মাটি কামড়ে নিজের পেশায় টিকে আছেন ময়মনসিংহের মৃৎশিল্পীরা
Published: 3rd, March 2025 GMT
পাকা সড়কের দুপাশে রোদে শুকানো হচ্ছে মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিস। সড়কের পাশেই একটি ঘরে মাটি দিয়ে তৈরি হচ্ছে এসব জিনিস। রোদে শুকানোর পর সেগুলো আগুনে পুড়িয়ে বিক্রির জন্য উপযোগী করা হয়। যুগ যুগ ধরে পালপাড়ার মৃৎশিল্পীদের এ কর্মব্যস্ততা। মাটির তৈরি জিনিসের চাহিদা দিন দিন কমলেও এখনো টিকে আছে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার মৃৎশিল্প। আদি পেশা আঁকড়ে জীবন কাটিয়ে যাচ্ছেন এসব পরিবারের সদস্যরা।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার সবচেয়ে বড় পালপাড়া হলো পুটিজানা ইউনিয়নের শিবগঞ্জ পালপাড়া। এ গ্রামে প্রায় ২০০ পাল পরিবার বসবাস করে। তাদের সবার পেশা মাটি দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করা। সম্প্রতি শিবগঞ্জ পালপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি পাল পরিবারের উঠানে তৈরি হচ্ছে প্রয়োজনমতো জিনিসপত্র। মাটির তৈরি জিনিসপত্র তৈরিতে ব্যস্ত নারীরা। পুরুষেরা করছেন অন্য কাজ। মাটির বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে উঠানে কিংবা পাকা সড়কের পাশে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। প্রতি বাড়িতেই মাটির তৈরি জিনিস পোড়ানোর জন্য রয়েছে চুল্লি। সেখান থেকে মাটির তৈরি জিনিস নামাতেও দেখা গেছে। পুড়ে লাল বর্ণ ধারণ করা মাটির এসব জিনিসের একসময় সর্বত্র চাহিদা থাকলেও দিন দিন এসবের ব্যবহার কমছে। প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম ও স্টিলের জিনিসপত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারছে না মাটির জিনিসপত্র। ফলে অনেকে পেশা পাল্টে অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন।
বাড়ির মন্দিরের একপাশে বসে রিনা রানী পাল (৩৮) ও তাঁর শাশুড়ি অবলা রানী পাল (৬০) তৈরি করছিলেন দই রাখার পাত্র। গরম আসায় দইয়ের পাত্রের চাহিদা বেড়েছে। দইয়ের পাত্র তৈরির পর তাঁরা তা পাকা সড়কের পাশে রোদে শুকাতে দিচ্ছিলেন। রিনা বলেন, দুই দশক আগেও বহু ধরনের জিনিস তৈরি হতো। কিন্তু দিন দিন চাহিদা কমছে। গরম এলে দইয়ের পাত্রের চাহিদা বাড়ে মিষ্টির দোকানগুলোতে। সাধারণত, বাড়ির নারীরা এগুলো বানান, পুরুষেরা বাজারে নিয়ে দোকানে দোকানে সরবরাহ করেন।
মাটির পাত্র তৈরির কাজে ব্যস্ত এক নারী। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার শিবগঞ্জ পালপাড়ায়.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দর কাঠ ও ফুলের গামারি
ময়মনসিংহ শহরের ব্রহ্মপুত্র তীরের কাছারিঘাট ও শিল্পাচার্য জয়নুল উদ্যান সকালে প্রাতভ্র৴মণকারীদের পদচারণে মুখর থাকে। কয়েক দিন আগে হেঁটে ফেরার পথে জেলা নির্বাচন অফিসের পেছনে গামারিগাছে ফুল ফুটতে দেখলাম। এই গাছের পাতা শীতে ঝরে গিয়েছিল। বসন্তে পত্রশূন্য গাছে ফুল ফুটেছে। ফুল ফোটার পর আবার পাতা গজাচ্ছে। কাঠের জন্য লাগানো হলেও এর হলুদ ফুলও কিন্তু সুন্দর। গামারি ফুল ভ্রমরের খুব প্রিয়; কারণ, এই ফুলে বেশ মধু আছে। তাই গামারির আরেক নাম ভ্রমরপ্রিয়া। টিয়া ও কাঠবিড়ালিরও প্রিয় এই ফুল। ফুলের নিচের দিকটা খয়েরি বাদামি।
গামারি সবুজ ও ঘন পাতাবিশিষ্ট, দ্রুত বর্ধনশীল পত্রঝরা বৃক্ষ। গামারি কাঠের জন্য লাগানো হলেও এর ফুলও কম সুন্দর নয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Gmelina arborea, এটি Lamiaceae পরিবারের বৃক্ষ। ইংরেজিতে এই গাছ কান্ধার ট্রি, কাশ্মীর ট্রি, গুমার ট্রি, মালয় বুশ-বিচ, হোয়াইট বিচ, হোয়াইট টিক ইত্যাদি নামে পরিচিত। এ ছাড়া বাংলা নাম গামার, গাম্বার, গাম্ভারি, তার কাঠ, গাম্ভারিকা ইত্যাদি নাম রয়েছে। এর সংস্কৃত নামগুলো হলো মধুমতি, গাম্ভারি, সিন্ধুপর্ণী, ভাদ্রাপর্ণী, গামহার ইত্যাদি।
আদিনিবাস ভারতবর্ষ ও মিয়ানমার। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় জন্মে। ভারতের আসাম, দক্ষিণ বিহার, ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল–সংলগ্ন এলাকায় এ গাছ হয়। বাংলাদেশের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় বেশি দেখা যায়।
এই গাছ লম্বায় ১৫ থেকে ৩৫ মিটার উঁচু হয়। গাছের প্রশাখা ও কুঁড়ি রোমশ। বাকল সাদা বা উজ্জ্বল ধূসর। পাতা পানপাতার আকৃতির, ২০ থেকে ২৪ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। পাতার ওপর দিক উজ্জ্বল সবুজ, নিচে পাণ্ডুর, বোঁটা ৬ থেকে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা। শীতে পাতা ঝরে। এটি অত্যধিক খরা–সহনশীল। বসন্তকালে পাতাহীন ডালে ডালে দেখা যায় গাঢ় হলুদ ফুল। পাঁচটি পাপড়ি থাকলেও মাঝের পাপড়িটি অন্যগুলোর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ লম্বা। বড় পাপড়িটির লম্বা পতাকার মতো অংশটি গাঢ় হলুদ। ফুলের গোড়ার দিকে হলুদ রঙের পাশাপাশি দেখা মেলে লালচে-বাদামি ও খয়েরি রঙের। ফুলের অনেক মিষ্টি গন্ধ, ফুল ৩ থেকে ৩ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার লম্বা, ২ ভাগে বিভক্ত। এর পুষ্পমধু ভোমরাদের খুবই প্রিয়। গামারির ফল দেখতে গোলাকার, ডিম্বাকৃতির, ফলে এক-দুটি বীজ হয়। ফল তিন সেন্টিমিটার চওড়া, শাঁসাল, পাকলে হালকা হলুদ হয়। শীতের পর ফুল এবং তাঁর দুই মাস পর ফল হয়।
কাঠ হলুদ, খানিকটা লাল অথবা সাদা। কাঠ টেকসই, সহজে কাজ করা যায়। সেগুনের পরেই গামারি কাঠের স্থান। এ জন্য ইংরেজিতে একে হোয়াইট টিক বলে। এই কাঠ আসবাব নির্মাণের জন্য বিশেষ উপযোগী। খোদাইয়ের কাজ, তক্তা, বাক্স, চিরুনি, খেলনা, গাড়ি ও নৌকা এই কাঠ দিয়ে বানানো যায়। এই কাঠের প্লাইউড বেশ ভালো।
গামারির অনেক ভেষজ গুণ রয়েছে। কটু–তিক্ত রস, গুরুপাক, উষ্ণবীর্য, কফ ও ত্রিদোষনাশক, বিষদোষ দাহ, জ্বর, তৃষ্ণা ও রক্তদোষনাশক। এর ছাল এবং কাঠে আছে অনেক তিক্ত পদার্থ ও স্টেরোল। পাতার রসে আছে জীবাণুনাশক শক্তি। কচি পাতার রস গনোরিয়া ও কাশিতে উপকারী। শিকড় কৃমিনাশক ও কুষ্ঠরোগে উপকারী। ক্ষতের পুঁজ বের করে দেয়। ফল চর্মরোগ ও চুল ওঠা বন্ধ করার মহৌষধ। শিকড় কৃমিনাশক ও কুষ্ঠরোগে উপকারী। গামারিগাছের পাতা এবং ফল গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এগুলো পুষ্টিকর এবং প্রাণীদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
চয়ন বিকাশ ভদ্র: অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি কলেজ, ময়মনসিংহ