মহানবী (সা.) বয়োজ্যেষ্ঠদের যত্ন নিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি নিজে যে নীতি শিখিয়েছিলেন, তা নিজের জীবনে প্রয়োগ করে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

ইসলামে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি দায়িত্ব

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যদি কোনো যুবক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে তাঁর বয়সের কারণে সম্মান করে, তবে আল্লাহ তার বৃদ্ধ বয়সে তাকে সম্মান করার জন্য কাউকে নিযুক্ত করবেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,০২২)

বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করতে তিনি যুবসমাজকে উৎসাহিত করেছেন, যাতে প্রজন্মের মধ্যে দূরত্ব কমে এবং ভালোবাসা ও বোঝাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে। হাদিসে ‘বয়োজ্যেষ্ঠ’ শব্দটি সাধারণভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা জাতি বা ধর্মের সীমাবদ্ধতা ছাড়াই সব বয়োজ্যেষ্ঠের প্রতি সম্মান প্রকাশ করে।

সে আমাদের মধ্যে নয়, যে আমাদের শিশুদের প্রতি দয়া করে না এবং আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান দেখায় না।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১,৯১৯

আরেকটি হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ করে বলছি, আল্লাহ দয়াবান ব্যক্তি ছাড়া কারো ওপর তাঁর রহমত প্রদান করেন না।’ সাহাবিরা বললেন, ‘আমরা সবাই দয়াবান।’ নবীজি (সা.

) বললেন, ‘শুধু একে অপরের প্রতি দয়া নয়, বরং সব মানুষের প্রতি দয়া।’ (মুসনাদে আবু ইয়া’লা, হাদিস: ১,০৬,৮৮৩)

আরও পড়ুনবড়দের থেকে উপদেশ নেওয়া০৭ ডিসেম্বর ২০২৩আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা

একটি হাদিসে বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মানকে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন: ‘আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধার অংশ হলো শ্বেতকেশী (বয়োজ্যেষ্ঠ) মুসলিমকে সম্মান করা।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৮৪৩)

তিনি আরও বলেছেন: ‘সে আমাদের মধ্যে নয়, যে আমাদের শিশুদের প্রতি দয়া করে না এবং আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান দেখায় না।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১,৯১৯)

ব্যবহারিক উদাহরণ

নবীজি (সা.) বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান প্রকাশে ব্যবহারিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যুবকের উচিত বয়োজ্যেষ্ঠকে সালাম দেওয়া, পথচারীর উচিত বসে থাকা ব্যক্তিকে সালাম দেওয়া, এবং ছোট দলের উচিত বড় দলকে সালাম দেওয়া।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,২৩১)

তিনি আরও বলেছেন, ‘জিবরিল আমাকে বয়োজ্যেষ্ঠদের অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (আল-ফাওয়াইদ, আবু বকর আশ-শাফিঈ, দারুল কুতুব, বৈরুত: ১৯৮৫, পৃ. ৮৭)

তিনি পানীয় পরিবেশন বা অনুরূপ কাজে বয়োজ্যেষ্ঠদের অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। (মুসনাদে আবু ইয়া’লা, হাদিস: ২,৪১৬)

যুবকের উচিত বয়োজ্যেষ্ঠকে সালাম দেওয়া, পথচারীর উচিত বসে থাকা ব্যক্তিকে সালাম দেওয়া, এবং ছোট দলের উচিত বড় দলকে সালাম দেওয়া।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,২৩১

নামাজের ইমামতির ক্ষেত্রেও বয়োজ্যেষ্ঠদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। নবীজি (সা.) বলেছেন: ‘যখন নামাজের সময় হয়, তোমাদের একজন আজান দেবে এবং তোমাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ, তিনি নামাজের ইমামতি করবেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৮৪)

একটি ঘটনায় দেখা যায়, সাহাবি হুওয়াইয়্যিসা, মুহাইয়্যিসা ও আবদুর রহমান নবীজির কাছে কথা বলতে এলে সবচেয়ে কনিষ্ঠ আবদুর রহমান কথা শুরু করেন। নবীজি (সা.) বলেন, ‘বয়োজ্যেষ্ঠকে প্রথমে কথা বলতে দাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৮৪৭)

বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য শরিয়াহর সহজ বিধান

বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য শরিয়াহর বিধান সহজ ও নমনীয় করা হয়েছে। খাওলা বিনতে সা’লাবার ঘটনায় আছে, তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ স্বামী আওস ইবনে আস-সামিত ‘জিহার’ ঘোষণা করেন। কোরআনে জিহারের কাফফারা হিসেবে দাস মুক্তি, দুই মাস উপবাস বা ষাটজন দরিদ্রকে খাওয়ানোর বিধান দেওয়া হয় (সুরা মুজাদিলা, আয়াত: ৩-৪)।

নবীজি (সা.) মুআয ইবনে জাবালকে দীর্ঘ নামাজের জন্য তিরস্কার করেন, কারণ এটি বয়োজ্যেষ্ঠ ও দুর্বলদের জন্য কষ্টকর ছিল।

কিন্তু আওসের অক্ষমতা জানতে পেরে নবীজি তাঁকে ষাটজন দরিদ্রকে খাওয়ানোর নির্দেশ দেন এবং নিজে তাঁকে সাহায্য করেন। নবীজি খাওলাকে তাঁর চাচাতো ভাইয়ের (আওস) যত্ন নেওয়ার পরামর্শও দেন। (ইবনে কাসির, তাফসির, দারুল কুতুব, বৈরুত: ২০০০, খণ্ড ৮, পৃ. ২৩৪)

বয়োজ্যেষ্ঠরা রমজানের রোজা রাখতে অক্ষম হলে প্রতিদিনের জন্য একজন দরিদ্রকে খাওয়ানোর বিধান রয়েছে। যারা দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারেন না, তাঁরা বসে বা শুয়ে নামাজ পড়তে পারেন।

নবীজি (সা.) মুআয ইবনে জাবালকে দীর্ঘ নামাজের জন্য তিরস্কার করেন, কারণ এটি বয়োজ্যেষ্ঠ ও দুর্বলদের জন্য কষ্টকর ছিল। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭০৫)

হজের ক্ষেত্রে, বয়োজ্যেষ্ঠরা অন্যকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে পারেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৩৩৩)

আরও পড়ুনপ্রবীণের সম্মান প্রতিষ্ঠায় গোটা সমাজ সম্মানিত হয়০২ অক্টোবর ২০২০নবীজি (সা.)-এর দয়ার উদাহরণ

বদরের যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের পুত্র আমর বন্দী হন। আবু সুফিয়ান মুক্তিপণ দিতে অস্বীকার করেন এবং বনু আমর ইবনে আওফের বয়োজ্যেষ্ঠ সা‘দ ইবনে নু‘মানকে মক্কায় ওমরাহর সময় বন্দী করেন। নবীজি (সা.) আমরকে মুক্তিপণ ছাড়াই ছেড়ে দেন, যার ফলে সা‘দ মুক্ত হন। (ইবনে হিশাম, আস-সীরাতুন নববিয়্যাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা: ২০০৪, খণ্ড ২, পৃ. ৩৪৫)

নবীজি (সা.) বলেন, ‘তুমি কেন বৃদ্ধকে তাঁর বাড়িতে রেখে আসনি? আমি নিজে তাঁর কাছে যেতাম।’

মক্কা বিজয়ের সময় আবু বকর (রা.) তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ পিতা আবু কুহাফাকে নবীজি (সা.)-এর কাছে নিয়ে আসেন। নবীজি (সা.) বলেন, ‘তুমি কেন বৃদ্ধকে তাঁর বাড়িতে রেখে আসনি? আমি নিজে তাঁর কাছে যেতাম।’

তিনি আবু কুহাফাকে সম্মানের সঙ্গে বসান, তাঁর বুকে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান এবং তাঁর শ্বেতকেশ রং করার নির্দেশ দেন। (ইবনে কাসির, আস-সীরাতুন নববিয়্যাহ, দারুল কুতুব, বৈরুত: ১৯৮৮, খণ্ড ৪, পৃ. ২৩৬)

নবীজির বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি আচরণ ইসলামের মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন। তিনি সম্মান, দয়া ও সহজ বিধানের মাধ্যমে তাঁদের মর্যাদা রক্ষা করেছেন। তাঁর শিক্ষা ও গল্পগুলো মুসলিম সমাজের জন্য একটি ব্যবহারিক মডেল, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সংহতি ও করুণার চেতনা ছড়িয়ে দেয়।

আরও পড়ুনসম্মানীকে সম্মান দেওয়ার সৌন্দর্য০২ এপ্রিল ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সহ হ ব খ র ব যবহ র ক আম দ র বল ছ ন র জন য আল ল হ ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

বিসিএলে বিদেশি দল, এনসিএলে বিদেশি ক্রিকেটার

দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের মান নিয়ে প্রশ্ন আজকের নয়। জাতীয় ক্রিকেট লিগ, বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ যে মানের হয়, যেভাবে আয়োজন হয় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে হরহামেশা। অতীতে সমালোচনার পর কিছুটা মান বেড়েছে। কিন্তু তারপরও ‘আপ টু মার্ক’ হয়নি।

বিশেষ করে ঘরোয়া ক্রিকেটে দিব‌্যি পারফর্ম করা ক্রিকেটাররা যখন জাতীয় দলে এসে ধুকতে থাকেন তখন তারতম‌্য প্রকটভাবে ফুটে উঠে। এজন‌্য ঘরোয়া ক্রিকেটের মান বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। জাতীয় ক্রিকেট লিগে বিদেশি ক্রিকেটারকে নিয়ে আসতে চায় বিসিবি। এছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগে যুক্ত করতে চায় বিদেশি দল।

বিসিবির পরিচালক ও টুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারম‌্যান আকরাম খান রাইজিংবিডিকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

আরো পড়ুন:

তিন সপ্তাহের জন্য আসছেন উড, মনোবিদ স্কট

সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার বেলায়েত হোসেন মারা গেছেন

বিসিএল শুরু থেকে ছিল ফ্রাঞ্চাইজিভিত্তিক প্রতিযোগিতা। ওয়ালটন সেন্ট্রাল জোন, প্রাইম ব‌্যাংক সাউথ জোন, ইসলামী ব‌্যাংক ইষ্ট জোন ও বিসিবি নর্থ জোন নামে চারটি দল শুরুর কয়েক বছর বিসিএলে অংশ নিয়েছে। পেশাদারিত্বের ঘাটতি, পরিকল্পনার অভাব এবং বাণিজ‌্যিকভাবে লাভবান না হওয়ায় তিনটি ফ্রাঞ্চাইজি ধীরে ধীরে সরে যায়। পরবর্তীতে বিসিবি চারটি দলই নিজস্ব খরচে পরিচালনা করে বিসিএল চালু রাখে। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীতার অভাব বোঝা যায়।

এজন‌্য বিসিবি সামনের আসরে বিদেশ থেকে একটি দল নিয়ে আসতে চায়। শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগও করেছে। বিসিএল যেই সময়ে আয়োজন করতে চাচ্ছে সেই সময়ে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে ব‌্যস্ত থাকবেন। আফগানিস্তানকে চূড়ান্ত করার পথে হাঁটছে। বিসিবির পুরো খরচেই অতিথি দল প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। বাকি তিনটি দল গঠন করবে বিসিবি।

আকরাম খান বলেছেন, ‘‘আমরা প্রথমবারের মতো বিসিএলে একটি বিদেশি দলকে পেতে যাচ্ছি। হয়তো তারা এ দল হিসেবে আসবে। নয়তো অন‌্য কোনো নামে। এক মাস এই টুর্নামেন্ট চলবে। ফেব্রুয়ারিতে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’’

এদিকে জাতীয় ক্রিকেট লিগে বিদেশি ক্রিকেটার অন্তর্ভূক্ত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে কোন প্রক্রিয়ায় তারা যুক্ত হবেন, কিভাবে আসবেন, পারিশ্রমিক কত হতে পারে সেসব নিয়ে এখনও কোনো উপায় খুঁজতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। তবে ভালোমানের বিদেশি খোঁজার প্রক্রিয়া চলছে।

তাদের পারিশ্রমিক চূড়ান্ত করা, পুরো আসরে অ‌্যাভেইলেভেল থাকবেন কিনা সেসব নিয়েও কাজ হচ্ছে। এজন‌্য আগেভাগে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চান না আকরাম।

আগামী ১৫ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দুই স্তরে জাতীয় ক্রিকেট লিগের খেলা অনুষ্ঠিত হবে। আট দলে একজন করে বিদেশি ক্রিকেটার রাখার ইচ্ছা বিসিবির। অতীতে বিদেশি ক্রিকেটার জাতীয় ক্রিকেট লিগে অংশ নিয়েছে। ইমরান ফরহাদ, আমির ওয়াসিমরা খেলেছেন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রথম শ্রেণির এই টুর্মামেন্টে।

মূলত প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং মান বাড়াতে এই উদ‌্যোগ নিতে যাচ্ছে আয়োজকরা। যদিও একজন করে বিদেশি ক্রিকেটার খেলানোর নিয়ম প্লেয়িং কন্ডিশনে সব সময়ই ছিল, ছিল সর্বশেষ মৌসুমেও। বিভাগীয় দলগুলো আগ্রহ না থাকায় বিসিবিও জোর দেয়নি। তবে এবার বিসিবি বিদেশি ক্রিকেটারকে যুক্ত করবে। পাশাপাশি তাদের পারিশ্রমিক ও সুযোগ সুবিধার বিষয়টিও দেখভাল করবে।

ঢাকা/ইয়াসিন

সম্পর্কিত নিবন্ধ