নদী, নগর ব্যবস্থাপনা, প্রাণ-পরিবেশ-প্রকৃতি নিয়ে বিস্তর কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে যোগ দিয়েছেন মোহাম্মদ এজাজ। অন্য সিটি করপোরেশনগুলোতেও অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। নতুন অ্যাডমিনিস্ট্রেটদের শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনটি প্রস্তাব তাঁদের সামনে তুলে ধরছি।

বাংলাদেশের আর সব প্রতিষ্ঠানের মতো সিটি করপোরেশনগুলো জনগণের সেবার বদলে ক্ষমতাসীনদের জুলুমের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে বরাবর। জনগণের সম্পদ লুটপাট, দুর্নীতি আর অপচয়ের অন্যতম সেরা হাতিয়ার সিটি করপোরেশনগুলো। মশার ওষুধে ভেজাল, সংরক্ষিত জলাধার বা নিম্নভূমি ভরাট ও দখলে সহায়তা, উন্নয়নের নামে একই রাস্তা প্রতিবছর কাটা, নর্দমা পরিষ্কার করে আবার সেই একই ময়লা দিয়ে নর্দমা ভরাট করার চক্র, ফুটপাতকে ক্ষমতাসীনদের অর্থ উপার্জনের উপায় বানানো, ট্রেড লাইসেন্স, জন্মসনদ, হোল্ডিং ট্যাক্স ব্যবস্থার জবাবদিহিহীনতায় সাধারণের ভোগান্তি আর ঘুষ-দুর্নীতির অফুরন্ত সুযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি হাজারো অভিযোগ সিটি করপোরেশনগুলোর বিরুদ্ধে গত ৫৪ বছরের বাংলাদেশে আছে।

নতুন বাংলাদেশেও কি একই অবস্থা চলতে থাকবে? জনগণ নিশ্চয় তা আশা করে না। আবার অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশে মানুষের প্রত্যাশা হয়েছে আকাশচুম্বী। সে তুলনায় অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সফলতার হার প্রায় চোখে দেখা যায় না। সরকারের অদক্ষতা, অযোগ্যতার সঙ্গে বিভিন্ন বাস্তবিক সংকট, ষড়যন্ত্রও এর পেছনে দায়ী।

২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ‘পরিবর্তন চাই’ নামের সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে আমার কাজের সুযোগ হয়েছিল। নাগরিক পরিচ্ছন্নতায় সচেতনতা তৈরি, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে পলিসি ও অবকাঠামোগত সহায়তা ইত্যাদি ছিল পরিবর্তন চাইয়ের কাজের পরিধিতে। তখন সামগ্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ সিটি করপোরেশনগুলোর কাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবার, বোঝার ও গবেষণার কিছু সুযোগ পেয়েছি। নতুন বাংলাদেশের যে অবারিত সম্ভাবনা এবং বাস্তবিক সংকটগুলো আছে, সেসব বিবেচনায় নিচের তিনটি কাজ যদি আগামী এক বছরে সিটি করপোরেশনগুলো থেকে পাই, তাহলে সন্তুষ্ট হব।

১.

বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর

১.১ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ দেশের কয়েকটি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ তৈরির একাধিক প্রকল্পের কথা বহু বছর ধরে শুনে আসছি। আদতে কোনো নমুনাও দেখিনি। যেমন ঢাকা উত্তরের আমিন বাজারে ডব্লিউটিই পাওয়ার প্ল্যান্ট নর্থ ঢাকা প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি ইনসিনারেশন প্ল্যান্ট প্রকল্প ২০২৪ সালে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল।

এসব প্রকল্প যদি আদৌ সত্যি হয়, তবে সেগুলো দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করা জরুরি। যদি পুরোটাই ভুয়া হয়, তবে নতুন করে এমন প্রকল্প নেওয়া দরকার।

এসব কারখানায় পুনর্ব্যবহারের অযোগ্য পলিথিনসহ যাবতীয় উচ্চ দাহ্যক্ষমতার বর্জ্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

১.২ বাংলাদেশে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ তৈরির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সরবরাহ চ্যানেলে পলিথিন বর্জ্য ও কিচেন বর্জ্য একসঙ্গে থাকার ফলে বর্জ্যের দাহ্যক্ষমতা কমে যাওয়া। সেটার সমাধানে সোর্স থেকেই যথাসম্ভব কিচেন বর্জ্যমুক্ত দাহ্য বর্জ্য সংগ্রহ করা যায়।

সারা দেশে এখন যেমন প্লাস্টিক বোতল আর বর্জ্য হিসেবে রাস্তাঘাটে পরে থাকে না, কারণ সেগুলো বিক্রি করা সম্ভব। প্লাস্টিকসহ অন্যান্য দাহ্য বর্জ্যও ঠিক তেমনি কারখানার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হলে সেগুলো আর সর্বশেষ নদী বা সাগরের তলদেশে জমা হয়ে পরিবেশদূষণ করবে না। আবার এসব কারখানায় আধুনিক ফিল্ট্রেশন পদ্ধতি ব্যবহার করায় বায়ুদূষণও হবে না। বরং বাই প্রোডাক্ট হিসেবে আরও কিছু অর্থকরী বিভিন্ন সম্পদ পাওয়া সম্ভব হবে।

বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের সময় তিনটি ভাগে সেগ্রিগেশন (পৃথক) করে দেওয়াকে উৎসাহিত করতে হবে। এমনকি সে বর্জ্য কিনে নেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। তেমন হলে সবাই বর্জ্যগুলো সঠিকভাবে আলাদা করে দেবেন নিশ্চয়।

১.৩ সংগৃহীত কিচেন বর্জ্য জৈব সার তৈরিতে এবং অন্যান্য বর্জ্য উপযোগিতা ভেদে রিসাইকেল করা হবে।

এ ধরনের একটি সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই কম খরচে এবং ছয় মাস সময়ে অন্তত সীমিত পরিসরে শুরু করা নিশ্চয়ই সম্ভব বলে মনে করি।

১.৪ ইনসিনারেশন প্ল্যান্টের মতো সুনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ ছাড়া বর্জ্য পোড়ানো অতিদ্রুত বন্ধ করা জরুরি। এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি।

১.৫ এ প্রকল্পের মাধ্যমে বৈশ্বিক কার্বন ব্যাংক থেকে আর্থিক সুবিধা আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া।

২. গণশৌচাগারের সংখ্যা বাড়ানো

সারা ঢাকায় মাত্র কয়েক শ গণশৌচাগার আছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এর প্রায় সব কটি আবার ব্যয়সাপেক্ষ। ফলে বেশির ভাগ পথজীবীর পক্ষে ব্যবহার সম্ভব হয় না। ফলাফল পথজীবী ও অনেক পথচারী যেখানে–সেখানে নোংরা করতে বাধ্য হন এবং অনেক মহিলা দুরারোগ্য কিডনি রোগে আক্রান্ত হন।

সব স্কুল, মার্কেট, মসজিদ, সরকারি–বেসরকারি ভবনে এক বা একাধিক শৌচাগার থাকে। কিন্তু সেগুলো সাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে না। আবার উন্মুক্ত শৌচাগারগুলো পরিচ্ছন্ন থাকে না। এগুলোর অন্তত একটি অংশ নগরবাসীর জন্য উন্মুক্ত, ব্যবহার উপযোগী রাখা সেই কর্তৃপক্ষ বা ভবনমালিকের জন্য খুব দুঃসাধ্য কিছু না। এ ধরনের উপযুক্ত ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন গণশৌচাগার রাখার জন্য সিটি করপোরেশন উৎসাহ প্রদান করবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিনা খরচে সাবান, পানি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিয়ে সহায়তা করবে। এভাবে দুই ঢাকায় অন্তত ১ হাজার গণশৌচাগার ৩ মাসের মধ্যে করা সম্ভব হবে। এর উপকার পাবে সব পথজীবী, পথচারী, বিশেষ করে নারীরা।

৩. হকার নিবন্ধন

বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা, বেকারত্ব, বাজার ব্যবস্থাপনা ও দ্রব্যমূল্য ইত্যাদি কারণে হকার একটি বাস্তবতা। সর্বোচ্চভাবে চাইলেও এ দেশে হকার বন্ধ করা সম্ভব নয়। বরং এ চেষ্টার ঝুঁকি অনেক বেশি। এ দেশে হকাররা সরকারি দলের পান্ডাদের কাছে গড়ে দিনে ৬০ থেকে ৫০০ টাকার বিনিময়ে বেসরকারিভাবে নিবন্ধন নেয়। বিনিময়ে অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহার, যত্রতত্র বসে পথচারীদের অসুবিধার মধ্যে ফেলে।

সিটি করপোরেশনগুলোকে উপযুক্ত মাসিক ফির মাধ্যমে হকারদের নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে।

সিটি করপোরেশন নগর–পরিকল্পনাবিদ ও স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে হকার বসার স্থান, হকারের সংখ্যা, সময়, কার্ট বা চৌকির ডিজাইন ও মাপ ইত্যাদি নির্ধারণ করে এ নিবন্ধন দেবে। হকারদের বৈধ বিদ্যুৎ, গণশৌচাগারের সুবিধা, নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। নিবন্ধিত হকাররা নির্ধারিত স্থানে, সময়ে, নির্ধারিত পণ্য বিক্রয় করবেন।

এ প্রকল্প সম্পন্ন হলে এলাকাভিত্তিক হকার ব্যবস্থাপনা সম্ভব। সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বেশ বাড়ানো সম্ভব। সর্বোচ্চ ছয় মাসে যেকোনো এলাকায় এ প্রকল্প সম্পন্ন করা সম্ভব।

গণ–অভ্যুত্থানের আগের আর পরের সিটিগুলো ব্যবস্থাপনা, সুবিধার দিক থেকে একই হতে পারে না। জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি, ব্যয় কমানোর এক আবশ্যকীয়তায় সিটি করপোরেশনগুলো ৫৪ বছর ধরে কেবল ব্যর্থই ছিল। ফলাফল বিশ্বের বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকায় দেশের শহরগুলোর খুবই দৃষ্টিকটু উপস্থিতি (শীর্ষ ১০টির মধ্যে ৩টি শহর বাংলাদেশের)। এবার অন্তত তিনটি বিষয়ে নাগরিকদের তারা সুবিধা দিক। এই তিনটি কাজ করতে পারলেই বসবাসযোগ্যতায় অনেকাংশে এগিয়ে যাবে দেশের নগরগুলো, এ কথা হলফ করে বলা যায়। বলা বাহুল্য, উপরেল্লিখিত যেকোনো প্রস্তাব নিয়ে আরো বিস্তারিত আলাপসহ যেকোনো সহযোগিতা করতে আমি ও আমার সংগঠন সদা প্রস্তুত।

দিদারুল ভূঁইয়া অর্থ সমন্বয়ক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ব যবস থ গণশ চ গ র ন বর জ য ব যবহ র প রকল প ন বন ধ র জন য সরক র ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

অসহায় মায়েদের স্বস্তির আশ্রয়স্থল

স্বামী মারা গেছেন অনেক বছর আগে। ট্রেন দুর্ঘটনায় বড় ছেলের মৃত্যুর পর রাবেয়া বেগমের (৮০) মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। খোঁজখবর নেওয়া বন্ধ করে দেন অন্য ছেলেরা। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছিল তাঁর। এমন সময় তিনি নিজের গ্রামেই এমন একটি জায়গার খোঁজ পান, যেখানে থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে পরনের কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যায়।

এর পর থেকে ১২ বছর ধরে ‘ওল্ড কেয়ার হোম’ নামের সেই জায়গাতেই থাকছেন রাবেয়া। সেখানে আরও অনেক অসহায় মায়ের সঙ্গে সুখে-শান্তিতে দিন কাটছে তাঁর।

যশোর সদর উপজেলার সমসপুর গ্রামে ওল্ড কেয়ার হোমটি গড়ে তুলেছেন জ্যোৎস্না মুখার্জি নামের এক নারী। ভৈরব নদের পাড়ে পাঁচ বিঘা জমির ওপর ছায়া-সুনিবিড় বৃদ্ধাশ্রমটি হয়ে উঠেছে অসহায় মায়েদের শেষ জীবনের নিরাপদ আশ্রয়স্থল।

এক যুগের বেশি সময় আগে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বৃদ্ধাশ্রমটি একাধিকবার পরিদর্শন করেছেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আশিকুজ্জামান তুহিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একেবারেই প্রকৃতির মধ্যে একটি বৃদ্ধানিবাস। বৃদ্ধ মায়েরা শেষ বয়সে প্রকৃতির মধ্যে থাকলে তাঁদের মনেও প্রশান্তি থাকে। এই বৃদ্ধানিবাস ঠিক তেমনই। এমন উদ্যোগ খুব ভালো লেগেছে।’

‘ওল্ড কেয়ার হোমে’ একদিন

যশোর শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়ক ধরে ১২ কিলোমিটার গেলে মান্দারতলা বাজার। সেখান থেকে পাকা সড়ক দিয়ে এক কিলোমিটার পশ্চিমে ভৈরব নদ। নদের পশ্চিম পাশে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ঝনঝনিয়া গ্রাম। আর পূর্ব পাশে যশোরের সমসপুর, একেবারেই অজপাড়াগাঁ।

গ্রামের নদের পাড়েই ওল্ড কেয়ার হোমের অবস্থান। সরেজমিনে দেখা যায়, এল-প্যাটার্নের একতলা ভবনটিতে ছয়টি কক্ষ, একটি রান্নাঘর, চারটি শৌচাগার রয়েছে। ভবনের পাশে রয়েছে তিনটি কক্ষ। কক্ষগুলো পাকা গাঁথুনি, টিনের ছাউনি। হিন্দু ও মুসলমান নারীদের জন্য রয়েছে পৃথক প্রার্থনা স্থান। বিনোদনের জন্য রয়েছে দুটি টেলিভিশন। বিদ্যুৎ–সংযোগের পাশাপাশি রয়েছে নিজস্ব সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা।

বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বর্তমান এখানে ২০ জন বৃদ্ধা আছেন। তাঁরা জ্যোৎস্না মুখার্জিকে ‌‘আম্মু’ বলে ডাকেন। কেউ কেউ ‘খালা’ বলে সম্বোধন করেন। তাঁরা আরও জানান, তিন বেলা খাবারের পাশাপাশি পরনের কাপড়, জুতা-স্যান্ডেল, তেল, সাবান, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, কম্বল, স্যুয়েটার দেওয়া হয়। এমনকি ওষুধও দেওয়া হয়। চারজন চিকিৎসক নিয়মিত মুঠোফোনে চিকিৎসাসেবা দেন। মাঝেমধ্যে চিকিৎসাশিবির করা হয়।

টিনের ছাউনি থেকে ভবন

বিয়ের পর ১৯৯৮ সালে স্বামী অমরনাথ মুখার্জির সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান গৃহিণী জ্যোৎস্না মুখার্জি। সেই সময় উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাকপুরে তিনটি বৃদ্ধাশ্রম ঘুরে দেখেন। সেখান থেকে স্বপ্ন দেখেন সুযোগ পেলে নিজের গ্রামে একটি বৃদ্ধাশ্রম করবেন। ২০০১ সালে হৃদ্‌রোগে স্বামী মারা গেলে অধরা থেকে যায় বৃদ্ধাশ্রম গড়ার স্বপ্ন। কিন্তু তিনি দমে যাননি।

২০০৮ সালে সমসপুর গ্রামে একটি মাটির ঘরে এলাকার দুস্থ ও অসহায় বৃদ্ধাদের সেবা দেওয়া শুরু করলেন জ্যোৎস্না মুখার্জি। কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি তাঁদের কিছু টাকা, শাড়ি, কম্বল দিতে শুরু করলেন। একদিন বাবাকে জানালেন তাঁর স্বপ্নের কথা। শুনে বাবা বিশ্বনাথ গাঙ্গুলী বৃদ্ধাশ্রম করার জন্য ২০১০ সালে মেয়েকে পাঁচ বিঘা জমি লিখে দিলেন। ক্যানসারে আক্রান্ত বাবা মারা যান ২০১৬ সালে।

সেই জমিতে ২০১২ সালে শুরু হয় ওল্ড কেয়ার হোমের পথচলা। প্রথমে প্রায় চার লাখ টাকা ব্যয়ে ছয়টি কক্ষ নির্মাণ করা হয়। ছাউনি টিনের। প্রথম বছরেই ঠাঁই হয় ৪০ জন মায়ের। হাঁটি হাঁটি পা পা করে ২০১৪ সালে এটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনভুক্ত হয়। ২০১৭ সালে জেলা পরিষদ সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয়ে একটি কক্ষ নির্মাণ করে দেয়। কক্ষটি মায়েরা হলরুম হিসেবে ব্যবহার করেন। ২০২০ সালে উপজেলা পরিষদ ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে টিনের ছাউনির জায়গায় ছয়টি কক্ষে ছাদ দেয়।

আনন্দ–বিনোদনে কাটে সময়

বৃদ্ধাশ্রমে সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা থাকায় আনন্দেই দিন কাটে বাসিন্দাদের। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা আম্বিয়া বেগম (৬৮) প্রায় ১০ বছর ধরে এখানে আছেন। তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলেরা আমাকে অবহেলা করত। তখন আমি আশ্রমে চলে আসি। সেই থেকে এখানে আছি। এখানে থাকতে ভালো লাগে। কোনো কিছুর অভাব নেই। এখন ছেলেরা বাড়ি যেতে বলে। মাঝেমধ্যে ছুটি নিয়ে বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।’

বাসিন্দারা জানান, প্রতিদিন নিয়ম করে সবাই মিলে গল্পের আসর বসে বৃদ্ধাশ্রমে। মাঝেমধ্যে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে নাচ, গান এবং বিভিন্ন খেলার ব্যবস্থা থাকে। নিয়মিত টেলিভিশন দেখেন তাঁরা। বছরে দুইবার বাইরে ঘুরতেও যান। নদের পাড়ে প্রায় ১০ ফুট ওপরে গাছের সঙ্গে একটি কাঠের ঘর করা হয়েছে। নাম টি হাউস। মাসে এক থেকে দুইবার সেখানে সবাইকে নিয়ে আড্ডা দেন ‘আম্মু’। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে চলে লুচি, সুজি, ডাল বা মুড়ি-চানাচুর মাখা খাওয়া। বাসিন্দাদের কারও মৃত্যুর পর মৃতদেহ গ্রহণের মতো আত্মীয়স্বজন না থাকলে তাঁদের দাফনের জন্য আট শতক জমি কেনা হয়েছে।

মুরাদগড় গ্রামের রোকেয়া বেগম (৭৫) বলেন, ‘আমার স্বামী বেঁচে নেই। ছেলেরা অবহেলা করত। এরপর আশ্রমে চলে আসি। ১৩ বছর ধরে এখানে আছি। ভালো আছি। আম্মু আমাদের খুব ভালো রেখেছেন।’

বৃদ্ধাশ্রমেরও নিজস্ব আয় আছে

একসময় ঢাকায় মোবাইল ফোনের ব্যবসা ছিল জ্যোৎস্না মুখার্জিদের। এই ব্যবসার আয়ে চলত বৃদ্ধাশ্রমটি। এখন মোবাইল ফোনের ব্যবসা নেই। স্থানীয় বাজারে তাঁর ভুসিমালের ব্যবসা আছে। এ ছাড়া বাজারের বাড়ির তিনটি কক্ষ ভাড়া দেওয়া আছে। ব্যবসা ও বাড়িভাড়ার টাকা দিয়ে বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রমের কিছু ব্যয় বহন করা হয়। তবে খরচের বড় অংশই আসে বৃদ্ধাশ্রমের নিজস্ব আয় থেকে।

এক ছেলেকে নিয়ে এখন জ্যোৎস্না মুখার্জির বেশির ভাগ সময় কাটে বৃদ্ধাশ্রমের দেখভাল করে। তিনি জানান, বৃদ্ধাশ্রমের জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ হয়। বিভিন্ন ফলদ গাছ এবং বাঁশ রয়েছে। ৩টি গরু, ২টি ছাগল, ৩০ জোড়া কবুতর, ২৫টি মুরগি এবং ৪টি হাঁসও আছে। কৃষি এবং গবাদি পশুপাখি থেকে আয় দিয়ে বৃদ্ধাশ্রম চলে। মাঝেমধ্যে কিছু মানুষ সহায়তা করেন। জেলা প্রশাসন থেকে প্রতিবছর কিছু চালও পাওয়া যায়।

স্থানীয় তিনজন নারী নামমাত্র সম্মানীতে বৃদ্ধাশ্রমটি দেখাশোনা করেন উল্লেখ করে জ্যোৎস্না মুখার্জি বলেন, এখানে সব সময় ২০ থেকে ২৫ জন মা থাকেন। এখন সব মিলিয়ে মাসে গড়ে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। মায়েরা একসঙ্গে খেত থেকে শাক তোলেন, কাটেন, পরিষ্কার করেন এবং রান্নায় সহায়তা করেন। দেখে খুব ভালো লাগে।

ওল্ড কেয়ার হোমের পরিধি বাড়ানো নিয়ে আরও বড় স্বপ্ন দেখেন জ্যোৎস্না মুখার্জি। তিনি বলেন, ‘ওল্ড কেয়ার হোমে এখনো সীমানাপ্রাচীর দিতে পারিনি। আমার ইচ্ছা নদের পাড়ে দুই কক্ষের একটি ভবন তুলব। সেখানে অন্তত পাঁচজন বৃদ্ধ বাবা থাকবেন।’

জ্যোৎস্না মুখার্জির কার্যক্রমে গর্বিত এলাকার বাসিন্দারা। সমসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাশেম আলী বলেন, ‘অজপাড়াগাঁয়ে এমন ভালো বৃদ্ধাশ্রম বাংলাদেশে আছে কি না, আমার জানা নেই। এখানকার পরিবেশ খুব সুন্দর। এখানে থাকার পাশাপাশি পায়ের জুতা থেকে শুরু করে সবকিছু বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। ওষুধও দেওয়া হয়।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ