দুই দিনে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবারও যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের উদ্যোগে সম্প্রতি চালু হওয়া ফাউন্ডেশনটির ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার অভিযোগ, জিএইচএফ গাজায় ত্রাণ বিতরণে নিরপেক্ষতার নীতি লঙ্ঘন করছে এবং ত্রাণ বিতরণের মাধ্যমে গাজা খালি করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।

গাজা হামলার ৫৯৯তম দিনে গতকাল অধিকৃত পশ্চিম তীরে নতুন করে আরও ২২টি বসতি স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। কয়েক দশকের মধ্যে এটি ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বসতি স্থাপনের ঘোষণা। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াল।

গতকাল সকাল পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় গাজার বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৫৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ফিলিস্তিনের সরকারি সংবাদ সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, গতকাল ভোরে উত্তর গাজার জাবালিয়ায় একটি কিন্ডারগার্টেন ও আজ্জাম পরিবারের বাড়িতে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত সাতজন নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, মধ্য গাজার বুরেইজ শরণার্থীশিবিরের আবাসিক ভবনে ইসরায়েলের কয়েক দফা বিমান হামলায় মারা গেছেন অন্তত ১৯ জন।

গতকাল মধ্য গাজার নেটজারিম করিডরে জিএইচএফের একটি ত্রাণ কেন্দ্রের কাছে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। বিস্ফোরণের কারণ ও হতাহতের খবর তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

গাজার সরকারি সংবাদমাধ্যম কার্যালয় জানিয়েছে, দক্ষিণ গাজায় মঙ্গল ও বুধবার জিএইচএফের কেন্দ্র থেকে খাবার আনতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ১০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। একই সময়ে সেখানে আরও প্রায় ৬২ জন আহত হয়েছেন।

জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো জিএইচএফকে বর্জন করেছে। তাদের অভিযোগ, মানবিক সহায়তা কোনো ধরনের পক্ষপাত ছাড়া প্রয়োজনের ভিত্তিতে বণ্টন করতে হয়। কিন্তু মানবিক সহায়তা দেওয়ার সেই নীতিকে লঙ্ঘন করছে জিএইচএফ।

অধিকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চলে জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ সহায়তা কর্মকর্তা জনাথন হুইটল জেরুজালেমে সাংবাদিকদের বলেন, নজরদারি করে নতুন পদ্ধতিতে ত্রাণ দিচ্ছে জিএইচএফ। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের পরিকল্পিতভাবে বঞ্চনা করার নীতিকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে।

জনাথন হুইটল আরও বলেন, জাতিসংঘ এই পরিকল্পনায় অংশ নিতে রাজি হয়নি। কারণ, বাস্তবতার দিক থেকে এটি অকার্যকর এবং মানবিক নীতির লঙ্ঘন। তারা ত্রাণকে গাজার নির্দিষ্ট এলাকা খালি করার বৃহত্তর ইসরায়েলি পরিকল্পনার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

গাজার নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় মঙ্গলবার থেকে ত্রাণ বিতরণ শুরু করেছে জিএইচএফ।

খাদ্যগুদামে ‘ক্ষুধার্ত মানুষের’ ঢল

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) বরাতে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দলে দলে ‘ক্ষুধার্ত মানুষ’ বুধবার মধ্য গাজার একটি খাদ্যগুদামে ঢুকে পড়েছেন।

এ ঘটনায় দুজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। ডব্লিউএফপি জানিয়েছে, তারা বিস্তারিত তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখছে।

বার্তা সংস্থা এএফপির ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, দেইর আল-বালাহ শহরের আল-ঘাফারি গুদামে ক্ষুধার্ত লোকজন ঢুকে খাদ্যের বস্তা ও ময়দার প্যাকেট নিয়ে যাচ্ছেন। সেই সময় গুলির শব্দ শোনা যায়। গুলি কোথা থেকে এসেছে, তা তখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না।

ডব্লিউএফপি এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রায় তিন মাস ধরে চলা ইসরায়েলি অবরোধের পর মানবিক সংকট ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে’। গত সপ্তাহে এ অবরোধ কিছুটা শিথিল করা হয়েছে।

ডব্লিউএফপি সতর্ক করে বলেছে, গাজায় অবিলম্বে খাদ্যসহায়তা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। মানুষকে নিশ্চিত করতে হবে যে তাঁরা অনাহারে মরবেন না। পরিস্থিতি দ্রুত খারাপের দিকে যাচ্ছে। সাহায্য সীমিত করার কারণে ক্ষুধার্ত মানুষের জীবন আরও হুমকির মুখে পড়ছে।

ফিলিস্তিনি পুরুষেরা গম সংগ্রহ করছেন, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের হামলার পর নিজের খেত থেকে গম সংগ্রহ করছেন এক ফিলিস্তিনি। ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে, ২৮ মে, ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত র ণ ব তরণ ইসর য় ল র জ এইচএফ গতক ল

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল

যখন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, তখন তা শুধু ক্ষুধার নয়, বরং সমাজের ভাঙনেরও প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এ অবস্থায় মানুষ আবর্জনার স্তূপ থেকে খাবার খুঁজে আনে। কেউ গোপনে রান্না করে; কেউ আত্মীয়দের থেকে খাবার লুকিয়ে রাখে, কোনো পরিবার হয়তো খাবারের জন্য তাদের দাদিমার গয়না বিক্রি করে দেয়।

দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মুখে কোনো অনুভূতি থাকে না। তাদের চোখে থাকে ফাঁপা দৃষ্টি। মানুষ পশুর মতো খাবারের জন্য লড়াই করে। এটিই হলো সামাজিক অবক্ষয় ও অপমানের চরম রূপ। এটিই হলো মানবিক মর্যাদার বিলোপ। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজকের গাজাবাসী যাচ্ছে। 

গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ নামে একটি নতুন সংস্থা (যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে মে মাসে যাত্রা শুরু করে) নিজেদের কার্যক্রমকে একুশ শতকের আধুনিক ও সহানুভূতিশীল সংস্থা বলে দাবি করছে। তারা বলছে, তাদের চারটি ‘নিরাপদ বিতরণ কেন্দ্র’ থেকে তারা প্রতিদিন ২০ লাখের বেশি প্যাকেট খাবার বিতরণ করছে। সেখানকার ছবিতে দেখা যায়, বাচ্চাদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন সংস্থার কর্মীরা।

আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি। 

ইসরায়েলি মুখপাত্ররা বলছেন, জাতিসংঘের ট্রাকগুলো গাজার সীমানার ভেতরে আছে কিন্তু জাতিসংঘ নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বিতরণ করছে না। কিন্তু এ বক্তব্য খুব সহজ বিশ্লেষণেই ভেঙে পড়ে। 

প্রথমত, সংখ্যা ঠিক মিলছে না। গত এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা হিসাব করে জানায়, ১৮ মাসের অবরোধ ও যুদ্ধের পর এবং দুই মাসের পূর্ণ ইসরায়েলি অবরোধের ফলে মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে গাজায় জীবন বাঁচানোর জন্য যে পরিমাণ খাবার দরকার, তার অর্ধেকের নিচে নেমে যাবে। অর্থাৎ গাজার সব মানুষের খাদ্যের পুরো চাহিদা পূরণ করতে হবে এই ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিদিনের ২০ লাখ প্যাকেট খাবার গাজার প্রয়োজনের অর্ধেকও নয়। 

আরও পড়ুনইসরায়েল কেন গাজায় অস্ত্রধারী গুন্ডা পোষে ১১ জুন ২০২৫

দ্বিতীয়ত, শুধু সংখ্যায় খাবার পৌঁছালেই দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয় না; দুর্ভিক্ষ আঘাত করে সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোর ওপর। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, যখন ২০ শতাংশ পরিবার মারাত্মক খাদ্যসংকটে পড়ে, তখন সেটিকে ‘দুর্ভিক্ষ’ বলা যায়। এ অবস্থায় নারীরা, বিশেষ করে যাঁদের স্বামী নেই এবং যাঁদের অনেক শিশু বা বয়স্ক অভিভাবক আছেন, তাঁরাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন। সেসব পরিবারকে চিনে ত্রাণ পৌঁছানোই আসল কাজ। 

জিএইচএফ গাজায় চারটি বিতরণ কেন্দ্র চালায়—তিনটি রাফার ধ্বংসস্তূপে, আরেকটি গাজার মাঝখানে। সব কটিই সামরিক এলাকায়। এরা খুব অল্প সময়ের জন্য এবং খাবার বিতরণের খুব অল্প আগে সবাইকে জানিয়ে খোলে। মানুষ ধ্বংসস্তূপে শিবির করে বসে থাকে, কখন দরজা খুলবে সেই আশায়। তারা জানে, ইসরায়েলি সেনারা ভিড় সামলাতে গুলি চালাতে দ্বিধা করে না। যেসব দুর্বল মা, বয়স্ক মানুষ বা প্রতিবন্ধী এই দৌড়ে অংশ নিতে পারেন না, তাঁরা কীভাবে খাবার পাবেন? 

আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫

তৃতীয়ত, মানুষের বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়া দরকার। যেমন অপুষ্ট শিশুদের জন্য দরকার বিশেষ ধরনের খাবার (যেমন ‘প্লাম্পিনাট’, যা সাধারণ খাবার খেতে না পারা শিশুর জন্য তৈরি) দেওয়া দরকার। কিন্তু জিএইচএফের বক্সে থাকে ময়দা, পাস্তা, তেল, চাল, ডাল, তাহিনি (তিলবীজ থেকে তৈরি একধরনের মাখনবিশেষ)। জিএইচএফের ত্রাণের মধ্যে কোনো শিশুখাদ্য বা প্লাম্পিনাট নেই। কোনো প্রশিক্ষিত নার্স বা পুষ্টিবিদও নেই, যাঁরা অপুষ্ট শিশুদের সেবা দিতে পারেন। 

আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি। 

অ্যালেক্স ডি ওয়াল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক

দ্য গার্ডিয়ান, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৬০ হাজার ছাড়াল
  • গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল
  • ইসরায়েল বলছে তারা গাজায় ত্রাণ দিচ্ছে, তাহলে ফিলিস্তিনিরা না খেয়ে মরছে কেন