পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে যাত্রীবাহী ট্রেন জাফর এক্সেপ্রেসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করার ঘটনায় দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ সশস্ত্র গোষ্ঠী বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। এ ঘটনায় জিম্মি যাত্রীদের উদ্ধারে বেশ ‘জটিল অভিযান’ পরিচালনা করেছেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।

কিন্তু প্রশ্ন হলো—কে এই বিএলএ? এই গোষ্ঠীর সদস্য কারা? কেনই–বা হঠাৎ করে যাত্রীবাহী ট্রেন জিম্মি করার মতো এত বড় ঘটনা ঘটাল বিএলএ? বিশ্বে কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকে এ ধরনের ঘটনা খুব কমই ঘটাতে দেখা গেছে।

ঘটনার সূত্রপাত্র গতকাল মঙ্গলবার সকালে। নিরাপত্তা বাহিনী বলছে, বেলুচিস্তানের বোলান এলাকার কাছে কোয়েটা থেকে পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেস নামের যাত্রীবাহী ট্রেনের নিয়ন্ত্রণ নেয় সশস্ত্র একটি গোষ্ঠী। এ সময় তারা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে যাত্রীদের জিম্মি করে। ট্রেনটির নয়টি বগিতে চার শতাধিক যাত্রী ছিলেন।

এর আগে সশস্ত্র ব্যক্তিরা রেললাইনে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ট্রেনটি থামান। এ সময় তাঁরা ট্রেনটির চালকের কক্ষে গুলি চালান। এতে চালক আহত হন। দুর্গম আফগান-ইরান সীমান্তের পাশে সিবি শহরের পার্বত্য অঞ্চলে থাকা একটি সুড়ঙ্গে (বোলান পাস) প্রবেশের আগমুহূর্তে ট্রেনটি থামানো হয়। ঘটনাস্থল কোয়েটা থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে।

তবে কতজন সশস্ত্র ব্যক্তি ট্রেনটিতে হামলা চালান, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এরই মধ্যে হামলার দায় স্বীকার করেছে বিএলএ।

বেলুচিস্তানে বিএলএর ক্রমবিকাশ ও রাষ্ট্রের গোয়েন্দা–ব্যর্থতার আরেকটি বড় কারণ, পুরো প্রদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এই গোষ্ঠীর যোদ্ধাদের নখদর্পণে। বিপরীতে সামরিক বাহিনীর যেসব সদস্য বিদ্রোহ দমনে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগকে পাঞ্জাব বা খাইবার পাখতুনখাওয়া থেকে আনা হয়।—মালিক সিরাজ আকবর, বেলুচিস্তান–বিষয়ক বিশ্লেষক।

আজ বুধবার বেলা ১টা পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্যে জানা যায়, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিএলএর অন্তত ২৭ সদস্য নিহত হয়েছেন। নিরাপত্তা বাহিনী বলছে, সব সদস্যকে নির্মূল না করা পর্যন্ত অভিযান চলবে। ট্রেনে জিম্মি অন্তত ১৫৫ জন যাত্রীকে উদ্ধার করার কথা জানিয়েছেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ এ তথ্য জানিয়েছে।

এবারই প্রথম নয়

বিএলএ হলো পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী। বেলুচ লিবারেশন আর্মি নামেও এই গোষ্ঠী পরিচিত। পাকিস্তানের ভূখণ্ড থেকে বেলুচিস্তান প্রদেশকে স্বাধীন করতে চান এই গোষ্ঠীর সদস্যরা।

২০০০ সালের মধ্যভাগে বিএলএর যাত্রা শুরু। প্রদেশটিতে কয়েক বছর ধরে একের পর এক হামলা চালিয়ে আসছেন বিএলএর সদস্যরা।

বিএলএ বেশ কিছু উন্নত অস্ত্র পেয়েছে, যার কিছু কিছু আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী রেখে গিয়েছিল। এসব অস্ত্র বিএলএর শক্তি বাড়িয়েছে। তাদের আক্রমণগুলো আরও মারাত্মক ও ধারালো করে তুলেছে।—রফিউল্লাহ কাকার, বেলুচিস্তান–বিষয়ক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

ট্রেনে হামলায় দায় স্বীকার করে দেওয়া এক বিবৃতিতে বিএলএ বলেছে, ছয় সামরিক সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। ট্রেন লাইনে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। এর ফলে ট্রেনটি থেমে গেলে নিয়ন্ত্রণ নেন গোষ্ঠীর সদস্যরা। এ ছাড়া বিএলএ সতর্ক করে বলেছে, যেকোনো সামরিক অভিযান চালানো হলে সেটার পরিণতি হবে ‘মারাত্মক’।

বিএলএর এমন দাবির বিষয়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানায়নি। এমনকি আল–জাজিরা প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেও কিছুই জানানো হয়নি।

প্রাদেশিক সরকারের মুখপাত্র শহীদ রিন্দ বলেন, এ ঘটনায় বেলুচিস্তান সরকার জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সংগঠিত করা হয়েছে। সিবি ও আশপাশের শহরগুলোর হাসপাতালে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। সতর্ক রাখা হয়েছে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের।

পবিত্র রমজান মাসে নিরীহ মানুষের ওপর চালানো এ হামলার তীব্র সমালোচনা করেছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে জাতীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

হামলা বাড়ছে কেন

আয়তনে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ বেলুচিস্তান। তবে প্রদেশটি বেশ অনুন্নত। উন্নয়নের যাত্রায় পাঞ্জাব–সিন্ধুর চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে বেলুচিস্তান। প্রদেশটিতে দেড় কোটি মানুষের বসবাস।

উন্নয়নে পিছিয়ে থাকলেও বেলুচিস্তান খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। এখানে তামার খনি ও গ্যাসকূপ রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বেলুচদের। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভিযোগ, স্বাধীনতার পক্ষে যাঁরাই সরব হয়েছেন, রাষ্ট্র তাঁদের অপহরণ করেছে, নির্যাতন করেছে।

ঘটনার সূত্রপাত্র গতকাল মঙ্গলবার সকালে। নিরাপত্তা বাহিনী বলছে, বেলুচিস্তানের বোলান এলাকার কাছে কোয়েটা থেকে পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেস নামের যাত্রীবাহী ট্রেনের নিয়ন্ত্রণ নেয় সশস্ত্র একটি গোষ্ঠী। এ সময় তারা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে যাত্রীদের জিম্মি করে। ট্রেনটির নয়টি বগিতে চার শতাধিক যাত্রী ছিলেন।

প্রায় এক দশক আগে বেলুচিস্তানে শুরু হয় ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলারের চীন–পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের (সিপিইসি) মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এর ফলে সেখানকার জটিল সংঘাতময় পরিস্থিতি আরও জোরদার হয়।

বেলুচিস্তানে চীনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও স্থাপনার ওপর বেশ কয়েকবার হামলা চালিয়েছে বিএলএ। এর মধ্যে আলোচিত গোয়াদার বন্দরও রয়েছে। সিপিইসি প্রকল্পের অন্যতম বড় অংশ এই বন্দর। এসব হামলায় অনেক চীনা নাগরিক নিহত হয়েছেন।

সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বেলুচিস্তানজুড়ে হামলা–সংঘাতের ঘটনা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। গত মাসে স্থানীয় কালাত শহরে বিএলএর হামলায় অন্তত ১৮ সেনা নিহত হন। মার্চের শুরুর দিকে একই শহরে বিএলএর এক নারী সদস্য আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্য নিহত হন।

জাফর এক্সপ্রেসেও এর আগে বিভিন্ন সময় হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর বিএলএ সদস্যরা রেললাইন উড়িয়ে দিলে মাস দুয়েক ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। গত নভেম্বরে কোয়েটা রেলস্টেশন ত্যাগের আগমুহূর্তে এই ট্রেনে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিরাপত্তা রক্ষীসহ অন্তত ৩০ জন নিহত হন।

আরও পড়ুনপাকিস্তানে বোমা ফাটিয়ে ও গুলি চালিয়ে ট্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিল সশস্ত্র গোষ্ঠী১১ মার্চ ২০২৫

যেভাবে সক্ষমতা বাড়ছে

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বিএলএর সদস্যদের কর্মকাণ্ড দমনে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা ও পুরোনো কৌশল এই গোষ্ঠীর সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ।

ওয়াশিংটনভিত্তিক বেলুচিস্তান–বিষয়ক বিশ্লেষক মালিক সিরাজ আকবর বলেন, বিএলএ একসময় ছোট আকারের হামলা চালাত। যেমন ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে হামলা হতো কিংবা পাইপলাইন ধ্বংস করত। ধীরে ধীরে এই গোষ্ঠীর সদস্যরা তুলনামূলক বড় আকারের হামলা চালাতে শুরু করেছেন।

ইসলামাবাদভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব পিস স্টাডিজ (পিআইপিএস) গত জানুয়ারিতে সতর্ক করে বলেছিল, বেলুচিস্তানের পরিস্থিতি ভীষণ উদ্বেগজনক। এক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, হামলার ঘটনা ১১৯ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর প্রদেশটিতে দেড় শ-এর বেশি হামলা হয়েছে।

এই বিশ্লেষক আল–জাজিরাকে আরও বলেন, ‘এই গোষ্ঠী এখন যাত্রীবাহী ট্রেনে সাম্প্রতিক হামলার মতো বড় হামলা চালিয়েছে। এই পরিবর্তন তাদের ক্রমবর্ধমান সাহসের প্রতিফলন। এখন এটা বোঝা যায় যে এই গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সরকারের নেই।’

বেলুচিস্তান–বিষয়ক রাজনৈতিক বিশ্লেষক রফিউল্লাহ কাকার বলেন, বিএলএ তার কমান্ড কাঠামো শক্তিশালী করেছে। অভিযানের ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের সদস্যদের আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

রফিউল্লাহ কাকার আল–জাজিরাকে আরও বলেন, তারা বেশ কিছু উন্নত অস্ত্র পেয়েছে, যার কিছু কিছু আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী রেখে গিয়েছিল। এসব অস্ত্র বিএলএর শক্তি বাড়িয়েছে। তাদের আক্রমণগুলো আরও মারাত্মক ও ধারালো করে তুলেছে।

পাকিস্তানের একটি ট্রেন.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব ল চ স ত ন ব ষয়ক গ ষ ঠ র সদস য এই গ ষ ঠ র সরক র র সশস ত র র ঘটন ক ষমত ব এলএ র একট

এছাড়াও পড়ুন:

বাজারে আগাম সবজি আসতে দেরি, দাম চড়া

শীতের মৌসুম শুরু হলেও রাজধানীর বাজারে শীতের সবজির সরবরাহ এবার কম। এ কারণে দামও চড়া। বাজারে অধিকাংশ সবজির কেজি ৮০ টাকার বেশি। কিছু সবজির দাম ১০০ টাকার ওপরে।

বছরের এপ্রিল-অক্টোবর সময়টা মূলত গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুম। এ সময়ে প্রাণিজ আমিষ, অর্থাৎ মাছ, মাংস ও ডিমের দাম তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়। তাতে সবজির ওপর চাপ বাড়ে। ফলে সবজির সরবরাহ মোটামুটি থাকলেও দাম থাকে চড়া। শীতের আগাম সবজি বাজারে আসতে শুরু করলে দামও কমতে শুরু করে। শীতের আগাম সবজি বাজারে আসতে শুরু করে সেপ্টেম্বর–অক্টোবরে।

বিক্রেতারা বলছেন, এ বছর শীতের আগাম সবজি আসতে তুলনামূলক বেশি সময় লাগছে। এ কারণে দীর্ঘ সময় ধরে বাজারে চড়া দামে সবজি বিক্রি হচ্ছে। তবে গত কয়েক দিনে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ফুলকপি, শিমসহ শীতের আগাম কিছু সবজি আসতে শুরু করেছে। এতে এসব সবজির দামও কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা কমেছে। বিক্রেতারা বলছেন, অক্টোবরের শুরুতেই আগাম শীতের সবজি বাজারে আসার কথা। কিন্তু এবার বেশ দেরিতেই এসব সবজি বাজারে এসেছে।

দেশে সবজির অন্যতম উৎপাদনস্থল যশোর। যশোরের সদর উপজেলার নোঙরপুর গ্রামের কৃষক বদরুল আলম এ বছর ৪০ শতক জমিতে আগাম মুলা চাষ করেছেন। ইতিমধ্যে ২৫ শতক জমির মুলা তিনি বিক্রি করেছেন। তিনি জানান, আবহাওয়াগত কারণে এবার আগাম সবজি একটু দেরিতে চাষ হয়েছে। এ জন্য খেত থেকে সবজি তুলতেও দেরি হয়।

এ বছর একটা লম্বা সময় ধরে বিভিন্ন অঞ্চলে টানা বৃষ্টি হয়েছে। ফলে বৃষ্টির সময়ে কেউ আগাম সবজি চাষের ঝুঁকি নেননি। এ কারণে আগাম শীতকালীন সবজি অক্টোবরের শেষে বাজারে আসা শুরু হয়েছে।আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ, অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান মাস্টার বলেন, এ বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে অনেক কৃষক ওই সময়ে আগাম সবজি চাষ করতে পারেননি। চাষাবাদ শুরু করতে দেরি হওয়ায় সবজি পেতেও দেরি হয়েছে। এতে বাজারেও প্রভাব পড়েছে।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

কৃষিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছর আগাম সবজি চাষে দেরি হওয়ার পেছনে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের টানা বৃষ্টির একটি ভূমিকা ছিল। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ সময়ে হঠাৎ টানা বৃষ্টি হয়। সামনের বছরগুলোতেও এমন পরিস্থিতি আসতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তাঁরা।

এ বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে অনেক কৃষক ওই সময়ে আগাম সবজি চাষ করতে পারেননি। চাষাবাদ শুরু করতে দেরি হওয়ায় সবজি পেতেও দেরি হয়েছে। ইমরান মাস্টার, সভাপতি, কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতি

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ জানান, দেশে ফসল উৎপাদন মূলত প্রকৃতিনির্ভর চাষাবাদ পদ্ধতিতে এবং খোলা মাঠে হয়। এ ক্ষেত্রে বৃষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে গত কয়েক বছরে দেশে বৃষ্টির ধরন পরিবর্তন হয়ে গেছে। কখনো খুব বেশি বৃষ্টি হয়, কখনো কম। এ বছর একটা লম্বা সময় ধরে বিভিন্ন অঞ্চলে টানা বৃষ্টি হয়েছে। ফলে বৃষ্টির সময়ে কেউ আগাম সবজি চাষের ঝুঁকি নেননি। এ কারণে অন্যান্য সময় যেখানে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আগাম শীতকালীন সবজি বাজারে চলে আসে, সেখানে এবার তা অক্টোবরের শেষে আসা শুরু হয়েছে। এটিই বাজারে সবজির দাম না কমার অন্যতম কারণ।

ভিন্ন দাবি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর অতিবৃষ্টির কারণে দুই দফায় সবজির ক্ষতি হয়। এর মধ্যে গত আগস্টে প্রায় ১৮ দিনের বৃষ্টিতে ৩৫১ হেক্টর জমির এবং সেপ্টেম্বরে ১৫ দিনে ১২৪ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সংস্থাটির কর্মকর্তাদের দাবি, চলতি বছর শীতের আগাম সবজি আসতে উল্লেখ করার মতো দেরি হয়নি। স্থানভেদে কোথাও কয়েক দিন দেরিতে চাষ শুরু হয়েছে। তবে সেটি সার্বিক চিত্র নয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, ‘আগাম সবজির সরবরাহ কম, এটি ব্যবসায়ীদের সাধারণ কথা। আমাদের তথ্য বলছে, শীতের আগাম সবজি ইতিমধ্যে বাজারে চলে এসেছে। দেশের সব বাজারেই এখন শীতের আগাম সবজি পাওয়া যায়। দামও সহনীয় হয়ে এসেছে। আগাম সবজি যদি কম থাকত, তাহলে দাম আরও চড়া থাকার কথা ছিল।’

বৃষ্টির কারণে সবজি আসতে দেরি হয়েছে কি না—এ প্রসঙ্গে ওবায়দুর রহমান বলেন,সারা দেশে একসঙ্গে টানা বৃষ্টি হয়নি। শুধু কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধাসহ রংপুরের কয়েকটি জেলা এবং চট্টগ্রামের কিছু জেলার নিচু এলাকায় অতিবৃষ্টির প্রভাব পড়েছিল। এ ছাড়া বগুড়া, যশোর অঞ্চলে বৃষ্টির তেমন প্রভাব পড়েনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আরও জানিয়েছে, চলতি বছর শীতকালে (রবি মৌসুম) প্রায় ৬ লাখ ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অনুমান করেছে তারা। এর মধ্যে ১ লাখ ২৯ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে আগাম সবজি চাষ হয়েছে। যেসব জমিতে আগাম সবজি চাষ হয়েছে, সেখানে আবার সবজি চাষ হবে। গত বছর শীত মৌসুমে সব মিলিয়ে ৬ লাখ ৪২ হাজার হেক্টরে সবজি চাষ হয়েছিল।

করণীয় কী

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, বৃষ্টির অস্বাভাবিকতা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে কৃষিতে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। এ সত্যকে মেনে নিতে হবে। এ পরিস্থিতিতে আধুনিক প্রযুক্তির চাষাবাদ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে এক ফসলি জমিকে দুই বা তিন ফসলি করা এবং নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো জরুরি।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ জানান, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে কৃষিতে প্রযুক্তিনির্ভর অভিযোজনের বিকল্প নেই। কম খরচে পলিথিনের শেড তৈরি করে সবজি চাষ করা সম্ভব, যা বৃষ্টি বা তাপমাত্রার পরিবর্তনে তেমন প্রভাবিত হয় না। পাতাজাতীয় শাকসবজি, মরিচ, টমেটো, বেগুন ও শসার মতো ফসল এতে সহজে উৎপাদন করা যায়। উৎপাদন স্থিতিশীল থাকলে সবজির সরবরাহ ঠিক থাকবে, কৃষকেরাও ভালো দাম পাবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ