‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ও ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ কী
Published: 4th, August 2025 GMT
জাতির সামনে আগামীকাল মঙ্গলবার বিকেলে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ উপস্থাপন করবে অন্তর্বর্তী সরকার। অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ব্যস্ত ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ চূড়ান্ত করার কাজে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত দুটি বিষয় ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ও ‘জুলাই জাতীয় সনদ’। এ দুটি বিষয় একই বা কাছাকাছি মনে হলেও আসলে তা নয়। ঘোষণাপত্র ও সনদ দুটি পুরোপুরি আলাদা বিষয়।
সহজভাবে বলা যায়, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ হলো ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের একটি দলিল। যার মাধ্যমে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। অন্যদিকে জুলাই জাতীয় সনদ হলো—রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে ঐকমত্যের একটি রাজনৈতিক দলিল।
গত বছরের জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শুরু হওয়া আন্দোলন এক পর্যায়ে রূপ নেয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ও দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার পতনের পর থেকেই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা ছাত্র, তরুণেরা অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা বলে আসছেন। তাঁরা একাধিকবার নিজেরা এ ঘোষণাপত্র দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। একপর্যায়ে সরকার বিষয়টি নিয়ে সব দলের সঙ্গে বৈঠক করে এবং সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত হয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) শুরু থেকেই এই ঘোষণাপত্রের বিষয়ে সোচ্চার। দলটির নেতারা বিভিন্ন সময় বলেছেন, এই ঘোষণাপত্র না হলে ভবিষ্যতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে ‘অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা দখল’ হিসেবে দেখিয়ে এতে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতা বা এর মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই জায়গা থেকে এ অভ্যুত্থানের একটি স্বীকৃতি দরকার। এ কাজটিই জুলাই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।
জুলাই ঘোষণাপত্রে কী থাকছেজুলাই ঘোষণাপত্রে কী কী থাকছে তার একটি খসড়া সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে। খসড়ায় মোট ২৬টি দফার উল্লেখ আছে। এর মধ্যে প্রথম ২১টিতে সংক্ষেপে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের মানুষের অতীতের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম থেকে শুরু করে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে সংবিধান সংশোধন করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল কায়েমের সমালোচনা করা হয়েছে। ‘পিলখানা ট্র্যাজেডি’ ‘শাপলা চত্বরে গণহত্যা’র বিষয়েও এখানে উল্লেখ আছে।
খসড়া ঘোষণাপত্রের একটি দফায় বলা হয়েছে, জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়।
বাকি দফাগুলোতে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা, আওয়ামী লীগ শাসনামলে গুম-খুন, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধের দ্রুত উপযুক্ত বিচার, আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়েছে।
খসড়ার একটি দফায় বলা হয়েছে,‘ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪—এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। বিশেষত, সংবিধানের প্রস্তাবনায় এর উল্লেখ থাকবে এবং তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সংযুক্ত থাকবে।’
খসড়ায় যেভাবে বলা আছে সেভাবে এটি গৃহীত হলে জুলাই ঘোষণাপত্র ভবিষ্যতে সংবিধানের অংশ হবে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে বিএনপির কিছুটা ভিন্নমত আছে। তারা জুলাই ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের প্রস্তাবনায় না রেখে চতুর্থ তফসিলে রাখার পক্ষে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, এই ঘোষণাপত্র ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর বলে ধরে নেওয়া হবে।
জুলাই সনদ কীগণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনার উদ্যোগ নেয়। ইতিমধ্যে প্রথম ধাপে গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে। যেসব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে, সেগুলো নিয়ে তৈরি করা হবে একটি সনদ। এটিই ‘জুলাই জাতীয় সনদ’। এই সনদেরও একটি খসড়া তৈরি করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
মোটাদাগে, জুলাই জাতীয় সনদের খসড়ায় তিনটি ভাগ আছে। প্রথম অংশে আছে এই সনদের পটভূমি। দ্বিতীয় অংশে কোন কোন সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার উল্লেখ। আর তৃতীয় অংশে থাকছে, সনদ তথা সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার। সেখানে বলা আছে, আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে দলগুলো।
তবে এই অঙ্গীকারের বিষয়ে কোনো কোনো দলের আপত্তি আছে। শুধু এ ধরনের অঙ্গীকার করা হলে শেষ পর্যন্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন কতটা হবে, তা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ অনেকের শঙ্কা আছে। তারা চায় জুলাই জাতীয় সনদকে একটি আইনি ভিত্তি দেওয়া হোক।
সংস্কার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কী হবে, সে বিষয়ে এখন আবার রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরপর চূড়ান্ত করা হবে জুলাই জাতীয় সনদ। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোট অংশ নেয়। সনদে এই দলগুলোর সই করার কথা রয়েছে। আগামী দিনের সংবিধান কেমন হবে, তার রূপরেখা থাকবে এই জাতীয় সনদে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স স ক র প রস ত ব জ ল ই জ ত য় সনদ উল ল খ র একট খসড় য় সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সুপারিশ নিয়ে বিতর্ক, কতটা যৌক্তিক
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের যে সুপারিশ করেছে, তার কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্ক ও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমতের উল্লেখ না থাকা, বিকল্প একটি সুপারিশ অনুযায়ী একপর্যায়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রস্তাবগুলো সংবিধানে যুক্ত হবে—এমন বিষয়ে আপত্তি ও প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি কিছু মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে ভিন্নমত দিয়েছে। দলটির ভিন্নমত অনুসারে সংস্কার বাস্তবায়ন করা হলে খুব বেশি মৌলিক পরিবর্তন আসবে না। অন্যদিকে নির্দিষ্ট সময়ের পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংস্কার প্রস্তাব সংবিধানে যুক্ত করার সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবসম্মত নয়।
গত মঙ্গলবার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিকল্প দুটি সুপারিশ জমা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর পর থেকে এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা হচ্ছে।
শুরু থেকেই জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশ কয়েকটি দলের দাবি ছিল, ভিন্নমত অনুসারে নয়, ঐকমত্য কমিশন যেভাবে প্রস্তাব দিয়েছে বা সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেভাবেই এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।ভিন্নমত নিয়ে বিতর্কজুলাই জাতীয় সনদের ৮৪টি প্রস্তাবের ৪৮টি সংবিধান-সম্পর্কিত। ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে অন্তত ৩৬টিতে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে। ১৭ অক্টোবর যে জুলাই জাতীয় সনদ সই হয়েছে, সেখানে কোন প্রস্তাবে কার ভিন্নমত আছে, তা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘অবশ্য কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা সেইমতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।’
কিন্তু জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ার তফসিলে সংস্কার প্রস্তাবগুলোই শুধু উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে ভিন্নমতের উল্লেখ নেই। আদেশে বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ ‘আদেশের তফসিল-১-এ বর্ণিত জুলাই জাতীয় সনদ’ অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করবে। এর আগে গণভোটও হবে সনদের তফসিলে থাকা প্রস্তাবগুলোর অনুমোদন প্রশ্নে। অর্থাৎ সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভিন্নমত গুরুত্ব পাবে না।
কমিশন মনে করে, রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যই চূড়ান্ত নয়। এখানে জনগণের মতও প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতের সুরক্ষা থাকে।মূল সনদে ভিন্নমত থাকলেও বাস্তবায়নের সুপারিশে এটা না রাখাকে প্রতারণা হিসেবে উল্লেখ করেছে বিএনপি। অন্যদিকে শুরু থেকেই জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশ কয়েকটি দলের দাবি ছিল, ভিন্নমত অনুসারে নয়, ঐকমত্য কমিশন যেভাবে প্রস্তাব দিয়েছে বা সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেভাবেই এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।
জুলাই সনদে ভিন্নমতের কথা উল্লেখ আছে, বাস্তবায়নের সুপারিশে তা না রাখা ঠিক হয়নি বলে মনে করেন সংসদ বিষয়ে গবেষক নিজাম উদ্দিন আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন যেকোনো দল বলতে পারে, এটা উল্লেখ না থাকলে তারা জুলাই সনদে সই করত না। ভিন্নমতের উল্লেখ ছিল বলেই তারা সই করেছে। এখন তারা সুপারিশ না মানলে হয়তো কিছু করার থাকবে না।
ভিন্নমত বাদ কেনঐকমত্য কমিশন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের সমন্বয়ে কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণ করেছে। রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের বড় অংশের মতামত ছিল ভিন্নমত রেখে সনদ বাস্তবায়ন করা হলে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসবে না। কমিশনও সেটাই মনে করে। তা ছাড়া নোট অব ডিসেন্ট হলো একটি সিদ্ধান্তে কারও ভিন্নমতের উল্লেখ। এতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয় না।
সংবিধান সংস্কারের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো কিছু মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন আনা। যেমন ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা; সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি কঠিন করা, যাতে কোনো দল ইচ্ছেমতো তা পরিবর্তন করতে না পারে। এ জন্য বেশ কিছু সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে। যার একটি হলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন। এ পদ্ধতিতে সারা দেশে একটি দল যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে। নিম্নকক্ষে (সংসদ) দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধান সংশোধনী বিল অনুমোদিত হওয়ার পর উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এটি পাস হতে হবে। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ হলে একক দলের ইচ্ছায় সংবিধান সংশোধন কঠিন হবে।
বিএনপি চায় নিম্নকক্ষে পাওয়া আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন। কিন্তু এভাবে উচ্চকক্ষ গঠন করা হলে সেটি হবে নিম্নকক্ষের অনুলিপি। এতে উচ্চকক্ষ গঠনের মূল লক্ষ্য পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এতে শুধু সংসদ সদস্যের সংখ্যা এবং রাষ্ট্রের ব্যয় বাড়বে। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনাতেও বিষয়টি এভাবে উঠে এসেছিল।
অনেকে মনে করেন, বেশির ভাগ দল ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় তাদের দলীয় অবস্থান ও আদর্শ বিবেচনায় প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সংবিধান শুধু কোনো দলের চিন্তার বিষয় নয়। সংবিধান হলো জনগণের অভিপ্রায়। তাই এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার জনগণের হাতে ছেড়ে দিতে প্রস্তাবগুলো ভিন্নমত ছাড়া গণভোটে দেওয়ার সুপারিশ যৌক্তিক।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ৪৮টি প্রস্তাবের ৩০টির মধ্যে দলগুলোর একধরনের ঐকমত্য আছে। বাকিগুলোতে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে। কিন্তু কমিশন মনে করে, রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যই চূড়ান্ত নয়। এখানে জনগণের মতও প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতের সুরক্ষা থাকে।
সংবিধানে কিছু কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে পারেসংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প সুপারিশ করা হয়েছে। একটিতে বলা হয়েছে, প্রথমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ জারি করা হবে। এর ভিত্তিতে হবে গণভোট। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। এ সময়ে সংস্কার করতে সংসদ ব্যর্থ হলে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে। এর জন্য সংস্কার প্রস্তাবগুলো সংবিধান সংস্কার বিল (সংবিধান সংশোধনে আইনের খসড়া) আকারে আদেশের তফসিলে থাকবে। আরেকটি বিকল্প সুপারিশের কাঠামোও একই। কিন্তু সেখানে ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন না হলে কী হবে, তার উল্লেখ নেই। এখানে তফসিলে থাকবে শুধু সংস্কার প্রস্তাব।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সংবিধানে কোনো কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে পারে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। কোন প্রক্রিয়ায় এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে, সেটাও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে কোনো কিছু যুক্ত হওয়ার বিধানও বিদ্যমান সংবিধান অনুমোদন করে না। অবশ্য জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ গণভোটে পাস হলে এই বিধান গণভোটের মাধ্যমেও ভিত্তি পাবে।
তবে সুপারিশের এ অংশ বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন সংসদ বিষয়ে গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে কিছু যুক্ত হতে পারে—এমন বিধান কোথাও আছে বলে তাঁর জানা নেই। সংবিধানে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।
ঐকমত্য কমিশন গিলোটিন প্রসিডিউরের ধারণা থেকে এই বিধান সুপারিশ করেছে। এটি হলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিতর্ক শেষ না হলে আলোচনা বন্ধ করে দিয়ে বিল পাস করানো।
এ বিষয়ে নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, গিলোটিনের চর্চা সাধারণত অর্থবিলে হয়ে থাকে। সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এ ধারণা প্রয়োগ করা ঠিক হবে না।
বিল তৈরিতে জটিলতা হতে পারেসংস্কার প্রস্তাবগুলোকে বিল আকারে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রেও জটিলতা আছে। কারণ, সনদের কয়েকটি প্রস্তাব সুনির্দিষ্ট ও চূড়ান্ত নয়। যেমন বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ করা হবে। সেখানে কী কী থাকবে, তা সুনির্দিষ্ট নয়। সনদে বলা আছে, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ-সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রস্তাবগুলো ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে, যাতে রাজনৈতিক দলের নেতারা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেন এবং ভবিষ্যতে জনপ্রতিনিধিরা সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও আইনি বিধানাবলি পরিবর্তন করতে পারেন।
তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মৌলিক অধিকারের বিষয়টি কীভাবে গণভোটের বিলে যুক্ত করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। মৌলিক অধিকারে কী কী থাকবে, সেটা কে নির্ধারণ করবে, কীভাবে নির্ধারণ করবে?
প্রক্রিয়াগত জটিলতাসংসদে একটি বিল পাস হওয়ার পর তাতে সই করেন স্পিকার। এরপর সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠায় সংসদ সচিবালয়। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর তা আইনে পরিণত হয়। এ প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার বিধান হাস্যকর।
সংবিধান সংস্কারবিষয়ক প্রস্তাবগুলো গণভোটে পাস হলে সেগুলো যাবে সংসদে (সংবিধান সংস্কার পরিষদ)। বিল সংসদে পাস হবে কি না, তা মূলত নির্ভর করবে সরকারি দল তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ওপর। কারণ, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, কোনো সংসদ সদস্য নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। সংসদের স্পিকারও হবেন সরকারি দল থেকে। রাষ্ট্রপতিও হবেন সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থী।
সরকারি দল না চাইলে ২৭০ দিনের মধ্যে বিলটি পাস হবে না। ২৭০ দিন পর বিলটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর উদ্যোগ কে নেবে, রাষ্ট্রপতি এটিতে সই করবেন কি না, গেজেট কীভাবে প্রকাশিত হবে—এ প্রক্রিয়া পরিষ্কার নয়।
তবে নানা প্রশ্ন থাকলেও সনদ বাস্তবায়ন হবে এ নিশ্চয়তা বিধান করতেই মূলত স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হবে—এমন সুপারিশ এসেছে। কারণ, অনেকে মনে করেন এ রকম বিধান না থাকলে সংস্কারের পরিণতি হবে নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের পর তিন জোটের রূপরেখার মতো। কয়েকটি দলও সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা চেয়েছে।
এখানে আরেকটি বিকল্প আলোচনায় ছিল, সেটা হলো ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার বাস্তবায়ন না হলে সংসদ বিলুপ্ত হবে। কিন্তু এটি রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না এবং এটি ভবিষ্যতে সংকট তৈরি করতে পারে, এমন বিবেচনায় সেটা রাখা হয়নি বলে কমিশন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়নে কমিশন দুটি বিকল্প দিয়েছে। এর একটিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাতে দ্রুত সংস্কার সম্পন্ন করা যায়, সে জন্য এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আরেকটা বিকল্প পথও বলা হয়েছে। সরকার সেটাও নিতে পারে। তিনি বলেন, সংসদীয় ব্যবস্থায় গিলোটিন প্রসিডিউরের ধারণা থেকে তাঁরা প্রথম বিকল্পের সুপারিশ করেছেন। তবে কমিশনের দৃঢ় বিশ্বাস, এত দূর যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। সংসদে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সংস্কার সম্পন্ন করবে দলগুলো।