‘‌স্বাধীনতা’ শব্দটি উচ্চারণ মাত্র আমাদের চেতনায় এমন এক অনুভূতি সঞ্চারিত হয়, যা পরম আনন্দের। মুক্ত বাতাসে উড্ডীন পাখির যে অবারিত উন্মুক্ত পৃথিবী, তার নাম হয়তো স্বাধীনতা। কিন্তু এই উপমায় কি স্বাধীনতার তাৎপর্য সবটুকু বোঝা যায়? নিজেকে প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিই— না, বোঝা সম্ভব নয়। স্বাধীনতা এমন এক মুক্তির স্বাদ যা কোনো উপমাতেই পরিপূর্ণ করা সম্ভব নয়, এ আনন্দ অনির্বচনীয়। এ কেবল অনুভব করবার বিষয়। 

প্রিয় পাঠক কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি অনেকেই পড়েছেন। ‘রবিঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান’ থেকে শুরু করে ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা মহান পুরুষ’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের তুলনা দিয়েও স্বাধীনতার আনন্দ আর বিশালতা শেষ করতে পারেননি কবি। গ্রামের পুকুরে অবাধ উচ্ছ্বল সাঁতারের উপমায়ও তা পরিপূর্ণ হয় না। তাই কবি যেমন খুশি তেমন লেখার প্রিয় কবিতার খাতার সঙ্গে উপমিত করেন প্রিয় স্বাধীনতাকে। 

পরাধীনতার গ্লানির তিক্ত অভিজ্ঞতা না থাকলে স্বাধীনতার পরমানন্দ কিংবা তার মহিমা পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করা যায় না। প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের গ্লানির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে এই জনপদের মানুষকে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা পরাধীনতার সেই গ্লানি থেকে মুক্তির আশায় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের একটি স্বাধীন আবাসভূমি গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল নেতাও তাঁর তরুণ বয়সে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তরুণ ছাত্রনেতা মুজিবই প্রথম টের পেয়েছিলেন যে, এই স্বাধীনতায়  অবাঙালি পাঞ্জাবি-পাঠান বেলুচসহ পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালিদের স্বাধীনতার আনন্দ দিলেও বাংলার মানুষের স্বাধীনতা আসবে না। কারণ ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ১৯৪৭ সালে মুক্ত হয়ে পূর্ব বাংলা বন্দী  হয়েছিল আরেক উপনিবেশ পাকিস্তানি অবাঙালি কেন্দ্রীয় শাসকদের কাছে। আর তাই ১৯৪৮ সাল থেকেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করেছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকচক্র।

আরো পড়ুন:

অর্জন-অগ্রগতি তুলে ধরে জাতিকে সম্ভাবনার বার্তা প্রধান ‍উপদেষ্টার

ইতিহাসের পাতায় ২৫ মার্চ ১৯৭১

১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বায়ান্নর রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে নানা স্তরে স্বাধিকারের সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। সেই ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তথা বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্তাৎপর্য। 

সেই দীর্ঘ পরিসরে বিস্তৃত ইতিহাসের দিকে না তাকিয়ে আমরা যদি ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গত অর্ধশতাব্দীর আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের পরিবর্তনের দিকে তাকাই, তাহলেই বুঝতে পারি স্বাধীনতা আমাদের কী দিয়েছে! পঞ্চাশের দশকে যাদের জন্ম অর্থাৎ আমাদের প্রজন্ম হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি পাকিস্তানি দুঃশাসনে কতটা জর্জরিত ছিল এই বাংলাদেশ। কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কী চরম দারিদ্র্যে জর্জরিত ছিল এই জনপদ, তা আমাদের চেয়ে বেশি আর কেউ উপলব্ধি করবে! খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, যোগাযোগ, চিকিৎসাসহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে চরম পশ্চাৎপদ ছিল এই বাংলাদেশ। অথচ খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ তো বটেই, এমনকি উদ্বৃত্ত ফসলের অধিকারী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এই বাংলা ভূখণ্ড অর্ধাহারে অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরেছে কেবল এই ভিন্নতর সংস্কৃতির ও বাঙালি শাসকদের বৈষম্যনীতির কারণে। আর সেজন্য সঙ্গত কারণেই পাকিস্তানের পূর্বাংশ তথা পূর্ব বাংলায় বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠেছিল মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। বলতে গেলে তা ভাষা আন্দোলন তথা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি জন্মের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।

শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী,  মওলানা ভাসানী, আবদুর রশীদ তর্কবাগিশসহ বাংলাদেশের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানি শাসকচক্রের চরম বৈষম্যমূলক নীতি তথা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন এ কথা সত্য, কিন্তু তার চূড়ান্ত পরিণতি দিয়েছেন অতুলনীয় দেশপ্রেমিক সাহসী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অবিচল নেতৃত্বেই প্রায় দুই দশকব্যাপী স্বাধিকারের আন্দোলন স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধে উত্তীর্ণ হতে পেরেছিল।

এ কোনো আবেগের কথা নয়, এ হচ্ছে ইতিহাসের সত্য। দুর্ভাগ্য যে ইতিহাসের এই অনির্বাণ সত্যকেও বিতর্কিত করার অপচেষ্টা ১৯৭৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশে জারি আছে। যে শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই গণমুখী চেতনা থেকেও এ দেশের রাজনীতি বহু দূরে সরে যায়। পাকিস্তানি স্টাইলে স্বাধীন বাংলাদেশেও মুজিব হত্যার পর সামরিক শাসনের অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে। তার পরবর্তী ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। ইতিহাসের এই ঘটনা প্রবাহ স্মৃতিতে উদ্ভাসিত হলো এ কারণে যে, আজ সম্পূর্ণ ভিন্নতারা প্রেক্ষাপটে আমরা আমাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছি।

আজ ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩তম বার্ষিকী বা ৫৪তম স্বাধীনতা দিবসে যখন পেছনে ফিরে তাকাই তখন নানা চড়াই-উৎরাই এর দৃশ্যাবলী চোখের সামনে চলচ্চিত্রের পর্দার মতো জীবন্ত হয়ে ওঠে। একটা পরাধীন জাতি, ৪৭-এ স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েও চরম দারিদ্র্যে জর্জরিত, অশিক্ষা কুসংস্কারে নিমজ্জিত! এমনকি অন্ন, বস্ত্র শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদাও তার পূরণ হয় না, সে জাতিই আজ তৃতীয় বিশ্বের এক উদীয়মান বিপুল সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশ। শিক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, চিকিৎসা, যোগাযোগসহ সকল ক্ষেত্রেই যার ঘটে গেছে অভাবিত বৈপ্লবিক পরিবর্তন! পরাধীন পূর্ব বাংলার আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ আকাশ পাতাল ব্যবধান!

স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল বলেই আজ ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে অর্থবিত্তের জৌলুস। পাকিস্তান আমলে যেখানে সমস্ত শিল্পকারখানার মালিক ছিল অবাঙালি পাকিস্তানিরা, যেখানে এ দেশে কোটিপতি তো দূরের কথা, লাখপতি বাঙালিও হাতে গুনে বের করার অবস্থা ছিল না, সেই দেশেই আজ হাজার হাজার কোটিপতি শিল্পোদ্যোক্তা, বড় বড় ব্যবসায়ী, বড় বড় সামরিক বেসামরিক আমলা যা পাকিস্তান আমলে ছিল কল্পনারও অতীত।

অনেকে বলবেন স্বাধীন দেশে ধনী আরও ধনী হয়েছে। এখনো চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য আছে। গরিব ধনীর ভেদাভেদ আছে— একথা সত্য কিন্তু তারপরেও অনাহারে মানুষ মারা যাচ্ছে না এই স্বাধীন দেশে। ধনী আরো ধনী হয়েছে এবং হচ্ছে কিন্তু গরিব আরো গরিব হয়নি। দরিদ্র অতি দরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। এর সবই সম্ভব হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাঙালি জাতির আত্মপ্রকাশের কারণে। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এই কৃতজ্ঞতাবোধ দিন দিন কমে আসছে। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়েও বিভ্রান্ত। তাদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পঁচাত্তর পরবর্তী কালে রাজনৈতিক হীন স্বার্থে ইতিহাস বিকৃতির এই চরম অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। 

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ২৭ শে মার্চ থেকে হঠাৎ করে যেন শুরু হয়ে গেছে —ভাবটা এরকম! ৬৬ সালে শেখ মুজিব উপস্থাপিত বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা , আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের সম্ভাবনা এবং তা জেনারেল ইহাহিয়া, ভুট্টোদের চক্রান্তে নস্যাৎ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র— এর কোনো কিছুই তাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নেই!

এমনকি ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১ মার্চ হঠাৎ বেতার ঘোষণার মাধ্যমে জেনারেল ইয়াহিয়া খান বন্ধ করে দেয়ার পর পূর্ব বাংলায় যে গণ- অসন্তোষের দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল তারও কিছু ইতিহাসে নেই তাদের। তাদের ইতিহাসে নেই মার্চের ২ তারিখ থেকে অসহযোগ আন্দোলন, ৭ই মার্চ শেখ মুজিবের রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণ, যার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইহাহিয়ার ঢাকায় আগমন এবং শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করে জাহাজের পর জাহাজ ভর্তি  সেনা সদস্য, মারণাস্ত্র গোলাবারুদ পূর্ব বাংলায় এনে গণহত্যার নীল নকশা প্রণয়নের তথ্যও। এমনকি তারা ভুলেও উচ্চারণ করে না মানব-ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা পঁচিশে মার্চের কাল রাত্রির বয়ান। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির বিভ্রান্তি নিয়েই একাধিক প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে এই দেশে। একাত্তরের বাঙালি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ জাতি দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেছে স্বাধীনতা বিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে।

প্রজন্মের মধ্যে ছড়ানো সেই বিভ্রান্তি সম্প্রতি এত তীব্র আকার ধারণ করেছে যে, ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তি চরম আস্ফালন দেখাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে তরুণসমাজ অতীতের মতো এখন আর রুখে দাঁড়াতে পারছে না। ১৯৭১ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ এক সময় ছিল শুধু স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আল বদর আর জামাত-শিবিরের মধ্যেই বিব্রতকর একটি উপসর্গ। এখন তরুণ প্রজন্মেরও একটি বিস্তৃত অংশ স্বাধীনতাবিরোধীদের দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে কিংবা বলা যায় তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। পক্ষান্তরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান  করেছিলেন যারা, সেই রাজনীতিবিদরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরি করতে পারেননি সেভাবে। 

আমরা যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী এবং অংশগ্রহণকারী তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ৭ই মার্চের সেই উত্তাল জনসভায় শেখ মুজিবের উদাত্ত আহ্বান। শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে এখনো ধনী প্রতিধ্বনিত হয় ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মশিউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই ছাত্র তরুণদের স্বাধীন বাংলার ইশতেহার পাঠ, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা— এসব ছবি চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের প্রজন্মের মধ্যে। সেদিন আমরা যারা কিশোর তরুণ যুবক ছিলাম তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মার্চ চিরজীবিত।

সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে মার্চ একটি ইংরেজি সাধারণ মাস। কিন্তু আমাদের কাছে যারা মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্বাস করি তাদের কাছে মার্চ এক ঐতিহাসিক গৌরবের মাস। অতুলনীয় আনন্দ বেদনার মহাকাব্য তুল্য একটি মাস। তাই মার্চ আমাদের চেতনায় সেই অগ্নিগর্ভ দিনগুলির ভয়াবহ স্মৃতি ফিরিয়ে আনে—যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাকিস্তানের এই অংশ একটি প্রদেশের উপর হিংস্র নেতৃত্বেও ভয়ঙ্কর হিংস্রতায় তার নাগরিকদের উপর মেশিনগান কামান ট্যাংক নিয়ে নেমে পড়ে রাতের অন্ধকারে! 

মার্চ আমাদের চেতনায় এবং স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনে সেই সব দুঃস্বপ্নের মতো ভয়াল দিনরাত্রি—যেখানে হাজার হাজার মানুষ প্রাণের ভয়ে ঘরবাড়ি ফেলে সীমান্তে পৌঁছাতে প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে। সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়েও পথে পথে প্রাণ হারায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর এদেশে তাদের অনুচর ঘাতক-দালালদের আক্রমণে। মা-বোনেরা হারায় তাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ সম্ভ্রম এবং জীবন। তারপর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ঢোকার পরেও শত শত মানুষ শরণার্থী শিবিরে মারা যায় কলেরায়, অপুষ্টিতে অর্ধাহারে অনাহারে। 

অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, শিশুখাদ্য নেই, ওষুধ নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, এমন বাস্তবতার মধ্যেও বাংলার আপামর জনগণ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সশস্ত্র হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী বাহিনী ইপিআর, আনসারসহ বাঙালি সৈনিকরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে যে যার অবস্থান থেকে। তারা তাদের পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে বাংলার আপামর জনসাধারণকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়েছে দেশের অভ্যন্তরে। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বারবার। 

কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের আম্রকাননে তথা মুজিবনগরে গঠিত ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের অসামান্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন, সেই অবিস্মরণীয় দিন-রাত্রির স্মৃতি এখনো আমাদের চেতনায় জীবন্ত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে লেখা নাটক জল্লাদের দরবার, এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ শোনা সেইসব দিনরাত্রি কী করে ভুলবো আমরা! আমাদের স্মৃতিতে তা এখনো প্রতিধ্বনিময়।

দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না, এটাই ইতিহাসের চিরন্তন সত্য। স্বাধীনতার বিধি মূলে যারা আত্মদান করেছেন সেই লক্ষ লক্ষ বীর শহীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি আজ স্বাধীনতার সূর্যকরোজ্জ্বল দিনে।

লেখক: বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক

তারা//

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ব ধ নত স ব ধ নত র র স ব ধ নত র পরবর ত প রজন ম পর প র অব ঙ ল জন ম র পর ধ ন র জন ত র স মন সরক র আনন দ

এছাড়াও পড়ুন:

পুতিন এমন কিছু চান, যা তিনি কখনোই পাবেন না

ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই বলেছেন, তিনি কোনো সাধারণ নেতা নন, সিংহাসনে আসীন একজন আইনজ্ঞ শাসক। শুরু থেকেই তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের পরিচিতির অংশ হিসেবে একসময় যে তিনি আইনশাস্ত্র পড়েছেন, সেটা ভুলে যাননি। গত মে মাসে একদল ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি তাঁদের বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত তো আমি আইনশাস্ত্রে ডিগ্রিধারী।’ সেই বৈঠকে ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, একটি শান্তিচুক্তি হলে পশ্চিমা প্রতিযোগীরা রাশিয়ায় ফিরে আসতে পারে। এর উত্তরে পুতিন আরও বলেন, ‘আপনারা যদি আমাকে চুক্তিপত্রটি দেন, তাহলে আমি উল্টেপাল্টে দেখে বলে দেব কী করতে হবে।’

আমরা সাধারণত স্বৈরাচার মানেই এমন একজনকে ভেবে নিই, যিনি আইনকানুনের তোয়াক্কা করেন না। এটা একদম সত্যি। কিন্তু পুতিনের মতো একজন একনায়কের কাছে আইনের লঙ্ঘনের চেয়ে বরং আইনের দোহাই দেওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সুশৃঙ্খল কাঠামো থেকে নির্দেশ মেনে চলতে চলতে প্রেসিডেন্টের আসন পর্যন্ত পৌঁছেছেন।

আজকের রাশিয়ায় রাজনৈতিক দমন-পীড়নের প্রতিটি নতুন ঢেউয়ের আগে নতুন কোনো আইন পাস হয় অথবা পুরোনো আইনে সংশোধন আনা হয়, যাতে আইন লঙ্ঘন না করেই আরও বেশি মানুষকে ‘আইনের আওতায়’ শাস্তি দেওয়া যায়।

একজন ব্যক্তির ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য আইনি ব্যবস্থাকে সীমাহীনভাবে ব্যবহার করে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘটনাক্রমে একটি উচ্চতর বৈধতার দাবি করে। প্রকৃতপক্ষে পুতিনের সমগ্র রাজনৈতিক জীবনই কেটেছে এমন একটি বৈধতার উৎস খুঁজতে খুঁজতে, যেটা আইনের চেয়েও গভীর। নিজের কর্তৃত্ব প্রমাণের এটা একটা ব্যক্তিগত বাতিক। এটা বিজয়ের বাসনার মতোই একটি ব্যাপার। এটাই ইউক্রেন যুদ্ধে তাকে চালিত করেছে। এ যুদ্ধের লক্ষ্য হলো সামরিক বিজয়ের মাধ্যমে রাশিয়াকে আবার বিশ্বশক্তির অভিজাত ক্লাবে ফেরত নিয়ে যাওয়া। কিন্তু এ প্রত্যাবর্তন পশ্চিমা বিশ্বের স্বীকৃতি ছাড়া অসম্ভব। আর দিন দিন এ ধারণা পরিষ্কার হচ্ছে যে পুতিন সেই স্বীকৃতি হয়তো আর কখনোই পাবেন না।

পুতিনের রাজত্ব শুরুর বছরগুলোতে একটি কৌশল কাজ করেছিল। তিনি পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে সম্মেলনে অংশ নিতেন। দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিলেন। কিন্তু ২০১২ সালে তিনি যখন আবার প্রেসিডেন্ট পদে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন, তখন দেশজুড়ে বড় ধরনের প্রতিবাদ শুরু হয়। তখন থেকেই তিনি বিধ্বংসী পশ্চিমা প্রভাবের বিরুদ্ধে তথাকথিত রুশ ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ রক্ষার লড়াই শুরু করেন।

এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের অর্থ ছিল সরাসরি পশ্চিমের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া, যার পরীক্ষাক্ষেত্র হয়ে ওঠে ইউক্রেন। ক্রিমিয়া দখলকে পুতিন একটি ঐতিহাসিক অবিচারের ‘সংশোধন’ বলে তুলে ধরেছিলেন। এর পরপরই পূর্ব ইউক্রেনে হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রার আগ্রাসন শুরু করেন। এটিকে তিনি চমকপ্রদ বিদ্যুৎ গতির আক্রমণ মনে করেছিলেন। এটা তার পশ্চিমাদের প্রতি বৈরিতাপূর্ণ নীতির চূড়ান্ত রূপ।

পুতিন এখন সেই একই দ্বিধার পড়েছেন। যতটা সম্ভব ভূখণ্ড দখল করে নেওয়া এবং দখল করা অঞ্চলের ওপর বৈধতা প্রতিষ্ঠা—এই দুয়ের মধ্যে কোন পথটি তিনি বেছে নেবেন। স্তালিনও একসময় দ্বিধায় থেকে শেষ পর্যন্ত যে পথ বেছে নিয়েছিলেন, পুতিনও সম্ভবত সেই পথেই হাঁটবেন।

এসব প্রচেষ্টা রাশিয়ার ভেতরে পুতিনের সমর্থন জয় করে নেওয়ার জন্য চোখে পড়ার মতো সফল ছিল। তবে একই সঙ্গে এগুলো রাশিয়া ও পশ্চিমের সম্পর্ক ভাঙার নয়; বরং তা নতুনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টাও ছিল। এমনকি ক্রিমিয়া দখল ও পূর্ব ইউক্রেনে সংঘাতের পরও ক্রেমলিন আলোচনার পথ অনুসরণ করে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো মিনস্ক চুক্তি। এর লক্ষ্য ছিল কূটনৈতিক একঘরে অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে প্রধান শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনার টেবিলে নিজের আসন পুনরুদ্ধার করা। সেই প্রচেষ্টাগুলো ব্যর্থ হয় এবং পুতিন আরও ঝুঁকি বাড়ানোর পথ বেছে নেন। এখন ক্রেমলিন কিছু মাত্রায় নমনীয়তা দেখাতে প্রস্তুত।

সব অনমনীয় কথাবার্তার পরও ক্রেমলিন এরই মধ্যে কিছু চরম অবস্থান থেকে সরে এসেছে। মার্চ মাসে পুতিন ইউক্রেনকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে প্রদান কিংবা যেকোনো আলোচনা শুরুর পূর্বশর্ত হিসেবে ইউক্রেনের নির্বাচন দেওয়ার মতো ধারণাগুলো নিয়ে এসেছিলেন। মস্কো এখন আর জোর দিয়ে বলছে না যে ইউক্রেনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা অর্থহীন এবং যেকোনো প্রকৃত চুক্তির আগে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে। রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা নিষিদ্ধকারী আইন বাতিলের জন্য ইউক্রেনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে দাবি তোলা হয়েছিল, সেখান থেকেও রাশিয়া নীরবে সরে এসেছে।

নিশ্চয়ই এ নতুন নমনীয়তারও একটা সীমা আছে। মস্কো এর মূল দাবিগুলো এখনো পরিত্যাগ করেনি। কারণ, গত তিন বছরে রাশিয়া এক যুদ্ধরত দেশে পরিণত হয়েছে। শত্রু হয়ে উঠেছে একপ্রকার পৌরাণিক শয়তান, সেনারা এখন নায়ক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বেশি মানুষ আর কোনো যুদ্ধে নিহত বা আহত হননি। যুদ্ধ-অর্থনীতি সচল হয়ে উঠেছে; ভিন্নমত গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি পুতিন নিজেও এখন প্রায়ই ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ না বলে সরাসরি ‘যুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করছেন। যুদ্ধ যত দীর্ঘ ও বিস্তৃত হয়, এর ফলাফল ততই বিশ্বাসযোগ্য ও জোরালো হতে হয়।

এখানেই আসে দর-কষাকষির বিষয়টি। ক্রেমলিন স্পষ্টতই দর–কষাকষির বিষয়টাকে এমন একটা হিসেবে দেখছে, যেন সেখানে তারা একটি বিজয় দাবি করতে পারে, যেটা তারা যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জন করতে পারেনি। রাশিয়া কেন ইউক্রেনকে এমন সব এলাকা থেকেও সরে যাওয়ার দাবি তুলেছে, যেগুলোর ওপর দেশটির নিয়ন্ত্রণই নেই—এর ব্যাখ্যা এখান থেকে পাওয়া যায়। পুতিনের কাছে বিজয় মানে শুধু ভূখণ্ড দখল নয়। তাঁর কাছে বিজয় মানে, শর্ত চাপিয়ে দেওয়া, নতুন করে সীমান্ত আঁকা এবং সেই নতুন বাস্তবতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়। এভাবেই পুতিন তাঁর কাঙ্ক্ষিত বৈধতা নিশ্চিত করতে পারেন।

পুতিনের এ অবস্থান বুঝতে পারাটা মোটেই কঠিন নয়। এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনে থাকা পুতিনের প্রতি সবচেয়ে সহানুভূতিশীল ব্যক্তিরাও মনে করেন যে পুতিন অনেক বেশি দাবি করছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হতাশা স্পষ্টতই বাড়ছে। শান্তির জন্য তাঁর ৫০ দিনের সময়সীমা এখন কমে এসে ‘১০ বা ১২ দিনে’ দাঁড়িয়েছে, যা তাঁর ধৈর্য ফুরিয়ে আসারই প্রমাণ। অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধক্লান্তির লক্ষণ ও বেদনাদায়ক আপসের বিষয়টি বিবেচনা করা সত্ত্বেও এটা বিশ্বাস করার এমন কোনো কারণ নেই যে মস্কোর চূড়ান্ত শর্ত মেনে নেবে। এমনকি এর কিছু অংশে যদি ওয়াশিংটন সমর্থন দেয়, তারপরও সেটা নয়।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হতাশা স্পষ্টতই বাড়ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পুতিন এমন কিছু চান, যা তিনি কখনোই পাবেন না