এমন একটা কথা রটে গেছে যে ‘বই আজকাল আর কে পড়ে’। কথাটি ভুল স্থানে ভুলভাবে ব্যবহৃত হতে বেশি দেখা যায়। দেখুন যারা পড়ুয়া, যারা বুদ্ধির চর্চা করেন, তাদের সংখ্যা বরাবরই কম। যে কারণে সফল মানুষের সংখ্যা কম, গড় মানুষ বেশি এবং উৎকৃষ্ট শাসকের সংখ্যা কম, অপশাসক আর শাসিতের (পড়ুন শোষিতের) সংখ্যা বেশি। বুদ্ধির চর্চা মানুষে মানুষে বৌদ্ধিক পার্থক্য গড়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, বংশানুক্রমে এর সুফল-কুফল দৃষ্টান্তসহ রাখে।
সিইও-ওয়ার্ল্ড পত্রিকা একটি পরিসংখ্যান তৈরি করেছে এ বছর, যেখানে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ বই পাঠে উন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনেক কম সময় দিচ্ছে। ৯৭তম অবস্থান আমাদের দেশের! পার্থক্য কীভাবে তৈরি করছি আমরা নিজেরাই, বই পাঠে সময় দানের অনুপাতই বলে দেয়। আবার সব বই কিন্তু বুক বাঁচাবে না। কিছু বই আছে ব্যতিক্রম, উৎকৃষ্ট। এরা এক ধরনের বৌদ্ধিক আভিজাত্য তৈরি করে। সেই বইগুলো চিনতে পারা, চিনিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। সমর্থ কি অসমর্থ, যা-ই হোক না কেন, কাগজে-কলমে কোনো একটি সাহিত্য পুরস্কারের আয়োজকবৃন্দ এই কাজটি করতে চায়।
৪ জুলাই রাজধানীর পাঁচতারকা হোটেল সোনারগাঁওয়ের বলরুমে অনুষ্ঠিত ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩-এর অনুষ্ঠানটি উপস্থিত লেখক-পাঠক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব-রাজনীতিক-ব্যবসায়ীসহ সকল স্তরের মানুষের মন আলো করে রাখবে আরও অনেকদিন। শুরু হয়েছিল শেষ বিকেলে, ৬টায়। পর্দা নেমেছিল রাত ৯টায়। দীর্ঘ সময়জুড়ে একে একে এলো সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, পরিচিতি-আলাপন, পুরস্কার বিতরণ। এ বছর চারজন পুরস্কৃত হয়েছেন। শ্রেষ্ঠ তরুণ কথাসাহিত্যিক হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন উম্মে ফারহানা। শ্রেষ্ঠ সৃজনশীল সাহিত্যিক হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন ধ্রুব এষ এবং শ্রেষ্ঠ মননশীল সাহিত্যিক হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন আমিনুল ইসলাম ভুইয়া। আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন হাসনাত আবদুল হাই।
উম্মে ফারহানা যে গ্রন্থটির জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন, এর নাম ‘টক টু মি’। গল্পগ্রন্থ। ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আটটি গল্প এতে স্থান পেয়েছে। ‘পাবে না সময় আর হয়তো’, ‘গণশা’দা’, ‘আশিকি টু’, ‘এই ফুল ঝামেলা’, ‘ডায়ানা নামের বিলাই’, ‘আমার ভালো আব্বা’, ‘সুজানা’ ও ‘টক টু মি’। উম্মে ফারহানার লেখা সাধারণ ধ্রুপদি সাহিত্য পাঠকদের একটুখানি বিপাকে ফেলে দিতে পারে। কেননা, ভাষা এখানে সত্যের মতো রূঢ়। তাতে সৌন্দর্য আছে অবশ্যই। তবে তা গলায় পরার অলংকারের মতো সৌন্দর্য নয়। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে উপমা ধার করে বললে, বলতে হয়– বন্যেরা বনে যেমন সুন্দর, উম্মে ফারহানার গল্প, ভাষা সেই সুন্দরে বিভোর। ভাষা উত্তপ্ত, কাঁটালো, এ ভাষা হৃদয়ে রক্তপাত ঘটাতে পারে।
ধ্রুব এষ যে গ্রন্থটির জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন, সেটি নিয়েও ধ্রুপদি সাহিত্য পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এ গ্রন্থ কি তাদের পেয়ালার চা? এখানেও আরেক পৃথিবীর খেয়াল বাজছে। ধ্রুব এষের গ্রন্থটি উপন্যাস। আমাদের পরাবাস্তব টাউনের দিনলিপি। লেখার বিমূর্ততা, মুহুর্মুহু প্লট ও পট-বদল ঘটছে। চরিত্রগুলো নিছক ‘চরিত্র’ নয়। যেন মন। মনের যেমন ক্ষণে ক্ষণে মতি বদল ঘটছে, এ গ্রন্থের চরিত্রগুলোরও তেমন স্থান-কাল পর্ব ও পার্বণ বদল ঘটছে। অপরিসর উপন্যাস। বর্ণনার ধরনের কারণে সুপরিসরের আবহ ফোটে। তবে খেই হারানোর সুযোগ নেই। এই লেখা পাঠককে ‘নতুন কিছু’ পাঠের অভিজ্ঞতা দেয়।
দুটি গ্রন্থই এমন ব্যতিক্রমী আমাদের কাছে ধীরে ধ্রুপদের সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে, চিন্তার জগতে একটা প্যারাডাইম শিফট ঘটছে। অর্থাৎ চিন্তা পদ্ধতিতে আসছে আমূল পরিবর্তন। ফলে পাঠকের ভবিষ্যৎ গন্তব্যও যাবে বদলে। আমরা এখনও প্রকৃত ভালো ও মন্দ বিচারের ক্ষমতা রাখি না। অনেক সিদ্ধান্ত টেনে দেবে ভবিষ্যৎ, টেনে দেবে ইতিহাস। তবু ভিন্নতাকে তার স্বকীয়তাসহই গ্রহণ করতে হবে, যা আমাদের বিচারকরা করেছেন। তারাও ধ্রুপদি মানুষ। কিন্তু ধ্রুপদকে আবদ্ধ সরোবর হতে দেননি, যথাসাধ্য। গ্রন্থগুলো নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে বাজি ধরা যেতে পারে। তাই এই স্বীকৃতি। শেষ বিচার বর্তমান ও অনাগত সময়ের পাঠকের। শ্রেষ্ঠ মননশীল গ্রন্থটি আদর্শ ধ্রুপদ বলয়ের। আমিনুল ইসলাম ভুইয়ার ‘প্লেটো প্রবেশিকা’। আলো নিজস্ব গতিতে পথ অতিক্রম করে। আর প্রজ্ঞার আলোও নিজস্ব গতিতে কাল অতিক্রম করে। তা বিবেক-নির্গত আলো। প্রাচীন প্রাজ্ঞ মানুষেরা যে ধারায় চিন্তা করেছেন, তা আমাদের চিন্তাকাঠামো গড়ে দিয়েছে, আমরা সেই অনুপাতে আমাদের মূল্যবোধকেও আকার দিয়েছি। নতুন চিন্তায়, নতুন সিদ্ধান্তে যেতে হলে অতীতের কাঠামো– তার শুদ্ধ-অশুদ্ধ, কালের কিরিচে কতটা কাটা পড়েছে বা পড়েনি, সেইসমস্ত বিচারে রাখা চাই। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং মানুষের জ্ঞান তার সামগ্রিক ইতিহাসেরই লব্ধি। সেই যে প্রাচীন অমূল্য জ্ঞানের খনি, তাতে প্রবেশের জন্য তো প্রবেশিকা চাই। প্লেটো প্রবেশিকা তা-ই। প্লেটোর ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রকাঠামো বুঝতে, যুঝতে ও নতুন চিন্তাসূত্র উদঘাটনে ওই গ্রন্থ পাঠককে ‘অধিকার’ দান করতে পারবে বলে বিচারকদের বিশ্বাস হয়েছে।
আজীবন সম্মাননা নিয়ে বলতে গিয়ে আমাদের কলম হয়তো খানিকটা আবেগাক্রান্ত হবে। কেবল রেনেসাঁকাল ছাড়া কোনো জাতি একসঙ্গে অনেক সূর্যসন্তান পায় না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্তমান রেনেসাঁকাল নিজেকে চিনতে পারে না, এ কালে রেনেসাঁ চলছিল কিনা তা বিচারের ভার পড়ে ভাবীকালের ওপর। আমরা কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তরকালে একসঙ্গে সাহিত্যে অনেকজন শিল্পী-সাহিত্যিক পেয়েছি, যারা সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুরাষ্ট্রকে যৌবনে পৌঁছে দিয়েছেন। এখন যৌবনের দ্বন্দ্ব-দ্বৈরথ সে সহ্য করছে। কঠিন এই সময় পেরিয়ে গেলে জীবন যখন খানিকটা স্থির হবে, মানুষ বুঝতে পারবে বা টের পাবে, কোন কাল পেরিয়ে কোন কাল এলো। আমার ধারণা, একটি নীরব রেনেসাঁকাল চলেছে বাংলাদেশের জন্মের পর। এবং সেটিকে যারা বহন করেছেন, নজরুলের উপমা ধার করি যদি, ‘সেই তূর্যবাদকদের’ একজন হিসেবে হাসনাত আবদুল হাইকেও পেয়েছিলাম আমরা, এ কথা বলতেই হয়। সৃজনশীল সাহিত্য, মননশীল সাহিত্য– দুটি শাখার প্রায় সমস্ত প্রশাখায় তাঁর ফোটানো ফুল আমাদের আরও বহুকাল সৌরভ দিয়ে যাবে। ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কারের আজীবন সম্মাননা পদক স্বয়ং তাঁকে পেয়ে সম্মানিত হয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার পর্ষদ প্রত্যেকের কর্মকে উদযাপনের সুযোগ পেয়ে কৃতার্থ হয়েছে– এ কথা বারংবার উচ্চারণ করেছে।
এ অনুষ্ঠান সব সময় স্বকীয় ধারায়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। শুরুতেই অর্থি ড্যান্স একাডেমি পঞ্চকবির গানের সঙ্গে নাচ পরিদর্শন করে। পাঁচ কবি– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুল প্রসাদ সেন ও কাজী নজরুল ইসলামের গানের ছোট ছোট অংশের সঙ্গে বদলে যাওয়া নাচের এই আয়োজন দারুণ পছন্দ করেন দর্শকরা। প্রথমে বেজে ওঠে রজনীকান্ত সেনের গান, ‘প্রেমে জল হয়ে যাও গলে’। চলে এর আরোহণ, অবরোহণের সঙ্গে মাত্রাসিদ্ধা নাচ চলতে থাকে। হঠাৎ গানে পরিবর্তন। বেজে ওঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! সঙ্গে সঙ্গে নাচের মুদ্রায়ও বদলে যায়। ‘ঢালো ঢালো শশধর, ঢালো ঢালো জোছনা.
এর পরই শামা রহমান রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন। ‘আবার এসেছে আষাঢ়, আকাশ ছেয়ে/ আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে/ এই পুরাতন হৃদয় আমার...’ মধুক্ষরা কণ্ঠ তাঁর। এরপর গাইলেন রবীন্দ্রনাথের প্রেমপর্বের একটি গান যেখানে বৃষ্টির সুবাস আছে। ‘আজ গোধূলিলগনে এই বাদলগগনে তার চরণধ্বনি আমি হৃদয়ে গণি...’। সেদিন, ৪ জুলাই, ২০ আষাঢ়। স্নাত বিকেল গড়িয়ে তখন গোধূলি লগ্ন সত্যিই নেমে এসেছিল। এরপর তৃতীয় সংগীত, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি’ ললিত বিষণ্নতা ছড়াল। সর্বশেষ পরিবেশন করলেন এমন এক গান, যে গান বিপুল উপস্থিতির বুকে যুগপৎ দুঃখের উচ্ছ্বাস ও ক্ষমা-বন্দনার আনন্দ জাগায়। ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে শোন শোন পিতা’। এরপর এলো সান্ধ্য উপাসনার বিরতি।
এ অনুষ্ঠানের একটি বিশেষত্ব হলো এখানে প্রত্যেক পুরস্কৃতকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়। নেপথ্যে তাদের জীবন ও কাজের বর্ণনা উচ্চারিত হতে থাকে। অন্তঃস্থ বিরতিতে তাদের সঙ্গে আলাপচিত্রের বিশেষ অংশগুলো প্রদর্শিত হয়। সেখানে তারা জীবনের নানান বাঁক, বিশেষ মুহূর্ত, প্রবণতা, স্মৃতিচারণ প্রভৃতি বর্ণনা করেন। সম্ভবত এই পর্বটিই এ অনুষ্ঠানের দর্শকরা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেন। সময় কেটে যেতে থাকে দ্রুত।
আয়োজন ও উদযাপন উপলক্ষ রেখে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন পুরস্কার বিজয়ী উম্মে ফারহানা, ধ্রুব এষ ও আমিনুল ইসলাম ভুইয়া। স্মৃতিচারণে শ্রোতাদের আবেগস্নাত করে তোলেন হাসনাত আবদুল হাই। বিচারকদের প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলেন ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। ব্র্যাক ব্যাংকের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা-উত্তর প্রতিক্রিয়া ও পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করেন ব্যাংকটির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ইকরাম কবির ও ভাইস চেয়ারপারসন ফারুক মঈনউদ্দীন। আপন প্রতিক্রিয়া ও পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন হা-মীম গ্রুপ ও টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ। শুভেচ্ছার পর অনুভূতি ও স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করেন সমকালের সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী এবং অনুষ্ঠানের সার্বিক শুভ বিবৃত করেন সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। গোটা সময় সুচারু সঞ্চালনায় ছিলেন সমকালের উপসম্পাদক মাহবুব আজীজ।
সমাপনী বক্তব্যের পর ভোজপর্বের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কারের ১৩তম আসর।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রস ক র অন ষ ঠ ন র ল ইসল ম ফ রহ ন আম দ র ধ র পদ গ রন থ রব ন দ প রব শ স ন দর র একট নজর ল
এছাড়াও পড়ুন:
চাকরি-এনসিপির পদ হারিয়ে মুনতাসির কেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ভাইকে দুষছেন
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবি করে বিক্ষোভ করেছিলেন মুনতাসির মাহমুদ; তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠকের পদটি হারান তিনি। রেড ক্রিসেন্টের চাকরিটিও হারান। এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ভাই ও এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুব আলমের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন মুনতাসির। এদিকে মাহবুব দাবি করেছেন যে তাঁকে জড়িয়ে মনগড়া কথা বলছেন মুনতাসির।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. আজিজুল ইসলামের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের পুনর্বাসনের অভিযোগ তুলে গতকাল রোববার দুপুরে মগবাজারে সংস্থাটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢুকে বিক্ষোভ করেন মুনতাসির। এরপর সন্ধ্যায়ই এনসিপি তাঁকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায়।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে আসলে কী ঘটছে, মুনতাসির কেন এনসিপি থেকে অব্যাহতি পেলেন, এখন কেন তিনি উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ভাইকে দুষছেন—এসব বিষয়ে জানতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাতে জানা গেছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর মুনতাসির রেড ক্রিসেন্টে উপপরিচালক পদে চাকরি পেয়েছিলেন। আর উপদেষ্টা মাহফুজের ভাই মাহবুব রেড ক্রিসেন্টের ব্যবস্থাপনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
রেড ক্রিসেন্টে মুনতাসির মাহমুদের চাকরিটি ছিল অস্থায়ী। কয়েক দিন ধরে তিনি রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছিলেন। এনসিপির পক্ষ থেকে নিষেধ করার পরও গতকাল তিনি সেখানে বিক্ষোভ করেন। ওই দিন রেড ক্রিসেন্টের বোর্ড সভায় তাঁকে চাকরি থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত হয়।
রেড ক্রিসেন্টে মুনতাসির মাহমুদের চাকরিটি ছিল অস্থায়ী। কয়েক দিন ধরে তিনি সংস্থাটির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছিলেন। এনসিপির নিষেধ শুনছিলেন না। এরপর রেড ক্রিসেন্ট তাঁকে চাকরিচ্যুত করে, এনসিপি দেয় অব্যাহতি।সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, বোর্ড সভায় উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ভাই মাহবুব আলমও ছিলেন। সভার পর রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি থেকে বের হতে গেলে তাঁকে অবরুদ্ধ করেন মুনতাসির মাহমুদের অনুসারীরা। দফায় দফায় এনসিপির ঘনিষ্ঠ কয়েকজন মুনতাসিরকে ফোন করে রেড ক্রিসেন্টে আন্দোলন বন্ধ করে চলে যেতে অনুরোধ করতে থাকেন। আন্দোলন বন্ধ না করলেও সন্ধ্যা ৬টার দিকে মাহবুবকে রেড ক্রিসেন্ট কার্যালয় থেকে বের হতে দেন মুনতাসিরের অনুসারীরা। কিন্তু সংস্থার চেয়ারম্যান তখনো অবরুদ্ধ ছিলেন। পরে পুলিশ গিয়ে মুনতাসিরের অনুসারীদের ওপর চড়াও হয়।
এর মধ্যে সন্ধ্যায় মুনতাসিরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ও অব্যাহতির চিঠি ফেসবুকে প্রকাশ করে এনসিপি।
মুনতাসিরের অভিযোগ
গতকালের ওই ঘটনার পর রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে মাহবুব আলমের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ করেন মুনতাসির। উপদেষ্টার ভাই কেন রেড ক্রিসেন্ট চেয়ারম্যানের পক্ষ নিলেন, এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘সে (মাহবুব) আমাকে সরাসরি হুমকি দিয়েছে, “আমি উপদেষ্টা মাহফুজের ভাই, তুই মুনতাসির কে? তোর চাকরি আমি খেয়ে দিব।” আমিও পাল্টা জবাব দিই। তখন সে চেয়ারম্যানের (রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান) কক্ষে ঢুকে ওসি এবং অন্যান্য পুলিশকে বলে, “আমি উপদেষ্টা মাহফুজের ভাই, আমি বলছি আপনারা এখনই মুনতাসিরকে গ্রেপ্তার করুন এবং বাকি সবাইকে মেরে সরিয়ে দিন।”’
অবশ্য পরে মাহবুব তাঁর কাছে ‘মাফ’ চেয়ে কিছু প্রতিশ্রুতি দেন বলে মুনতাসির দাবি করেন। তিনি লিখেছেন, ‘সে (মাহবুব) প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায় যে সে মাহফুজ ভাইকে বোঝাতে যাচ্ছে এবং আজকেই চেয়ারম্যান পদত্যাগ করবে। কিন্ত সে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স আসে। ডিসি আমাকে চাপ দেন এবং পরে পুলিশ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা করে আমাদের আহত করে। যা–ই হোক, জুলাইয়ের গাদ্দার, ভাই আমার আজ সফল হয়েছে! আসলেই আমার চাকরি খেয়ে দিছে, দল থেকে অব্যাহতি দেওয়াইছে এবং পুলিশ দিয়ে মাইর খাওয়াইছে, কত বিশাল ক্ষমতা তার। আমি আমার ভাইয়ের হেদায়েতের জন্য দোয়া করি।’
আসলেই আমার চাকরি খেয়ে দিছে, দল থেকে অব্যাহতি দেওয়াইছে এবং পুলিশ দিয়ে মাইর খাওয়াইছে, কত বিশাল ক্ষমতা তার। আমি আমার ভাইয়ের হেদায়েতের জন্য দোয়া করি।মুনতাসির মাহমুদআজ সোমবার বিকেলে মুনতাসির দুটি সাধারণ ডায়েরির (জিডি) কপিসহ আরেকটি পোস্ট দেন। দুটি জিডিই হাতিরঝিল থানায় করা। দুটি জিডিতেই বাদীর নামটি ঢেকে দিয়েছেন মুনতাসির। এর মধ্যে ৮ অক্টোবর করা জিডিতে ছয় ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ১৫-২০ জনের বিরুদ্ধে রেড ক্রিসেন্ট কার্যালয়ে ঢুকতে বাধা, গালাগালি ও হুমকির অভিযোগ করা হয়।
৯ অক্টোবর করা অন্য জিডিতে তিন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে অভিযোগ করা হয়, একজনের বিরুদ্ধে রেড ক্রিসেন্ট কার্যালয়ে অভিযোগ দেওয়ার পর অফিসে এলে তাঁর অনুমতি না নিয়ে আরেকজন গোপনে তাঁর ভিডিও ধারণ করেন। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৭ অক্টোবর হাতিরঝিলের গাবতলা এলাকায় রিকশা দিয়ে যাওয়ার পথে তাঁকে ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়া হয়।
এই পোস্টের ক্যাপশনে মুনতাসির লিখেছেন, ‘অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত বা ব্যবস্থা না নিয়ে ভুক্তভোগীদের হয়রানি করা হচ্ছে এবং পাল্টা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করানোর পাঁয়তারা করছে! জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরও কোন ফ্যাসিবাদের নির্দেশে এসব সাহস তারা দেখাচ্ছে এবং কারা প্রশাসন চালাচ্ছে?’
যোগাযোগ করা হলে এনসিপির নেতা মুনতাসির প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর যা বক্তব্য, তা ফেসবুক পোস্টেই রয়েছে।
উপদেষ্টার ভাই যা বলছেন
উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ভাই মাহবুব আলম প্রথম আলোর জিজ্ঞাসায় বলেন, প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকার পরও ‘বিশেষ বিবেচনায়’ রেড ক্রিসেন্টের উপপরিচালক পদে চাকরি নিয়েছিলেন মুনতাসির। তিনি কয়েক দিন ধরে রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ করছিলেন। এর মধ্যে গত শনিবার রাতে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সঙ্গে কথা বলেন মুনতাসির ও এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মাহমুদা মিতু (রেড ক্রিসেন্টের আরেক বোর্ড সদস্য)। নাহিদ তাঁদের আন্দোলনের পরিবর্তে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু মুনতাসির তারপরও বিক্ষোভ চালিয়ে যান।
রোববার রেড ক্রিসেন্টের বোর্ড সভায় মুনতাসিরের সদলবল ‘মব’ সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা হয় জানিয়ে মাহবুব আলম বলেন, ‘হঠাৎ বোর্ড সভায় ঢুকে মুনতাসির দুটি জিডির কপি দেখান, যেগুলো নিয়ে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। পরে তিনি চলে যান। এরপর বোর্ডের বেশির ভাগ সদস্যের সিদ্ধান্তে তাঁকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সভার পর মুনতাসিরের সঙ্গে আমার কথা হয়। সেখানে হুমকিধমকির মতো কিছু হয়নি। রেড ক্রিসেন্ট থেকে বেরোতে গেলে তাঁর সঙ্গে থাকা ছেলেরা আমার পথরোধ করে আধঘণ্টা আটকে রেখে জেরা করেন। তাঁরা ৬টা পর্যন্ত আমাকে অফিসে অবরুদ্ধ করে রাখেন। অবশ্য পরে মুনতাসির এসে আমার কাছে ক্ষমা চান।’
অভিযোগ আছে, তিনি (মুনতাসির) রেড ক্রিসেন্টের নিয়মকানুন অনুযায়ী কাজ করেন না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি আমার সমর্থন চেয়েছিলেন। সেটা না করায় তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমার নাম জড়িয়ে মনগড়া কথা বলছেন।মাহবুব আলমমাহবুব আলম বলেন, হাতিরঝিল থানার ওসি ও তেজগাঁও জোনের এসি রেড ক্রিসেন্ট কার্যালয়ে গতকাল সারা দিন ছিলেন। বিক্ষোভকারীদের ওপর কোনো বল প্রয়োগ করা হয়নি। তবে রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান বিভিন্ন মহলে কথা বলেছেন। পরে রমনার ডিসিও এসেছিলেন। তিনি (মাহবুব) চলে আসার পর বিক্ষোভকারীদের ওপর বল প্রয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে তাঁর কোনো ভূমিকা নেই।
কিছু না করে থাকলে মুনতাসির কেন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন? প্রশ্নে মাহবুব বলেন, ‘অভিযোগ আছে, তিনি (মুনতাসির) রেড ক্রিসেন্টের নিয়মকানুন অনুযায়ী কাজ করেন না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি আমার সমর্থন চেয়েছিলেন। সেটা না করায় তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমার নাম জড়িয়ে মনগড়া কথা বলছেন। তাঁর চাকরি যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার কোনো হাত নেই। গতকালের ঘটনার সময় এনসিপির শৃঙ্খলা কমিটি, স্বাস্থ্য সেলসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে মুনতাসিরকে ফোন করে আন্দোলন থেকে সরে আসতে বলা হয়। তিনি কারও কথাই শুনছিলেন না। পরে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এখানে আমার কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। আমি তাঁকে কোনো হুমকিও দিইনি।’
আরও পড়ুনদুপুরে রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ, সন্ধ্যায় এনসিপি থেকে অব্যাহতি১২ অক্টোবর ২০২৫