সরকার ও বিএনপি—কেউ দায় এড়াতে পারে না
Published: 13th, July 2025 GMT
গত বুধবার পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর ফটকে কয়েকজন দুর্বৃত্ত মিলে যেভাবে এক ব্যবসায়ীকে নৃশংস ও নারকীয় কায়দায় হত্যা করেছে, তাদের ধিক্কার জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। এই ব্যবসায়ীর নাম লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ। পুলিশ বলছে, এলাকার ভাঙারির ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে বিরোধের জেরেই দুর্বৃত্তরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
এই পাষণ্ডরা সোহাগকে কুপিয়ে ও শরীর-মস্তক পাথরে থেঁতলে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা তাঁর লাশের ওপর নৃত্য করতেও দ্বিধা করেনি। মানুষ এত বর্বর ও নিষ্ঠুর হয় কী করে! সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, আশপাশের লোকজন হতবিহ্বলে সোহাগ হত্যা প্রত্যক্ষ করলেও এগিয়ে আসেননি। নির্বিকার ছিলেন হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার সদস্যরাও। আমরা কেমন সমাজে বাস করছি, যেখানে অপরাধের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেন না?
অতীব উদ্বেগের বিষয়, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপির যুব সংগঠন যুবদলের স্থানীয় নেতা-কর্মী জড়িত বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলীয় প্ররোচনায় অনেক হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এই পুরান ঢাকায়ই বিরোধী দলের হরতাল কর্মসূচি বন্ধ করতে বিশ্বজিৎ দাস নামের এক দরজিকেও কুপিয়ে হত্যা করেছিল ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তরা। এরপর তাদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। কিন্তু চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পরও যে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলো তার প্রমাণ। গত শুক্রবার খুলনার দৌলতপুরে যুবদল থেকে বহিষ্কৃত নেতাকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত, চার মাসে রাজধানীতেই খুন হয়েছেন ১৩৬ জন। সারা দেশে এই সংখ্যা ১২ শতাধিক। অন্যদিকে ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে ঢাকায় এই সংখ্যা ছিল ৫৫, ২০২২ সালে ৫৪, ২০২৩ সালে ৫১ ও ২০২৪ সালে ৪৭।
সোহাগ হত্যার প্রতিবাদে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও এলাকায় বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করাকেই সরকারের সাফল্য বলে দাবি করেছেন। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল অপরাধীদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হত্যার বিচার করার কথা বলেছেন।
কিন্তু তাঁদের আশ্বাস ও অঙ্গীকার কেন অপরাধ কমাতে পারছে না? সাম্প্রতিক কালে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কও চলছে। সোহাগ হত্যার ঘটনায় যুবদল সভাপতি সংবাদ সম্মেলন করে মামলা থেকে বাদীর এজাহারভুক্ত তিন আসামিকে বাদ দেওয়া হয়েছে, এমন অভিযোগ তুলে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। তাঁর এই প্রশ্নের যথার্থতা স্বীকার করে বলব, যে সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় এ রকম খুনি তৈরি হয়, সেই সংগঠন কি খুনের দায় এড়াতে পারে? রাজনৈতিক দলগুলো তাদের যেসব নেতা-কর্মী হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁদের বহিষ্কার করেই দায়িত্ব শেষ করছে। কিন্তু কীভাবে দলের আশ্রয়ে তাঁরা দুর্ধর্ষ অপরাধীতে পরিণত হচ্ছেন, সেই প্রশ্ন নিজেদের করছেন না।
একের পর এক নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মমাফিক কার্যক্রমের বাইরে কিছু করছে না। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ, র্যাব, বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও নিয়োজিত আছেন। অপরাধ দমন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও পক্ষপাতমূলক। লালমনিরহাটের পাটগ্রামে আসামি ছিনতাই করার দায়ে সরকার স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কিন্তু চট্টগ্রামের পটিয়ায় যাঁরা পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হলেন, সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে সেখানকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এটা আইনের শাসনের পরিপন্থী।
অপরাধীদের দমন করতে হলে আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দায় এড়ানোর মনোবৃত্তি থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: হত য ক ণ ড হত য র সরক র ব যবস অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
এবার দুর্গাপূজায় বড় অঘটন হয়নি, তবে সরকারের পদক্ষেপে আয়োজকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়
এবারের শারদীয় দুর্গাপূজা উৎসাহ–উদ্দীপনায় উদ্যাপিত হলেও কোনো কোনো প্রতিমার অবয়বে অশুভশক্তির প্রকাশে শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি বা অসচেতনতাকে কেন্দ্র করে সরকারের আইনি পদক্ষেপ পূজার আয়োজক ও প্রতিমাশিল্পীদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক তৈরি করেছিল বলে জানিয়েছে পূজা উদ্যাপন পরিষদ।
আজ সোমবার ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়। পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। উপস্থিত ছিলেন পূজা উদ্যাপন পরিষদের সহসভাপতি অধ্যাপক চন্দ্রনাথ পোদ্দার, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সহসভাপতি গোপাল চন্দ্র দেবনাথ প্রমুখ।
সারা দেশে এবার অত্যন্ত সুন্দরভাবে পূজা উদ্যাপিত হয়েছে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনের বাসুদেব ধর বলেন, এই উৎসব আয়োজনে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা অত্যন্ত আন্তরিকতা নিয়ে তাঁদের পাশে ছিল। রাজনৈতিক দলগুলোরও সক্রিয় সহযোগিতা তাঁরা পেয়েছেন। এই মাটির হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে যে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পথ দেখিয়েছে, এবারের উৎসব তারই ধারা বহন করতে পেরেছে।
দুর্গোৎসব শুরু হওয়ার আগে অন্তত ১৪টি জেলায় প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে জানিয়ে বাসুদেব ধর বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের কারণে কয়েকটি স্থানে দুর্বৃত্তরা ধরাও পড়ে। পূজার পাঁচ দিন দেশের কোথাও বড় মাত্রায় অঘটনের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। পূজার পরও সে রকম কোনো খবর আসেনি। সরকারের কঠোর অবস্থান, বিশেষ করে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সক্রিয় ও সতর্ক ভূমিকা এই ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
পূজা ‘সুন্দরভাবে’ হলেও কোনো কোনো প্রতিমার অবয়বে অশুভশক্তির প্রকাশে শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি বা অসচেতনতাকে কেন্দ্র করে সরকারের পদক্ষেপে পূজার আয়োজক ও প্রতিমাশিল্পীদের মধ্যে উদ্বেগ ও শঙ্কা তৈরি হয়েছিল বলে জানান বাসুদেব।
‘প্রতিমায় যে অবয়ব প্রকাশের কথা বলা হচ্ছে, তা নতুন বা হঠাৎ এ বছরই হয়েছে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। অতীতে অনেক প্রতিমায় তা শিল্পী বা অয়োজকেরা নানাভাবে প্রকাশ করেছেন। এবার কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি না।বাসুদেব ধর, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতিবাসুদেব ধর বলেন, ‘সুষ্ঠুভাবে দুর্গাপূজা সম্পন্ন হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ৫ অক্টোবর “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত” হানার অজুহাতে শিল্পী, পূজারি ও আয়োজকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার কথা ঘোষণার পর কিছু পদক্ষেপের কথা জানা যাচ্ছে। থানায় সাধারণ ডায়েরি দায়ের ও সরকারি তদন্তের কথা বলা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যের পর পূজার আয়োজক ও প্রতিমাশিল্পীদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে যেকোনো পূজা-পার্বণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।’
সরকার বিষয়টি নজরে আনার পর সম্ভাব্য অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি এড়াতে পূজা উদ্যাপন পরিষদ দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছিল জানিয়ে বাসুদেব বলেন, ‘সরকার, সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি একযোগে সমস্যাটির সমাধান করে। এতে পূজার উৎসবে ভাটা পড়েনি। অথচ পূজা শেষ হওয়ার পর বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্নধারায় প্রবাহিত করার চেষ্টা হচ্ছে, যা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উৎসাহিত করতে পারে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নানাভাবে হয়রানি ও নিপীড়নের মুখে পড়তে পারে। অন্যদিকে একসঙ্গে কাজ করার যে নজিরবিহীন ধারাটি তৈরি হয়েছে, তা–ও গতি হারাতে পারে।’এ প্রসঙ্গে পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি আরও বলেন, প্রতিমায় যে অবয়ব প্রকাশের কথা বলা হচ্ছে, তা নতুন বা হঠাৎ এ বছরই হয়েছে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। অতীতে অনেক প্রতিমায় তা শিল্পী বা অয়োজকেরা নানাভাবে প্রকাশ করেছেন। এবার কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন না।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ‘অস্বীকারের রাজনীতি’ দেখে আসার কথা জানিয়ে বাসুদেব ধর বলেন, ‘দুঃখজনক হচ্ছে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। বাস্তবতা এড়িয়ে সমস্যা-সংকটের অবসান হবে না। পরিসংখ্যান অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই ৫৪ বছরে হিন্দু সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ১৮ থেকে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে।’
আরও পড়ুনএবার সারা দেশে ৩৩ হাজার ৩৫৫ মণ্ডপ-মন্দিরে দুর্গাপূজা হবে২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫