তরুণ ভোটারদের পৃথক বুথের প্রস্তাব সংবিধানসম্মত নয়
Published: 12th, July 2025 GMT
আগের তিন নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় ১৮ থেকে ৩৩ বছর বয়সী ভোটারদের জন্য পৃথক ভোটার তালিকা ও বুথ স্থাপনের প্রস্তাব সংবিধানসম্মত নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এমন নজির বিশ্বের কোথাও নেই। পাশাপাশি এর ফলে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এমনকি নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
গত বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ড.
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের কোনো দেশেই তরুণ ভোটারদের জন্য ভোটকেন্দ্রে বাড়তি সুবিধা রাখা হয় না। বয়স্ক, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য কিছু সুবিধা রাখা হয়।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণির জন্য পৃথক বুথের অনেক নেতিবাচক দিক রয়েছে। যে কারণে সংবিধানের সপ্তম ভাগে নির্বাচনসংক্রান্ত অনুচ্ছেদে (১২১) বলা আছে, ‘সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রত্যেক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার একটি করে ভোটার তালিকা থাকবে এবং ধর্ম, জাত, বর্ণ ও নারী-পুরুষভেদে ভোটারদের বিন্যস্ত করে কোনো বিশেষ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা যাবে না।’
ভোট গ্রহণ কাজে অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা জানান, সংবিধানের এই নির্দেশনার অনেকগুলো যৌক্তিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, একজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পরে যদি তিনি চিহ্নিত করতে পারেন যে, বিশেষ কোনো ধর্ম, বর্ণ বা পেশার মানুষ তাকে ভোট দিয়েছেন অথবা দেননি তাহলে তিনি সবার ওপর সমান আচরণ করবেন না। এতে নির্বাচনের মূল্য উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ইসি সচিবালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ভোট গ্রহণের সুবিধার্থে কেন্দ্রভিত্তিক নারী ও পুরুষ ভোটারদের পৃথক তালিকা করা হয়। কিন্তু এটাকে নির্বাচনী এলাকার জন্য একটি ভোটার তালিকা হিসেবেই গণ্য করা হয়ে থাকে। তিনি আরও জানান, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের জন্য ১০ জুলাইয়ের মধ্যে মাঠ পর্যায় থেকে ইসি সচিবালয়ের তালিকা পাঠানোর নির্দেশনা ছিল। সে অনুযায়ী ইতোমধ্যেই তালিকা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সাধারণত তিন থেকে পাঁচ হাজার ভোটারের জন্য একটি কেন্দ্র এবং ৪০০ থেকে ৬০০ ভোটারের জন্য একটি বুথ তৈরি করা হয়। ব্যালট পেপারে প্রতি মিনিটে গড়ে একটি করে ভোট গ্রহণ করা হবে– এমন হিসাব ধরে ৮ ঘণ্টায় ৪৮০ মিনিটে প্রায় ৫০০ ভোট নেওয়া সম্ভব বলে ওই কর্মকর্তা জানান। তিনি বলেন, বয়স্ক ভোটার এবং অন্তঃসত্ত্বাদের ভোটের লাইনে আগে দেওয়ার একটি নির্দেশনা থাকে। এর বাইরে বিশেষ কোনো বয়সের ভোটারদের জন্য পৃথক বুথ তৈরির বাস্তবতা নেই।
নির্বাচন-সংশ্লিষ্টদের মতে, বিশ্বের কোনো দেশে প্রথম ভোটার বা ৩৩ বছর বয়স পর্যন্ত ভোটারদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা রাখার তথ্য পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশসহ অনেক দেশে নারীদের জন্য পৃথক লাইনের ব্যবস্থা রাখা হয়। নারীরা যাতে ভোট দিতে আগ্রহী হন, সে জন্য বিশেষ প্রচারণা চালানো হয়। উন্নত দেশে বয়স্কদের জন্য বিশেষ প্রবেশপথ, স্বেচ্ছাসেবী, হুইলচেয়ার, ভোটকেন্দ্রে র্যাম্প, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল ব্যালট, বড় আকারের ব্যালট পেপার, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সুবিধা এমনকি বাড়িতে গিয়ে ভোট গ্রহণেরও ব্যবস্থা আছে। পোস্টাল ভোটদান এবং অনলাইনে ভোটদানের ব্যবস্থাও আছে কিছু দেশে। দূতাবাসে কর্মরত বা প্রবাসী নাগরিকদের জন্য ভোটের বিশেষ ব্যবস্থা আছে। ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশে প্রক্সি ভোটের ব্যবস্থা আছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ভোটের প্রধান বিষয় হলো ভোটকেন্দ্র যেন শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর হয় এবং ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী, বয়স্ক বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য কিছু বাড়তি সুবিধা রাখা প্রয়োজন। কিন্তু বয়স ধরে বিশেষ ব্যবস্থা বাস্তবসম্মত নয়। নির্বাচন কমিশন সংস্কার প্রস্তাবেও এ রকম কিছু তারা বলেননি।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলিম বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে জন্ম নেওয়া দেশগুলোতে অনলাইনে ভোট দেওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসীরা অনলাইনে ভোট দিতে পারেন। ফ্রান্সে মনোনীত ব্যক্তিকে দিয়ে প্রক্সি ভোট দেওয়ার বিধান আছে। বয়স্ক, প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক জায়গায় অনেক সুবিধা আছে। কিন্তু ১৮ থেকে ৩৩ বছর বয়সী ভোটারদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা কখনও শুনিনি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘এটা শুনে অবাক হয়েছি। বিষয়টি রহস্যজনক। বিশেষ উদ্দেশ্যে এটা করা হতে পারে। এটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডেরও (সবার জন্য সমান সুযোগ) অন্তরায়। এটা সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। একজন শোষকের ভোটেরও যে মূল্য, শোষিতের ভোটেরও একই মূল্য। ধনী বা শ্রমিকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, ‘এ ধরনের কথা আমি জীবনেও শুনিনি। নিয়ম হলো, যারা বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে পড়েছে তাদের জন্য সুবিধা দেওয়া। এ রকম উদ্ভট চিন্তাভাবনা দুনিয়ার কোথাও নেই। এভাবে করলে অনেক প্রশ্ন আসবে– কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলকে সুবিধা দেওয়ার জন্য এটা করা হচ্ছে কিনা।’
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব সমকালকে বলেন, ‘বিগত নির্বাচনগুলোতে যুবকরা ভোট দিতে পারেনি। এ কারণে হয়তো তাদের উৎসাহিত করতে এটা করা হতে পারে।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: দ র জন য ব শ ষ ত দ র জন য ভ টক ন দ র ভ ট গ রহণ কর মকর ত ব যবস থ বয়স ক
এছাড়াও পড়ুন:
অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক
অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।
বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক।
আরো পড়ুন:
রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী
‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত
সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।
প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।
জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।
লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড
ঢাকা/লিপি