চাকরি ফিরে পেতে এক শ্রমিকের ১৮ বছরের লড়াই
Published: 1st, May 2025 GMT
২০০৭ সালের মে মাসে চাকরি হারান শ্রমিক কবির হোসেন। চাকরি ফিরে পেতে দ্বারস্থ হন আদালতের। এরপর ১৮ বছর হতে চলল। আইনি লড়াই এখনো শেষ হয়নি। মামলার খরচ জোগাড়ে হয়েছেন ঋণগ্রস্ত। ইতিমধ্যে মারা গেছেন মামলা পরিচালনাকারী দুই আইনজীবীও। ক্লান্ত কবির এখনো জানেন না কবে চাকরি ফিরে পাবেন।
চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড এলাকায় সিহান স্পেশালাইজড টেক্সটাইলে তাঁতি পদে কর্মরত ছিলেন কবির। বেতন ছিল ১ হাজার ২১৭ টাকা। কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাঁর করা মামলাটি বর্তমানে প্রথম শ্রম আদালত চট্টগ্রামে বিচারাধীন।
চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ এলাকার একটি সরকারি বাড়িতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রম আদালতের কার্যক্রম চলে। দুটি শ্রম আদালতে এখন ১ হাজার ৯১৩টি মামলা বিচারাধীন। ১৫০ দিনের মধ্যে শ্রম আদালতের মামলা নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি, সমন জারিতে দেরি, জবাব দাখিলে আইনজীবীদের বারবার সময় নেওয়া, প্রতিনিধিদের মতামত প্রদানে দেরির কারণে শ্রম আদালতে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন মামলার বিচার ঝুলে আছে।
কবিরদের মতো শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে গড়ব এ দেশ নতুন করে’।
গত রোববার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের শ্রম আদালত প্রাঙ্গণে কথা হয় কবির হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৮ বছর ধরে চালিয়ে নেওয়া এই লড়াইয়ের কথা।
আদালত সূত্র জানায়, ২০০৪ সালের ৭ মার্চ চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড এলাকায় সিহান স্পেশালাইজড টেক্সটাইলে তাঁতি পদে যোগ দেন কবির হোসেন। অসৌজন্যমূলক আচরণ, এক সহকর্মীকে মারধরের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৭ মার্চ তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ। তিনি এর উত্তর দিলেও তা সন্তোষজনক মনে না করে একই বছরের ২২ মে কবিরকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
‘মিথ্যা অভিযোগে’ চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে দাবি করে কবির ওই বছরের জুলাইয়ে প্রথম শ্রম আদালত চট্টগ্রামে মামলা করেন। এতে বিবাদী করা হয় কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইমরান আলী ভূঁইয়াসহ ১০ জনকে। মামলার পর বিবাদীরা কয়েকটি ধার্য দিনে হাজির হন। পরে আর হাজির হননি। একতরফা রায় দেন আদালত ২০০৮ সালের ২৫ মার্চ। রায়ের আদেশে কবির হোসেনকে চাকরিতে পুনর্বহাল ও বকেয়া বেতন–ভাতা পরিশোধের নির্দেশ দেন আদালত।
কবির হোসেন বলেন, আদালত নির্দেশ দিলেও ফিরে পাননি চাকরি। শেষে ২০০৮ সালের ২২ মার্চ কারখানার এমডি ইমরান আলী ভূঁইয়াসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতের নির্দেশ অমান্য করায় ফৌজদারি মামলা করেন প্রথম শ্রম আদালত চট্টগ্রামে। এরপর কারখানা কর্তৃপক্ষ আদালতে হাজির হয়ে কবিরকে চাকরিতে পুনর্বহালের আদেশ দিয়ে দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল (মিস মামলা) করে শ্রম আদালতে।
আবেদনে বলা হয়, একতরফা রায় হয়েছে। তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হোক। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কবির যে ফৌজদারি মামলা করেছেন সেটির কার্যক্রম যাতে স্থগিত রাখা হয়। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ২০০৮ সালের ২৫ আগস্ট আদালত কারখানা কর্তৃপক্ষের করা মিস মামলার আবেদন মঞ্জুর এবং কবিরের করা ফৌজদারি মামলার কার্যক্রম স্থগিতের আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, কার্যক্রম স্থগিত না রাখলে আইনগত জটিলতা দেখা দেবে।
আবার শুরু হয় কবিরের দৌড়ঝাঁপ, আদালতে দৌড়াদৌড়ি। রোদ–বৃষ্টি উপেক্ষা করে ধার্য দিনে হাজির হন আদালতে। এভাবে কেটে যায় ছয়টি বছর। এর মধ্যে ২০১১ সালে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগে আক্রান্ত হন কবিরের বাবা আবদুল হালিম হাওলাদার। একদিকে মামলার খচর অন্যদিকে অসুস্থ বাবা।
কবির হোসেন বলেন, ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর প্রথম শ্রম আদালতে দুই তরফা শুনানি শেষে অর্থাৎ কবির ও তাঁর মালিকপক্ষের উপস্থিতিতে আদালত রায় দেন। সেই রায়ে তাঁকে চাকরিতে পুনর্বহাল ও বকেয়া বেতন–ভাতা পরিশোধের নির্দেশ দেন আদালত। আগে দেওয়া রায় (২০০৮ সালের ২৫ মার্চ) বহাল রাখেন, মালিকপক্ষের করা মিস মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যায়।
আদালতের রায় নিয়ে কবির আবার হাসিমুখে ছুটে যান কারখানায়। কিন্তু এবারও তাঁকে নিরাশ হতে হয়। কবিরকে চাকরিতে পুনর্বহাল ও বকেয়া বেতন–ভাতা পরিশোধের চট্টগ্রাম শ্রম আদালতে দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ঢাকার শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
এবার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় কবিরের। কেটে যায় সাড়ে চার বছর। এর মধ্যে ২০১৮ সালে আপিল খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। মালিকপক্ষ এটি পুনর্বিবেচনার আবেদন করে। আদালত তা মঞ্জুর করলে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই ট্রাইব্যুনালে মালিকপক্ষের করা আপিল নামঞ্জুর করে শ্রম আদালতে দেওয়া রায় পুনর্বহাল রাখেন।
আপিল ট্রাইব্যুনালে রায় পেয়েও কবিরের ভাগ্যে জোটেনি চাকরি। আবার দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন আদালতপাড়া ও আইনজীবীর কাছে। ২০২০ সালের শুরুতে এক আইনজীবীর পরামর্শে আবার নতুন করে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেন। সাড়ে তিন বছর দৌড়ঝাঁপের পর বুঝতে পারেন তার আগের করা (২০০৮ সালের ২২ মার্চ) ফৌজদারি মামলা রয়েছে। সেটির স্থগিতাদেশ থাকবে না মালিকপক্ষের মিস মামলা ও আপিল নামঞ্জুর হওয়ায়।
গত বছরের ১৩ জুন মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে আগের করা (২০০৮ সালের ২২ মার্চ) ফৌজদারি মামলা আবার চালুর জন্য প্রথম শ্রম আদালত চট্টগ্রামে আবেদন করেন। আদালত তা মঞ্জুর করেন। কার্যক্রম শুরুর জন্য মালিকপক্ষের পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালত সমন জারি করেন। পরে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর ইপিজেড থানার এএসআই মাসুদ আলম আদালতকে লিখিতভাবে জানান, কারখানার ঠিকানায় গিয়ে ওই নামের কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে বর্তমানে স্মার্ট জ্যাকেট (বিডি) নামে থাকা কারখানার উপমহাব্যবস্থাপক (এজিএম) ইউসুফ চৌধুরী জানিয়েছেন, আগের মালিকানা বিক্রি হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আদালত বাদী কবির হোসেনকে কারখানা কর্তৃপক্ষের ঠিকানা দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। ১৩ মে পরবর্তী তারিখ রয়েছে।
কারখানার আগের এমডি ইমরান আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তাঁদের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী সুখময় চক্রবর্তী বলেন, অনেক বছর ধরে তাঁরা আর যোগাযোগ করেন না। এখন কোথায় আছেন জানেন না। বর্তমান কারখানার এজিএম ইউসুফ চৌধুরী জানান, শ্রমিক কবিরের যাবতীয় লেনদেন আগের মালিকের সঙ্গে।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলায় বাড়ি কবিরের। চাকরি হারোনোর পর সেখান থেকে চট্টগ্রামে এসে মামলার খোঁজ নেন। একবার আসা–যাওয়ায় তাঁর খরচ হয় তিন হাজার টাকা। বরিশালে বিভিন্ন কারখানায় দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করে মামলার খরচ চালান। এ পর্যন্ত তাঁর সাত থেকে আট লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে দাবি করেন।
শ্রমিকদের পাওনাসহ নানা দাবি সহজে আদায়ের জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতিতে এগোনোর পরামর্শ দেন শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহীন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আইনের দুর্বলতা, রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানা কারণে শ্রম আইন বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কবিরের মামলা লড়ার জন্য মালিকপক্ষ যে টাকা খরচ করেছে তার অর্ধেক টাকা দিয়ে তাঁকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিতে পারতেন। আপসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে সচেতনতা বাড়াতে শ্রমিক সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা উচিত।
শ্রমিক কবির হোসেনের চাওয়া এখন আদালতের নির্দেশমতো চাকরিতে পুনর্বহাল হওয়া ও বকেয়া বেতন–ভাতা পাওয়া। তিনি বলেন, ‘অন্যায়ভাবে আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ১৮ ধরে বছর ঘুরছি। আর কত দিন? বিচার কি পাব না?’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম ল কপক ষ র ২০০৮ স ল র স ল র ২২ আইনজ ব ও বক য় র ২২ ম র জন য চ কর ত কর ত প বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়
ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত হয়েছিল সংবিধানে, তা–ই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে আপিল বিভাগে এ–সংক্রান্ত শুনানিতে বলেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল–পরবর্তী নির্বাচনগুলোর চিত্র দেখিয়ে জয়নুল আবেদীন বলেছেন, ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন এবং ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে—দেশের জনগণ এমন বিতর্কিত কোনো নির্বাচন হোক, তা চায় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের ওপর আজ রোববার ষষ্ঠ দিনের মতো শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে বিএনপি মহাসচিবের আপিল–সংক্রান্ত শুনানি করেন জয়নুল আবেদীন।
সকাল ৯টা ২০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। বেলা ১১টা থেকে মাঝে বিরতি দিয়ে ১টা পর্যন্ত শুনানি চলে। পরবর্তী শুনানির জন্য মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দিন রাখা হয়েছে। এদিন বিরতির পর শুনানি শুরুর আগে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অপর বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে আসেন বাংলাদেশে সফররত নেপালের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ মান সিং রাউত। বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে বসে এই শুনানি পর্যবেক্ষণ করেন তিনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেই একটি আলোচিত বিষয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে যুক্ত করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছর পর সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে এই ব্যবস্থা বাতিল করে। তার আগে সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
ওই রায়ের ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন ও আপিল বিভাগের রুলসের ব্যত্যয় ঘটেছে দাবি করে শুনানিতে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রায়ে সইয়ের আগেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সংবিধান সংশোধন (পঞ্চদশ সংশোধনী) করে। পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও স্বাক্ষরের (বিচারপতিদের রায়ে সই করা) আগে সরকার সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের বলে তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে, যা দেশবাসীর জানা। দেশের বিবেকবান মানুষ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে এই সংবিধান সংশোধনকে সরকারের হীন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিল। এটি জনগণের বিরুদ্ধে বড় ষড়যন্ত্র।’
বিএনপির একসময়ের আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদীন শুনানিতে বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করেছেন। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে বহাল রাখার লক্ষ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি (বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক) দেশের প্রচলিত আইন ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রুলস যথাযথভাবে অনুসরণ না করে সর্বশেষ (পূর্ণাঙ্গ রায়) রায় দেন, যা প্রথমে দেওয়া রায়ের (শর্ট অর্ডার সংক্ষিপ্ত রায়) সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।’
শুনানিতে অবসরের পর রায়ে সই প্রসঙ্গ
অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করলে তার আইনগত মূল্য কী হবে—এ প্রসঙ্গ ওঠে শুনানিতে। বিরতির পর শুনানিতে অংশ নিয়ে এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিবের অপর আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, রায় ঘোষণা ও রায়ে সই করা দুটি ভিন্ন বিষয়। রায় ঘোষণার সময় এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদে আসীন ছিলেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে যা ছিল, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা পরিবর্তন করা হয়েছে।
দেওয়ানি কার্যবিধি, আপিল বিভাগের রুলস ও সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘শর্ট অর্ডারের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ে যে পার্থক্য, তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করেছেন একজন বিচারপতি। এই বিচারপতিও বলেননি অবসরের পরে বিচারপতি খায়রুল হকের লেখা রায়টি অবৈধ হয়েছে। স্বাক্ষর পরে করেছেন বলে রায় অবৈধ বলা যাবে না। কারণ, অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করতে পারবেন না কিংবা কত দিনের মধ্যে সই না করলে সেটি অবৈধ হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আইনে নেই।’
রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘প্রকাশ্য আদালতে কোনো বিচারপতি যখন কোনো রায় দেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে দিলে ছোটখাটো দাড়ি, কমা, শব্দ বাদ পড়েছে—এগুলো ছাড়া যেকোনো পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই সেটি রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) ছাড়া হবে না, যার ওপর শুনানি চলছে।’
এ মামলায় সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়। ওই প্রসঙ্গে সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক বলেন, ‘অবসরের পর রায়ে সই করলে তা বাতিল বা অকার্যকর হবে না। যেদিন প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করলেন, সেই তারিখ হচ্ছে মূল। এটি হচ্ছে রায়ের তারিখ। কবে সই করলেন, এটি প্রাসঙ্গিক নয়। আপিল বিভাগের রুলসে বলা আছে, এ ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধির (সিপিসি) বিধান কার্যকর হবে না। আপিল বিভাগের জন্য সিপিসি প্রযোজ্য নয়।’
মামলার পূর্বাপর
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন পৃথক আবেদন (রিভিউ) করেন। সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়।
রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে অপর রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এ অনুসারে পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের করা রিভিউসহ অপর রিভিউ আবেদন এবং বিএনপির মহাসচিবের আপিল শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে।
পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের ওপর ২১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। এরপর ইন্টারভেনার হিসেবে যুক্ত সংগঠনের পক্ষে শুনানি করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। এরপর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল এবং এ এস এম শাহরিয়ার কবির শুনানি করেন। শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য উপস্থাপনের পর হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (রিভিউ আবেদনকারী) পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক শুনানি করেন। এরপর বিএনপির মহাসচিবের পক্ষে জয়নুল আবেদীন শুনানি শুরু করেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর পর গত আগস্টে বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেপ্তার হন। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।