ইরানের কাছে পরমাণু চুক্তির প্রস্তাব পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
Published: 1st, June 2025 GMT
ইরানের কাছে পারমাণবিক চুক্তির প্রস্তাব পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওমানের মাধ্যমে এই প্রস্তাব পৌঁছে দিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, চুক্তিটি গ্রহণ করা ইরানের স্বার্থে ভালো হবে। তবে চুক্তির নির্দিষ্ট শর্তাবলী এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
রবিবার (১ জুন) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে পারমাণবিক চুক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে বলে শনিবার (৩১ মে) নিশ্চিত করেছে হোয়াইট হাউস।
আরো পড়ুন:
যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাক থেকে পালিয়ে গেল ২৫ কোটি মৌমাছি, সতর্কতা জারি
শি জিনপিংয়ের সঙ্গে কথা বলতে চান ট্রাম্প
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাদর আল বুসাইদি সম্প্রতি তেহরান সফরের সময় তাকে ‘মার্কিন চুক্তির উপাদানগুলো’ তুলে দিয়েছেন।
এই প্রস্তাবটি এসেছে এমন এক সময়ে, যখন জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের উৎপাদন আরো বাড়িয়েছে।
শনিবার (৩১ মে) হোয়াইট হাউজের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লিভিট বলেন, “চুক্তিটি ইরানের গ্রহণ করাই তাদের স্বার্থে ভালো”। তিনি আরো বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ইরান কখনোই পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারবে না।”
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘এক্স’ পোস্টে লিখেছেন, “এই প্রস্তাবের যথাযথ উত্তর ইরানের নীতি, জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেওয়া হবে।”
যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান- উভয় পক্ষ পরমাণু চুক্তি প্রস্তাবটির বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেনি।
বিবিসি জানিয়েছে, জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএ-এর প্রতিবেদনের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবটি তৈরি করা হয়েছে। আইএইএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান বর্তমানে ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ৪০০ কেজির বেশি ইউরেনিয়াম মজুদ করে রেখেছে—যা অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশ মাত্রার খুব কাছাকাছি।
আইএইএ বলছে, এটি বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি ও গবেষণার উদ্দেশ্যে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধতার স্তরের চেয়ে অনেক বেশি। আরো পরিশোধিত হলে এটি প্রায় ১০টি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য যথেষ্ট, যা ইরানকে এই স্তরে ইউরেনিয়াম উৎপাদনকারী একমাত্র অ-পারমাণবিক-সশস্ত্র রাষ্ট্রে পরিণত করে।
এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি আইএইএ-র বোর্ডে ইরানকে পারমাণবিক চুক্তির লঙ্ঘনকারী হিসেবে ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইরান এসব অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ও ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেছে এবং সতর্ক করেছে যে, আইএইএ-র বোর্ডে যদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে তারা ‘উপযুক্ত জবাব দেবে’।
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইরানের পারমাণবিক ক্ষমতা সীমিত করার চেষ্টা করে আসছে। ওমানের মধ্যস্থতায় দুই শক্তির মধ্যে এপ্রিল মাস থেকে আলোচনা চলছে।
দুই পক্ষই আলোচনা নিয়ে আশাবাদী হলেও মূল বিতর্ক ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ চালিয়ে যাওয়ার অধিকার নিয়ে।
তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে চলমান আলোচনা সত্ত্বেও, আইএইএ’র রিপোর্টে এমন কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি যে, ইরান তার পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ প্রচেষ্টা ধীর করে দিয়েছে।
আইএইএ’র রিপোর্টে দেখা গেছে, ইরান গত তিন মাস ধরে প্রতি মাসে প্রায় একটি পারমাণবিক অস্ত্রের সমান হারে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন করেছে।
মার্কিন কর্মকর্তারা অনুমান করেছেন যে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায়, তাহলে তারা দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে অস্ত্র-মানের ইউরোনিয়াম তৈরি করতে পারে এবং কয়েক মাসের মধ্যে সম্ভাব্যভাবে পারমাণবিক বোমা তৈরিতে সক্ষম হতে পারে।
ইরান দীর্ঘদিন ধরেই অস্বীকার করে আসছে, তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। যদিও ইরানের এই দাবি সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি আইএইএ। কারণ ইরান আইএইএ’র সিনিয়র পরিদর্শকদের তেহরানে প্রবেশাধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে দীর্ঘদিনের প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।
২০১৫ সালে ছয় বিশ্ব শক্তি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করেছিল ইরান। এই চুক্তির আনুষ্ঠানিক নাম জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ), যা সংক্ষেপে ইরান পরমাণু চুক্তি নামে পরিচিত। ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম নজরদারি করার জন্য এই চুক্তি করা হয়েছিল, যাতে দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে।
চুক্তি করার বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছিল পশ্চিমা দেশগুলো। কিন্তু ২০১৮ সালে তৎকালীন ট্রাম্প প্রশাসন এই চুক্তি থেকে একতরফা বের হয়ে যায়।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে চুক্তিটি নবায়নের জন্য জোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি। গত জানুয়ারিতে ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে তেহরানের সঙ্গে নতুন পরমাণু চুক্তির চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে দেশ দুটির কর্মকর্তাদের মধ্যে ওমান ও অস্ট্রিয়ায় কয়েক দফায় অপ্রত্যক্ষ বৈঠক হয়েছে।
ট্রাম্প কিছুদিন আগে হুমকি দিয়ে বলেছেন, আলোচনা যদি চুক্তি অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালাবে।
ঢাকা/ফিরোজ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর য ক তর ষ ট র য ক তর ষ ট র প রস ত ব প আইএইএ র র জন য ইউর ন পরম ণ
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানের উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়ামের মজুত ৪০৮ কেজি, যা নজিরবিহীন: আইএইএ
ইরান তিন মাসের ব্যবধানে উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে বলে দাবি করেছে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির এ মাত্রা পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার খুব কাছাকাছি উল্লেখ করে সংস্থাটি বলেছে, দেশটি ৪০৮ কেজি ইউরেনিয়াম মজুত করেছে, যা বিশ্বের কোনো পরমাণু অস্ত্রবিহীন দেশের জন্য নজিরবিহীন।
বিশ্বব্যাপী পরমাণু শক্তির নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ এবং পর্যবেক্ষণমূলক ব্যবহারের তদারকি-বিষয়ক সংস্থা আইএইএ আজ শনিবার এক প্রতিবেদনে এসব দাবি করেছে। আইএইএর প্রতিবেদনটি এমন এক সময়ে প্রকাশ করা হয়েছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে নতুন পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। তেহরান বলছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচির উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ।
জাতিসংঘের পরমাণু নজরদারি সংস্থাটি জানিয়েছে, ১৭ মে পর্যন্ত ইরান ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ৪০৮ দশমিক ৬ কেজি ইউরেনিয়াম মজুত করেছে। পারমাণু অস্ত্র নেই—এমন যেকোনো দেশের ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ এই পরিমাণ ইউরেনিয়াম মজুত নজিরবিহীন ঘটনা। ফেব্রুয়ারির সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এই মজুতের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে ১৩৩ দশমিক ৮ কেজিতে পৌঁছেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ৯০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ হলেই তা পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য উপযুক্ত। ফলে ইরানের এ অগ্রগতি আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ তৈরি করেছে। আইএইএর গোপনীয় প্রতিবেদনটি বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার হাতে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, সংস্থাটির নজরদারির বাইরে তিনটি স্থানে গোপনে পারমাণবিক কার্যক্রম চালিয়েছে তেহরান। সংস্থাটি বিষয়টিকে ‘গভীর উদ্বেগের’ বলে উল্লেখ করেছে।
তবে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি দেশটির দীর্ঘদিনের অবস্থান পুনরায় তুলে ধরে বলেন, তেহরান পারমাণবিক অস্ত্রকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মনে করে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান পারমাণবিক আলোচনায় ইরানের প্রধান আলোচক আরাগচি টেলিভিশনে দেওয়া এক বক্তব্যে বলেন, ‘যদি বিষয়টা পারমাণবিক অস্ত্র হয়, তাহলে হ্যাঁ, আমরাও এ ধরনের অস্ত্রকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই বিষয়ে আমরা তাদের [আইএইএ] সঙ্গে একমত।’
আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রোববার চতুর্থ দফায় আলোচনায় বসছে ইরান১০ মে ২০২৫২০১৫ সালে ছয় বিশ্ব শক্তি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করেছিল ইরান। এই চুক্তির আনুষ্ঠানিক নাম জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ), যা সংক্ষেপে ইরান পরমাণু চুক্তি নামে পরিচিত। ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম নজরদারি করার জন্য এই চুক্তি করা হয়েছিল, যাতে দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে।
চুক্তি করার বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছিল পশ্চিমা দেশগুলো। কিন্তু ২০১৮ সালে তৎকালীন ট্রাম্প প্রশাসন এই চুক্তি থেকে একতরফা বের হয়ে যায়। ফলে চুক্তিটি বাতিল হয়ে যায়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে চুক্তিটি নবায়নের জন্য জোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি। গত জানুয়ারিতে ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে তেহরানের সঙ্গে নতুন পরমাণু চুক্তির চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে দেশ দুটির কর্মকর্তাদের মধ্যে ওমান ও অস্ট্রিয়ায় কয়েক দফায় অপ্রত্যক্ষ বৈঠক হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার ট্রাম্প বলেছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র রাখতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, তাঁরা নিজেকে ধ্বংস করতে চায় না। বরং তাঁরা একটি চুক্তি করতে চায়। তিনি যোগ করেন, ‘আমরা যদি এমন একটি চুক্তি করতে পারি, যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে বোমা বর্ষণ করতে হবে না, তাহলে সেটা খুব ভালো হবে।’
আইএইএর সর্বশেষ প্রতিবেদনটি সংস্থার ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট গভর্নিং বোর্ডের অনুরোধে তৈরি করা হয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানি ইরানকে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক চুক্তির লঙ্ঘনকারী হিসেবে ঘোষণার পথে এগোতে পারে। এ নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেও ইরানবিরোধী প্রস্তাব উত্থাপন হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের এই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ একটি কৌশল, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আলোচনায় চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হামেদ মোসাভি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘উভয় পক্ষই আলোচনায় সুবিধাজনক অবস্থান নিতে চেষ্টা করছে। ইরানের জন্য পারমাণবিক অগ্রগতি একটি চাপ তৈরির হাতিয়ার।’
মোসাভির মতে, ‘৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কোনো অস্ত্র তৈরির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিয়ে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কৌশল।’