মহানবী (সা.) যেভাবে বয়োজ্যেষ্ঠদের যত্ন নিতেন
Published: 29th, July 2025 GMT
মহানবী (সা.) বয়োজ্যেষ্ঠদের যত্ন নিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি নিজে যে নীতি শিখিয়েছিলেন, তা নিজের জীবনে প্রয়োগ করে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
ইসলামে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি দায়িত্বনবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যদি কোনো যুবক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে তাঁর বয়সের কারণে সম্মান করে, তবে আল্লাহ তার বৃদ্ধ বয়সে তাকে সম্মান করার জন্য কাউকে নিযুক্ত করবেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,০২২)
বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করতে তিনি যুবসমাজকে উৎসাহিত করেছেন, যাতে প্রজন্মের মধ্যে দূরত্ব কমে এবং ভালোবাসা ও বোঝাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে। হাদিসে ‘বয়োজ্যেষ্ঠ’ শব্দটি সাধারণভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা জাতি বা ধর্মের সীমাবদ্ধতা ছাড়াই সব বয়োজ্যেষ্ঠের প্রতি সম্মান প্রকাশ করে।
সে আমাদের মধ্যে নয়, যে আমাদের শিশুদের প্রতি দয়া করে না এবং আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান দেখায় না।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১,৯১৯আরেকটি হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ করে বলছি, আল্লাহ দয়াবান ব্যক্তি ছাড়া কারো ওপর তাঁর রহমত প্রদান করেন না।’ সাহাবিরা বললেন, ‘আমরা সবাই দয়াবান।’ নবীজি (সা.
একটি হাদিসে বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মানকে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন: ‘আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধার অংশ হলো শ্বেতকেশী (বয়োজ্যেষ্ঠ) মুসলিমকে সম্মান করা।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৮৪৩)
তিনি আরও বলেছেন: ‘সে আমাদের মধ্যে নয়, যে আমাদের শিশুদের প্রতি দয়া করে না এবং আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান দেখায় না।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১,৯১৯)
ব্যবহারিক উদাহরণনবীজি (সা.) বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান প্রকাশে ব্যবহারিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যুবকের উচিত বয়োজ্যেষ্ঠকে সালাম দেওয়া, পথচারীর উচিত বসে থাকা ব্যক্তিকে সালাম দেওয়া, এবং ছোট দলের উচিত বড় দলকে সালাম দেওয়া।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,২৩১)
তিনি আরও বলেছেন, ‘জিবরিল আমাকে বয়োজ্যেষ্ঠদের অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (আল-ফাওয়াইদ, আবু বকর আশ-শাফিঈ, দারুল কুতুব, বৈরুত: ১৯৮৫, পৃ. ৮৭)
তিনি পানীয় পরিবেশন বা অনুরূপ কাজে বয়োজ্যেষ্ঠদের অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। (মুসনাদে আবু ইয়া’লা, হাদিস: ২,৪১৬)
যুবকের উচিত বয়োজ্যেষ্ঠকে সালাম দেওয়া, পথচারীর উচিত বসে থাকা ব্যক্তিকে সালাম দেওয়া, এবং ছোট দলের উচিত বড় দলকে সালাম দেওয়া।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,২৩১নামাজের ইমামতির ক্ষেত্রেও বয়োজ্যেষ্ঠদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। নবীজি (সা.) বলেছেন: ‘যখন নামাজের সময় হয়, তোমাদের একজন আজান দেবে এবং তোমাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ, তিনি নামাজের ইমামতি করবেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৮৪)
একটি ঘটনায় দেখা যায়, সাহাবি হুওয়াইয়্যিসা, মুহাইয়্যিসা ও আবদুর রহমান নবীজির কাছে কথা বলতে এলে সবচেয়ে কনিষ্ঠ আবদুর রহমান কথা শুরু করেন। নবীজি (সা.) বলেন, ‘বয়োজ্যেষ্ঠকে প্রথমে কথা বলতে দাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৮৪৭)
বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য শরিয়াহর সহজ বিধানবয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য শরিয়াহর বিধান সহজ ও নমনীয় করা হয়েছে। খাওলা বিনতে সা’লাবার ঘটনায় আছে, তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ স্বামী আওস ইবনে আস-সামিত ‘জিহার’ ঘোষণা করেন। কোরআনে জিহারের কাফফারা হিসেবে দাস মুক্তি, দুই মাস উপবাস বা ষাটজন দরিদ্রকে খাওয়ানোর বিধান দেওয়া হয় (সুরা মুজাদিলা, আয়াত: ৩-৪)।
নবীজি (সা.) মুআয ইবনে জাবালকে দীর্ঘ নামাজের জন্য তিরস্কার করেন, কারণ এটি বয়োজ্যেষ্ঠ ও দুর্বলদের জন্য কষ্টকর ছিল।কিন্তু আওসের অক্ষমতা জানতে পেরে নবীজি তাঁকে ষাটজন দরিদ্রকে খাওয়ানোর নির্দেশ দেন এবং নিজে তাঁকে সাহায্য করেন। নবীজি খাওলাকে তাঁর চাচাতো ভাইয়ের (আওস) যত্ন নেওয়ার পরামর্শও দেন। (ইবনে কাসির, তাফসির, দারুল কুতুব, বৈরুত: ২০০০, খণ্ড ৮, পৃ. ২৩৪)
বয়োজ্যেষ্ঠরা রমজানের রোজা রাখতে অক্ষম হলে প্রতিদিনের জন্য একজন দরিদ্রকে খাওয়ানোর বিধান রয়েছে। যারা দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারেন না, তাঁরা বসে বা শুয়ে নামাজ পড়তে পারেন।
নবীজি (সা.) মুআয ইবনে জাবালকে দীর্ঘ নামাজের জন্য তিরস্কার করেন, কারণ এটি বয়োজ্যেষ্ঠ ও দুর্বলদের জন্য কষ্টকর ছিল। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭০৫)
হজের ক্ষেত্রে, বয়োজ্যেষ্ঠরা অন্যকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে পারেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৩৩৩)
আরও পড়ুনপ্রবীণের সম্মান প্রতিষ্ঠায় গোটা সমাজ সম্মানিত হয়০২ অক্টোবর ২০২০নবীজি (সা.)-এর দয়ার উদাহরণবদরের যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের পুত্র আমর বন্দী হন। আবু সুফিয়ান মুক্তিপণ দিতে অস্বীকার করেন এবং বনু আমর ইবনে আওফের বয়োজ্যেষ্ঠ সা‘দ ইবনে নু‘মানকে মক্কায় ওমরাহর সময় বন্দী করেন। নবীজি (সা.) আমরকে মুক্তিপণ ছাড়াই ছেড়ে দেন, যার ফলে সা‘দ মুক্ত হন। (ইবনে হিশাম, আস-সীরাতুন নববিয়্যাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা: ২০০৪, খণ্ড ২, পৃ. ৩৪৫)
নবীজি (সা.) বলেন, ‘তুমি কেন বৃদ্ধকে তাঁর বাড়িতে রেখে আসনি? আমি নিজে তাঁর কাছে যেতাম।’মক্কা বিজয়ের সময় আবু বকর (রা.) তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ পিতা আবু কুহাফাকে নবীজি (সা.)-এর কাছে নিয়ে আসেন। নবীজি (সা.) বলেন, ‘তুমি কেন বৃদ্ধকে তাঁর বাড়িতে রেখে আসনি? আমি নিজে তাঁর কাছে যেতাম।’
তিনি আবু কুহাফাকে সম্মানের সঙ্গে বসান, তাঁর বুকে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান এবং তাঁর শ্বেতকেশ রং করার নির্দেশ দেন। (ইবনে কাসির, আস-সীরাতুন নববিয়্যাহ, দারুল কুতুব, বৈরুত: ১৯৮৮, খণ্ড ৪, পৃ. ২৩৬)
নবীজির বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি আচরণ ইসলামের মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন। তিনি সম্মান, দয়া ও সহজ বিধানের মাধ্যমে তাঁদের মর্যাদা রক্ষা করেছেন। তাঁর শিক্ষা ও গল্পগুলো মুসলিম সমাজের জন্য একটি ব্যবহারিক মডেল, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সংহতি ও করুণার চেতনা ছড়িয়ে দেয়।
আরও পড়ুনসম্মানীকে সম্মান দেওয়ার সৌন্দর্য০২ এপ্রিল ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সহ হ ব খ র ব যবহ র ক আম দ র বল ছ ন র জন য আল ল হ ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।