পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় অন্য রাজ্যের মানুষ, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ মমতার
Published: 4th, March 2025 GMT
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অষ্টাদশ বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক এক বছর আগে তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে কয়েক দিন ধরে লাগাতার আক্রমণ করে যাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় অবাঙালি রাজ্যের মানুষের নাম ঢোকানো হয়েছে, যাঁদের পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি নিজেদের রাজ্যতেও ভোটার কার্ড রয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য ছিল, বিষয়টি জেনেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না ভারতের জাতীয় নির্বাচন কমিশন। বিষয়টিকে আগামী দিনে তৃণমূল কংগ্রেস যে ভারতের নির্বাচন কমিশন এবং বিজেপির বিরুদ্ধে একটা ইস্যুতে পরিণত করবে, তা বোঝা যাচ্ছে। কারণ, মমতা ‘ভুতুড়ে ভোটার’ খুঁজে বের করতে একটি কমিটি গঠন করেছেন। এই কমিটি আগামী বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) বৈঠক করবে বলে আজ মঙ্গলবার জানানো হয়েছে।
‘ভুতুড়ে ভোটার’ কীতৃণমূল কংগ্রেসের চাপে গত রোববার বিষয়টি নিয়ে সাফাই দেয় নির্বাচন কমিশন। কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘ইলেকশন ফটো আইডেনটিটি কার্ড’ (এপিক) বা ভোটার কার্ডের নম্বর একটি থাকলেও একই ভোটারের একাধিক কার্ড থাকতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের এই বক্তব্য মানতে নারাজ তৃণমূল কংগ্রেস। গতকাল সোমবার তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচন কমিশনকে ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়ে বলেছে, কেন পশ্চিমবঙ্গে বাইরের রাজ্যের এত ‘ভুতুড়ে ভোটার’, তা কমিশনকে ব্যাখ্যা করতে হবে। নইলে এই ভোটারদের নাম ও অন্যান্য নথিপত্র প্রকাশ্যে আনবে তৃণমূল।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত সপ্তাহে এক সভায় অভিযোগ তুলে বলেছেন, অন্য রাজ্যের এই ভুতুড়ে ভোটারের কারণেই দিল্লিসহ বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি নির্বাচনে জিতছে। যাঁরা রাজ্যের ভোটার নন, তাঁদের অন্য রাজ্য থেকে এনে রাতারাতি ভোটার বানিয়ে ভোট দেওয়ানো হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গেও এটা করার চেষ্টা হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দলীয় নেতা-কর্মীদের সতর্ক করে বলেন, তাঁরা যেন অবশ্যই নিজ নিজ বুথের ভোটার তালিকার প্রতিটি নাম খতিয়ে দেখেন।
মমতা এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তৃণমূল কংগ্রেসের বিশাল দলীয় কর্মী এবং ছোট ও মাঝারি মাপের নেতারা মাঠে নেমে পড়েন এবং দিন দুয়েকের মধ্যেই হাজার হাজার ভুতুড়ে ভোটারের তালিকা প্রস্তুত করেন। এই তালিকার একাংশ তৃণমূল কংগ্রেস প্রকাশও করেছে। তৃণমূল নেতারা এখন বলছেন, বাকি নামগুলোও তাঁরা প্রকাশ করবেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, জাতীয় নির্বাচন কমিশনের মদদেই এই ভুয়া বা ভুতুড়ে ভোটারদের বিজেপিশাসিত রাজ্য থেকে এনে পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় ঢোকানো হয়েছে।
বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে মমতা যে কোর কমিটি গঠন করেছেন, সেই দলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও রয়েছেন। কমিটির মাথায় রয়েছেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা সুব্রত বক্সী। কমিটিতে আরও রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলার তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি এবং জেলা স্তরের জ্যেষ্ঠ ও পোড় খাওয়া নেতারা।
এই কমিটি কীভাবে বিষয়টি তদন্ত করবে, ভুয়া বা ভুতুড়ে ভোটারদের নাম নির্বাচন কমিশনের হাতে তুলে দেবে নাকি প্রকাশ্যে আনবে—তা খতিয়ে দেখা হবে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার একাধিক গ্রাম পঞ্চায়েতে ভুয়া ভোটারের খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার চম্পাহাটি গ্রামসহ মুর্শিদাবাদের রানীনগর, দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর ইত্যাদি এলাকা।
আগামী বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠেয় বৈঠকে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের কোন কোন জেলার কোন কোন অঞ্চলে বেশি ভুতুড়ে ভোটার থাকতে পারে—তা নিয়ে আলোচনা করবে। ওই সব অঞ্চলে বিশেষ দল গঠন করে নজরদারি চালানো হবে বলেও দলীয় নেতৃত্ব জানিয়েছে।
দলের মুখপাত্র কুনাল ঘোষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানিয়েছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা অভিযোগ ইতিমধ্যে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং একাধিক রাজ্যে একই ভোটারের নামের অভিযোগ যে ঠিক, তা (নির্বাচন কমিশনের কথাতেই) স্পষ্ট হয়েছে। ভুতুড়ে ভোটার খুঁজে বের করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা চলবে।
তৃণমূলের এই ভুতুড়ে ভোটার খুঁজে বের করার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিরোধী বিজেপিদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়ে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের চাপে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন শুভেন্দু ও বিজেপির নেতৃত্ব।
নির্বাচনের প্রায় এক বছর বাকি থাকলেও এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গে হাওয়া গরম হতে শুরু করেছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বন দ য প ধ য য
এছাড়াও পড়ুন:
অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে
সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।
এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।
এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।