সাভার হত্যাকাণ্ড ও মোহাম্মদপুরের ভিডিওচিত্র
Published: 13th, July 2025 GMT
দফায় দফায় পুলিশের মুহুমুহু গুলিবর্ষণ, চিৎকার–ছোটাছুটি, প্রাণে বাঁচতে দৌড়াতে গিয়ে নিমেষেই চোখের সামনে একে একে ধুপধাপ পড়ে যাওয়া, এমনকি ফুটেজ ধারণের সময় গুলিবিদ্ধ হওয়া—পর্দায় যেন এক যুদ্ধেরই জীবন্ত অভিজ্ঞতা।
এসব গল্প উঠে এসেছে প্রথম আলো নির্মিত ‘সাভার গণহত্যা: হাসিনা পালানোর পরের ৬ ঘণ্টা’ শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্রে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকা–আরিচা মহাসড়কের প্রায় ১ কিলোমিটার, আর সাভার থানা রোডের আরও ১ কিলোমিটারজুড়ে ঘটেছে অসংখ্য ঘটনা। এসব ঘটনা নিয়েই আড়াই মাসের অনুসন্ধানে নির্মিত এই প্রামাণ্যচিত্র। প্রকাশের সাড়ে চারমাসে ইউটিউবে তা দেখেছেন ৪৫ লাখ মানুষ।
ঢাকার অদূরেই ছোট্ট সাভারের অলিগলি আমার কাছে একেবারেই অচেনা–অজানা স্থান। এমন এলাকা থেকে ৫ আগস্টের শত শত ফুটেজ—মুঠোফোন, সিসিটিভি ক্যামেরা, অডিও ক্লিপ—সংগ্রহ শুধু চ্যালেঞ্জেরই নয়, কিছু ক্ষেত্রে অসম্ভব মনে হয়েছে। এসব ফুটেজ–নিহত ব্যক্তিরাই ‘এগিয়ে নিয়েছেন’ ঘটনা।
পরে ফরেনসিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে এসব ফুটেজের। অর্থাৎ ধরে ধরে শত শত ফুটেজের সত্যতা যাচাই, সেকেন্ড ধরে সেগুলো বিশ্লেষণ, ধারণের সময়–স্থান শনাক্ত, ফুটেজ দেখে নিহত ব্যক্তিকে শনাক্ত, তাঁদের পরিবারকে খুঁজে বের করে, ঘটনার ধারাবাহিকতা মিলানো, বিভিন্ন ফুটেজের মাধ্যমে একটি অপূর্ণাঙ্গ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা, প্রতিটা ফুটেজের পেছনের গল্প জানা, সূত্র মেলাতে ডজনের পর ডজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলা—এ যেন সমুদ্রে নেমে জল মাপা!
এর বাইরে পুলিশের গুলিতে ঠিক কতজন নিহত, কোথায়–কাকে–কীভাবে গুলি করে হত্যা করার প্রমাণ সংগ্রহ, ফুটেজে অনেকের জীবনের শেষ কিছু মুহূর্ত খোঁজা—এসব তথ্য খোঁজা ও বিশ্লেষণ করার অর্থ আসলে মানসিকভাবে অস্থিরতা বাড়ানো। কিন্তু মূল্য উদ্দেশ্য ছিল, গল্পগুলো যেকোনো উপায়েই বের করে আনতে হবে।
সাভার গণহত্যা নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রের আগেই মূলত আরও দুটি ভিজ্যুয়াল অনুসন্ধান করেছিলাম—‘কাউন্সিলর আসিফ–রাজীবের নেতৃত্বে গুলিবর্ষণ, ছিলেন নানকের সহকারীও’; আর ‘কাউন্সিলর আসিফ যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেন বিক্ষোভকারীদের ওপর’। জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের পরই সবচেয়ে আন্দোলনমুখর এলাকাগুলোর একটি ছিল মোহাম্মদপুর। সেখানকার আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলরসহ আরও কিছু দলীয় নেতা–কর্মীর তাণ্ডব, গুলিবর্ষণ, মৃত্যুর গল্পই এখানে উঠে এসেছে।
অভ্যুত্থানের পরপরই মনে হয়েছিল, এখনই সময় বাস্তবতা–ভয়াবহতাকে দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরার। কিন্তু সে সময় আসলে ঘটনা অনেক, চ্যালেঞ্জও অনেক। তার ওপর ‘ভিজ্যুয়াল অনুসন্ধান’ দেশে এর আগে বলতে গেলে সেভাবে হয়নি। নিজের সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নতুন এ ধরনের বিষয়ে দেখে দেখে শেখা জ্ঞান নিয়ে ছোট পরিসরে নির্মাণ করেছিলাম এগুলো।
আসলে এসব একেকটা কাজের পরিধি এত বিশাল যে ভিডিও প্রমাণ সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, যাচাই–বাছাইয়ে চলে যায় দীর্ঘ সময়। তার ওপর বীভৎস সব ফুটেজ দিনের পর দিন দেখার পর মানসিক অবস্থাও দফায় দফায় খুবই খারাপ হয়ে যায়। এত চ্যালেঞ্জের পরও এমন অনুসন্ধান আসলে মনে প্রশান্তি দেয়—মানুষের সামনে সত্য তুলে ধরার প্রশান্তি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র পর
এছাড়াও পড়ুন:
সুদানে কারা গণহত্যা চালাচ্ছে, আরব আমিরাতের ভূমিকা কী
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সুদান এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিতে দেশটির সামরিক বাহিনী এবং শক্তিশালী আধা সামরিক গোষ্ঠী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে শুরু হওয়া তীব্র লড়াই থেকে এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় এবং সেখানে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অভিযোগও ওঠে।
সম্প্রতি আরএসএফ এল-ফাশের শহরটি দখল করার পর এর বাসিন্দাদের নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত সারা দেশে দেড় লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন এবং প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। জাতিসংঘ এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকট বলে অভিহিত করেছে।
পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থান ও সংঘাতের শুরু১৯৮৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই দফায় দফায় যে উত্তেজনা চলছিল, তার সর্বশেষ পরিস্থিতি হচ্ছে বর্তমান গৃহযুদ্ধ।
বশিরের প্রায় তিন দশকের শাসনের অবসানের দাবিতে বিশাল জনবিক্ষোভ হয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু দেশটির মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে একটি যৌথ সামরিক-বেসামরিক সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারটিকে উৎখাত করা হয়। এই অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ও দেশটির কার্যত প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং তাঁর ডেপুটি ও আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো।
এই দুই জেনারেল দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ও বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়া নিয়ে প্রস্তাবিত পদক্ষেপে একমত হতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয় ছিল প্রায় এক লাখ সদস্যের আরএসএফ-কে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা এবং নতুন এই যৌথ বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে। ধারণা করা হয়, দুজন জেনারেলই তাঁদের ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব ধরে রাখতে চেয়েছিলেন।
আরএসএফ সদস্যদের দেশের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হলে সেনাবাহিনী বিষয়টিকে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। এ নিয়ে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। সেই লড়াই দ্রুত তীব্র আকার ধারণ করে এবং আরএসএফ খার্তুমের বেশির ভাগ অংশ দখল করে নেয়। যদিও প্রায় দুই বছর পর সেনাবাহিনী খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়।
জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান (বামে) এবং আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো (ডানে)