বাংলাদেশে বেগুন অন্যতম জনপ্রিয় ও পুষ্টিকর সবজি, যা সারা বছরই চাষ করা যায়। এটি আলুর পরেই দেশের দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সবজি। তবে বেগুন চাষে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কীটপতঙ্গ। বিশেষ করে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা (Leucinodes orbonalis)।

এ পোকার আক্রমণে কৃষকের ফলনের ৩০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি হয়। তাই বেগুন চাষিরা প্রতি মৌসুমে ১০০ বারেরও বেশি কীটনাশক স্প্রে করেন; যা স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জমির জন্য ক্ষতিকর।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ও ইউএসএআইডি-এর আইপিএম অ্যাক্টিভিটির একদল গবেষক বেগুন চাষে পরিবেশবান্ধব সমাধান খুঁজতে গবেষণা শুরু করেন। তারা ‘মেটিং ডিসরাপশন’ নামে একটি প্রযুক্তির কার্যকারিতা পরীক্ষা করেন, যা কীটনাশকের বিকল্প হতে পারে।

গবেষণার নেতৃত্ব দেন বাকৃবি কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড.

মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ এবং ভার্জিনিয়া টেকের আইপিএম ল্যাবের পরিচালক ড. রাঙ্গাস্বামী মুনিয়াপ্পান গবেষণাটি পর্যবেক্ষণ করেন।

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ বলেন, “বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী স্ত্রী পোকা পাতার নিচে, ডালপালা ও ফুলের উপর ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বের হওয়া লার্ভা গাছের নরম অংশে ঢুকে সংরক্ষিত টিস্যু খেয়ে ফেলে। ফলে গাছের উপরের অংশ শুকিয়ে মারা যায়।”

তিনি বলেন, “গাছে ফল আসলে এরা ফলেও আক্রমণ করে ও ফলের অভ্যন্তরীণ অংশ খেয়ে এটি নষ্ট করে, যা বাজারজাতকরণ ও ভোক্তার ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত করে তোলে। বাংলাদেশে এ পোকার কারণে ফলনের ক্ষতি ৮৬ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।”

এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ভার্জিনিয়া টেক ও ইউএসএআইডি এর আর্থিক সহায়তায় ফিড দ্যা ফিউচার মিশনের ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্টিভিটি এটি বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। এ প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য ছিল- বাংলাদেশের কৃষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, যেন তারা সম্মিলিতভাবে পরিবেশসম্মতভাবে ফসলের বর্তমান এবং উদ্ভূত হুমকির নিয়ন্ত্রণ ও বিস্তার রোধ করতে পারে। এ প্রকল্প বেগুনসহ ১৩টি ফসলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করে।

২০২৩ সালে ঢাকায় এক কর্মশালার মাধ্যমে এ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। পরে মাগুরা, ঝিনাইদহ ও বাকৃবির গবেষণা খামারে মাঠ পর্যায়ে মেটিং ডিসরাপশন প্রযুক্তি পরীক্ষা করা হয়।

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার বিষয়ে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ বলেন, “সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ফেরোমন। কারণ এটি রাসায়নিক বালাইনাশকের উপর নির্ভরশীল না থেকে ক্ষতিকর পোকামাকড়কে মোকাবেলা করে। ফেরোমন হলো এক শ্রেণীর সেমিওকেমিক্যাল উপাদান। যা পোকামাকড় ও অন্যান্য প্রাণীরা তার নিজ প্রজাতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যবহার করে। এতে ওই পোকামাকড় বিপরীত লিঙ্গের পোকামাকড় ও তার স্বজাতির পোকাদের মধ্যে একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।”

নতুন প্রযুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, “মেটিং ডিসরাপশন হলো কীট দমন প্রযুক্তির একটি কৌশল, যেখানে কৃত্রিম উদ্দীপনার মাধ্যমে পোকাদের বিভ্রান্ত করা হয় এবং তাদের সঙ্গী সন্ধান ও প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যাহত করা হয়। এতে তাদের বংশবিস্তার বন্ধ হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে কীটের সংখ্যা কমে আসে।”

“বেগুনের জমিতে চারা রোপণের সাতদিনের মধ্যে প্রথমবার এই মিটিং ডিসরাপসশন জেল প্রয়োগ করা হয়। যখন ছোট থাকে তখন কাঠের মাথায় এবং যখন বড় হয়ে যায় তখন প্রতি মাসে একবার গাছের ডগায় প্রয়োগ করা হয়। যেহেতু বেগুন সারি সারি রোপন করা হয় তাই প্রতি এক সারি অন্তর যেমন এক, চার‌, সাত এভাবে প্রতি সারিতে মেটিং ডিসরাপশন জেল প্রয়োগ করা হয়েছে। একইভাবে পরের মাসে দুই, পাঁচ এবং আট এভাবে সমান দূরত্বে মিটিং ডিসরাপশন জেল প্রয়োগ করা হয়েছে। এভাবে পরের মাসেও প্রয়োগ করা হয়েছে,” যুক্ত করেন ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ।

বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার পাশাপাশি আরো বেশকিছু পোকা যেমন সাদামাছি, জাব পোকা ইত্যাদির মাধ্যমে বেগুন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব পোকা দমন এবং রোগ ব্যবস্থাপনায় জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়েছে। এ গবেষণায় কোয়াড্রেট পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রতিটি বর্গক্ষেত্রের সবগুলো বেগুন গাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময় পর বেগুনগুলো ভোক্তার গ্রহণের উপযুক্ত হলে সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত বেগুন ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে মান অনুযায়ী বাছাই করা হয়। ট্রিটমেন্ট (যেটায় মেটিং ডিসরাপশন ব্যবহার করা হয়েছে) এবং কন্ট্রোল (রাসায়নিক কীটনাশক) জমি থেকে এ উপাত্তগুলো সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণার ফলাফল নিয়ে ড. সাইফুল্লাহ জানান, ময়মনসিংহ, মাগুরা এবং ঝিনাইদহের ডিসেম্বরের ২০২৩ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত বিভিন্ন মাসে মেটিং ডিসরাপশন প্রয়োগ করা জমিতে ধরা পড়া পোকার সংখ্যা ট্রিটমেন্ট জমি থেকে কম। অন্যদিকে ময়মনসিংহে বিভিন্ন মাসে বেগুনের ক্ষেতে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমনের শতকরা হার কন্ট্রোল জমি থেকে মেটিং ডিসরাপশন ব্যবহার করা জমিতে তুলনামূলক কম।

তিনি আরো জানান, মাগুরা ও ঝিনাইদহে ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত জমিতে পোকা আক্রমণের শতকরা মেটিং ডিসরাপশন ব্যবহার করা জমি থেকে কন্ট্রোল জমিতে তুলনামূলক বেশি। কিন্তু পরবর্তীতে মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ট্রিটমেন্ট ও নিয়ন্ত্রিত জমিতে একই রকম ফলাফল পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে তাপমাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

রাসায়নিক কীটনাশকের উচ্চ খরচ এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় মেটিং ডিসরাপশন প্রযুক্তি কৃষকদের জন্য লাভজনক ও নিরাপদ বিকল্প। এটি ব্যবহারে বেগুন চাষে উৎপাদন খরচ কমবে, পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বেগুন চাষে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই সমাধান সম্ভব, যা কৃষকদের জন্য লাভজনক এবং ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করবে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ।

ঢাকা/মেহেদী

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবহ র কর পর ব শ র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

মুক্তিপণ দিয়েও পাঁচ মাস ধরে ১৪ তরুণের খোঁজ পাচ্ছেন না স্বজনেরা

অবৈধ পথে ইতালির উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ১৪ তরুণ। কিন্তু দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর পাঁচ মাস ধরে তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। স্বজনদের দাবি, দালালের প্রলোভনে পড়ে জনপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণও দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু সন্ধান না পাওয়ায় চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা।

ইউরোপের কোনো দেশে গেলে সচ্ছলতা আসবে, এমন ধারণা নিয়ে প্রতিবছর মাদারীপুর থেকে শত শত তরুণ সেখানে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছেন। তবে অবৈধ পথে ইউরোপ যেতে গিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। কেউবা দালালের খপ্পরে পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে কাটাচ্ছেন বন্দিজীবন। জেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত জেলার ৪৫ জন লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে মারা গেছেন। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে লিবিয়া থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছেন অন্তত ৩৫০ তরুণ। নিখোঁজ আছেন তিন শতাধিক।

সবশেষ নিখোঁজ তরুণদের সবার বাড়ি রাজৈরের বাজিতপুর ইউনিয়নে। তাঁরা হলেন পাখুল্লা গ্রামের জাহাঙ্গীর ব্যাপারীর ছেলে সালমান ব্যাপারী, চৌরাশী গ্রামের মোসলেম শিকদারের ছেলে বাবুল শিকদার, একই গ্রামের মজিবর বয়াতীর ছেলে সাজ্জাদ বয়াতী, জাকির মাতুব্বরের ছেলে বাদল মাতুব্বর, কানাই রায়ের ছেলে লিটন রায়, নিরঞ্জন বাড়ৈর ছেলে বাঁধন বাড়ৈ, কিসমদ্দি বাজিতপুর গ্রামের আলম চৌকিদারের ছেলে ইমন চৌকিদার, অহিদুল মাতুব্বরের ছেলে নয়ন মাতুব্বর, আজিজ খালাসির ছেলে খলিল খালাসি, সোনা মিয়া চৌকিদারের ছেলে সোহেল চৌকিদার, নয়াকান্দি বাজিতপুর গ্রামের গৌরাঙ্গ বাড়ৈর ছেলে গৌতম বাড়ৈ, একই গ্রামের সামচু সরদারের ছেলে ইমরান সরদার, শ্রীনাথদী বাজিতপুরের জলিল বয়াতীর ছেলে আল আমিন বয়াতি ও শ্রীনদী গ্রামের সিদ্দিকুর রহমান ঘরামির ছেলে আলী ঘরামি। তাঁদের সবার বয়স ১৮ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে।

স্বজনদের অভিযোগ, মানব পাচার চক্রের সক্রিয় সদস্য বাজিতপুর এলাকার বাবুল হাওলাদার ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেক পরিবারের কাছ থেকে প্রথমে ১৬ লাখ টাকা করে নেন। পরে লিবিয়ায় বন্দী করে আদায় করেন আরও ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। এর পর থেকে ঘরে তালা ঝুলিয়ে পালিয়েছেন অভিযুক্ত বাবুল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।

মাদারীপুরের ১৪ তরুণ ইতালি যেতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে দালালের হাত ধরে ঘর ছাড়েন। নিখোঁজ তরুণদের সন্ধানে তাদের ছবি হাতে স্বজনেরা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হুতিদের হামলায় সৌদি যুবরাজের লোহিত সাগর বন্দর পরিকল্পনা কি ভেস্তে যাবে
  • গাজায় নৃশংসতা চালিয়ে ইসরায়েল কি পশ্চিমা বিশ্বেও একঘরে হয়ে যাচ্ছে
  • স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগ থেকে মুক্তি পাকেতার
  • কলকাতায় বাংলাদেশি অভিনেত্রী গ্রেপ্তার , দাবি ভারতীয় গণমাধ্যমের
  • কলকাতায় গ্রেপ্তার বাংলাদেশি অভিনেত্রী
  • ওভালে টস হেরে ব্যাটিংয়ে ভারত, একাদশে চার পরিবর্তন
  • কর্মস্থলে অনুপস্থিত, পাঁচ প্রকৌশলী ও এক স্থপতি বরখাস্ত
  • গণপূর্ত অধিদপ্তরের ৫ প্রকৌশলী ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের স্থপতি বরখাস্
  • মুক্তিপণ দিয়েও পাঁচ মাস ধরে ১৪ তরুণের খোঁজ পাচ্ছেন না স্বজনেরা
  • দলবদলের বাজারে চেলসিই রাজা, শীর্ষ দশে আর কারা