দিল্লিতে ‘হাত’ ধরলে ‘ঝাড়ু’র বিদায় হতো না
Published: 9th, February 2025 GMT
ভারতের দিল্লি বিধানসভার ভোটে ২৭ বছর পর বিজেপি কীভাবে ও কেন জিতল, আম আদমি পার্টির (আপ) এমন সশব্দ পতনই–বা কেন ঘটল, তা নিয়ে নানা তত্ত্বের মধ্যে সহজ পাটিগণিত দেখাচ্ছে, কংগ্রেস ও আপ জোটবদ্ধ হয়ে লড়লে অন্তত ৩৬টি আসন জিতে তারাই সরকার গড়তে পারত। বিজেপির স্বপ্ন থাকত অধরা।
রাজনীতির রসায়ণ ও পাটিগণিতে বিস্তর ফারাকের কথা সবার জানা। তবু সত্য এ–ই, লোকসভা ভোটের সময় দিল্লিতে বিজেপিকে হারাতে তড়িঘড়ি যে জোট কংগ্রেস ও আপ করেছিল এবং ব্যর্থ হয়েছিল, দ্রুত তা ভেঙে না দিয়ে পারস্পরিক অভিযোগ, মনোমালিন্য ও বিবাদ সরিয়ে দেওয়া–নেওয়ার ভিত্তিতে সম্মানের সঙ্গে সেই জোট ধরে রাখলে বিধানসভা ভোটের ফল বদলে যেতে পারত।
জোর দিয়ে এ কথা বলা যাচ্ছে; কারণ, চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর দেখা যাচ্ছে, ৭০ আসনের মধ্যে ১৪টিতে বিজেপির জয়ের ব্যবধান থেকে আম আদমি ও কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা বেশি। অর্থাৎ সহজ কথায়, কংগ্রেস ও আপ যৌথভাবে বিজেপি প্রার্থীর তুলনায় ওই ১৪ কেন্দ্রে বেশি ভোট পেয়েছে।
কেন্দ্রগুলো হলো নিউদিল্লি, জংপুরা, গ্রেটার কৈলাস, মালবিয়ানগর, রাজেন্দ্রনগর, টিমারপুর, বাদলি, নাংলোই জাট, মাদিপুর, মেহরৌলি, ছত্তরপুর, সঙ্গমবিহার, ত্রিলোকপুরী ও কস্তুরবানগর।
নিউদিল্লি কেন্দ্রে ইন্দ্রপতন ঘটেছে আম আদমি প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল হেরে যাওয়ায়। তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী করেছিল দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সাহেব সিং ভার্মার পুত্র প্রভেশকে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রভেশের বিরুদ্ধে বহু সময় লোক খ্যাপানোর অভিযোগ উঠেছে। ঘৃণাভাষণের দায় চেপেছে। ওই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী করেছিল তাদের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত শীলা দীক্ষিতের পুত্র সন্দীপকে, যিনি রাজ্য রাজনীতিতে প্রবলভাবে কেজরিওয়ালবিরোধী বলে পরিচিত এবং লোকসভা ভোটে জোটের বিরোধিতায় সরব ছিলেন। ভোটের ফল ঘোষণার পর দেখা যাচ্ছে, কেজরিওয়াল হেরেছেন ৪ হাজার ৯৯ ভোটে, অথচ সন্দীপ পেয়েছেন ৪ হাজার ৫০৪ ভোট। পাটিগণিতের হিসাব দেখাচ্ছে, এই ভোট কেজরিওয়াল পেলে জিতে যেতেন ৪০৫ ভোটে।
একই ছবি জংপুরাতেও। এখানে হেরেছেন আপের সাবেক উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়া। বিজেপির তারবিন্দর সিং মারোয়ার কাছে তিনি হেরেছেন মাত্র ৬৭৫ ভোটে। অথচ ওই কেন্দ্রে কংগ্রেসের ফরহাদ সুরি পেয়েছেন ৭ হাজার ৩৫০ ভোট। দক্ষিণ দিল্লির গ্রেটার কৈলাসে হেরেছেন আপের মন্ত্রী সৌরভ ভরদ্বাজ। তাঁকে হারিয়েছেন বিজেপির কাউন্সিলর শিখা রায়। শিখা জিতেছেন ৩ হাজার ১৮৮ ভোটে, অথচ কংগ্রেস প্রার্থী গরবিত সিংভি পেয়েছেন ৬ হাজার ৭১১ ভোট। মালভিয়ানগরেও একই ছবি। সেখানে হেরেছেন কেজরিওয়ালের আর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী সোমনাথ ভারতী। বিজেপির প্রার্থীর কাছে তিনি হেরেছেন মাত্র ২ হাজার ১৩১ ভোটে। অথচ ওই কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী জিতেন্দ্র কুমার কোচার পেয়েছেন ৬ হাজার ৭৭০ ভোট। আপ নেতৃত্ব ও বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার রাখি বিড়লা দাঁড়িয়েছিলেন মঙ্গলাপুরী কেন্দ্রে। সেখান থেকে পরপর তিনবারের এমএলএ তিনি। বিজেপির কৈলাস গাঙ্গোয়ালের কাছে তিনি ১০ হাজার ৮৯৯ ভোটে হেরে যান। ওই কেন্দ্র তৃতীয় হন কংগ্রেসের জে পি পানোয়ার। তিনি পেয়েছেন ১৭ হাজার ৯৫৮ ভোট। রাজেন্দ্রনগরে আপ প্রার্থী ছিলেন দুর্গেশ পাঠক। বিজেপির উমঙ্গ বাজাজের কাছে তিনি হেরেছেন মাত্র ১ হাজার ২৩১ ভোটে। কংগ্রেসের বিনীত যাদব ওই কেন্দ্রে পেয়েছেন ৪ হাজার ১৫ ভোট। সঙ্গমবিহারে আম আদমির বিধায়ক দীনেশ মোহানিয়া বিজেপির চন্দন চৌধুরীর কাছে হেরেছেন ৩৪৪ ভোটে। সেখানে কংগ্রেসের হরিশ চৌধুরী পান ১৫ হাজার ৮৬৩ ভোট।
এই একই ছবি দেখা গেছে বাদলি, ছত্তরপুর, মেহরৌলি, নাংলোই জাট, টিমারপুর ও ত্রিলোকপুরীতে। কস্তুরবানগর কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী দ্বিতীয় হয়েছেন ১১ হাজার ৪৮ ভোটের ব্যবধানে। আপের ভোট পেলে কংগ্রেস ওই আসনে জিততেও পারত।
এ কথা ঠিক, আড়াই থেকে তিন বছর ধরে উন্নয়ন ও প্রশাসনের দিকে নজর না দিয়ে আপ ক্রমাগত ঝগড়া করে গেছে উপরাজ্যপালের সঙ্গে। এই সময়ে দুর্নীতির কালি লেপে গেছে আপের ভাবমূর্তিতে। আবগারি (মদ) কেলেংকারির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘শিসমহল’। সৎ ও স্বচ্ছ রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা কেজরিওয়াল ও তাঁর দল তত দিনে আর পাঁচটা দলের রূপ ধারণ করেছে। মাত্রা ছাড়া বায়ুদূষণ, পানীয় জলের অভাব, জঞ্জাল সমস্যা ও যমুনা নদীর দূষণের কারণে সাধারণ মানুষের বিরক্তি ঝরেছে এই সময়ে। আপ নেতৃত্বকে সবদিক দিয়ে ব্যতিব্যস্ত রেখে সেই সুযোগে বিজেপি তার সাংগঠনিক প্রভাব বিস্তার করেছে দিল্লিতে। আপের দুর্গ বলে পরিচিত ঝুগ্গি–ঝোপড়ি এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেছে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মহলে আপেরই মতো দানখয়রাতের প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, যে আরএসএস লোকসভা ভোটে বিজেপির দিকে সহায়তার হাত সেভাবে বাড়ায়নি, মান অভিমান পর্ব শেষে সেই আরএসএসকে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব এবার সক্রিয় করে তুলেছে। এসবের মধ্যে সোনায় সোহাগা হয়েছে আপ ও কংগ্রেসের ক্রমবর্ধমান রেষারেষি। লড়াইটা তীব্রভাবে ত্রিমুখী হয়ে ওঠায় বিজেপিও স্বস্তির শ্বাস ফেলেছে।
না ফেলে উপায়ও ছিল না। ১৪ আসন জিতে গেলে ৩৬টি আসন পেয়ে আপ–কংগ্রেসের ‘ইন্ডিয়া’ জোটই দিল্লিতে ক্ষমতায় আসত। প্রাপ্ত ভোটের হিসাবেও বিজেপি পড়ত অনেক পিছিয়ে। ৭ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে বিজেপি এবার পেয়েছে ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ। সেখানে আপের ভোট ১০ শতাংশ কমে হয়েছে ৪৩ দশমিক ৮। মজার বিষয় এ–ই, জোট থাকলে আপের সঙ্গে কংগ্রেসের সাড়ে ৬ শতাংশ ভোট যোগ হতো। বিজেপির চেয়ে ‘ইন্ডিয়া’ তাহলে এগিয়ে থাকত ৫ শতাংশ ভোটে। দিল্লিও অধরা থাকত বিজেপির কাছে। হারের হ্যাটট্রিক এড়াতে পারতেন না নরেন্দ্র মোদি।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।