‘আট মাস ধরে ছেলেটারে নিয়া হাসপাতাল হাসপাতালে দৌড়াইছি। ছেলেটার চোখটা ফালায় দিতে হইলো। ও এত মন খারাপ করে! এখন আর হাসপাতালে যাইতে চায় না, জিদ করে।’

কথাগুলো বলছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত স্কুলছাত্র সাকিব হাসানের (১২) মা সাবিনা ইয়াসমিন। ২১ মে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমবার হাসপাতালে থাকার সময় ১৫ দিন কোনো কথাই বলেনি সাকিব। মন খারাপ করে বসে থাকত সব সময়।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গুলিতে ঠোঁট, মাড়ি, তালু, নাক, বাঁ চোখ হারানো খোকন চন্দ্র বর্মণ (২৩) এখনো নিজেকে আয়নায় দেখে ভয় পান। শুরুতে কান্নাকাটি করতেন। পেশায় গাড়িচালক খোকন গত বছরের অক্টোবরে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমার চেহারা দেখে এখন আমি নিজেই ভয় পাই। এর চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো ছিল।’

এখনো বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পাননি খোকন। ২১ মে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যদি সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা না পান, তাহলে তাঁর কী অবস্থা হবে, ভেবে সব সময় দুশ্চিন্তা হয়। দুশ্চিন্তা থেকে বিষণ্নতায় ভোগেন।

গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত সাকিব-খোকনদের মতো ব্যক্তিদের মধ্যে বিষণ্নতা ও পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের (পিটিএসডি) মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বেশি বলে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) এক গবেষণায় (https://www.

cureus.com/articles/369958#!/) উঠে এসেছে।

গবেষণায় অংশগ্রহণকারী আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ বিষণ্নতায় ভুগছেন। আর পিটিএসডিতে ভুগছেন ৬৪ দশমিক ১ শতাংশ।

গবেষণাটির শিরোনাম: ‘বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানের মানসিক স্বাস্থ্যগত পরিণতি: সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিষণ্নতা ও পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার-সংক্রান্ত একটি গবেষণা’। গবেষণা প্রতিবেদনটি ১৮ মে প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা স্প্রিংগার নেচার গ্রুপের ওয়েবভিত্তিক চিকিৎসাবিজ্ঞান সাময়িকী কিউরাসে প্রকাশিত হয়।

বিএমইউ, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান—এই তিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ২১৭ জন আহত ব্যক্তি গবেষণায় অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে নারী ৬ জন। গবেষণার জন্য তাঁদের সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

গবেষণাটি পরিচালিত হয় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ গুরুতর বিষণ্নতা এবং ২০ শতাংশের বেশি গুরুতর পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে (পিটিএসডি) ভুগছেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

গবেষণায় বলা হয়, পিটিএসডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে জীবনযাপনের প্রতি অনাগ্রহ দেখা দেয়, মৃত্যুর চিন্তা আসে, অমনোযোগ সৃষ্টি হয়, মন ভার থাকে, নিজেকে দোষারোপ করার প্রবণতা দেখা দেয়, আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন, নেতিবাচক চিন্তাভাবনা হয়, এমনকি নিজের ক্ষতি করার মতো আচরণও দেখা যায়। মানসিক স্বাস্থ্যচিকিৎসার ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এসব ব্যক্তির মধ্যে তীব্র বিষণ্নতা, আত্মহত্যার ঝুঁকি, সহিংস আচরণ, হত্যাকাণ্ডের প্রবণতা ও মাদকাসক্তির মতো জটিল মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

পিটিএসডি সম্পর্কে চিকিৎসকেরা বলছেন, সচরাচর চোখের সামনে ঘটে না, এমন সহিংসতার শিকার বা আকস্মিক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে মানসিক চাপ তীব্র হয়। ঘটনার এক মাস পরও সেই ঘটনা তাঁদের মনে নাড়া দেয়। তাঁরা চমকে চমকে ওঠেন। যে তারিখে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল বা বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেই তারিখ এলে তাঁরা আগের কথা ভেবে বিষণ্ন হয়ে পড়েন। ঘটনাস্থলের সামনে গেলে চমকে ওঠেন। সেসব তারিখ ও ঘটনাস্থল এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয় তাঁদের মধ্যে। এমনকি নির্দিষ্ট রং ও পোশাক তাঁদের সেই দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ ধরনের ব্যক্তিদের পিটিএসডি আক্রান্ত বলা হয়। এটা একধরনের মানসিক সমস্যা।

গ্রামাঞ্চলের রোগীদের মধ্যে বিষণ্নতা-পিটিএসডি বেশি

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গবেষণায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের ৮৯ দশমিক ৪ শতাংশ গুলিতে আহত হন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৮ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ২৯ বছর। আর ২৫ শতাংশের বয়স ২০ বছরের নিচে।

গবেষণায় অংশগ্রহণকারী আহত ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন পুরুষ (৯৭ দশমিক ২ শতাংশ), বাকি ২ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। শহরাঞ্চলের বাসিন্দা ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ, বাকিরা গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা। শিক্ষার্থী ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ, বাকিরা নানা পেশার সাধারণ মানুষ। প্রায় ৭০ শতাংশ নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির। আর উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষ ১২ দশমিক ৪ শতাংশ।

গবেষণায় বলা হয়, শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলের রোগীদের মধ্যে বিষণ্নতা ও পিটিএসডি বেশি।

মূল গবেষক বিএমইউয়ের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সামসুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যসহায়তা, সামাজিক সহযোগিতার নেটওয়ার্ক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা শহরের তুলনায় গ্রামে সীমিত। এ কারণে গ্রামের আহত ব্যক্তিরা দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্নতা ও মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়ে থাকতে পারেন।

আরও পড়ুনজুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চারজনের বিষপান২৫ মে ২০২৫দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য সংকটের আশঙ্কা

গত বছরের ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানার সামনে খুব কাছ থেকে পুলিশের ছোড়া গুলিতে গুরুতর আহত হন খোকন। সরকারি খরচে গত ২১ ফেব্রুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে রাশিয়ায় পাঠানো হয়। ৭ মে প্রথম দফা অস্ত্রোপচার শেষে তিনি দেশে ফেরেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন তাঁর মুখে নিচের চোয়াল বসানো হয়েছে। এ ছাড়া আগের মতোই ঠোঁট, তালু, মাড়ির জায়গায় বড় গর্ত রয়েছে।

খোকন আরও বলেন, ‘আমার সব সময় বিষণ্ন লাগে। শিশুরা, এমনকি বড়রাও আমাকে দেখলে ভয় পেয়ে যায়। তখন খুব মন খারাপ হয়।’

গত বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুরের ইসিবি চত্বরে বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে যাওয়া সাকিবের ডান চোখে ছররা গুলি লাগে। পুলিশ ধরতে পারে—এই ভয়ে স্থানীয় ফার্মেসিতে সাকিবের চিকিৎসা করানো হয়। অবস্থা গুরুতর হলে ঘটনার দুই দিন পর সাকিবকে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিয়ে যায় পরিবার।

গত ১৭ মার্চ এই হাসপাতালে তৃতীয় দফা অস্ত্রোপচারের দিন সাকিব ও তাঁর মা সাবিনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল এই প্রতিবেদকের। সেদিন চিকিৎসকেরা সাকিবের অকেজো ডান চোখে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রস্থেটিক আই বা কৃত্রিম চোখ স্থাপন করেন।

সাবিনা ও তাঁর স্বামী তাঁদের দুই সন্তান নিয়ে ঢাকা ছেড়ে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। সাবিনা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ছেলের মতো তিনিও ওই সময়ের ঘটনা ভুলতে পারেন না। শুধু মনে হয়, ছেলেটার এত বড় ক্ষতি কেন হলো?

আরও পড়ুন অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে জরুরি প্রস্তাব২০ অক্টোবর ২০২৪

বিএমইউয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সামসুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণায় দেখা যায়, জুলাই মাসে আহত অনেকে কমপক্ষে ছয় দিন পর্যন্ত বিনা চিকিৎসায় ছিলেন। কেউ গ্রেপ্তারের ভয়ে হাসপাতালে যাননি। পুলিশি হেফাজতে থাকা আহত অনেকে চিকিৎসা পাননি। বিশেষ করে সাভার ও আশুলিয়ায় পুলিশের বাধার মুখে বিনা চিকিৎসায় ছিলেন অনেকে। সে সময় চিকিৎসা পাওয়ার বিষয়েই তাঁদের মনোযোগ বেশি ছিল, মানসিক স্বাস্থ্যের কথা কেউ ভাবতে পারেনি।

জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন সামসুল আহসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক মানুষ আহত হয়েছেন। বহু মানুষ সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। তাঁদের জন্য বিশেষায়িত সমন্বিত চিকিৎসা দরকার। তা না হলে এটা দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য সংকট তৈরি করতে পারে।’

ক্রাচ হাতে, হুইলচেয়ারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের মানববন্ধনজাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের বিক্ষোভহাসপাতালে যেমন আছেন গণ-অভ্যুত্থানে আহত শ্রমজীবী মানুষগণ-অভ্যুত্থানের ৬ মাস: আংশিক সহায়তা পেয়েছে ৮১% শহীদ পরিবার, আহতদের ২৩%গুলিতে খোকনের ঠোঁট, মাড়ি, তালু, নাকের আর অস্তিত্ব নেই

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল ক গত বছর র প ট এসড আহতদ র দশম ক

এছাড়াও পড়ুন:

আহতদের চিকিৎসা দিয়ে ফিরে গেছে ভারতীয় চিকিৎসকরা

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে আহতদের বিশেষ চিকিৎসা সহায়তা প্রদান শেষে দেশে ফিরে গেছে ভারতীয় চিকিৎসক দল।

ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন জানায়, সোমবার (২৮ জুলাই) সন্ধ্যায় নয়াদিল্লির রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতাল এবং সফদরজং হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত চার সদস্যের দলটি ঢাকা ছেড়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশনায় গত ২৩ জুলাই বাংলাদেশে আসে এই চিকিৎসক দল।

গত ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে বহু মানুষ হতাহত হন। দুর্ঘটনার পরপরই ভারত বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে চিকিৎসা সহায়তার আশ্বাস দেয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলটি বাংলাদেশে পাঠানো হয়।

ঢাকায় অবস্থানকালে ভারতীয় চিকিৎসক দলটি জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকদের সঙ্গে একযোগে কাজ করে। তারা মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ ও আহতদের চিকিৎসায় কারিগরি পরামর্শ প্রদান করেন এবং জটিল কিছু ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মতামত বিনিময় করেন।

ভারতীয় চিকিৎসকরা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গৃহীত চিকিৎসা পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে ইনস্টিটিউটের বার্ন কেয়ার ইউনিট ও ক্রিটিক্যাল কেস ম্যানেজমেন্টে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের দক্ষতার প্রশংসা করেন তারা।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আহতদের উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশ যদি চায় তাহলে ভারত আরো চিকিৎসা সহায়তা দিতে প্রস্তুত। প্রয়োজনে ভারতীয় হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগ দেওয়া হবে।

ভারতীয় হাইকমিশন জানায়, দেশটির মেডিকেল টিমের এই সফর দুই দেশের মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক আস্থা, সহযোগিতা ও সহানুভূতির চিরন্তন বন্ধনের প্রতিফল।

ঢাকা/হাসান/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদের দাবিতে শাহবাগ অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ 
  • আহতদের চিকিৎসা দিয়ে ফিরে গেছে ভারতীয় চিকিৎসকরা
  • মাইলস্টোনে বিমান দূর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য মহানগর সাংস্কৃতিক জোটের দোয়া
  • জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ জাতি ভুলে যেতে পারে না: স্বাস্থ্য উপদেষ্টা
  • মাইলস্টোনে বিমান বিধ্বস্তে হতাহতদের জন্য জিয়া সৈনিকদলের দোয়া