পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে বেগুনের পোকা দমনে কমাবে কীটনাশক ব্যয়
Published: 10th, March 2025 GMT
বাংলাদেশে বেগুন অন্যতম জনপ্রিয় ও পুষ্টিকর সবজি, যা সারা বছরই চাষ করা যায়। এটি আলুর পরেই দেশের দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সবজি। তবে বেগুন চাষে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কীটপতঙ্গ। বিশেষ করে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা (Leucinodes orbonalis)।
এ পোকার আক্রমণে কৃষকের ফলনের ৩০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি হয়। তাই বেগুন চাষিরা প্রতি মৌসুমে ১০০ বারেরও বেশি কীটনাশক স্প্রে করেন; যা স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জমির জন্য ক্ষতিকর।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ও ইউএসএআইডি-এর আইপিএম অ্যাক্টিভিটির একদল গবেষক বেগুন চাষে পরিবেশবান্ধব সমাধান খুঁজতে গবেষণা শুরু করেন। তারা ‘মেটিং ডিসরাপশন’ নামে একটি প্রযুক্তির কার্যকারিতা পরীক্ষা করেন, যা কীটনাশকের বিকল্প হতে পারে।
গবেষণার নেতৃত্ব দেন বাকৃবি কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড.
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ বলেন, “বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী স্ত্রী পোকা পাতার নিচে, ডালপালা ও ফুলের উপর ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বের হওয়া লার্ভা গাছের নরম অংশে ঢুকে সংরক্ষিত টিস্যু খেয়ে ফেলে। ফলে গাছের উপরের অংশ শুকিয়ে মারা যায়।”
তিনি বলেন, “গাছে ফল আসলে এরা ফলেও আক্রমণ করে ও ফলের অভ্যন্তরীণ অংশ খেয়ে এটি নষ্ট করে, যা বাজারজাতকরণ ও ভোক্তার ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত করে তোলে। বাংলাদেশে এ পোকার কারণে ফলনের ক্ষতি ৮৬ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।”
এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ভার্জিনিয়া টেক ও ইউএসএআইডি এর আর্থিক সহায়তায় ফিড দ্যা ফিউচার মিশনের ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্টিভিটি এটি বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। এ প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য ছিল- বাংলাদেশের কৃষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, যেন তারা সম্মিলিতভাবে পরিবেশসম্মতভাবে ফসলের বর্তমান এবং উদ্ভূত হুমকির নিয়ন্ত্রণ ও বিস্তার রোধ করতে পারে। এ প্রকল্প বেগুনসহ ১৩টি ফসলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করে।
২০২৩ সালে ঢাকায় এক কর্মশালার মাধ্যমে এ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। পরে মাগুরা, ঝিনাইদহ ও বাকৃবির গবেষণা খামারে মাঠ পর্যায়ে মেটিং ডিসরাপশন প্রযুক্তি পরীক্ষা করা হয়।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার বিষয়ে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ বলেন, “সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ফেরোমন। কারণ এটি রাসায়নিক বালাইনাশকের উপর নির্ভরশীল না থেকে ক্ষতিকর পোকামাকড়কে মোকাবেলা করে। ফেরোমন হলো এক শ্রেণীর সেমিওকেমিক্যাল উপাদান। যা পোকামাকড় ও অন্যান্য প্রাণীরা তার নিজ প্রজাতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যবহার করে। এতে ওই পোকামাকড় বিপরীত লিঙ্গের পোকামাকড় ও তার স্বজাতির পোকাদের মধ্যে একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।”
নতুন প্রযুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, “মেটিং ডিসরাপশন হলো কীট দমন প্রযুক্তির একটি কৌশল, যেখানে কৃত্রিম উদ্দীপনার মাধ্যমে পোকাদের বিভ্রান্ত করা হয় এবং তাদের সঙ্গী সন্ধান ও প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যাহত করা হয়। এতে তাদের বংশবিস্তার বন্ধ হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে কীটের সংখ্যা কমে আসে।”
“বেগুনের জমিতে চারা রোপণের সাতদিনের মধ্যে প্রথমবার এই মিটিং ডিসরাপসশন জেল প্রয়োগ করা হয়। যখন ছোট থাকে তখন কাঠের মাথায় এবং যখন বড় হয়ে যায় তখন প্রতি মাসে একবার গাছের ডগায় প্রয়োগ করা হয়। যেহেতু বেগুন সারি সারি রোপন করা হয় তাই প্রতি এক সারি অন্তর যেমন এক, চার, সাত এভাবে প্রতি সারিতে মেটিং ডিসরাপশন জেল প্রয়োগ করা হয়েছে। একইভাবে পরের মাসে দুই, পাঁচ এবং আট এভাবে সমান দূরত্বে মিটিং ডিসরাপশন জেল প্রয়োগ করা হয়েছে। এভাবে পরের মাসেও প্রয়োগ করা হয়েছে,” যুক্ত করেন ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ।
বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার পাশাপাশি আরো বেশকিছু পোকা যেমন সাদামাছি, জাব পোকা ইত্যাদির মাধ্যমে বেগুন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব পোকা দমন এবং রোগ ব্যবস্থাপনায় জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়েছে। এ গবেষণায় কোয়াড্রেট পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রতিটি বর্গক্ষেত্রের সবগুলো বেগুন গাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময় পর বেগুনগুলো ভোক্তার গ্রহণের উপযুক্ত হলে সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত বেগুন ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে মান অনুযায়ী বাছাই করা হয়। ট্রিটমেন্ট (যেটায় মেটিং ডিসরাপশন ব্যবহার করা হয়েছে) এবং কন্ট্রোল (রাসায়নিক কীটনাশক) জমি থেকে এ উপাত্তগুলো সংগ্রহ করা হয়।
গবেষণার ফলাফল নিয়ে ড. সাইফুল্লাহ জানান, ময়মনসিংহ, মাগুরা এবং ঝিনাইদহের ডিসেম্বরের ২০২৩ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত বিভিন্ন মাসে মেটিং ডিসরাপশন প্রয়োগ করা জমিতে ধরা পড়া পোকার সংখ্যা ট্রিটমেন্ট জমি থেকে কম। অন্যদিকে ময়মনসিংহে বিভিন্ন মাসে বেগুনের ক্ষেতে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমনের শতকরা হার কন্ট্রোল জমি থেকে মেটিং ডিসরাপশন ব্যবহার করা জমিতে তুলনামূলক কম।
তিনি আরো জানান, মাগুরা ও ঝিনাইদহে ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত জমিতে পোকা আক্রমণের শতকরা মেটিং ডিসরাপশন ব্যবহার করা জমি থেকে কন্ট্রোল জমিতে তুলনামূলক বেশি। কিন্তু পরবর্তীতে মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ট্রিটমেন্ট ও নিয়ন্ত্রিত জমিতে একই রকম ফলাফল পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে তাপমাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
রাসায়নিক কীটনাশকের উচ্চ খরচ এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় মেটিং ডিসরাপশন প্রযুক্তি কৃষকদের জন্য লাভজনক ও নিরাপদ বিকল্প। এটি ব্যবহারে বেগুন চাষে উৎপাদন খরচ কমবে, পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বেগুন চাষে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই সমাধান সম্ভব, যা কৃষকদের জন্য লাভজনক এবং ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করবে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ।
ঢাকা/মেহেদী
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবহ র কর পর ব শ র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে
সুদ পরিশোধে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এ ব্যয় বহন করতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাজেটে সরকারের সুদ পরিশোধ সংক্রান্ত পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, আগামী বছরগুলোতে সুদ ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে।
পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ১৫ ভাগ অর্থই সুদ খাতে খরচ করতে হচ্ছে এখন। এ পরিস্থিতিতে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতেই ব্যয় করতে হবে চার লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। পাঁচ অর্থবছরের ব্যবধানে সুদ ব্যয় বাড়ছে ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে শতাংশের হিসাবে বৈদেশিক ঋণের সুদ ব্যয় সবচেয়ে বেশি বাড়বে।
অর্থ বিভাগের করা ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি-২০২৫-২০২৬ থেকে ২০২৭-২০২৮’ এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হয়েছিল এক লাখ ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ খাতে সুদ ব্যয় ছিল ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় গেছে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে (যা চলতি জুনের ৩০ তারিখে শেষ হয়ে যাবে) মূল বাজেটে সুদ খাতে ব্যয় বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে এই সীমায় সুদ ব্যয় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ হিসাবের মধ্যে ছিল অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় ৯৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের ২২ হাজার কোটি টাকা।
একইভাবে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়েরও একটি প্রক্ষেপণ করেছে অর্থ বিভাগ। এই হিসেবে দেখা যায় আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হবে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা (অভ্যন্তরীণ এক লাখ কোটি টাকা , বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকা)। একইভাবে এর পরের অর্থবছর ২০২৬-২০২৭ অর্থবছরে একলাখ ৩৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা(অভ্যন্তরীণ এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা) এবং ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়ের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, মোট সুদ ব্যয়ের সিংহভাগই অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে এক লাখ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা গিয়ে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু মোট বাজেটের অনুপাতে অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধের হার ২০২৩ -২০২৪ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ২৯ শতাংশ থেকে কমে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশে হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ মোট সুদ ব্যয়ের তুলনায় কম, তবে এটি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ফলে এটি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ২৭ হাজার ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে। মোট বাজেটের অনুপাতে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ এ সময়কালে ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের কার্যকর ব্যবস্থাপনা শুধু আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যই নয়, বরং এটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক ঋণমান বজায় রাখা এবং ভবিষ্যতের উন্নয়ন সম্ভাবনা সুরক্ষিত রাখার জন্য অপরিহার্য।