজারে আসা মানুষকে শোনাতেন। তাঁরা এসব কবিতায় আনন্দ খুঁজে পেতেন। প্রেম-বিরহের কাহিনি থেকে শুরু করে সমসাময়িক নানা ঘটনা এসব কবিতার বিষয়বস্তু হতো। এসব কবিতাকে কেউ বলতেন ‘হাটুরে কবিতা’, আবার কেউ বলতেন ‘পথকবিতা’। রচয়িতারা চারণকবি, পথকবি অথবা হাটুরে কবি হিসেবে পরিচিত হতেন।
প্রযুক্তির প্রসারে মানুষের জীবনে বিনোদনের নতুন নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত হয়। আবেদন কমতে থাকে গ্রামীণ কবিদের। এখন আর কেউ এসব শুনতে চান না। তাই ভাটা পড়ে তাঁর হাটুরে কবিতা লেখায়। গ্রামের মেঠো পথ, ছোট-বড় বিভিন্ন হাটবাজার আর নদীর ঘাট ঘুরে, সুরে সুরে গাওয়া পুঁথি ফেরি করা হয় না আর তাঁদের। তবে কালেভদ্রে তাঁর মতো কবির ডাক পড়ে।
এত দিন ধরে কবিতা লিখে মানুষকে আনন্দ দিলেন, কিন্তু নিজের মূল্যায়ন করতে পারলেন না; সেই আক্ষেপ আজগর আলীর। তিনি বলেন, গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন। এরপর নানা কারণে আর পড়ালেখা এগোয়নি তাঁর। তবে ছোটবেলা থেকেই মুখে মুখে ছন্দ দিয়ে কথা বলতে পারতেন তিনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁর যশ বাড়তে থাকে। ১৮-২০ বছর বয়সে একদিন সাহস করে লিখে ফেলেন পুরো একটি হাটুরে কবিতা। গ্রামের দুই-একজন এটি দেখে পরামর্শ দিলেন, থানা সদরে গিয়ে প্রকাশ করতে। তাঁদের পরামর্শ মেনে প্রথম কবিতা ছাপিয়ে হাটে গিয়ে লোকজনকে শোনালেন। খুশি হয়ে অনেকে কিনে বাড়ি নিয়ে গেলেন।
আজগর আলী বাড়ি ফিরে কবিতা বিক্রির পয়সা গুণে অবাক হলেন। খরচের চেয়ে বেশি টাকা পেয়েছেন তিনি। সেই থেকে কবিতা লেখার কাজটি তাঁর নেশা হয়ে ওঠে। বাড়ি থেকে চলে যেতেন বিভিন্ন হাটবাজারে। ছন্দে ছন্দে সেই কবিতা শুনে লোকজন প্রশংসা করতে থাকেন তাঁর। এর মধ্যে বিয়ে করে ঘরসংসারে থিতু হওয়ার চেষ্টা করেন আজগর আলী। প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে তিন মেয়ে আর দুই ছেলে তাঁর। সব মিলিয়ে তাঁর ১১ জন নাতি-নাতনি।
একেক করে আজগর আলী ৪৫টি কবিতা লিখেছেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে এ জন্য গ্রহণ করেছেন নিবন্ধন নম্বর। এসব কবিতার মধ্যে বেশির ভাগই বিভিন্ন এলাকায় ঘটে যাওয়া চমকপ্রদ ঘটনা, প্রেমকাহিনি ও চিত্তাকর্ষক বিষয় নিয়ে রচিত। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ঘটনা ও ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়েও কবিতা লিখেছেন তিনি।
অতীতের কথা স্মরণ করে আজগর আলী বলেন, এলাকার ও দেশ-বিদেশের আলোচিত ঘটনা নিয়ে লেখা গ্রাম্য কবিতার হাটবাজারে খুব কদর ছিল। ছন্দে ছন্দে এসব কবিতা পড়ে শোনালে অনেকেই খুশি হয়ে শুনতেন। এখন এসব কবিতার আর কদর নেই আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ডিজিটাল যুগে সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন। সেখানে ইচ্ছেমতো সবকিছু দেখা ও শোনা যায়।
ছেলেমেয়েরা একসময় গ্রাম্য কবিতা লেখার বিষয়ে উৎসাহ দিলেও এখন মানা করে দিয়েছে বলে জানান আজগর আলী। তবু জীবনে আর যে কয়েক দিন বাঁচবেন, তিনি এসব নিয়েই থাকতে চান।
পাশের বস্তুল টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ মো. শাহিনুর ইসলাম বলেন, গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ হয়েও আজগর আলী অসাধারণ একজন কবি। গ্রাম্য কবিতা, যাকে হাটুরে কবিতা বলা হয়; তার জন্য পরিচিত তিনি। তাঁদের জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে তাঁর লেখা কবিতা শুনে ও পড়ে। এখন আর কেউ এসব কবিতা শুনতে চায় না। ফলে চলন নেই।
উপজেলার সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ভিলেজ ভিশনের পরিচালক শরীফ খন্দকার বলেন, ‘আজগর আলীর কবিতা আমরা হাটবাজারে শুনতাম। জমানো পয়সা দিয়ে কিনে এনে আসর জমিয়ে নিজেরা পড়তাম অথবা শুনতাম। এখন আর সেদিন নেই। গ্রামের এসব লুকায়িত প্রতিভাধর মানুষকে সবার সামনে নিয়ে আসা দরকার।’
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত, সচিব কমিটি উপদেষ্টা পরিষদে পাঠাবে
পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে অধ্যাদেশের খসড়াটি সচিব কমিটির মাধ্যমে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের জন্য যাবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশনের কাঠামো ও কার্যক্রমের খসড়া তৈরি করেছে।
খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এই কমিশনের চেয়ারপারসন হবেন। সদস্য থাকবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ; গ্রেড-২ পদমর্যাদার নিচে নন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা; অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার নিচে নন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা; পুলিশ একাডেমির একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ; আইন, অপরাধবিজ্ঞান বিষয়ের একজন কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক; ১৫ বছর অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন একজন মানবাধিকারকর্মী।
আরও পড়ুনপুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে স্বাধীন কমিশন অপরিহার্য৮ ঘণ্টা আগেকমিশনের চেয়ারপারসন আপিল বিভাগের বিচারপতি এবং সদস্যরা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির সমপদমর্যাদার হবেন।কমিশনের চেয়ারপারসন আপিল বিভাগের বিচারপতি এবং সদস্যরা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির সমপদমর্যাদার হবেন। সদস্যরা যোগদানের দিন থেকে চার বছর নিজ নিজ পদে থাকবেন। মেয়াদ শেষে কোনো সদস্য আবার নিয়োগের যোগ্য হবেন না।
অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, পুলিশ কমিশনের নির্দেশ বা সুপারিশ প্রতিপালনে বাধ্যবাধকতার বিষয়ে বলা হয়েছে—এই কমিশন যেকোনো কর্তৃপক্ষ বা সত্তাকে কোনো নির্দেশ দিলে উক্ত কর্তৃপক্ষ বা সত্তা অনধিক তিন মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করে কমিশনকে অবহিত করতে হবে। তবে কমিশনের নির্দেশ বা সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো অসুবিধা হলে সে ক্ষেত্রে নির্দেশ বা সুপারিশ পাওয়ার অনধিক তিন মাসের মধ্যে কমিশনকে অবহিত করতে হবে। কমিশন বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে যে নির্দেশ বা সুপারিশ পাঠাবে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেই নির্দেশ বা সুপারিশ কমিশন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করে কমিশনকে জানাতে হবে।
আরও পড়ুনকোনো দল নয়, পুলিশের আনুগত্য থাকবে আইন ও দেশের প্রতি৯ ঘণ্টা আগেপুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের পর জুলাই জাতীয় সনদেও এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।এই কমিশনের সদস্য পদে নিয়োগের সুপারিশ প্রদানের জন্য সাত সদস্যের সমন্বয়ে একটি বাছাই কমিটি গঠন করা হবে। খসড়া অধ্যাদেশে প্রধান বিচারপতির মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপারসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির মনোনীত একজন সরকারদলীয় এবং একজন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যকে বাছাই কমিটিতে রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ন্যূনতম পাঁচ সদস্যের উপস্থিতিতে বাছাই কমিটির কোরাম হওয়া ও বাছাই কমিটির বাছাই প্রক্রিয়া শুরুর ৩০ দিনের মধ্যে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে খসড়া প্রস্তাবে।
আরও পড়ুন‘আওয়ামী পুলিশ, বিএনপি পুলিশ’ তকমা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কঠিন: সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা১৭ ঘণ্টা আগেপুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ খসড়ায় কমিশন প্রতিষ্ঠা, কার্যালয়, সদস্যদের নিয়োগ, মেয়াদ, কমিশনের সদস্য হওয়ার জন্য কারা অযোগ্য, সদস্যদের পদত্যাগ, অপসারণ, পুলিশি কার্যক্রমে দক্ষতা বৃদ্ধি, শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, নাগরিকের অভিযোগ অনুসন্ধান-নিষ্পত্তি, পুলিশ সদস্যদের সংক্ষোভ নিরসন, পুলিশপ্রধান নিয়োগ, আইন-বিধি, নীতিমালা প্রণয়ন ও গবেষণা বিষয়েও প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের পর জুলাই জাতীয় সনদেও এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আরও পড়ুনমাঝেমধ্যে শুনতে হয়, ‘উনি কি আমাদের লোক’: আইজিপি১৭ ঘণ্টা আগে