জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের বেশির ভাগ বিষণ্নতা ও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন
Published: 30th, May 2025 GMT
‘আট মাস ধরে ছেলেটারে নিয়া হাসপাতাল হাসপাতালে দৌড়াইছি। ছেলেটার চোখটা ফালায় দিতে হইলো। ও এত মন খারাপ করে! এখন আর হাসপাতালে যাইতে চায় না, জিদ করে।’
কথাগুলো বলছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত স্কুলছাত্র সাকিব হাসানের (১২) মা সাবিনা ইয়াসমিন। ২১ মে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমবার হাসপাতালে থাকার সময় ১৫ দিন কোনো কথাই বলেনি সাকিব। মন খারাপ করে বসে থাকত সব সময়।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গুলিতে ঠোঁট, মাড়ি, তালু, নাক, বাঁ চোখ হারানো খোকন চন্দ্র বর্মণ (২৩) এখনো নিজেকে আয়নায় দেখে ভয় পান। শুরুতে কান্নাকাটি করতেন। পেশায় গাড়িচালক খোকন গত বছরের অক্টোবরে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমার চেহারা দেখে এখন আমি নিজেই ভয় পাই। এর চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো ছিল।’
এখনো বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পাননি খোকন। ২১ মে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যদি সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা না পান, তাহলে তাঁর কী অবস্থা হবে, ভেবে সব সময় দুশ্চিন্তা হয়। দুশ্চিন্তা থেকে বিষণ্নতায় ভোগেন।
গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত সাকিব-খোকনদের মতো ব্যক্তিদের মধ্যে বিষণ্নতা ও পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের (পিটিএসডি) মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বেশি বলে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) এক গবেষণায় (https://www.
গবেষণায় অংশগ্রহণকারী আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ বিষণ্নতায় ভুগছেন। আর পিটিএসডিতে ভুগছেন ৬৪ দশমিক ১ শতাংশ।
গবেষণাটির শিরোনাম: ‘বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানের মানসিক স্বাস্থ্যগত পরিণতি: সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিষণ্নতা ও পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার-সংক্রান্ত একটি গবেষণা’। গবেষণা প্রতিবেদনটি ১৮ মে প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা স্প্রিংগার নেচার গ্রুপের ওয়েবভিত্তিক চিকিৎসাবিজ্ঞান সাময়িকী কিউরাসে প্রকাশিত হয়।
বিএমইউ, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান—এই তিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ২১৭ জন আহত ব্যক্তি গবেষণায় অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে নারী ৬ জন। গবেষণার জন্য তাঁদের সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
গবেষণাটি পরিচালিত হয় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ গুরুতর বিষণ্নতা এবং ২০ শতাংশের বেশি গুরুতর পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে (পিটিএসডি) ভুগছেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
গবেষণায় বলা হয়, পিটিএসডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে জীবনযাপনের প্রতি অনাগ্রহ দেখা দেয়, মৃত্যুর চিন্তা আসে, অমনোযোগ সৃষ্টি হয়, মন ভার থাকে, নিজেকে দোষারোপ করার প্রবণতা দেখা দেয়, আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন, নেতিবাচক চিন্তাভাবনা হয়, এমনকি নিজের ক্ষতি করার মতো আচরণও দেখা যায়। মানসিক স্বাস্থ্যচিকিৎসার ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এসব ব্যক্তির মধ্যে তীব্র বিষণ্নতা, আত্মহত্যার ঝুঁকি, সহিংস আচরণ, হত্যাকাণ্ডের প্রবণতা ও মাদকাসক্তির মতো জটিল মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
পিটিএসডি সম্পর্কে চিকিৎসকেরা বলছেন, সচরাচর চোখের সামনে ঘটে না, এমন সহিংসতার শিকার বা আকস্মিক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে মানসিক চাপ তীব্র হয়। ঘটনার এক মাস পরও সেই ঘটনা তাঁদের মনে নাড়া দেয়। তাঁরা চমকে চমকে ওঠেন। যে তারিখে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল বা বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেই তারিখ এলে তাঁরা আগের কথা ভেবে বিষণ্ন হয়ে পড়েন। ঘটনাস্থলের সামনে গেলে চমকে ওঠেন। সেসব তারিখ ও ঘটনাস্থল এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয় তাঁদের মধ্যে। এমনকি নির্দিষ্ট রং ও পোশাক তাঁদের সেই দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ ধরনের ব্যক্তিদের পিটিএসডি আক্রান্ত বলা হয়। এটা একধরনের মানসিক সমস্যা।
গ্রামাঞ্চলের রোগীদের মধ্যে বিষণ্নতা-পিটিএসডি বেশিগবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গবেষণায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের ৮৯ দশমিক ৪ শতাংশ গুলিতে আহত হন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৮ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ২৯ বছর। আর ২৫ শতাংশের বয়স ২০ বছরের নিচে।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারী আহত ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন পুরুষ (৯৭ দশমিক ২ শতাংশ), বাকি ২ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। শহরাঞ্চলের বাসিন্দা ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ, বাকিরা গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা। শিক্ষার্থী ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ, বাকিরা নানা পেশার সাধারণ মানুষ। প্রায় ৭০ শতাংশ নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির। আর উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষ ১২ দশমিক ৪ শতাংশ।
গবেষণায় বলা হয়, শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলের রোগীদের মধ্যে বিষণ্নতা ও পিটিএসডি বেশি।
মূল গবেষক বিএমইউয়ের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সামসুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যসহায়তা, সামাজিক সহযোগিতার নেটওয়ার্ক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা শহরের তুলনায় গ্রামে সীমিত। এ কারণে গ্রামের আহত ব্যক্তিরা দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্নতা ও মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়ে থাকতে পারেন।
আরও পড়ুনজুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চারজনের বিষপান২৫ মে ২০২৫দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য সংকটের আশঙ্কাগত বছরের ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানার সামনে খুব কাছ থেকে পুলিশের ছোড়া গুলিতে গুরুতর আহত হন খোকন। সরকারি খরচে গত ২১ ফেব্রুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে রাশিয়ায় পাঠানো হয়। ৭ মে প্রথম দফা অস্ত্রোপচার শেষে তিনি দেশে ফেরেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন তাঁর মুখে নিচের চোয়াল বসানো হয়েছে। এ ছাড়া আগের মতোই ঠোঁট, তালু, মাড়ির জায়গায় বড় গর্ত রয়েছে।
খোকন আরও বলেন, ‘আমার সব সময় বিষণ্ন লাগে। শিশুরা, এমনকি বড়রাও আমাকে দেখলে ভয় পেয়ে যায়। তখন খুব মন খারাপ হয়।’
গত বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুরের ইসিবি চত্বরে বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে যাওয়া সাকিবের ডান চোখে ছররা গুলি লাগে। পুলিশ ধরতে পারে—এই ভয়ে স্থানীয় ফার্মেসিতে সাকিবের চিকিৎসা করানো হয়। অবস্থা গুরুতর হলে ঘটনার দুই দিন পর সাকিবকে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিয়ে যায় পরিবার।
গত ১৭ মার্চ এই হাসপাতালে তৃতীয় দফা অস্ত্রোপচারের দিন সাকিব ও তাঁর মা সাবিনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল এই প্রতিবেদকের। সেদিন চিকিৎসকেরা সাকিবের অকেজো ডান চোখে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রস্থেটিক আই বা কৃত্রিম চোখ স্থাপন করেন।
সাবিনা ও তাঁর স্বামী তাঁদের দুই সন্তান নিয়ে ঢাকা ছেড়ে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। সাবিনা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ছেলের মতো তিনিও ওই সময়ের ঘটনা ভুলতে পারেন না। শুধু মনে হয়, ছেলেটার এত বড় ক্ষতি কেন হলো?
আরও পড়ুন অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে জরুরি প্রস্তাব২০ অক্টোবর ২০২৪বিএমইউয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সামসুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণায় দেখা যায়, জুলাই মাসে আহত অনেকে কমপক্ষে ছয় দিন পর্যন্ত বিনা চিকিৎসায় ছিলেন। কেউ গ্রেপ্তারের ভয়ে হাসপাতালে যাননি। পুলিশি হেফাজতে থাকা আহত অনেকে চিকিৎসা পাননি। বিশেষ করে সাভার ও আশুলিয়ায় পুলিশের বাধার মুখে বিনা চিকিৎসায় ছিলেন অনেকে। সে সময় চিকিৎসা পাওয়ার বিষয়েই তাঁদের মনোযোগ বেশি ছিল, মানসিক স্বাস্থ্যের কথা কেউ ভাবতে পারেনি।
জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন সামসুল আহসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক মানুষ আহত হয়েছেন। বহু মানুষ সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। তাঁদের জন্য বিশেষায়িত সমন্বিত চিকিৎসা দরকার। তা না হলে এটা দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য সংকট তৈরি করতে পারে।’
ক্রাচ হাতে, হুইলচেয়ারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের মানববন্ধনজাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের বিক্ষোভহাসপাতালে যেমন আছেন গণ-অভ্যুত্থানে আহত শ্রমজীবী মানুষগণ-অভ্যুত্থানের ৬ মাস: আংশিক সহায়তা পেয়েছে ৮১% শহীদ পরিবার, আহতদের ২৩%গুলিতে খোকনের ঠোঁট, মাড়ি, তালু, নাকের আর অস্তিত্ব নেইউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক গত বছর র প ট এসড আহতদ র দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতদের জন্য থাকছে বরাদ্দ
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ তহবিল করা হচ্ছে। এ তহবিলের আকার হতে পারে দেড় হাজার কোটি টাকার মতো। তহবিল থেকে অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত পরিবারগুলোকে এককালীন অর্থ, মাসিক ভাতা, দেশে-বিদেশে চিকিৎসা খরচ এবং কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। একই তহবিলের অর্থে তাঁদের জন্য ফ্ল্যাটও তৈরি হবে ঢাকার মিরপুরে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বাজেটে বিশেষ যে তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে সর্বোচ্চ ৭৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকবে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণে। আর এককালীন অনুদানের জন্য বরাদ্দ রাখা হতে পারে ২৫০ কোটি টাকা। এর বাইরে বাকি রবাদ্দ রাখা হবে চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও সম্মানী খরচ বাবদ।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেটভুক্ত জুলাই শহীদ পরিবার ৮৩৪টি। আর ১০ বিভাগে গেজেটভুক্ত আহত ১২ হাজার ৪৩ জন। জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের এককালীন আর্থিক সহায়তা দিতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগ মিলে ঠিক করেছে আগামী অর্থবছরে তা বাড়িয়ে তিন গুণ করা হবে। যার পরিমাণ হতে পারে ৬৩৮ কোটি টাকার মতো।
প্রতিটি শহীদ পরিবারকে এককালীন ৩০ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে, এ সিদ্ধান্ত আগেই হয়েছে। এতে মোট ব্যয় হবে ২৫০ কোটি ২০ লাখ টাকা। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আহত ব্যক্তিদের দেশে-বিদেশে চিকিৎসা এবং মাসিক অনুদান ও পুনর্বাসনে লাগবে আরও ৩৯০ কোটি টাকা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তর হবে, তার মাধ্যমে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বাজেট নিয়ে একটি সভা হয়। ওই সভায় গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার এবং আহত ব্যক্তিদের মাসিক সম্মানী ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছে বলে জানা গেছে। এই সম্মানী ভাতা ও এককালীন নগদ সহায়তা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার চিন্তা রয়েছে সরকারের।
জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ কাজ যৌথভাবে করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। শহীদ পরিবারগুলোকে চলতি অর্থবছরেই ১০ লাখ টাকা করে দেওয়ার কাজ চলমান। আগামী অর্থবছরে তাদের আরও ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনে দেওয়া হবে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে আহত ব্যক্তিদের এককালীন চিকিৎসা সহায়তা বাবদ অনুদান খাতে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। নতুন বাজেটেও একই পরিমাণ অর্থ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরে অবশ্য শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের জন্য মাসিক সম্মানী ভাতা বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়নি। আগামী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হতে পারে ১৫০ কোটি টাকা।
মাসিক ভাতা ও অনুদান আসছে
গণ-অভ্যুত্থানে অতি গুরুতর আহতদের জন্য ক, গুরুতর আহতদের জন্য খ এবং আহতদের জন্য গ-নামে তিনটি শ্রেণি করা হয়েছে। ক শ্রেণির ৪৯৩ জনকে মাসিক সম্মানী দেওয়া হতে পারে ২০ হাজার টাকা করে। যাঁরা উভয় হাত–পা হারিয়েছেন, দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়েছেন, মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন বা স্বাভাবিক কাজ করার সম্পূর্ণ অক্ষম হয়েছেন, তাঁদের ক শ্রেণিতে রাখা হচ্ছে।
এ ছাড়া খ শ্রেণির ৯০৮ জনকে দেওয়া হতে পারে প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা করে। যাঁরা একটি অঙ্গ হারিয়েছেন বা আংশিক অক্ষম হয়েছেন, তাঁদের খ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। আর গ শ্রেণির ১০ হাজার ৬৪৮ জন পেতে পারেন প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে। যাঁরা চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তাঁরা এই শ্রেণিতে রয়েছেন।
অনেক আহত আছেন, যাঁদের কোনো শ্রেণিতে ফেলা হচ্ছে না। তাঁদের কাউকে এককালীন ৩ লাখ, কাউকে এককালীন ২ লাখ টাকা করে দেওয়া হতে পারে। তাঁদের জন্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে শতকোটি টাকার বেশি।
এ ছাড়া শ্রেণিওয়ারি দুই লাখ, এক লাখ ও ৫০ হাজার টাকা করে চিকিৎসা অনুদান দেওয়ার কাজ চলমান থাকবে আগামী অর্থবছরেও। ক শ্রেণির জন্য এককালীন অনুদান ৫ লাখ এবং খ শ্রেণির ৩ লাখ টাকা করার উদ্যোগ রয়েছে। তবে গ শ্রেণির কেউ এককালীন অনুদান পাবেন না। তবে সরকারি চাকরি ও পুনর্বাসন কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হতে পারে তাঁদের।
ফ্ল্যাট দেওয়ার উদ্যোগ
জুলাইয়ে শহীদ ও গুরুতর আহত ব্যক্তিদের জন্য ঢাকায় একটি করে ফ্ল্যাট দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ঢাকার মিরপুরে এ জন্য পাঁচ একর জায়গাও চিহ্নিত করা হয়েছে। জায়গা হবে মিরপুর-১৪ নম্বর সেক্টরে পুলিশ স্টাফ কলেজের উল্টো পাশে এবং মিরপুর-৯ নম্বর এলাকার পল্লবী থানার পেছনে। ১৪ তলাবিশিষ্ট ২৫টি ভবন নির্মাণ করা হবে, যেসব ভবনে থাকবে ১ হাজার ২৫০ ও ১ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট। আগামী অর্থবছরে এ জন্য ৭৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকতে পারে।
জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষকে এ ধরনের কাজে বাজেট থেকে ঋণ হিসেবে অর্থ দেওয়া হলেও এবার দেওয়া হতে পারে অনুদান হিসেবে। শহীদ পরিবার ও গুরুতর আহত ব্যক্তিদের কাছে বিনা মূল্যে দেওয়া হতে পারে এসব ফ্ল্যাট। বাজেট পাস হওয়ার পর এ ব্যাপারে দরপত্র আহ্বান করা হবে। শহীদ পরিবারকে ১ হাজার ২৫০ বর্গফুট এবং ক শ্রেণির আহতদের জন্য ১ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট দেওয়া হতে পারে। প্রকল্প এলাকায় থাকবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মার্কেট, কমিউনিটি সেন্টার, খেলার মাঠ, সড়ক, পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সুবিধা থাকবে। দুই বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার চিন্তা সরকারের।
কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ
আহত ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে সরকার। বাজেট বক্তব্যে এ নিয়ে কথা থাকার কথা অর্থ উপদেষ্টার। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ছাড়াও বেসরকারি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকার আহত ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেছে। গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের মধ্যে খ এবং গ শ্রেণিভুক্তদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, শারীরিক অবস্থা ও সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে সরকার। আজীবন বিনা মূল্যে চিকিৎসা–সুবিধা ও বিনা মূল্যে উচ্চশিক্ষার সুযোগও দেওয়ার চিন্তা রয়েছে সরকারের।
আহত ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা, শারীরিক অবস্থা ও সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় উপযুক্ত বিষয়ে অর্থাৎ কম্পিউটার ট্রেড, ফ্রিল্যান্সিং, গবাদিপশু পালন, মৎস্য খামার, পোলট্রি ফার্মিং, মোবাইল সার্ভিসিং, ড্রাইভিং ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবে সরকার। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এ জন্য তাদের অনুদান নেওয়া হবে। অন্যদিকে শহীদের সন্তানেরা বিনা মূল্যে শিক্ষা সহায়তা পাবেন। যেকোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে সুবিধাভোগীর ব্যাংক হিসাবে। বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদি মাধ্যমে নেওয়ারও সুযোগ থাকবে।