পাখিদের বিধানসভা ও আত্ম-অন্বেষণের শৈল্পিক অভিযাত্রা
Published: 20th, February 2025 GMT
এ সভার ঘটনাবলি যেন একটি উল্টা পুরাণ, যা মানুষের জীবন থেকে ধার করা বয়ান নিয়ে পাখিদের আত্মিক অনুসন্ধানের যাত্রার বয়ান। আমরা যখন চীন-জাপানের রূপকথায় দেখতে পাই চাঁদ-সুরুজ, ড্রাগন-দেবদূত, প্রাণী-লতাপাতার জীবনের গল্প-সংলাপ দিয়ে মানুষের নৈতিকতা শিক্ষার গল্প। এ গল্পও ঠিক একই ধরনের কাল্পনিক অভিযাত্রার বর্ণনা।
গত ৭-১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় এ রকম একটি মরমি নাট্য প্রদর্শিত হলো। পারস্যের মরমি কবি ফরিদুদ্দিন আত্তারের ‘মানতিকুত তায়ের’ কাব্য অবলম্বনে এ-সময়ের জীবন, রাজনীতি ও আত্মঅভিঘাতের এক দুঃসাহসী প্রয়াস, যার নাট্যরূপ দিয়েছেন ড.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের প্রযোজনা এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা হলেও নাটকের মঞ্চ রূপায়ণ, অভিনয়ের ভাষা ও অনূদিত দক্ষতা প্রশংসার দাবিদার। নাটকের অভিনয়, আলোকসম্পাত, মঞ্চ, পোশাক, সাজ-সরঞ্জামের সুবিন্যস্ত ব্যবহার দেশজ পরিবেশনা শিল্পকে নতুন উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশের নাট্যনির্মাণ কৌশলের প্রথাগত ধারা কোথাও কোথাও ভেঙে দিয়ে দক্ষতা ও সৃজনী মেধার নতুন চিন্তাকে উস্কে দেয়, সে সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুণপনা যে প্রথাসিদ্ধ প্রতিবেশকে অনাবৃত করে এবং বিশ্বনাট্যের আস্বাদনে বিমোহিত করে, তার নমুনা পাওয়া গেল।
নাটকের মূল উপপাদ্য মূলত আত্মিক অনুসন্ধানের উদযাপন, যা কঠিন ও তিতিক্ষাময়। বিশেষ করে জাগতিক জীবনের দাসত্ব-ধারণা ও আত্মার মুক্তি, ভয় ও নির্ভয়ের দ্বন্দ্ব, প্রেম ও প্রতারণার মন বিকিরণ, মৃত্যুর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা, সংকীর্ণ মনের স্থবিরতা, সত্যের ভেতর দিয়ে নতুন মহাসত্যের উন্মোচন, পাখির ডানার শক্তি ও তাঁর সম্ভাবনা, মানবিকীকরণের ভেতর দিয়ে নিজকে আবিষ্কার এবং অপরাজেয় সাহসিকতার সরল পথের আভিযাত্রিক বোধ নতুনভাবে বেঁচে ওঠার স্বপ্ন জাগায়।
আলোর সঙ্গে ডানা প্রসারণের যে সম্পর্ক, তার সঙ্গে নৈসর্গিক সুর অনুপম মুগ্ধতা দান করেছে। ড. সাইদুর রহমান লিপনের আবহ সংগীত এবং ধীমান চন্দ্র বর্মণের আলোক নির্দেশনা যেন এ পাখিদের ডানার হাওয়া কিংবা দমের নির্ভরতা দিয়ে কুশীলবদের। প্রতিটি পাখি প্রজাতির শরীরের সক্ষমতার সঙ্গে মানুষের জীবনধারায় যে কতটা সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, এবং মানুষের জীবনের নানা ঐতিহাসিক ঘটনাবলির ভেতর ভুলকে শোধরে নেওয়ার কত যে জ্ঞান ও অনুধাবনের ইশারা রয়েছে, তা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে।
সুফি মতবাদের উসুলে সাবা বা সপ্তকর্মের অভিজ্ঞতার আলোকে মানুষের মুক্তি সম্ভব, আবার এ মুক্তির সঙ্গে মানুষের স্বপ্ন কিংবা লক্ষ্যের মিল না-ও থাকতে পারে। তবুও জীবনকে দহন করেই খাঁটিত্ব অর্জন করতে হয়, সেই উত্থান কিংবা উৎসে ফেরার ইতিহাস নাট্য-বিনির্মাণের পরতে পরতে প্রস্ফুটিত হয়েছে। এ ভাবনাকে নির্দেশকের ভাষায় বলা হয়েছে ‘নাটকটি শুধু একটি মঞ্চ-প্রযোজনা নয়, এটি আমাদের আধ্যাত্মিক যাত্রার এক প্রতীকী উপস্থাপন’। নাট্যকার অন্যভাবে বলেছেন ‘এই নাটক হয়ে উঠেছে আমাদের সময়ের সম্মিলিত রুহের শিহরণ-কম্পিত আধ্যাত্মিকতার এক রাজনৈতিক নাটলিপি’।
দারুল ইরফান রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পৃষ্ঠপোষকতা মঞ্চের আর্থিক সীমাবদ্ধতাকে উতরে দিতে বেশ সহায়ক হয়েছে। বাংলার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় ঘোর লাগা মানুষের দিশাহীন অভিগমনে নুয়ে পড়েছে সমাজ ও জীবনের নৈতিক প্রতিবেশ, মনের ভেতর অহর্নিশি সংশয় ও অস্থিরতা, সেখানে এ প্রযোজনা একটু প্রশান্তি দিয়েছে, থিতু হবার উপায় রেখেছে। মরমিবাদ সে কারণেই হাজার বছর ধরে লোকসমাজের কাছে প্রশ্রয়ের চাঁদোয়া হিসেবে টিকে আছে। গ্রামবাংলার দরগা-আখড়া মাজারে আত্মান্বেষণের সাধনা নানা ভঙ্গিতে টিকে আছে, সেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে উদযাপিত হয়, কিন্তু এ মহাশহরের মানুষেরা কেন ভেতরের বৈষয়িকতা ও আত্মানুশীলনের চর্চা থেকে দূরে থাকে? এ নাট্য প্রচেষ্টা সে প্রশ্নেরও মুখোমুখি দাঁড় করায় বারবার।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
জামিন দেওয়াকে কেন্দ্র করে আদালতে হাতাহাতি, স্টেনোগ্রাফার আহত
লক্ষ্মীপুরে আদালতে একটি জামিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজন বিচারকের আদালত বর্জন করেছে আইনজীবীরা। এ সময় আইনজীবীদের সাথে আদালতের কর্মচারীদের হাতাহাতি ও এজলাসে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এতে আহত হন ওই এজলাসের স্টেনোগ্রাফার আশরাফুজ্জামান।
রবিবার (১৫ জুন) দুপুর ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। আদালত বর্জন করায় ভোগান্তিতে পড়েন বিচারপ্রার্থীরা।
জানা গেছে, রায়পুর প্রিন্সিপাল কাজী ফারুকী স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আহম্মেদ কাউসার উদ্দিন জামান (৩৫) এর বিরুদ্ধে গত ৬ জুন সদর থানায় চুরির মামলা দায়ের করেন তারই প্রতিবেশি জেলা জজ আদালতের আইনজীবী আবু তৈয়ব। মামলায় আরও দুইজনকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় আসামি কাউসার ও রুবেল গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন। এরপর গত ১০ জুন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৩ এর বিচারক এম সাইফুল ইসলাম তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। এ নিয়ে তাৎক্ষণিক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দসহ আইনজীবীরা।
মামলায় অভিযোগ আনা হয়, বাদী এবং আসামিদের মধ্যে পূর্ব বিরোধ রয়েছে। ৫ জুন দিবাগত গভীর রাতে আসামিরা পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে বাদীর ভবনের সামনে থাকা একটি লোহার গেট কেটে নিয়ে এবং গেটের পিলার ভেঙে একটি পিক-আপ গাড়িতে করে রায়পুরের দিকে নিয়ে যায়। রায়পুর বাসাবাড়ি এলাকায় গেলে পিকআপ গাড়িটি টহল পুলিশ আটক করে। পরে গাড়িটি জব্দ ও চালক রুবেলকে আটক করে পুলিশ। মামলায় বাদী আড়াই লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
আদালত সূত্র জানায়, গত ৯ জুন আসামিদের জামিন প্রার্থণা করা হয়। এতে আসামিপক্ষ উল্লেখ করেন, মামলার বাদি আইনজীবী হওয়ায় আদালতে তাদের পক্ষে কোন আইনজীবী জামিন শুনানিতে অংশ নিতে ইচ্ছুক নয়। আসামিরা তাদের পক্ষে আইনজীবী না পেয়ে জামিন শুনানির জন্য লক্ষ্মীপুর লিগ্যাল এইড অফিসে আইনি সহায়তা চান। সেখান থেকে দুইজন আইনজীবীকে শুনানি করতে বলা হলেও তারা অন্য আইজীবীদের দ্বারা হেনস্তার ভয়ে জামিন শুনানিতে অংশ নেননি। অন্যদিকে বাদী পক্ষের আইনজীবী আসামিদের বিরুদ্ধে জামিনের বিরোধিতা করেন।
আদালত সূত্র আরও জানায়, আসামিরা ৯ জুন জামিনের জন্য আবেদন করলে পরদিন ১০ জুন নথি প্রাপ্ত সাপেক্ষে জামিন শুনানির জন্য রাখা হয় এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন।
বিষয়টি নিয়ে আদালতের পর্যালোচনায় উঠে আসে, ঈদুল আজহার বন্ধে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এবং গ্রেপ্তারের পর থেকে আসামিরা জামিনের শুনানির সুযোগ পাননি। চারদিন তাদের হাজতবাস হয়েছে। ৬ জুন আসামি গ্রেপ্তার হলেও বাদী একজন আইনজীবী হওয়ায় আসামিরা জামিন শুনানির জন্য কোন আইনজীবী পাননি এবং লিগ্যাল এইড অফিসের আইনজীবীরাও শুনানিতে অংশ নিতে অনীহার বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ায় ১৪ জুন পর্যন্ত ঈদের ছুটিতে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় জামিন অযোগ্য ধারায় গুরুতর অভিযোগ না থাকায় উভয় পক্ষের শুনানি অন্তে উভয় দরখাস্ত নিষ্পত্তি করা হলো।
আদালত আসামিদের রিমান্ড না মঞ্জুর করে চারদিনের হাজতবাস ও ঈদ বিবেচনা করে আসামি কাউসার ও রুবেলকে ১০০ টাকা বন্ডে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তির জিম্মায় জামিন মঞ্জুর করেন। তাদের জামিন হওয়ায় পর থেকেই আইনজীবীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করে। এ ঘটনায় তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে বিচারকের অপসারণের দাবি জানান।
ঈদের বন্ধ শেষে রবিবার (১৫ জুন) আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়। আইনজীবী সমিতি বৈঠক করে ওই আদালতের বিচারক এম সাইফুল ইসলামের আদালতের বর্জনের ঘোষণা দেন। এদিন সকাল থেকে ওই বিচারকের কক্ষে বিচারপ্রার্থীরা এসে উপস্থিত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বিচারপ্রার্থী জানান, আদালতের বিচারক এজলাসে বসা ছিলেন। এ সময় ৭-৮ জন আইনজীবী কক্ষে ঢুকে আদালত বর্জনের ঘোষণা দেন। এতে হট্টগোল দেখা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিচারক আদালত কর্মচারীদের দরজা বন্ধ করে দিতে বলেন। এ সময় আইনজীবী ও কর্মচারীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। আহত হন এজলাসের স্টেনোগ্রাফার আশরাফুজ্জামান। এতে বিচারকার্য সম্পন্ন না করেই এজলাস থেকে নেমে যান বিচারক।
আহত আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘‘আইনজীবীরা হট্টগোল করায় বিচারকের নির্দেশে আমি দরজা বন্ধ করতে গেলে আমার ওপর আইনজীবীরা হামলা করে। এতে আমার বাম চোখের পাশে রক্তাক্ত জখম হয়।’’
উপস্থিত আইনজীবীদের মধ্যে অ্যাডভোকেট আশিকুর রহমান জানান, কয়েকজন আইনজীবী এজলাসে গিয়ে আদালত বর্জনের বিষয়টি জানিয়ে দিতে গিয়েছেন। আদালত কর্মচারীরা উল্টো তাদের ওপর হামলা করেছে। এতে তিনি নিজেও আহত হন।
ঢাকা/লিটন/টিপু