গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে আমার জন্ম। গ্রামেই বেড়ে ওঠা। ছোটবেলায় দেখেছি, বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের দেশি মাছে ভরে যেত খাল-বিল, নদী-নালা। আমরা ধানি জমিতে কইয়া জাল, বড়শি ও আন্তা পেতে মাছ ধরতাম। খাল-বিলে তখন এত মাছ ছিল; পানিতে নেমে খালি হাতেও মাছ ধরতে পারতাম। দেশি প্রজাতির কই, শিং, মাগুর, শোল, টাকি, বোয়াল, বৈচা, ট্যাংরা, চিংড়ি, পুঁটি, বাইন, মলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পেতাম। গ্রামের মানুষ বেড় জাল, ধর্মজাল, ঠেলা জাল দিয়ে প্রচুর মাছ ধরত। এ সময়ে মাছ সংগ্রহ করে তা শুকিয়ে শুঁটকি করে রাখা হতো। কালের বিবর্তনে এখন আর মাছের আধিক্য তেমন দেখা যায় না।

তবে মাছের উৎপাদনের দিক দিয়ে কিন্তু বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে উন্নতি করেছে। গত দুই দশকে কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের মাধ্যমে মাছের সরবরাহ ও চাহিদা অনেকাংশে বাড়ানো হয়েছে। ‘বিলুপ্তপ্রায়’ কিছু ছোট মাছেরও আজকাল চাষ হচ্ছে। মৎস্যবিজ্ঞানীরা এ জায়গাটায় বড় ভূমিকা রেখে চলেছেন। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। জলাশয় কমে যাওয়াসহ নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বর্তমানে দেশে মাছের উৎপাদন ৪৯ দশমিক ১৫ লাখ টন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২৪’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিঠাপানির মাছ আহরণে বাংলাদেশ চীনকে টপকে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। এ ছাড়া বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থানের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। এ প্রতিবেদন অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্নতর। গ্রামগঞ্জে এখন আর দেশি প্রজাতির মাছ খুব একটা দেখা যায় না। বাজারে ঢুকলেই চোখে পড়ে নানা প্রজাতির চাষের মাছ। সম্প্রতি একটি বাজারে গিয়ে দেখলাম চাষের রুই, কাতলা, কৈ, শিং, তেলাপিয়া,  পাঙাশ এবং কার্প প্রজাতির মাছই বেশি। দেশি মাছ পুঁটি, ট্যাংরা, বাইন, চিংড়ি, মাগুর নিয়ে কয়েকজন বিক্রেতা বসে আছেন। তবে তারা যে দাম হাঁকছেন, তা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। 

দেশি মাছ কমে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণের মধ্যে আর একটি হলো বিভিন্ন ধরনের নিষিদ্ধ জালের অবাধ ব্যবহার। বিশেষ করে চায়না দুয়ারি, কারেন্ট জাল, সম্প্রতি বৈদ্যুতিক শক মেশিনসহ আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। 

দেশি মাছের প্রজনন মৌসুম সাধারণত বর্ষাকাল। বিশেষ করে জ্যৈষ্ঠ মাসের মধ্য থেকে শ্রাবণ মাস। জ্যৈষ্ঠ মাসের মধ্যকালে প্রথম বৃষ্টির পর থেকেই এসব স্বাদুপানির মাছ ডিম ছাড়া শুরু করে, যা চলে শ্রাবণ মাসের মধ্য পর্যন্ত।

বৃষ্টির পরপরই যখন জলাশয়গুলো পানিতে ভরে যায়, তখন নদ-নদী, খাল-বিল-নালা, হাওর-বাঁওড়, ধানক্ষেতসহ জলাবদ্ধ বিল জলাজমির সঙ্গে মিশে যায় এবং তখন মুক্ত জলাশয় থেকে ছড়িয়ে যায় মাগুর, শিং, কৈ, টাকি, শোল, ট্যাংরা, পুঁটি, মলা, বাইন, বোয়াল প্রভৃতি দেশি মাছ। এসব মাছ শিকারে মেতে ওঠে পেশাদারসহ মৌসুমি জেলেরা। যার মধ্যে অধিকাংশ থাকে ডিম ছাড়ার পর্যায়ের ‘মা মাছ’। যদিও পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ শিকার, ক্রয়-বিক্রয় আইনত অপরাধ, কিন্তু তা আইনের খাতাতেই ফাইলবন্দি। বাস্তবে প্রয়োগ হয় না। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে হাওরাঞ্চলসহ দেশের খাল-বিল, নদ-নদীতে মাছের আকাল পড়বে। এমন সময় আসবে যখন দেশি মাছ আর পাওয়াই যাবে না।

দেশি প্রজাতির মাছ রক্ষায় আরেকটি করণীয় হচ্ছে অভয়াশ্রম তৈরি। প্রতি শুষ্ক মৌসুমে উন্মুক্ত জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় মাছের আশ্রয়স্থল দিন দিন কমে যাচ্ছে। হাওর ও বিল সেচে অবাধে মাছ শিকারের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশি প্রজাতির মাছ। মৎস্য বিভাগ দেশি জাতের মাছ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জেলায় অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছে। উদ্দেশ্য, অভয়াশ্রমে নিরাপদে দেশি মাছের প্রজনন ঘটানো, মাছের বংশবৃদ্ধি। কিন্তু এক শ্রেণির মানুষের লোভের কারণে এই লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে শিকারিদের দমনে প্রযুক্তিগত নজরদারি বাড়ানো যেতে পারে। ড্রোন বা নৌ পুলিশ নিয়োজিত করার মতো আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ কার্যকর হতে পারে। কৃষকরা সার ব্যবহারে কীভাবে জৈবিক পরিবর্তন আনবে, তা আরও গবেষণার আওতায় আনা প্রযোজন। মাছের প্রজননকালে তাদের রক্ষা ও ডিম ছাড়ার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতেই হবে। সর্বোপরি, দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষায় সর্বস্তরের জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে হবে। 

কৃষিবিদ মো.

বশিরুল ইসলাম: উপপরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
mbashirpro1986@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: মৎস য প রজনন

এছাড়াও পড়ুন:

গর্ভধারণের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না ৭৭ শতাংশ নারী

দেশের ৭৭ শতাংশ নারীর সন্তান নেওয়ার বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। বিশ্বে এই হার ৬৬ শতাংশ। দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা সংকট, সামাজিক চাপ নারীর প্রজনন স্বাধীনতাকেও সীমাবদ্ধ করেছে। 

এসব তথ্য উঠে এসেছে জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএর বার্ষিক প্রতিবেদনে। 

সোমবার রাজধানীর গুলশান-২ এ অবস্থিত জাতিসংঘ ভবনে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন প্রতিবেদনটি অনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করা হয়। এ বছরের প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী প্রজননবিষয়ক সমস্যার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

ইউএনএফপিএ ১৪টি দেশের ১৪ হাজার মানুষের ওপর এ জরিপ চালিয়েছে। বাংলাদেশের অংশটি বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ প্রতিবেদন থেকে তথ্য নিয়েছে।

অনুষ্ঠানে ইউএনএফপিএ এ বাংলাদেশের প্রতিনিধি মিস ক্যাথরিন ব্রিন কামকং প্রতিবেদনটির গুরুত্বর্পূণ অংশ তুলে ধরেন। বৈশ্বিক ও জাতীয় জনসংখ্যা প্রবণতা ও উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ বিষয়ে মূল দিকনির্দেশনা উঠে আসে তার বক্তব্যে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ৪৫ শতাংশ মানুষ কাঙ্ক্ষিত পরিবারের আকার বা সন্তান সংখ্যা অর্জন করতে পারবেন কি না অনিশ্চয়তা রয়েছে। আর যাদের বয়স ৫০ বছর বা তার বেশি, তাদের মধ্যে ৩১ শতাংশ মনে করেন, তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক সন্তানের তুলনায় কম সন্তান জন্ম দিয়েছেন।

এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যেই প্রায় ৩৭ থেকে ৩৮ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক সন্তান পেয়েছেন। একই ধরনের পারিবারিক আকাঙ্ক্ষা থাকলেও, বাস্তব জীবনের নানা প্রতিবন্ধকতা অনেকের পক্ষে সেই লক্ষ্য পূরণকে ব্যাহত করছে।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্রধানত চার বাধার কারণে এসব জনগোষ্ঠী সন্তান কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক সন্তান নিতে পাচ্ছে। এদের মধ্যে ৩৯ শতাংশ মানুষ অর্থনীতি সংকটে থাকার কারণে সন্তান নিতে পাচ্ছেন না। ২৪ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে সন্তান নিতে পাচ্ছেন না। ২৪ শতাংশ ভালোসঙ্গীর কারণে সন্তান ধারণে পিছিয়ে রয়েছে। ১৯ শতাংশ মানুষ ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে সন্তান নিতে চান না।

ইউএনএফপিএ প্রতিবেদনে বলা হয়, সমস্যা এখন অধিক জন্ম অথবা জনসংখ্যা হ্রাস নয়  আসল সংকট হচ্ছে সন্তান নেয়ার স্বাধীনতা ও প্রজনন অধিকার নিয়ে। বলছে, বিশ্বের অনেক মানুষ, বিশেষ করে নারী ও তরুণরা, এখনও তাদের প্রজনন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের স্বাধীনতা পান না।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সংকট আরও প্রকট। অনেক নারীই এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না কখন সন্তান নেবেন, কীভাবে নেবেন। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ও কিশোরী মাতৃত্ব এখানকার বড় চ্যালেঞ্জ। দেশে প্রতি তিন নারীর একজন কখনো না কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার হন।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১১ শতাংশ নারী এখনও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ২৫ শতাংশ নারী নিজের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না এবং ২৪ শতাংশ নারী যৌন সম্পর্কে অসম্মতির অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না।

জাতিসংঘ প্রতিনিধি ক্যাথরিন ব্রিন কামকং বলেন, ‘এ বছরের প্রতিবেদন প্রচলিত ‘অতিরিক্ত’ বা ‘অপর্যাপ্ত’ জন্মসংখ্যার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। আসল সংকট হচ্ছে প্রজনন সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতার অভাব। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক জায়গায় নারী ও তরুণেরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও কাঠামোগত বাধার কারণে নিজেদের প্রজনন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না।”

তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বর্তমানে যেখানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ০ দশমিক ৭ শতাংশ এবং বাজেটের ২ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে, সেটি বাড়িয়ে যথাক্রমে ৫ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ করতে হবে। এতে করে প্রয়োজনীয় প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, দক্ষ মিডওয়াইফ ও জীবনরক্ষাকারী ওষুধের সহজ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

চলুন আমরা এমন একটি ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি, যেখানে প্রজনন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোকে সমর্থন করা হবে, বিচার নয় আর প্রতিটি মানুষ যেন স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে নিজের জীবনের পরিকল্পনা করতে করতে পারবে।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৫ সালে বিশ্ব জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ৫৭ লাখ, যার অর্ধেকই নারী। দুই-তৃতীয়াংশ (প্রায় ১১ দশমিক ৫ কোটি মানুষ কর্মক্ষম বয়সে রয়েছেন, যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জনের একটি সুযোগ। তবে একই সঙ্গে ৭ শতাংশ মানুষ (১ কোটি ২০ লাখ) ৬৫ বছরের বেশি বয়সী, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত চাপেরও ইঙ্গিত দেয়। 

বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরী (১০-১৯ বছর) জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ। আর ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি, যা ২৮ শতাংশ।

প্রতিবেদনটি আরও বলা হয়, বিশ্বজুড়ে মানুষ তাদের কাঙ্ক্ষিত সন্তানসংখ্যা অর্জন করতে পারছেন না। কেউ সন্তান নিতে চেয়েও সময়মতো পারেননি, কেউ আবার অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মা হয়েছেন। এমনকি একই ব্যক্তি দুই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন যা প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় কাঠামোগত দুর্বলতার দিকেই ইঙ্গিত করে। এই সংকট উচ্চ ও নিম্ন উভয় প্রজনন হারের দেশগুলোতেই বিদ্যমান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গর্ভধারণের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না ৭৭ শতাংশ নারী