দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্ধকারতম দিনগুলোতে আনা ফ্রাঙ্ক ও তাঁর পরিবার নাৎসি নির্যাতনের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে আমস্টারডামের একটি গোপন ছাদে লুকিয়ে ছিলেন। তাঁর মরণোত্তর প্রকাশিত ডায়েরি বিশ্বকে সেই সময়ে ইহুদি পরিবারগুলোর ভয় এবং মানসিক ট্রমার এক ভূতুড়ে আভাস দেয়।
আজ ফিলিস্তিনে তেমনই করুণ এক গল্পই ফুটে উঠছে। এবার আনা ফ্রাঙ্কের মতো হাজার হাজার শিশু ইসরায়েলি সরকারের অনাহার ও অবিরাম বোমাবর্ষণের কারণে মৃত্যুর মুখোমুখি। তাদের লুকানোর জন্য একটি ছাদও নেই; নির্বিচারে ইসরায়েলি আক্রমণে তাদের চারপাশের ভবনগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
হলোকাস্টের আট দশক পর আরেকটি গণহত্যা চলছে। এবার ফিলিস্তিনি শিশুরা জাতিগত নির্মূল অভিযানের শিকার ও সাক্ষী হয়ে থাকবে। এ শিশুদের প্রত্যেকেরই একটি মর্মান্তিক গল্প রয়েছে, যা বিশ্ববাসীকে শুনতে হবে। একদিন আমরা হয়তো তাদের স্মৃতিকথায় পড়তে পারি, যদি তারা সেগুলো লেখার জন্য ততদিন বেঁচে থাকে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদাযয়ের উচিত ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা না করা। এখনই তারা এই শিশুদের দুর্দশা বন্ধে উদ্যোগী হতে হবে। এ কারণে আমরা একটি তথ্যচিত্রের মাধ্যমে গাজার শিশুদের বার্তা তুলে ধরার সুযোগ করে দিয়েছি, যাতে তারা বিশ্বের সামনে একটি জোরালো প্রশ্ন তুলতে পারে। ‘তোমরা চুপ কেন?’ তুরস্কের উদ্যোগে গৃহীত এই তথ্যচিত্র গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা অভিযানের নৃশংস বাস্তবতা উদোম করে দিতে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে প্রচারিত প্রচেষ্টাগুলোর মধ্যে একটি।
অনেক পশ্চিমা রাষ্ট্র এখন গণহত্যার সহযোগী বা সমর্থক হিসেবে কাজ করে। তারা নৈতিক কর্তৃত্ব ও আধিপত্যবাদী বক্তব্য হারিয়েছে। আরও দুঃখজনক হলো, কেউ কেউ আট দশক আগে নিজেরাই সংঘটিত গণহত্যার আহ্বান জানিয়ে তাদের অবস্থানকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যারা একসময় ইতিহাসের ভুল পথে হেঁটেছিল, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছিল, তারা এখন অন্য জাতির প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংসযজ্ঞ এড়িয়ে যাচ্ছে। অতীতের নৃশংসতায় জড়িত থাকার দোষ নতুন কোনো তৎপরতার কারণে ক্ষমা করা যায় না। পুরোনো অপমান ঢাকতে নতুন করে লজ্জিত হলে বিবেকের পরিশুদ্ধি ঘটে না। ‘আর কখনও নয়’ কথাটির যদি কোনো তাৎপর্য থাকে, তবে এটি কেবল অতীতের ভুক্তভোগীদের বেলায় প্রযোজ্য নয়, বরং আজকের জন্যও কার্যকর হওয়া উচিত।
গাজায় গণহত্যার ক্ষেত্রে পশ্চিমা নীরবতা এবং তাদের জড়িত থাকার একটি প্রধান কারণ হলো ইসরায়েলের প্রোপাগান্ডা। তারা চলমান সহিংসতার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বৃহৎ অংশের অসংবেদনশীলতাকে কাজে লাগাচ্ছে। গাজাবাসীকে ‘পাপিষ্ট সন্তান’ হিসেবে উল্লেখ করে ইসরায়েলি রাজনীতিবিদরা তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
সব মানুষের বিশেষ করে ক্ষমতাহীনদের অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখার ভিত্তির ওপর একটি নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এখন যা প্রয়োজন তা হলো বিবেকের একটি জোট, যেখানে জাতিগুলো তাদের মূল্যবোধসম্পৃক্ত সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে যথেষ্ট সাহসী হবে এবং নেতারা উদ্যমী হয়ে কিছুটা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কাজ করতে প্রস্তুত থাকবে। ন্যায়বিচার নিজে থেকে আসবে না; এটি তাদের দ্বারাই নিশ্চিত হবে, যারা নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহসী।
যদি তারা ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে হবে। অবশ্যই তাদের লাখ লাখ শিশুর জিজ্ঞাসা বুঝতে হবে, যারা বলছে– ‘ কেন তোমরা চুপ আছো?’ গণহত্যাকারী ইসরায়েলি সরকারকে মুখোমুখি হতে দেরি করার প্রতিটি দিন ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আরও অপরাধ বয়ে আনছে। এই ব্যর্থতা কেবল ফিলিস্তিনিদের দুর্দশাকেই আরও গভীর করে না, বরং ইসরায়েলি জনগণের জন্যও এক গুরুতর ক্ষতিকর হিসেবে কাজ করে, যাদের অনেকেই ব্যাপকভাবে একটি নতুন ও ন্যায়সংগত নেতৃত্বের আশা করে। আসুন আমরা এখনই পদক্ষেপ নিই; যাতে আনা ফ্রাঙ্কের মতো স্মরিত হতে ফিলিস্তিনি শিশুদের নীরবে মরতে না হয়।
ফাহরেতিন আলতুন: তুরস্ক সরকারের যোগাযোগপ্রধান, আলজাজিরা থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণহত য র জন য ইসর য র একট
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ