ভোর ছয়টায় টাঙ্গাইল সার্কিট হাউস থেকে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। বদর ভাই তখন রানিং শুরু করে দিয়েছে, আমাদের দাঁড়াতে বললেন। ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অটোতে করে নগর জালফৈ বাইপাসে এলাম, গতকালের শেষ হাঁটার স্থান থেকে আজকের হাঁটা আরম্ভ হলো।

সকালের আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক। পথেও গাছগাছালি রয়েছে অনেক। শহরের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছি। একেবারে ১০কিমি হাঁটার পর বিরতি নিলাম গপ্পের বাজারে। ভোরের দিকে হাঁটা শুরু করলে অনেক দূর খুব সহজে চলে যাওয়া যায়। বাঘিল এসে দেখা হলো সমুদ্র ভাই, ডাক্তার শাহানাজ আর শামীমের সঙ্গে। তারা ঢাকা থেকে আমাদের সাঁতারের সঙ্গী হতে এসেছে। সমুদ্র ভাই ড্রোন শট নেবে। ‘প্রাণ' এই যাত্রায় শাকিলের টাইটেল স্পন্সর তাই তাদের পক্ষ থেকে সমুদ্র ভাই ডকুমেন্টেশন করবে। আর ডাক্তার শাহানা আমাদের সঙ্গে সাঁতার কাটবে। শামীম কিছুদূর হেঁটে ঢাকায় চলে যাবে। ওমরপুরে বড় ব্রিজ পার হয়ে ডান দিকে গ্রামের সরু পথে পা বাড়ালাম কাকুয়া বাজার অবদি। গ্রামের ধুলোমাখা পথ, চারিদিকে সবুজ ধান আর ভুট্টা ক্ষেত। হীম শীতল বাতাস বইছে, ধানের সবুজ শীষগুলো হেলেদুলে নাচছে। স্নিগ্ধ এক অনুভূতি! যেন ঠিক জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’। 

আলীপুর গ্রাম দিয়ে আমরা তিনজন যমুনা নদীর পাড়ে চলে এলাম। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে, হাওয়ার তোড়ে উত্তাল ঢেউ মনে শিহরণ জাগাচ্ছে। নান্দনিক দৃশ্য আর নদীর পাড় ধরে কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে চলা আমাদের কিছুটা সজীব করলো। এই বিশাল যমুনার বুকে একটু পরেই নামতে হবে। শাকিল আর আমার জন্য অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ শাকিল ভালো করে সাঁতার কাটতে পারে না এবং লম্বা দূরত্বে হেঁটে এসে সে ক্লান্ত। আজকেও আমাদের ২৫ কিলোমিটারের মতো হাঁটতে হয়েছে। যমুনা নদী পাড়ি দেওয়ার আগে আরো একটা নদী পার হতে হবে যা বংশী নদীর উৎস মুখ। যমুনার সাথে মিলিত হবার আগে এই নদী হয়েছে ধলেশ্বরী। এখানে পানি তেমন একটা নেই, খেয়া পারাপারের নৌকা আছে স্থানীয়দের জন্য। 

আমরা সাঁতারের পোষাক পরে জলে নেমে গেলাম। শাকিল ‘সি টু সামিট’ অভিযানে হাঁটার পথে কোনো যানবাহন ব্যবহার করবে না, তাই বাধ্য হয়ে নদী পথ সাঁতরে পাড়ি দিতে হবে। যমুনা পাড়ি দেওয়ার আগে এই ধলেশ্বরী একটা ওয়ার্মআপ বলা যায়। জলে নেমে তাকে কয়েকটা সাঁতারের টেকনিক শিখিয়ে দিলাম। দেখা যাক এই অল্প সময়ে আয়ত্তে আনতে পারে কিনা। নদীর জল হীম শীতল, কোথাও বেশি কোথাও কম। খুব অল্প সাঁতারে আমরা পাড়ে পৌঁছে গেলাম। বেড়িবাঁধ ধরে কিলো ২ গেলে দলিয়াপাড়া, পাথরঘাটা ঘাট। এখানে আমাদের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। নদীতে নামবো আমরা ২ জন, আর সহযোগী হিসেবে সাঁতার কাটবে টাঙ্গাইল থেকে হেলাল ভাই, শাকিল হাসান, সোনিয়া আপা, ডাক্তার শাহানাজ, মেরাজ ও সালমান।

ঘাটে পৌঁছানোর পরে হেলাল ভাই ও অন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে হলো। ঘড়িতে বেলা ৩টা বেজে গেছে। সূর্য এর মধ্যে হেলে পড়তে শুরু করেছে। অপূর্বদা আমাদের জন্য গামছা নিয়ে এসেছেন সিরাজগঞ্জ থেকে। সমুদ্র ভাই ড্রোন উড়িয়ে দিলো। আমাদের রেডি হওয়া, ফটোসেশান, নৌকা ঠিক করা এসব কাজ করতে করতে আরো এক ঘণ্টা চলে গেলো। এদিকে নৌকায় খাবার এবং পর্যাপ্ত পানি নেওয়ার কথা কারো মাথায় আসলো না। নৌকায় ছিল টনি, সিজান ও তার বন্ধুরা, শাকিল হাসানের কয়েকজন ছোটভাই আর অপূর্বদা। প্রথম অংশের দূরত্ব অল্পখানি। সাঁতার কেটে প্যাচপ্যাচে কাদায় পা ডুবিয়ে চরের ধান ক্ষেতে উঠে এলাম সবাই। শাকিলকে আমি আর হেলাল ভাই কাছাকাছি রেখে পাড়ে নিয়ে আসলাম। 

এরপর লম্বা পথ খালি পায়ে বালু চরে হেঁটে হেঁটে যমুনা সেতুর কাছে চলে এলাম। চরে বাদাম, আলু, পেঁয়াজ চাষ হয়। খালি পায়ে বালুর মধ্যে গতি ধীর হয়। ব্রীজের কাছাকাছি এসে বুক ভরে দম নিয়ে নিলাম। বেশ খানিকটা দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। কয়েকটা স্ট্রোক দেওয়ার পর বুঝলাম নদীতে বেশ স্রোত আছে। একটু বিরাম দিলেই অনেকটুুকু পিছিয়ে যাচ্ছি। শাকিলের কাছে একবার হেলাল ভাই আরেকবার আমি পালা করে সাঁতার কাটছি। শাকিল প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে হাত পা ছুড়তে। এদিকে সোনিয়া আপার চোখ দেখে আমি একটু ভয় পেলাম। এমন ঢেউয়ের মধ্যে শাকিলকে সামলানই কঠিন হয়ে পড়েছে, এর মধ্যে অন্য কাউকে রেস্কিউ করার প্রয়োজন হলে আমাদের মিশনটাই ভেস্তে যাবে! আমাদের  দেশে অনেকেই বলে ‘গ্রামে বড় হয়েছি, সাঁতার জানি’। কিন্তু সঠিক টেকনিক আর অনুশীলন না থাকলে নদী-খাল বা সাগরে লম্বা সময় টিকে থাকা চারটিখানি কথা নয়। সাধুবাদ জানাই তারা যমুনার উত্তাল ঢেউয়ে নামার সাহস দেখিয়েছেন, তবে এই মিশনে আমাদের যমুনা পাড়ি দেবার থেকে শাকিলকে সহিসালামতে নদীর অপর প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া মূল লক্ষ্য। 

লাইফজ্যাকেট দিয়ে সোনিয়া আপাকে একটু সামলে নিলাম। তারপর শাকিলকে হোসেনের হাওলায় দিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম। বাকিরা সাধ্য মতো চেষ্টা করে এগিয়ে গেলো। হেলাল ভাই ও শাকিল হোসেন এর আগেও এই অংশে সাঁতার কেটেছে তাই তাদের উপরই আমাদের ভরসা করতে হবে। ভালোভাবে এই অংশটা পাড়ি দিয়ে চরে উঠে গেলাম। এতো শুধু চর নয় এক বিস্তীর্ণ বিরাণভূমি। বিশাল জায়গাজুড়ে নদীর বুকে চর জেগেছে, এর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আমাদের হেঁটে যেতে হবে। ব্রিজের নিচ থেকে অস্তমিত রক্তিম সূর্যকে অপার্থিব মনে হচ্ছিল। তবে প্রকৃতি দেখা বা সাহিত্য কপচানোর থেকে আমরা কখন নদী পার হবো তার টেনশনে কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমাদের পায়ে নানা কিছু বিঁধে যাচ্ছে। শাকিল, হেলাল ভাই অনেকটুকু এগিয়ে গেলো। আমি সোনিয়া আর শাহনাজ একটু দূরেই বলা যায়। আমি তাদের কিছুটা কাউন্সিলিং করছিলাম এইটুকু পথ আপনারা নৌকায় উঠে যান। এদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসছে, মনে হচ্ছে এই পথের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। শাহনাজকে সাহসী মেয়ে বলতে হবে, শটকার্ট দেখে সে বদ্ধ খালে নেমে গেলো যেখানে দুজন মাঝি জাল ফেলছিল। তারা জলদি আমদের দিকে তেড়ে এলো। শাহানাজকে একজন জিজ্ঞেস করে বসল- ‘'আপনারা কি টেরোরিস্ট?’ 

এই বিরাণভূমির মধ্যে এমনভাবে দুইজন মেয়ে মানুষ কীভাবে ঢুকে পড়লো সেই ভাবনায় তাদের মনজগত উলটপালট হয়ে গেছে। শাহানাজকে দমাতে না পেরে পেছন থেকে বলল, আমাদের নাকি শেয়ালে খাবে। আমরাও হাসলাম, এরা কি বলতে চাইলো টুরিস্ট নাকি টেরোরিস্ট! চরে হাঁটার সময় ব্রীজের উপর থেকে হয়তো আমাদের বাচ্চা ছেলেমেয়ে ভেবে এক ট্রাক ড্রাইভার চিৎকার করে বলে উঠল ‘অই তোরা বাড়ি যা, ইফতারের টাইম হইয়া গেছে, আর ঘুরিছ না’। খুব মজা পেলাম এই কথা শুনে। এতোদিন ব্রীজের উপর থেকে এই নদীকে দেখছি, এবার আমরা ব্রীজের তলদেশে হেঁটে চলেছি বিন্দু হয়ে। সকালের দিকে টাঙ্গাইল শহর পেরিয়েছি, তখন একজন জিজ্ঞেস করেছিল ‘ভাই আপনারা কোন কম্পানির লোক?’ আমি উত্তর দিয়ে দিয়েছিলাম ‘টো টো কোম্পানি’। 

ইফতারের সময় এখন। নৌকায় অনেকে রোজা। দুই বোতল পানি সবাই মিলেমিশে শেষ হয়ে গেলো। আঁধার ঘনিয়ে এলেও আপারা মানলেন না, নদীতে নেমে গেলেন।  সুইমিং গগলস ভেদ করে কিছু দেখতে পারছি না। আমরা ব্রিজের থেকে অনেকটা দূরে ডান দিকে সরে এসে জলে নামলাম যেনো স্রোত আমাদের বামে পাড়ের দিকে নিয়ে যায়। এখন ভাটার সময়, যত ব্রীজের কাছাকাছি যাবো তত বিপদের মুখোমুখি হবো। কারণ সেখানে জলের ঘুর্নায়মান অংশ। একবার সেদিকে চলে গেলে শক্তি দিয়ে আর এগোনোর উপায় থাকবে না। এই অংশে দূরত্ব আগের অংশের চেয়ে আরো বেশি। তার উপর ভাটার স্রোত আরো তীব্রতর হয়েছে, সঙ্গ অন্ধকার। নৌকায় মাঝির কাছে বা রিস্কিউ টিমের কাছে কোনো বাতি নাই। এদিকে আমরা নদীর মাঝখানে এগিয়ে যাচ্ছি আর বালুর নৌকা আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। হেলাল ভাই নদী থেকে আমাদের বোটকে ডাকতে ডাকতে হয়রান হয়ে গেছেন। মাঝি স্রোতের তোড়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়েও থাকতে পারছে না। এদিকে সোনিয়া আপা নদীর মাঝ বরাবর এসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নৌকায় উঠে যাবে। ফলে নৌকা আবার তাকে তুলতে ব্যস্ত। এদিকে আমরা শাকিলকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। শাহানাজ ছিল শাকিল হোসেনের সঙ্গে, কিন্তু তাদেরও অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। এক মুহূর্তের জন্য পুরো ঘটনাটা একটু ভেবে দেখুন কি অবস্থায় পানিতে খাবি খাচ্ছি আমরা কয়েকজন!

মিরাজ, আমি আর হেলাল ভাই শাকিলকে ধরে রেখেছি, হঠাৎ হেলাল ভাইয়ের মাসল ক্র্যাম করলো। তিনি শাকিলকে ছেড়ে দিলেন। এবার আমি শাকিলকে যতদূর পারলাম সাঁতরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালালাম। মনে হলো এক জায়গাতেই রয়ে গেছি। নিজেই নিজেকে সামলাতে পারছি না এই স্রোতের মধ্যে। এর মধ্যে আমরা লোহার ব্রিজ অর্থাৎ যেখান দিয়ে ট্রেন যায় এবং কংক্রিটের ব্রিজ পার হয়ে বামে চলে এসেছি। নৌকা আমাদের কাছে চলে এসেছে, এবার একটু মানসিক শক্তি পেলাম। হেলাল ভাইও মনে হলো একটু ঠিক হয়েছেন। তিনি শাকিলকে ধরে বাম বরাবর একটা বাতির আলো ফলো করে এগোতে লাগলেন। বাংলা চ্যানেলে সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি আসলে একটা বিন্দু দেখা যায়। মনে হয় খুব কাছে চলে এসেছি, কিন্তু তখনো আরো ৫ কিলোমিটার বাকি। এখানেও একই রকম অবস্থা অনুমেয় হলো। এতো এনার্জি কোথা থেকে এলো জানি না, প্রাণপণ সাঁতার কাটা শুরু করলাম। বুঝতে পারছিলাম স্রোত আমাকে টেনে ধরে রেখেছে। খুব কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু আমাকে পারতেই হবে। 

নৌকা থেকে বলা হচ্ছে ডান দিকে সাঁতার কাটার জন্য। এখানেও বাংলা চ্যানেলের শিক্ষা কাজে লাগালাম, নৌকা থেকে তারা দেখতে পায় আমরা পানিতে থেকে দেখি না, তাই তাদের নির্দেশনা শুনতে হবে। পায়ে মনে হলো প্রপেলার লাগানো আমার। দুই পায়ের পাতা চলছে আর ডানে এবং বামে সর্বশক্তি দিয়ে স্ট্রোক দিয়ে যাচ্ছি। বাঁচা মরার যুদ্ধ। শাকিলদের দিকে দেখলাম তারা একটু দূরে সরে যাচ্ছে, নৌকা তাদের সাথে আছে। তবে তারা স্রোতের ঘুর্নিতে পড়েছে। ব্রীজের আলোতে নদীর পাড় দেখা যাচ্ছে কিন্তু মনে হচ্ছে যোজন যোজন দূরে। গতি ধীর হলেই পিছিয়ে যাচ্ছি। মাসল ক্র‍্যাম হবার আশঙ্কাও ছিল। যাই হোক, ভাগ্য সহায় হলো, যমুনার বালুতে পা ঠেকালাম। সৃষ্টিকর্তার কাছে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে শুয়ে পড়লাম বালুতে। একটু পর শাহানাজ আর শাকিল হোসেন আমার কাছে এসে বসলো। হেলাল ভাই, মিরাজ আর শাকিলও উঠে এসেছে একটু পরে। তবে ঠান্ডায় তার হাইপোথার্মিয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। সবাই গায়ে জামাকাপড় চাপিয়ে নৌকা থেকে নেমে এলাম। এ এক অন্য রকম মিশ্র অনুভূতি। ক্লান্তি, রাগ, অভিমান সবকিছু একসাথে মিশ্রিত। 

নৌকায় থাকা শুভাকাঙ্ক্ষীরা উল্লাস করছে আমাদের নিয়ে। সম্মিলিত ছবি তোলা হলো। অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে শাকিলের চোখে পানি এলো। অন্ধকারের উম্মাদ যমুনায় সত্যি ছেলেটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এভারেস্ট হয়ত তার কাছে এই নদী পার করা থেকে সহজ হবে। এবং আশাকরি সে সেটা করেও দেখাবে। মাউন্ট এভারেস্ট চড়তে যেমন শেরপা লাগে, শাকিল আমাদের ‘নদী পারাপারের শেরপা’ বলে আখ্যায়িত করলো। প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে জীবনের শিক্ষা হিসেবে দেখলে পথ চলায় অনেক সহজ হয়।

ঢাকা থেকে শাকিল আর টনির সঙ্গে আমি হেঁটেছি ১০০ কিলোমিটারেরও অধিক পথ। সাঁতার কেটেছি প্রায় ৩ কিলোমিটার আর চরের রুক্ষ পথে হেঁটেছি প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ। নদী পার হয়ে সিরাজগঞ্জ শহরে এসে আমরা মিষ্টিমুখ করলাম। এ বিজয় এবং আনন্দ এখন শুধু শাকিলের নয়, আমাদের সবার। সি টু সামিটের সঙ্গী হয়ে দারুণ কিছু অভিজ্ঞতা, মায়া আর ভালোবাসা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা, অবিরাম শুভকামনা এবং শুভ কাজের জয় হবেই।

ভ্রমণ লেখক, আয়রনম্যান৭০.

৩ ও বাংলা চ্যানেল ফিনিসার
 

তারা//

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর দ র জন য আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

শপথ না নিয়েই মেয়রের ‘দায়িত্ব’ পালন ইশরাকের

মেয়র হিসেবে এখন পর্যন্ত শপথ নিতে না পারলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় নগর ভবনে মতবিনিময় সভা করেছেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। সোমবার দুপুরে নগর ভবনে অনুষ্ঠিত ওই সভার ব্যানারে লেখা ছিল ‘পরিচ্ছন্ন ঢাকা ও নাগরিক সেবা নিশ্চিতকল্পে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে মতবিনিময় সভা। প্রধান অতিথি ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন। মাননীয় মেয়র, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।’

সিটি করপোরেশনের প্রায় ৭০ জন পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক এই সভায় অংশ নেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন বিএনপি–সমর্থিত ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক কয়েকজন কাউন্সিলর। নগর ভবনের মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মিলনায়তনে প্রায় দুই ঘণ্টা এই সভা চলে। তবে শপথ না নিয়ে ইশরাক হোসেন কীভাবে নগর ভবনে সভা করতে পারলেন এবং কর্মকর্তা–কর্মচারীদের নির্দেশনা দিলেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শপথ ছাড়াই যেভাবে ইশরাক হোসেন ‘মেয়রের দায়িত্ব পালন’ শুরু করেছেন, তা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং আইনের সুসম্পষ্ট লঙ্ঘন। নিয়ম–নীতি ও আইনকে পাশ কাটিয়ে গায়ের জোরে কেউ মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করেন তাঁরা।

মেয়র পরিচয়ে সিটি করপোরেশনে ইশরাক হোসেনের সভা প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টা আমাদের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর। কোনো কর্মকর্তা সিটি করপোরেশনে যেতে চাইলে তাঁদের প্রতি মারমুখী আচরণ করা হচ্ছে।’

আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘বলা হচ্ছে ইশরাক হোসেনের পুরো বিষয়টিতে স্থানীয় সরকার বিভাগ আইন ভঙ্গ করেছে। আসলে স্থানীয় সরকার বিভাগ কোনো আইন ভঙ্গ করেনি। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় গেজেটের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশনেরও মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে সেখানে নির্বাচন করেই নতুন একজনকে মেয়র দেওয়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া শপথ পাঠ করানোর সুযোগ নেই। তবে আমি প্রত্যাশা করব, বিএনপির মতো একটি বড় দল নাগরিকদের ভোগান্তির কথা বিবেচনায় নেবে। একই সঙ্গে যিনি পুরো কর্মসূচি পালন করছেন, নগর ভবনে গিয়ে বসছেন, তাঁর কাছ থেকেও আরও দায়িত্বশীল ও পরিপক্ব আচরণ প্রত্যাশা করব।’

বিএনপি নেতা ইশরাককে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে তাঁর সমর্থকেরা গত ১৪ মে থেকে নগর ভবনে অবস্থান নিয়ে টানা কর্মসূচি পালন করছেন। এই কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে। কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনেই নগর ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে নগর ভবনে সব ধরনের দাপ্তরিক কাজ বন্ধ রয়েছে। শুধু মশকনিধন ও পরিচ্ছন্নতা অভিযানের কাজ চলছে। কর্মকর্তারা অফিস করতে পারছেন না। ইশরাকের সমর্থকদের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ কর্মচারী। এই কর্মসূচির মধ্যেই গত ২১ ও ২২ মে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার পাশে অবস্থান নিয়ে রাস্তা আটকে বিক্ষোভ করেন ইশরাকের সমর্থকেরা। তবে এই কর্মসূচিতে অংশ নেন মূলত বিএনপির নেতা–কর্মীরা।

নগর ভবনে গত ১৪ মে থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ কর্মসূচি ঈদুল আজহার ছুটির জন্য সাময়িকভাবে শিখিল করা হয় ৪ জুন। ৫ জুন থেকে ঈদের সরকারি ছুটি শুরু হয়। ছুটি শেষে ১৫ জুন (গত রোববার) অফিস খোলার প্রথম দিন থেকেই নগর ভবনে আবার বিক্ষোভ শুরু হয়। সেদিন ইশরাক হোসেন নগর ভবনে গিয়ে ঘোষণা দেন, ‘প্রধান ফটকের তালা খোলা হবে না, এটা আন্দোলনের একটি প্রতীক। জনগণের দৈনন্দিন সেবা, আমাদের তত্ত্বাবধানে চালু থাকবে।’

ইশরাক আরও বলেছিলেন, ‘গায়ের জোরে নয়, সাংবিধানিকভাবে ও জনগণের ভোটে আমি বৈধ মেয়র; বরং ভবিষ্যতে সরকারের বিরুদ্ধে আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করার অভিযোগ উঠবে। তাই সরকারকে বলব, দ্রুত এ বিষয়ের সমাধান করুন।’

মেয়রের দায়িত্ব বুঝে পেতে ইশরাকের আন্দোলনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এক মাস ধরে অচলাবস্থা চলছে। সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চরম অস্বস্তির মধ্যে আছি। আইন লঙ্ঘন করে কেউ যদি দাপ্তরিক কার্যক্রমে অংশ নেন, সেটি পরিষ্কারভাবে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। সব ধরনের উন্নয়নকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুদিন পর এর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।’

ব্যানারে ‘মাননীয় মেয়র’

অন্যান্য দিনের মতো সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে নগর ভবন প্রাঙ্গণে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন ইশরাকের অনুসারী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির কর্মচারীরা। ইশরাক নগর ভবনে আসেন বেলা সোয়া ১১টার দিকে। এসেই নিচতলার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মিলনায়তনে প্রবেশ করেন।

সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শকদের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টার মতবিনিময় সভায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন। সভায় উপস্থিত থাকা একাধিক সূত্র বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন।

পরে ইশরাক হোসেনকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর নামের আগে ‘মেয়র’ লেখা হচ্ছে কেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কেবল নগর ভবন নয়, যেকোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালে আয়োজকেরা ব্যানারে আমার নামের আগে মেয়র লেখেন।’ তিনি বলেন, নামের আগে মেয়র লেখার বিষয়টি তাঁর নিজের নয়, ‘জনগণের দাবি’।

ইশরাক বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করেছে, সেখানে স্পষ্টভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে আমাকে ঘোষণা করা হয়েছে।’

সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, মঙ্গলবার (আজ) দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড সচিবদের নিয়ে নগর ভবনে বৈঠক করবেন ইশরাক। আগামীকাল বুধবার মশকনিধন সুপারভাইজারদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি।

‘রাজনৈতিক কারণে’

অন্তর্বর্তী সরকার কেবলমাত্র রাজনৈতিক কারণে তাঁকে শপথ পড়িয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের চেয়ারে বসতে দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেছেন ইশরাক। সোমবার নগর ভবনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি শুরু থেকেই বলে আসছি যে আমার এই বিষয়টা (শপথ পাঠ) সম্পূর্ণ রাজনৈতিক একটা সিদ্ধান্ত ছিল। রাজনৈতিকভাবে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আমাকে বা বিএনপির প্রার্থীকে এখানে বসতে দেওয়া হবে না।’

ইশরাক বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি উচ্চ আদালতের রায় পেলেও সরকার সিটি করপোরেশনে ‘প্যারালাল’ প্রশাসন চালাচ্ছে। মেয়রের গেজেট চ্যালেঞ্জ করে করা রিটটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যখন খারিজ করে দিয়েছে, সেই মুহূর্তে থেকে দক্ষিণ সিটির প্রশাসক অবৈধ হয়ে গেছেন বলেও দাবি করেন তিনি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র পদে নির্বাচন হয় ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। সেই নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন ইশরাক হোসেন। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মেয়র পদ থেকে শেখ ফজলে নূর তাপসকে অপসারণ করে সরকার। চলতি বছরের ২৭ মার্চ একটি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ইশরাক হোসেনকে গত সিটি নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা করেন। এরপর ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে ইসি।

ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায় ও গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে করা লিভ টু আপিল গত ২৯ মে পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করেন আপিল বিভাগ। আদেশের পর ইশরাকের আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তারাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে।

উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনা করে ৪ জুন নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন (ইসি) তার কাজ সম্পন্ন করেছে। আপিল বিভাগ ইসির গেজেট বাতিল করেনি।

খারাপ নজির স্থাপন

আদালত যেহেতু ইশরাকের পক্ষে রায় দিয়েছিল, আর তখন সিটি করপোরেশনের মেয়াদ এক-দেড় মাস বাকি ছিল, ওই সময় কেন তাঁকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি তা নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ। তবে তিনি বলেন, শপথ না নিয়ে ইশরাক হোসেন নিজেকে মেয়র ঘোষণা করা বা মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এখন যা ঘটছে তা খারাপ নজির স্থাপন করা হচ্ছে। বিএনপি অনেক বড় দল। তাদের কি এসব দেখার দায়িত্ব নেই? বিএনপি ও সরকারের দিক থেকে এ বিষয়টি শক্তভাবে দেখা উচিত।

অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ইশরাক অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে মেয়রের দায়িত্ব পালন শুরু করছেন, এটি সমীচীন নয়। এভাবে সিটি করপোরেশন দখল করে দলবল নিয়ে বসে থাকায় মানুষের কাছে কী বার্তা যাচ্ছে! এভাবে চলতে পারে না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ