ইসরায়েলের নজিরবিহীন হামলায় সামরিকভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে ইরান। হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ একক বা জোটগতভাবে ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুতিদের মতো তেহরানের সহায়তাপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অবস্থা বেশ দুর্বল হওয়ায় ইতিহাসের চরম এই ক্রান্তিকালে দেশটি এই মিত্রদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো সহায়তা পাচ্ছে না। চরম এই সংকটকালে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশটিকে এখন বড় নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে।

ইরানে গত শুক্রবার ভোররাতে ইসরায়েলের হামলার কয়েক ঘণ্টা পর এক বিবৃতিতে সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ভ্রাতৃপ্রতিম ইরানের ওপর ইসরায়েলের এই বর্বর হামলা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। ওমান, কাতার, কুয়েত ও বাহরাইনও প্রায় একই সুরে বিবৃতি দিয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে আরব (পারস্য) উপসাগরীয় অঞ্চলের অনেক দেশ ইরানের বর্তমান শাসকদের পছন্দ করে না। প্রকাশ্যে তারা ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানালেও তাদের প্রকৃত চাওয়া ভিন্ন। রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যই তারা এসব নিন্দা জানাচ্ছে। ইরানকে দুর্বল করাটাই অনেক উপসাগরীয় দেশের প্রকৃত চাওয়া।

ভয়, শঙ্কা ও কূটনৈতিক কৌশল

উপসাগরীয় দেশগুলো দুই ধরনের শঙ্কায় রয়েছে। একদিকে তাদের অধিকাংশ দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি আছে। ফলে বড় যুদ্ধ হলে ইরান এসব ঘাঁটিতে পাল্টা আঘাত হানতে পারে। অন্যদিকে যুদ্ধ বাধলে তেলের দাম, বাণিজ্যপথ এবং অঞ্চলটির অনেক দেশের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প হুমকিতে পড়বে।

ফ্রেডরিখ এবার্ট ফাউন্ডেশনের মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ মার্কাস স্নাইডার ডয়চে ভেলেকে বলেন, যুদ্ধ হলে নিজেরা নিরাপদ থাকতে পারবেন না, এটা উপসাগরীয় নেতারা জানেন। এসব দেশের ইসরায়েলের মতো কোনো কার্যকর প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও নেই।

তাই সৌদি আরবসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ ইসরায়েলের নিন্দা করার পাশাপাশি ইরানের প্রতিও শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। এই বিবৃতি ছাড়া সংঘাত বন্ধে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি বা বিশ্বজনমত তৈরির পক্ষে তারা কোনো কাজ করছে না।

চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচির পরিচালক সানাম ভাকিল বলেন, উপসাগরীয় দেশগুলো প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে ধিক্কার জানালেও অনেকেই মনে মনে তেহরানকে দুর্বল দেখলেই বেশি খুশি হবে। কূটনৈতিক চাপের কারণে দেশগুলো এ রকম দ্বিমুখী আচরণ করছে বলে মনে করেন সানাম ভাকিল। এসব দেশের কোনোটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হোক, তা চায় না। আবার ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে নিজেদের যে মাশুল গুনতে হবে, তা নিয়েও তারা উদ্বিগ্ন।

২০১৯ সালে সৌদি আরবের তেল স্থাপনায় হুতিদের ড্রোন হামলা কিংবা ২০২২ সালে আবুধাবিতে হামলার স্মৃতি এখনো টাটকা। সৌদি আরব ও আমিরাতের দাবি, এসব হামলার সঙ্গে ইরানের পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল।

হিজবুল্লাহ, হুতি ও ইরাকি মিলিশিয়ারা চুপ

ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলা নিয়ে হিজবুল্লাহ শুধু নিন্দা জানিয়েছে। তারা ইসরায়েলে হামলার ঘোষণা দেয়নি। হুতিরা ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে দু-একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। কিন্তু কয়েক মাস আগেও ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠীটির ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালানোর যতটা সক্ষমতা ছিল, বর্তমানে তা নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দফায় দফায় বিমান হামলায় গোষ্ঠীটির সামরিক সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।

এসব গোষ্ঠী এখন দুর্বল। গত বছর ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে হিজবুল্লাহর অনেক যোদ্ধা ও শীর্ষ নেতৃত্ব নিহত হয়েছেন। লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠীটির নেতৃত্ব প্রায় ভেঙে পড়েছে। অস্ত্রভান্ডার ধ্বংস হয়ে গেছে। ইরানের সহায়তাপুষ্ট ইরাকের মিলিশিয়ারা সরকারি বাহিনীর অংশ হয়ে গেছে। সরকারে যোগ দিয়ে তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে।

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ছিলেন ইরানের ঐতিহাসিক মিত্র। গত ডিসেম্বরে তাঁর পতন হয়েছে। এরপর সেখান থেকে ইরান সব সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। লেবাননে হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র পাঠানোর জন্য সিরিয়াকে ব্যবহার করত ইরান, এখন যা বন্ধ হয়ে গেছে।

সৌদি আরবের কৌশল

সৌদি আরব ২০১৬ সালে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল, যা গত বছর চীনের মধ্যস্থতায় পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। সুন্নি মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে পরিচিত এই দেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশ ও পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করার চেষ্টা করছে। গাজা যুদ্ধ নিয়েও সৌদি নেতারা বড় সম্মেলন করেছেন।

জার্মানির বন-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক কারপোর জ্যেষ্ঠ গবেষক ও উপসাগরীয় অঞ্চল-বিশেষজ্ঞ সেবাস্তিয়ান সন্স বলেন, সৌদি আরব এখন কোনো ঝুঁকি নয়, স্থিতিশীলতা চায়। তাই দেশটি যুদ্ধের পরিবর্তে কূটনৈতিক সমাধানকে প্রাধান্য দিচ্ছে।

আব্রাহাম চুক্তির প্রলোভন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ২০২০ সালে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন শুরু করে ইসরায়েল, যা আব্রাহাম চুক্তি নামে পরিচিত। সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), বাহরাইন, সুদান ও মরক্কো এতে সই করেছে। সৌদি আরবসহ আরও কিছু দেশের এই চুক্তিতে সই করার প্রস্তুতি প্রায় শেষের দিকে।

কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, সৌদি এই চুক্তিতে সই করতে যাচ্ছে এমন আশঙ্কা থেকেই ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল হামাস।

উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো কেন আব্রাহাম চুক্তিতে সই করতে চায়, এর উত্তরে মার্কাস স্নাইডার বলেন, এসব দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের অত্যাধুনিক সামরিক ও নজরদারি যন্ত্রপাতি পেতে আগ্রহী। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য তারা এসব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে।

অন্যদিকে উপসাগরীয় অঞ্চলের অনেক দেশ ইরানকে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে। এসব হিসাব-নিকাশের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তারা অনেকটা নীরব প্রত্যক্ষদর্শীর ভূমিকা পালন করছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ইসর য় ল র র অন ক দ শ ক টন ত ক দ র বল র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

সেই আছিয়ার পরিবারকে গরু ও ঘর দিল জামায়াত

মাগুরায় যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে মারা যাওয়া আলোচিত শিশু আছিয়ার পরিবারকে দুটি গরু ও একটি গোয়ালঘর উপহার দেওয়া হয়েছে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের পক্ষ থেকে আছিয়ার পরিবারকে এ উপহার দেওয়া হয়েছে।

বুধবার (৩০ জুলাই) বিকেলে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার জারিয়া গ্রামে আছিয়ার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উপহার হস্তান্তর করেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য এবং কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চলের পরিচালক মোবারক হোসাইন।

এ সময় জেলা জামায়াতের আমির এম বি বাকের, সাবেক আমির ও কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা আব্দুল মতিনসহ স্থানীয় এবং জেলা কমিটির নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

আরো পড়ুন:

শিশু ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন, মাদ্রাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা 

অপারেশনের পর শিশুর মৃত্যু: তদন্ত কমিটি গঠন, থানায় মামলা

গত ১৫ মার্চ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান আছিয়ার বাড়িতে যান। তিনি শিশুটির মৃত্যুর ঘটনায় দ্রুত বিচার চান। সে সময় আছিয়ার পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে একটি গোয়াল ঘর এবং দুটি গরু দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন জামায়াতের আমির। 

আট বয়সী আছিয়া মাগুরার নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয় বলে পরিবারের তরফ থেকে অভিযোগ ওঠে। গত ৬ মার্চ অচেতন অবস্থায় মাগুরার ২৫০ শয্যা হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। অবস্থার অবনতি হলে মাগুরা হাসপাতালের চিকিৎসকদের পরামর্শে শিশুটিকে নেওয়া হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে থেকে সেদিন সন্ধ্যায় উন্নত চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে ঢাকায় নেওয়া হয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করা হয়। দুই দিন পর ৮ মার্চ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হয়। ১৩ মার্চ বৃহস্পতিবার সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় আছিয়ার।

ঢাকা/শাহীন/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ