সকাল থেকেই দিনটার মেজাজ ছিল অন্য রকম। কখনো কখনো এ রকম হয় বটে, তবে আজকের ব্যাপারটা আলাদা যেন। চৈত্রের গরম হয়ে ওঠা হাওয়ার সঙ্গে একটা চাপা উত্তেজনা আরও তপ্ত করে তুলছিল চারপাশের পরিস্থিতি। সেই উত্তেজনা অজানা আশঙ্কা ও অব্যক্ত ক্রোধের। চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে নানা গুঞ্জন। কোনটা সত্যি, কোনটা বানানো—বোঝা মুশকিল। ঢাকা থেকে আসা খবরের ডালপালা ছড়ালেও মূল খবর একটাই, অবাঙালি মিলিটারিরা হাজারে হাজারে মানুষ মেরে ফেলেছে, পুলিশ ব্যারাকে আগুন দিয়ে বের হয়ে আসা পুলিশদের গুলি করেছে পাখির মতো, ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের হলগুলোতেও হামলা করেছে মাঝরাতে। রাস্তায় যাকে পেয়েছে তাকেই গুলি করে মেরেছে। অবিশ্বাস্য এ রকম খবরের পর খবর আসছে ঢেউয়ের মতো। খবরগুলো গুজবের মতো মনে হলেও অবিশ্বাস করে না কেউ।
একাব্বরের চায়ের দোকানে বসে রেডিওর খবর শোনার চেষ্টা করে ইলিয়াস, খবরটবর নেই কিছুই, একটানা বাজনা বেজে যাচ্ছে কেবল। কিছুক্ষণ পরপর হেঁড়ে গলায় একটা ঘোষণা শোনা যাচ্ছে অদ্ভুত এক ভাষায়, ‘ঢাকা শহর ও শহরতলিতে কারফিউ জারি করা হইয়াছে। কেহই এই কারফিউ ভঙ্গ করিবার অধিকার রাখে না। যাহাকে কারফিউ ভঙ্গ করিতে দেখা যাইবে, তাহাকে গুলি করিয়া মারা যাইতে পারে।’
এ রকম আজব ঘোষণা শুনে চায়ের দোকানে রেডিও শুনতে ভিড় করা লোকজন শুকনা মুখে ফ্যালফ্যাল করে চারপাশে তাকায়। একজন বলে, ‘এ বিটারে বাঙালি মোনে হচ্ছে না। বাঙালি অ্যানাউন্সারগের মাইরে ফেলাইসে মনে হয়।’ কেউ এ কথার কোনো জবাব দেয় না। অস্থিরভাবে উঠে পড়ে ইলিয়াস, বুকের ভেতর বহু দূর থেকে শোনা ঢাকের মতো শব্দ হচ্ছে। বড় রাস্তায় উঠলে চোখে পড়ে বড় গাছ ফেলে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পাহারা বসিয়েছে এলাকার মানুষ। শোনা গেছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে মিলিটারির বড় একটা দল এ পথ দিয়ে যাবে মূল শহরের দিকে। এভাবে গাছ ফেলে কতক্ষণ ওদের আটকে রাখা যাবে, কে জানে। তবে শহরে পৌঁছাতে দেরি করিয়ে দিতে পারলে শহরের বাঙালি সৈন্যরা আরও গুছিয়ে নিতে পারবে নিজেদের। এখান থেকে মাইলখানেক গেলে কাছিমের মতো পিঠ উঁচু করা ব্রিজটার ওপাশে বাঙালি সৈন্যদের একটা দল এসে ঘাঁটি গেড়েছে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা পাঞ্জাবি সৈন্যদের এখানেই আটকাতে হবে। স্থানীয় নেতাদের অনেকেই এসেছেন। তার মানে বড়সড় কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এখানে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর ইপিআরের অফিসারদের সঙ্গে দফায় দফায় সলাপরামর্শ চলছে তাদের। সেই আলোচনার যতটুকু বের হয়ে আসছে, সেসব শুনে মানুষের মধ্যে ভয় ও ক্রোধ একসঙ্গে দলা পাকিয়ে যায়।
দলে দলে মানুষ ছুটছে বাঙালি সেনাদের দেখতে। ইলিয়াস ওদের সঙ্গ নেয়। খালের ধারে যেখানে হাট বসে, সেখানকার সারি সারি চালার নিচে কবরের মতো উঁচু করা একচিলতে করে ভিটে, সেগুলোর সামনের সারির প্রতিটির পেছনে বসানো হচ্ছে দুই পায়ের ওপর ভর করা রাইফেলের মতো অস্ত্র। এত দিন পুলিশের হাতে যে মোটাসোটা রাইফেল দেখেছে মানুষ, এগুলো সে রকম নয়, আগে দেখেনি কেউ। কে যেন বেশ ভাব নিয়ে জানায়, এগুলো হচ্ছে এলএমজি। রাইফেলের মতো একটা একটা নয়, একসঙ্গে অনেকগুলো গুলি ছোড়া যায় এগুলো দিয়ে। বাজারের আধপাকা দোকান ঘরগুলোর আশপাশের আড়ালকেও কাজে লাগাতে চাইছে ওরা। কাছেধারে কোথাও বালু পাওয়া যায়নি, তাই এত অল্প সময়ের মধ্যে বালুর বস্তা দিয়ে বাংকার বানানো হয় না। দোকানের ইটের দেয়ালগুলোই আপাতত বাংকার। ঘুরেফিরে এসব জোগাড়যন্ত্র দেখতে গিয়ে ইলিয়াসের ইচ্ছা হয় হাতে একটা বন্দুক পেলে সে-ও এদের সঙ্গে নেমে যেত। তাই যুদ্ধপ্রস্তুতির জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করে না ওর, যদি কোনো কাজে লাগতে পারে। মানুষের ভিড় বাড়তে থাকলে সৈন্যরা কড়া গলায় ওদের সরে যেতে বলে। এতে উৎসুক মানুষের জটলা একটু টোল খায়, তবে সবাই চলে যায় না। সৈন্যদের নেতাগোছের একজন এসে বলে, ‘এখানে তামাশা দেখার কিছু নাই। আমাদের জন্য চেয়ারম্যানের বাড়িতে রান্না হচ্ছে, পারলে সেখানে গিয়া ফাইফরমাশ খাটেন।’ এ কথা শুনে কয়েকজনের সঙ্গে ইলিয়াস ছুট লাগায় আফাজুল্লা চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে। সেখানে বড় বড় ডেকচিতে বাঙালি সৈন্যদের জন্য দুপুরের রান্না চড়িয়েছে কাসেম বাবুর্চি। ভাত, বুটের ডাল আর গরুর মাংস। হারেস মেম্বার একটা চেয়ারে বসে রান্নার তদারক করছে দেখে ইলিয়াস সামনে গিয়ে সালাম দেয়। হারেস মেম্বার ওকে দেখে বলে, ‘তুমি আইসে পড়িছ, ভালোই অলো। মিছিল–মিটিং তো বহুত করিস, অ্যাহন অন্য কিছু করা লাগবি। এহান থে খানা যাবে সোলজারগের জন্যি। পেলেট–বাটি জোগাড় হচ্ছে, সেগুলান ধুয়ে নিতি অবে। তোমরা হাত লাগাবা।’
একটা কাজ পেয়ে খুশিতে বুকের ভেতরটা ভরে যায় ইলিয়াসের। এখন আপাতত আর কোনো কাজ নেই, তাই এখানে খামোখা বসে না থেকে রাস্তার দিকে ছুট লাগায় ও। অসহযোগ আন্দোলনে স্কুল বন্ধ হওয়ার পর থেকে পড়াশোনা করতে হচ্ছে না, ম্যাট্রিক পরীক্ষা কখন হবে আল্লাহ মালুম। যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, শিগগিরই হবে বলেও মনে হচ্ছে না। অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে মিছিলে যাওয়াই ছিল একমাত্র কাজ। মাত্র কিছুদিন আগে এখানকার জুট মিলের বিহারিদের সঙ্গে একটা দাঙ্গা লাগতে গিয়েও লাগেনি। নেতারা পরিস্থিতি সামলে বলে, ‘এদের মাইরে কী অবে? আমাগের যুদ্ধ খানসেনার সঙ্গে। শুনিসনি, তোমরা আমাগের ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাগের কিচ্ছু বলবে না নে। কিন্তু আর আমার ভাইয়ের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা কোরো না।’
হাঁটতে হাঁটতে ও ভাবে, এখন তো আর ওরা ব্যারাকে নেই, তাহলে এখন কী হবে?
রাস্তার ওপর কাত হয়ে পড়ে থাকা বিরাট গাছটার দুপাশে লোকজন উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করছে। কারও কারও হাতে শক্ত লাঠি। পরিচিত কাউকে দেখতে পায় না ও। মিলিটারিরা যদি সত্যিই চলে আসে ঠিক কী করতে হবে, জড়ো হওয়া লোকজনকে সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করছিল নেতাগোছের একজন। কিন্তু আসলে নিজেও ঠিক জানে না নিরস্ত্র মানুষ কী করবে। ওকে বলতে শোনা যায়, ‘খালি হাতে কী আর করবানে আমরা? দা-কুড়োল নিয়ে ওগের সাতে যুদ্ধ করতি পারবা? খুব বেশি অলে দূর থেইকে দু–চারডে পাথর মারতি পারবা বোধয়। অ্যাহন বাঙালি সোলজারগের সাহায্য করতি পারো। দু–এক দিনির মধ্যে বুইঝে যাবানে কী করতে অবে।’
এসব কথায় কান না দিয়ে কয়েকজন ভূপতিত গাছের ডালের ওপর বসে দূরে রাস্তার বাঁকের দিকে তাকিয়ে থাকে, মিলিটারির ট্রাক দেখা গেলেই ছুট লাগাবে।
একসময় মিলগেটের দিকে হাঁটতে থাকে ইলিয়াস। রাস্তায় কোনো গাড়ি চলছে না, দু–একটা রিকশা ব্যারিকেডের পাশের সংকীর্ণ পথ গলিয়ে চলাফেরা করছে নেহাত দায়ে ঠেকে। মিলগেট পেরিয়ে আরও কিছু দূর পর পাশের ব্রিকফিল্ড থেকে ইট এনে রাস্তার ওপর ছোটখাটো পাহাড় বানিয়ে ফেলেছে লোকজন। ওর ক্লাসে পড়া কয়েকজনও আছে সেখানে, ইট টানতে টানতে ধুলায় আর ঘামে চেহারা হয়েছে ভূতের মতো। ইলিয়াসকে দেখে বলে, ‘গায়ে হাওয়া লাগায়ে ঘুইরে বেড়াচ্ছিস? আমরা খাইটে মরতিসি এহানে।’ ওদের দেখে লজ্জা পায় ইলিয়াস। বলে, ‘আমি তো ইপিআর বাহিনীর ওহানে তোগের খুঁইজে আলাম। চেয়ারম্যানের বাড়িত্থে খাবার নিয়ে যাতি অবে ওগের জন্যি। যাবি?
ওরা বলে, ‘বানে। গোসল করতি অবে আগে। আজ জুমার নামাজে যাচ্ছিসনে?’
ইলিয়াস বলে, ‘নামাজে গেলি খাবার নিতি দেরি অয়ে যাবে নে। একদিন জুমা না পড়লি কিচ্ছু অবেনানে। পাঞ্জাবিরা আইসে পড়লি জুমা পড়বি কিডা?’
আসন্ন ঘূর্ণিঝড়ের আগে যেমন চারপাশ থমথম করে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দমবন্ধ করা পরিবেশটা বুকের ওপর আরও চেপে বসে, পুরো এলাকাটা সেই ভারী আবহাওয়ায় নিচে পড়ে হাঁসফাঁস করে যেন। দুপুরে জুমার আজানের শব্দও আজ অন্য রকম লাগে। মুয়াজ্জিনের গলা থেকে ভয়ার্ত কাঁপা স্বর যেন নিস্তব্ধ জনবিরল প্রান্তরের ওপর দিয়ে আহাজারির মতো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। অন্য দিন আজানের শব্দ শুনে লোকজন যেমন বাড়ির দিকে পা চালাত নামাজের প্রস্তুতির জন্য, আজ সে রকম বিশেষ চাঞ্চল্য দেখা যায় না। এক অনিশ্চিত অজানা আশঙ্কায় মানুষের দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহ যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে।
দুপুরের পর থেকে পথেঘাটে লোকজনের চলাচল আরও কমে আসে। বিকেল নাগাদ প্রধান রাস্তা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। একাব্বরের দোকানের ঝাঁপ অর্ধেক ফেলা। রাস্তার আশপাশে এদিক–সেদিক উৎসুক উদ্বিগ্ন মানুষের সংশয়ী জটলা। এ সময় ইউনিফর্ম পরা আনসার বাহিনীর সঙ্গে গ্রাম প্রতিরক্ষা দলের একটা প্লাটুন রাস্তা ধরে কুচকাওয়াজ করে যাচ্ছিল। রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে পৌঁছার পর হঠাৎ দলনেতার হুইসেল বেজে ওঠে। চোখের পলকে লাফ দিয়ে রাস্তার ঢালে নেমে লুকিয়ে পড়ে পুরো দলটা। আচমকা এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকে উৎসুক মানুষ রাস্তা ছেড়ে সভয়ে ছুটে পালাতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আত্মগোপনকারী দলটা রাস্তার ঢাল থেকে উঠে এসে আবার সারিবদ্ধ হলে মানুষ বুঝতে পারে, এটা ছিল একটা মহড়া।
সময়ের গতি যেন আজ বেশি অলস হয়ে পড়েছে। যা-ই ঘটুক, সেটা যেন দ্রুত ঘটে যায়, এমন অনিশ্চিত উৎকণ্ঠা আর বইতে পারছিল না মানুষ। এ সময় আসরের আজান শুরু হয়। সেই ডাকে সাড়া দেবে কি না বুঝতে পারে না কেউ। যেকোনো মুহূর্তে এসে পড়তে পারে পাঞ্জাবিরা। মানুষকে এই দোটানা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই যেন মিলগেটের দিক থেকে খই ফোটার মতো একপশলা শব্দ ছুটে আসে। সম্পূর্ণ অপরিচিত এই শব্দ শোনার পর মানুষ কী করবে বুঝতে পারে না। কেউ কেউ সন্তর্পণে সরে যায় রাস্তা থেকে। শব্দটা আগে শোনা না থাকলেও মানুষের মনে হয়, অশুভ কিছু একটা আছে তার মধ্যে। তাই বেশির ভাগ মানুষ দূরে সরে গিয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখে রাস্তার ওপর। বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না। গোঁ গোঁ শব্দ তুলে সেনাভর্তি বড় বড় ট্রাক আর জিপের বহর রাস্তার মোড় পেরিয়ে ব্যারিকেডের সামনে গিয়ে থেমে যায়। ট্রাক থেকে ঝুপঝুপ করে লাফিয়ে রাস্তায় নামে সৈন্যরা। পড়ন্ত বিকেলের রোদ তাদের লালচে চেহারাকে আরও লাল করে তোলে। রাস্তায় আড়াআড়িভাবে ফেলে রাখা বড় গাছটা সরানোর জন্য নিজেদের শক্তি খরচ করতে চায় না বলেই পালাতে না পারা লোকজনকে লাথি মেরে নিয়ে যায় ব্যারিকেড সরানোর কাজে। গুলি করছে না দেখে মানুষের ভেতরের ভয়টা কিছুটা কেটে যায়। তাই নিজেদের আড়াল করে পুরো দৃশ্যটা দেখে যায় ওরা।
ইলিয়াস এসব দেখার জন্য দাঁড়ায় না, পরিচিত আরও কয়েকজনসহ রাস্তা থেকে নেমে ফসলহীন মাঠের ওপর আড়াআড়ি ছুট দেয় খালের দিকে। ওটা পেরিয়ে ঘুর পথে পৌঁছে যাওয়া যাবে বাঙালি সৈন্যদের কাছে। এ সময় গোধূলির ম্লান আলো ধীরে ধীরে নেমে আসছিল গাছপালার জটলার ভেতর। ঠিক সে সময় ব্রিজের দিক থেকে শুরু হয় একটানা শব্দ। খই ফোটার মতো সেই শব্দের করাত দ্রুত নেমে আসা আঁধারের শরীরকে চিরে ফেলতে থাকে। খালের পাড় ধরে ছুটতে শুরু করে ওরা। চারপাশ থেকে ভেসে আসে স্বজন-বিচ্ছিন্ন মানুষের আর্তনাদ এবং চিৎকার। গুলির উৎস থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে মানুষ ছুটতে থাকে চারদিকে।
রাত বাড়তে থাকলে ধীরে ধীরে কমে আসে গুলির শব্দ। পরদিন সকালের নরম রোদ তপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করলে আবার শোনা যেতে থাকে গুলির শব্দ। এবারে কেবল একটানা একদিক থেকে নয়, বিভিন্ন দিক থেকে ভেসে আসছিল বিচ্ছিন্ন শব্দ, তবে কাল রাতের তুলনায় সেই শব্দ যেন আরও ক্লান্ত, একটানা চালিয়ে যাওয়ার শক্তি নেই। দুপুর নাগাদ সব শব্দ থেমে গেলে লুকিয়ে থাকা মানুষ সন্তর্পণে বেরিয়ে আসে। দুই বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা বের করার আগে ওদের চোখে পড়ে পাঞ্জাবি বাহিনীর পরিত্যক্ত ঘাঁটির কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা ইলিয়াসের লাশ। ওর হাতে তখনো ধরা ছিল একটা মাঝারি পাথর।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন য আরও ক র একট ল কজন র ওপর একট ন
এছাড়াও পড়ুন:
বাজারে আগাম সবজি আসতে দেরি, দাম চড়া
শীতের মৌসুম শুরু হলেও রাজধানীর বাজারে শীতের সবজির সরবরাহ এবার কম। এ কারণে দামও চড়া। বাজারে অধিকাংশ সবজির কেজি ৮০ টাকার বেশি। কিছু সবজির দাম ১০০ টাকার ওপরে।
বছরের এপ্রিল-অক্টোবর সময়টা মূলত গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুম। এ সময়ে প্রাণিজ আমিষ, অর্থাৎ মাছ, মাংস ও ডিমের দাম তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়। তাতে সবজির ওপর চাপ বাড়ে। ফলে সবজির সরবরাহ মোটামুটি থাকলেও দাম থাকে চড়া। শীতের আগাম সবজি বাজারে আসতে শুরু করলে দামও কমতে শুরু করে। শীতের আগাম সবজি বাজারে আসতে শুরু করে সেপ্টেম্বর–অক্টোবরে।
বিক্রেতারা বলছেন, এ বছর শীতের আগাম সবজি আসতে তুলনামূলক বেশি সময় লাগছে। এ কারণে দীর্ঘ সময় ধরে বাজারে চড়া দামে সবজি বিক্রি হচ্ছে। তবে গত কয়েক দিনে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ফুলকপি, শিমসহ শীতের আগাম কিছু সবজি আসতে শুরু করেছে। এতে এসব সবজির দামও কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা কমেছে। বিক্রেতারা বলছেন, অক্টোবরের শুরুতেই আগাম শীতের সবজি বাজারে আসার কথা। কিন্তু এবার বেশ দেরিতেই এসব সবজি বাজারে এসেছে।
দেশে সবজির অন্যতম উৎপাদনস্থল যশোর। যশোরের সদর উপজেলার নোঙরপুর গ্রামের কৃষক বদরুল আলম এ বছর ৪০ শতক জমিতে আগাম মুলা চাষ করেছেন। ইতিমধ্যে ২৫ শতক জমির মুলা তিনি বিক্রি করেছেন। তিনি জানান, আবহাওয়াগত কারণে এবার আগাম সবজি একটু দেরিতে চাষ হয়েছে। এ জন্য খেত থেকে সবজি তুলতেও দেরি হয়।
এ বছর একটা লম্বা সময় ধরে বিভিন্ন অঞ্চলে টানা বৃষ্টি হয়েছে। ফলে বৃষ্টির সময়ে কেউ আগাম সবজি চাষের ঝুঁকি নেননি। এ কারণে আগাম শীতকালীন সবজি অক্টোবরের শেষে বাজারে আসা শুরু হয়েছে।আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ, অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান মাস্টার বলেন, এ বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে অনেক কৃষক ওই সময়ে আগাম সবজি চাষ করতে পারেননি। চাষাবাদ শুরু করতে দেরি হওয়ায় সবজি পেতেও দেরি হয়েছে। এতে বাজারেও প্রভাব পড়েছে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরাকৃষিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছর আগাম সবজি চাষে দেরি হওয়ার পেছনে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের টানা বৃষ্টির একটি ভূমিকা ছিল। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ সময়ে হঠাৎ টানা বৃষ্টি হয়। সামনের বছরগুলোতেও এমন পরিস্থিতি আসতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তাঁরা।
এ বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে অনেক কৃষক ওই সময়ে আগাম সবজি চাষ করতে পারেননি। চাষাবাদ শুরু করতে দেরি হওয়ায় সবজি পেতেও দেরি হয়েছে। ইমরান মাস্টার, সভাপতি, কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতিশেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ জানান, দেশে ফসল উৎপাদন মূলত প্রকৃতিনির্ভর চাষাবাদ পদ্ধতিতে এবং খোলা মাঠে হয়। এ ক্ষেত্রে বৃষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে গত কয়েক বছরে দেশে বৃষ্টির ধরন পরিবর্তন হয়ে গেছে। কখনো খুব বেশি বৃষ্টি হয়, কখনো কম। এ বছর একটা লম্বা সময় ধরে বিভিন্ন অঞ্চলে টানা বৃষ্টি হয়েছে। ফলে বৃষ্টির সময়ে কেউ আগাম সবজি চাষের ঝুঁকি নেননি। এ কারণে অন্যান্য সময় যেখানে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আগাম শীতকালীন সবজি বাজারে চলে আসে, সেখানে এবার তা অক্টোবরের শেষে আসা শুরু হয়েছে। এটিই বাজারে সবজির দাম না কমার অন্যতম কারণ।
ভিন্ন দাবি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরেরকৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর অতিবৃষ্টির কারণে দুই দফায় সবজির ক্ষতি হয়। এর মধ্যে গত আগস্টে প্রায় ১৮ দিনের বৃষ্টিতে ৩৫১ হেক্টর জমির এবং সেপ্টেম্বরে ১৫ দিনে ১২৪ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সংস্থাটির কর্মকর্তাদের দাবি, চলতি বছর শীতের আগাম সবজি আসতে উল্লেখ করার মতো দেরি হয়নি। স্থানভেদে কোথাও কয়েক দিন দেরিতে চাষ শুরু হয়েছে। তবে সেটি সার্বিক চিত্র নয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, ‘আগাম সবজির সরবরাহ কম, এটি ব্যবসায়ীদের সাধারণ কথা। আমাদের তথ্য বলছে, শীতের আগাম সবজি ইতিমধ্যে বাজারে চলে এসেছে। দেশের সব বাজারেই এখন শীতের আগাম সবজি পাওয়া যায়। দামও সহনীয় হয়ে এসেছে। আগাম সবজি যদি কম থাকত, তাহলে দাম আরও চড়া থাকার কথা ছিল।’
বৃষ্টির কারণে সবজি আসতে দেরি হয়েছে কি না—এ প্রসঙ্গে ওবায়দুর রহমান বলেন,সারা দেশে একসঙ্গে টানা বৃষ্টি হয়নি। শুধু কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধাসহ রংপুরের কয়েকটি জেলা এবং চট্টগ্রামের কিছু জেলার নিচু এলাকায় অতিবৃষ্টির প্রভাব পড়েছিল। এ ছাড়া বগুড়া, যশোর অঞ্চলে বৃষ্টির তেমন প্রভাব পড়েনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আরও জানিয়েছে, চলতি বছর শীতকালে (রবি মৌসুম) প্রায় ৬ লাখ ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অনুমান করেছে তারা। এর মধ্যে ১ লাখ ২৯ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে আগাম সবজি চাষ হয়েছে। যেসব জমিতে আগাম সবজি চাষ হয়েছে, সেখানে আবার সবজি চাষ হবে। গত বছর শীত মৌসুমে সব মিলিয়ে ৬ লাখ ৪২ হাজার হেক্টরে সবজি চাষ হয়েছিল।
করণীয় কীবিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, বৃষ্টির অস্বাভাবিকতা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে কৃষিতে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। এ সত্যকে মেনে নিতে হবে। এ পরিস্থিতিতে আধুনিক প্রযুক্তির চাষাবাদ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে এক ফসলি জমিকে দুই বা তিন ফসলি করা এবং নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো জরুরি।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ জানান, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে কৃষিতে প্রযুক্তিনির্ভর অভিযোজনের বিকল্প নেই। কম খরচে পলিথিনের শেড তৈরি করে সবজি চাষ করা সম্ভব, যা বৃষ্টি বা তাপমাত্রার পরিবর্তনে তেমন প্রভাবিত হয় না। পাতাজাতীয় শাকসবজি, মরিচ, টমেটো, বেগুন ও শসার মতো ফসল এতে সহজে উৎপাদন করা যায়। উৎপাদন স্থিতিশীল থাকলে সবজির সরবরাহ ঠিক থাকবে, কৃষকেরাও ভালো দাম পাবেন।