ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধে আমেরিকার লাভ-ক্ষতি
Published: 2nd, February 2025 GMT
প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার এক সপ্তাহ না পেরোতেই ট্রাম্প ঘোষণা করেন, অবৈধ কলম্বিয়ান অভিবাসীদের সামরিক বিমানে করে বোগোতায় ফেরত পাঠানো হবে। জবাবে কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেদ্রো আহ্বান জানান, তাঁর দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্র যেন সম্মানের সঙ্গে ফেরত পাঠায়। প্রয়োজনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর প্রেসিডেন্সিয়াল বিমান পাঠাবেন। ক্ষিপ্ত ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম মারফত হুমকি দেন, কলম্বিয়ার সব রপ্তানি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে। এক সপ্তাহ পর শুল্কহার দ্বিগুণ বাড়ানো হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পেদ্রো পাল্টা হুমকি দেন, মার্কিন পণ্যের ওপর কলম্বিয়াও ২৫ শতাংশ শুল্ক ধার্য করবে।
কলম্বিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধ নিশ্চিতভাবেই দেশটির অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। ট্রাম্প সেই হিসাব কষেই শুল্ক আরোপ ও ভিসা নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখিয়ে কলম্বিয়াকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিলেন। কলম্বিয়া শক্ত অবস্থান নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রও সুর নরম করেছে। কেননা, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি কেবল মার্কিন বাজারে পণ্য রপ্তানিকারী দেশগুলোকে চাপে ফেলবে না, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও বুমেরাং হতে পারে। তেমনটাই মনে করছেন হালের খ্যাতিমান বিশ্লেষক ও রকফেলার ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান রুচির শর্মা। তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো, বৈশ্বিক বাণিজ্যের কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরে যাচ্ছে। নতুন কেন্দ্র হওয়ার দৌড়ে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থাকলেও এগিয়ে আছে চীন। সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ১০টি বাণিজ্য করিডোরের মাত্র দুটোর সঙ্গে সংযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিদ্বন্দ্বী চীন পাঁচটি করিডোরের সঙ্গে যুক্ত।
ট্রাম্প ও বাইডেন দু’জনেই ট্যারিফ আরোপ করে মার্কিন প্রতাপ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছেন। গত আট বছরে যুক্তরাষ্ট্র নতুন কোনো দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তিও স্বাক্ষর করেনি। এদিকে তাদের প্রতিবেশী ও নাফটার অন্যতম শরিক মেক্সিকো লাতিন আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে উদ্যোগী হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আটটি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। দক্ষিণ আমেরিকার বাণিজ্য ব্লক মার্কোসুরের সঙ্গে ২৫ বছর ধরে তাদের আলোচনা চলছিল। ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর দেরি করেনি। তড়িঘড়ি করে মার্কোসুরের সঙ্গে সমঝোতা চূড়ান্ত করে। ট্রাম্প ও বাইডেনের আমলে চীনও ৯টি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে, ট্যারিফকে অস্ত্র বানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মূল প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে চাপে ফেলতে তো পারেইনি, বরং তাদের মিত্র দেশগুলোকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো, এআই জগতে ডিপসিকের আকস্মিক উত্থান।
সেমিকন্ডাক্টর খাতে চীনকে রুখতে বাইডেন প্রশাসন গত তিন বছরে তিনটি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে এনভিডিয়ার মতো চিপ প্রস্তুতকারী মার্কিন কোম্পানিগুলো সর্বাধুনিক মডেলের চিপ চীনে রপ্তানি করতে পারত না। স্বল্প পরিচিত চীনা স্টার্টআপ ডিপসিক পুরোনো ও কম উন্নত মডেলের চিপ ব্যবহার করে একটি এআই মডেল উদ্ভাবন করেছে। মাত্র সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে উদ্ভাবিত এআই মডেল বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে উদ্ভাবিত ওপেনএআইর চ্যাটজিপিটি ও গুগলের জেমিনির সমকক্ষ। এ ঘটনা প্রত্যাশিতভাবেই মার্কিন শেয়ারবাজার ও সিলিকন ভ্যালিতে শোরগোল তুলে দিয়েছে। শেয়ারমূল্যে ধস নামায় এক দিনে এনভিডিয়ার বাজার মূলধন কমেছে ৬০০ বিলিয়ন ডলার! এনভিডিয়ার একজন শীর্ষ এআই গবেষক ও ওপেনএআইর সাবেক কর্মী জিম ফ্যান বলেছেন, ওপেনএআই গবেষণার পথ সবার জন্য খুলে দিতে চেয়েছিল। সেই চেতনা বাঁচিয়ে রাখল আমেরিকার বাইরের একটি কোম্পানি।
ডিপসিকের রেশ কাটার আগেই আলিবাবা ঘোষণা দিয়েছে, তারা আরও উন্নত এআই মডেল উদ্ভাবন করেছে। কেবল তথ্যপ্রযুক্তি খাতেই নয়, শিল্পপণ্যের ব্যবসাতেও শুল্ক-অস্ত্র প্রয়োগ করে চীনের অগ্রগতি রুখতে ব্যর্থ হয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। বাইডেন চীনা বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর শুল্কহার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০০ শতাংশে উন্নীত করেন। তবুও ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তে গিয়ে দেখা গেল, বিশ্বজুড়ে বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারের ৭৬ শতাংশ চলে গেছে চীনের দখলে।
যুক্তরাষ্ট্র শুধু আর্থিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না; রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভূরাজনীতির ময়দানেও পিছিয়ে পড়ছে। ২০২৩ সালে প্রকাশিত ‘আন্ডারগ্রাউন্ড এম্পায়ার: হাউ আমেরিকা ওয়েপনাইজড দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমি’ বইতে বিষয়টির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। বইটির লেখকদ্বয় জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেনরি ফ্যারেল ও জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্রাহাম নিউম্যান দেখিয়েছেন, নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে প্রয়োগকৃত নিষেধাজ্ঞা প্রকারান্তরে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ দেশের পক্ষেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার জাল এড়ানো অত্যন্ত কঠিন। পরিণতিতে বিশ্বের নানা প্রান্তে বিকাশমান অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কগুলো থমকে গেছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের অনুসন্ধান অনুযায়ী (২৫ জুলাই ২০২৪), পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র মোট ১৫ হাজার ৩৭৩টি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে, যা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি। আর দরিদ্র দেশগুলোর ৬০ শতাংশই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার শিকার। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করছে। মার্কিন আধিপত্য থেকে মুক্ত হতে ব্রিকস-ভুক্ত দেশগুলো লেনদেনের জন্য যদি ডলারের বিকল্প মুদ্রা বেছে নেয়, ট্রাম্প তাদের ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন।
অর্থাৎ বিশ্বায়নের সবচেয়ে প্রবল সমর্থক যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য উদারীকরণের পরিবর্তে রক্ষণশীল নীতির পথে হাঁটছে। তবে শুল্ক-অস্ত্র এবং নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা অভীষ্ট ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন। সেই সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রভাব দুটোই মারাত্মক হুমকির মুখে।
রেজওয়ানুর রহমান কৌশিক: লেখক ও গবেষক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প কলম ব য় র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
ইউরোপে পাইলটদের বেতন কোন দেশে কত
ইউরোপে সবচেয়ে বেশি বেতনের পেশার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে পাইলট। ফ্রান্সে এটি পঞ্চম সর্বোচ্চ মাসিক বেতনের পেশা। জার্মানিতে জটিল ভূমিকার পাইলটেরা মাসে ২৮ হাজার ৯৬ ইউরো উপার্জন করেন। যুক্তরাজ্যে পূর্ণকালীন পাইলট ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা মধ্যম আয়ে পঞ্চম স্থানে। ডেনমার্কে ২০২৩ সালে মাসিক বেতন ১৩ হাজার ৫২৩ ইউরো, দেশটির হিসাবে সপ্তম সর্বোচ্চ বেতন।
অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বেতনের বৈচিত্র্য
পাইলটদের বেতন দেশ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়। যুক্তরাজ্যে বেতন শুরু হয় বছরে ৫৪ হাজার ২৮৩ ইউরো (৪৭,০০০ পাউন্ড) থেকে, অভিজ্ঞ পাইলটদের জন্য এটি প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ২৪৩ ইউরো (১ ইউরো সমান ১৪১ টাকা ৭৭ পয়সা, ২২ অক্টোবর ২০২৫ হিসাবে) পর্যন্ত হতে পারে, জানিয়েছে ব্রিটিশ ন্যাশনাল ক্যারিয়ার্স সার্ভিস।
ইআরআই অর্থনৈতিক গবেষণা ইনস্টিটিউট জানায়, আট বছরের বেশি অভিজ্ঞতার পাইলটরা এক থেকে তিন বছরের অভিজ্ঞ পাইলটের চেয়ে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ বেশি আয় করেন। অর্থাৎ অভিজ্ঞ পাইলটরা প্রায় তিন গুণ বেশি উপার্জন করেন।
আরও পড়ুনফ্রিল্যান্সিংয়ে নামার আগে এ পাঁচটি বিষয় ভাবুন১৯ অক্টোবর ২০২৫দেশভিত্তিক তথ্যযুক্তরাজ্য
২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এএনএসের তথ্যানুসারে, পূর্ণকালীন ‘এয়ারক্রাফট পাইলট ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার’-এর বার্ষিক আয় প্রায় ৯৫ হাজার ২৪০ ইউরো (৮০,৪১৪)। ইআরআইয়ের মতে, গড় বার্ষিক বেতন ৯০ হাজার ২৫৩ ইউরো (৭৮,১৪৬ পাউন্ড), লন্ডনের জন্য ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৬২ ইউরো (১০০,০৬০ পাউন্ড)।
জার্মানি
জার্মানির ফেডারেল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিসের তথ্যমতে, গড় মাসিক বেতন ১২ হাজার ৫৬৬ ইউরো (বার্ষিক ১,৫০,৭৯২ ইউরো)। মধ্যম আয় ১০ হাজার ২০৭ ইউরো (বার্ষিক ১,২২,৪৮৪ ইউরো), অভিজ্ঞ ও বিশেষায়িত পাইলটদের ক্ষেত্রে তা ৩ লাখ ৪২ হাজার ৭২ ইউরো পর্যন্ত হতে পারে। ইআরআইয়ের তথ্য অনুসারে, এক থেকে তিন বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পাইলটের গড় বেতন ৭৩,৭৮৫ ইউরো, আট বছরের বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পাইলটদের জন্য ১ লাখ ৩২ হাজার ১১৭ ইউরো।
ফ্রান্স
INSEE জানায়, ‘সিভিল এভিয়েশন টেকনিক্যাল ও কমার্শিয়াল ফ্লাইট অফিসার’দের গড় মাসিক বেতন ৯ হাজার ৩০০ ইউরো (বার্ষিক ১,১১,৬০০ ইউরো)। ERI অনুসারে, অভিজ্ঞ পাইলটদের জন্য গড় বেতন ১ লাখ ৯ হাজার ২৯২ ইউরো।
ছবি: এমিরেটসের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া