তিন দিনে দেশের আট জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ১৪ জনের। এদের মধ্যে টাঙ্গাইলের মধুপুরে তিনজন, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, যশোরের মনিরামপুর ও ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে দু’জন করে নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া শেরপুরে সাত মাসের এক শিশু, চট্টগ্রাম নগরীতে এক তরুণ, সীতাকুণ্ডে এক যুবক ও নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর প্রাণ গেছে। 

একে একে নামল তিনটি খাটিয়া
গাড়ি থেকে একে একে নামানো হলো তিনটি খাটিয়া। ততক্ষণে শোকে যেন পাথর হয়ে গেছেন আনোয়ারা বেগম। কণ্ঠে কোনো শব্দ নেই, চোখজুড়ে রাজ্যের শূন্যতা। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে ধরলেন কফিনগুলো। হঠাৎই বাঁধ ভাঙল আনোয়ারার। বুক চাপড়ে বিলাপ শুরু করেন, ‘বাবা, একবার কথা বল, শুধু একবার। তোরা না বলছিলি ভাইয়ের লাশ নিয়ে আসবি.

. তোরা কেন কথা বলছিস না?’
কিন্তু কোনো উত্তর পাননি আনোয়ারা বেগম। তাঁর সৌদি আরবপ্রবাসী ছেলে মোহাম্মদ রুবেলের (২৭) লাশ নিতে শনিবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান বড় ছেলে মোহাম্মদ বাবুল (৩৭)। সঙ্গে ছিলেন আনোয়ারার ভাগনে মো. ওসমান গণি (৩৫)। এদিন বিকেলে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে তাদের অ্যাম্বুলেন্সটি দুর্ঘটনার শিকার হয়। এতে প্রাণ যায় বাবুল ও গণির। 
তিনটি লাশ শনিবার মধ্যরাতে আনা হয় চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার তালুকদার পাড়ায়। সেখানে আনোয়ারা বেগমের বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। 
বাবুলের স্ত্রী সাহেদা আক্তার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন বারবার। অবুঝ দুই মেয়েকে জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘আমি এখন সন্তানদের কী জবাব দেব? কী নিয়ে বাঁচব?’ গণির স্ত্রী নুসরাত জাহান শিমার পৃথিবীও যেন থমকে গেছে। তিনি বললেন, ‘দুর্ঘটনার কয়েক মিনিট আগেও ফোনে কথা হলো, বললেন লাশ নিয়ে ফিরছেন। কিন্তু তিনি (গণি) নিজেই ফিরলেন কফিনবন্দি হয়ে।’ দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে কীভাবে বাঁচবেন এখন তিনি।

অটোরিকশা দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। গতকাল সোমবার দুপুর ২টার দিকে টাঙ্গাইল-জামালপুর মহাসড়কের বাঘিল এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। এতে নিহত হন জামালপুরের মজিবুর রহমানের স্ত্রী কাজল রেখা (৪৫), তাঁর ছেলে শ্রাবণ (১৬) ও ফুলকুমারী (৩৫)। 
নিময় পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসটি ঢাকা থেকে ধনবাড়ী যাচ্ছিল। বাঘিল এলাকায় অটোরিকশার সঙ্গে বাসটির সংঘর্ষ হয়। আহত পাঁচজনকে উদ্ধার করে ধনবাড়ী ও মধুপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক তিনজনকে মৃত ঘোষণা করেন। 
এদিন দুপুরে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে ট্রাক ও অটোরিকশার সংঘর্ষে দু’জন নিহত হয়েছেন। তারা হলেন টাঙ্গাব ইউনিয়নের বামুনখালী বটতলা বাজারের ব্যবসায়ী মো. ইকবাল হোসেন (৫৫) ও পাঁচবাগ দিঘীরপাড় গ্রামের অটোরিকশাচালক ওয়াসিম (২৮)। দুপুর ১২টার দিকে টাঙ্গাব বটতলা বাজার থেকে পাঁচবাগ চৌকা বাজারে যাচ্ছিল অটোরিকশাটি। বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাকের সঙ্গে সেটির সংঘর্ষ হয়। পাগলা থানার ওসি ফেরদৌস আলম বলেন, এ ঘটনায় ট্রাকচালককে আটক করা হয়েছে। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সোমবার সকালে শেরপুর-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক সড়কের বাইপাস মোড়ে বাসচাপায় অটোরিকশার চালকসহ ছয় যাত্রী গুরুতর আহত হন। ঘটনাস্থলেই মারা যায় সাত মাসের এক শিশু। তার বাবা প্রসেনজিৎ ও মা তন্দ্রা গুরুতর অবস্থায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শিশুটি এ দম্পতির একমাত্র সন্তান।

মাথায় ছিল না হেলমেট
রোববার বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের মাইলের মাথা এলাকায় অটোরিকশার ধাক্কায় মোটরসাইকেল থেকে পড়ে যান আতাউর রহমান তামিম (১৯)। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। এ সময় আহত হয়েছেন তাঁর বন্ধু সাফায়েত ইসলাম। তামিম হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাপাছড়ি গ্রামে। তবে মা-বাবার সঙ্গে থাকতেন নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায়।
ইপিজেড থানার এসআই মামুনুর রশিদের ভাষ্য, সাফায়েত মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলেন। পেছনে ছিলেন তামিম। তাঁর মাথায় হেলমেট ছিল না। অটোরিকশার সঙ্গে তাদের মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দু’জনই পড়ে যান। 
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বেপরোয়া গতির লরির চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হন শুকলাল দাস (৪২) নামে এক ব্যক্তি। সোমবার সকাল ১০টার দিকে ভাটিয়ারী ইউনিয়নের জলিল গেইট এলাকায় ঢাকামুখী লেনে এ ঘটনা ঘটে। শুকলাল ওই ইউনিয়নের সোনারগাঁ গ্রামের জেলেপাড়া এলাকার তেজেন্দ্র দাসের ছেলে।
রোববার যশোরের মনিরামপুরে বাসচাপায় ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন দুই ব্যক্তি। আহত হন আরও তিনজন। তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। মনিরামপুর সরকারি কলেজের দক্ষিণ পাশে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন মনিরামপুরের জয়পুর গ্রামের নাজমুল হোসেন ও গাইবান্ধার সাঘাট উপজেলার আব্দুল্লাহপাড়া গ্রামের রতন মিয়া।
শনিবার বিকেলে নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে সড়ক দুর্ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় (৪৫) এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। রামপুরা কলাবাগান এলাকায় দ্রুতগতির গাড়ির ধাক্কায় গুরুতর আহত হন তিনি। পুলিশ তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক জানান, তিনি আগেই মারা গেছেন। 

তিন মাস পর চালক গ্রেপ্তার
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়ার চুনতিতে বাস ও মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে ১১ জনের প্রাণহানির ঘটনার তিন মাস পর বাসচালককে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। গত রোববার রাতে ঢাকার মিরপুরের আনসার ক্যাম্প এলাকা থেকে সোহেল তালুকদার (২৭) নামে ওই যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ২ এপ্রিল সকালে চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় মাইক্রোবাসের সঙ্গে রিলাক্স পরিবহনের বাসের সংঘর্ষে মাইক্রোবাসের ১০ যাত্রী নিহত হন। পরে হাসপাতালে আরেকজন মারা যান।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া অংশে সড়ক দুর্ঘটনায় আজগর আলী (২৫) নামের এক বাসচালকের সহকারী নিহত ও নারীসহ আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। সোমবার দুপুর ১টার দিকে আনারপুরা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
[তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধি ও সংবাদদাতা]

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন হত দ র ঘটন য় র স ঘর ষ স মব র এল ক য় উপজ ল সড়ক র

এছাড়াও পড়ুন:

‘রব্বানা হাবলানা’: পরিবারের জন্য এক অমূল্য দোয়া

‘হে আমাদের রব! আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্য থেকে আমাদের জন্য চোখের শীতলতা দান করো এবং আমাদের নেককারদের নেতা বানাও।’ এই কথাগুলো কোরআনের সুরা ফুরকানের ৭৪ নম্বর আয়াতে লিপিবদ্ধ আছে।

মূল আরবি দোয়াটির উচ্চারণ হলো, ‘রব্বানা হাবলানা মিন আযওয়াজিনা ওয়া জুররিয়্যাতিনা কুররাতা আ’ইয়ুন ওয়াজাআলনা লিল মুত্তাকিনা ইমামা।’

এটি শুধু একটি দোয়া নয়, বরং পরিবারের কল্যাণ, সন্তানের নেক আমল এবং নিজের নেতৃত্বের জন্য আল্লাহর কাছে এক হৃদয়গ্রাহী প্রার্থনা।

আরও পড়ুননবী সুলাইমান (আ.)–এর দোয়া১৪ মার্চ ২০২৪দোয়ার তাৎপর্য

পবিত্র কোরআনের সুরা ফুরকানে আল্লাহ তাঁর নেক বান্দাদের গুণাবলি বর্ণনা করেছেন। এই আয়াতে তাঁদের একটি আকাঙ্ক্ষা কথা প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে তাঁরা আল্লাহর কাছে এমন একটি পরিবারের প্রার্থনা করেন, যাঁরা তাঁদের চোখের শীতলতা এবং হৃদয়ের শান্তির উৎস হবে।

আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফী বলেন, এই দোয়া মুমিনকে তাঁর পরিবারের জন্য দায়িত্বশীল হতে শেখায়। এটি কেবল স্ত্রী-সন্তানের ভালো থাকার প্রার্থনা নয়, বরং নিজেকে এমন একজন নেতা হিসেবে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা, যিনি নেককারদের পথ দেখাতে পারেন।

এই দোয়ার দ্বিতীয় অংশ, ‘আমাদের মুত্তাকিদের নেতা বানাও,’ বোঝায় যে একজন মুমিনের উচিত নিজের পরিবারকে নেক পথে পরিচালিত করা এবং সমাজে ন্যায় ও সত্যের পথপ্রদর্শক হওয়া। (মাআরিফুল কোরআন, পৃষ্ঠা ৬৫৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৯৮)

আরও পড়ুনদোয়া কীভাবে করতে হয়২০ এপ্রিল ২০২৫এটি কেবল স্ত্রী-সন্তানের ভালো থাকার প্রার্থনা নয়, বরং নিজেকে এমন একজন নেতা হিসেবে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা, যিনি নেককারদের পথ দেখাতে পারেন।কখন এই দোয়া করতে হয়

‘রব্বানা হাবলানা’ দোয়াটি পড়ার নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। যেকোনো সময় পড়া যায়—নামাজের পর, সিজদায় বা দৈনন্দিন জীবনে যখন ইচ্ছা। বিশেষ করে বিবাহিত জীবনে শান্তি, সন্তানের নেক আমল বা পারিবারিক সুখ কামনায় এই দোয়া অত্যন্ত ফলপ্রসূ। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর কাছে সব সময় দোয়া করো, কারণ দোয়া ইবাদতের মূল।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৩৭১)

এই দোয়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা, সন্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং পারিবারিক শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।

আল্লামা শানকিতি বলেন, এই দোয়া মুমিনকে তাঁর পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার পাশাপাশি সমাজে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রস্তুত করে। একটি নেককার পরিবারই সমাজের মূল ভিত্তি এবং এই দোয়া সেই ভিত্তি মজবুত করার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। (শানকিতি, মুহাম্মদ আল-আমীন, আদ্বাউল বায়ান ফি ঈযাহিল কোরআন, পৃষ্ঠা ৪৭৮, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, ২০০৫)

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই, যে তার পরিবারের জন্য সর্বোত্তম।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১,৯৭৭)

আরও পড়ুনসন্তানকে বদ দোয়া করবেন না২১ এপ্রিল ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ