স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ এবং আজকের বাংলাদেশ
Published: 26th, March 2025 GMT
‘স্বাধীনতা’ শব্দটি উচ্চারণ মাত্র আমাদের চেতনায় এমন এক অনুভূতি সঞ্চারিত হয়, যা পরম আনন্দের। মুক্ত বাতাসে উড্ডীন পাখির যে অবারিত উন্মুক্ত পৃথিবী, তার নাম হয়তো স্বাধীনতা। কিন্তু এই উপমায় কি স্বাধীনতার তাৎপর্য সবটুকু বোঝা যায়? নিজেকে প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিই— না, বোঝা সম্ভব নয়। স্বাধীনতা এমন এক মুক্তির স্বাদ যা কোনো উপমাতেই পরিপূর্ণ করা সম্ভব নয়, এ আনন্দ অনির্বচনীয়। এ কেবল অনুভব করবার বিষয়।
প্রিয় পাঠক কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি অনেকেই পড়েছেন। ‘রবিঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান’ থেকে শুরু করে ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা মহান পুরুষ’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের তুলনা দিয়েও স্বাধীনতার আনন্দ আর বিশালতা শেষ করতে পারেননি কবি। গ্রামের পুকুরে অবাধ উচ্ছ্বল সাঁতারের উপমায়ও তা পরিপূর্ণ হয় না। তাই কবি যেমন খুশি তেমন লেখার প্রিয় কবিতার খাতার সঙ্গে উপমিত করেন প্রিয় স্বাধীনতাকে।
পরাধীনতার গ্লানির তিক্ত অভিজ্ঞতা না থাকলে স্বাধীনতার পরমানন্দ কিংবা তার মহিমা পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করা যায় না। প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের গ্লানির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে এই জনপদের মানুষকে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা পরাধীনতার সেই গ্লানি থেকে মুক্তির আশায় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের একটি স্বাধীন আবাসভূমি গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল নেতাও তাঁর তরুণ বয়সে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তরুণ ছাত্রনেতা মুজিবই প্রথম টের পেয়েছিলেন যে, এই স্বাধীনতায় অবাঙালি পাঞ্জাবি-পাঠান বেলুচসহ পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালিদের স্বাধীনতার আনন্দ দিলেও বাংলার মানুষের স্বাধীনতা আসবে না। কারণ ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ১৯৪৭ সালে মুক্ত হয়ে পূর্ব বাংলা বন্দী হয়েছিল আরেক উপনিবেশ পাকিস্তানি অবাঙালি কেন্দ্রীয় শাসকদের কাছে। আর তাই ১৯৪৮ সাল থেকেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করেছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকচক্র।
আরো পড়ুন:
অর্জন-অগ্রগতি তুলে ধরে জাতিকে সম্ভাবনার বার্তা প্রধান উপদেষ্টার
ইতিহাসের পাতায় ২৫ মার্চ ১৯৭১
১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বায়ান্নর রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে নানা স্তরে স্বাধিকারের সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। সেই ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তথা বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্তাৎপর্য।
সেই দীর্ঘ পরিসরে বিস্তৃত ইতিহাসের দিকে না তাকিয়ে আমরা যদি ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গত অর্ধশতাব্দীর আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের পরিবর্তনের দিকে তাকাই, তাহলেই বুঝতে পারি স্বাধীনতা আমাদের কী দিয়েছে! পঞ্চাশের দশকে যাদের জন্ম অর্থাৎ আমাদের প্রজন্ম হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি পাকিস্তানি দুঃশাসনে কতটা জর্জরিত ছিল এই বাংলাদেশ। কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কী চরম দারিদ্র্যে জর্জরিত ছিল এই জনপদ, তা আমাদের চেয়ে বেশি আর কেউ উপলব্ধি করবে! খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, যোগাযোগ, চিকিৎসাসহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে চরম পশ্চাৎপদ ছিল এই বাংলাদেশ। অথচ খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ তো বটেই, এমনকি উদ্বৃত্ত ফসলের অধিকারী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এই বাংলা ভূখণ্ড অর্ধাহারে অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরেছে কেবল এই ভিন্নতর সংস্কৃতির ও বাঙালি শাসকদের বৈষম্যনীতির কারণে। আর সেজন্য সঙ্গত কারণেই পাকিস্তানের পূর্বাংশ তথা পূর্ব বাংলায় বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠেছিল মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। বলতে গেলে তা ভাষা আন্দোলন তথা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি জন্মের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, আবদুর রশীদ তর্কবাগিশসহ বাংলাদেশের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানি শাসকচক্রের চরম বৈষম্যমূলক নীতি তথা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন এ কথা সত্য, কিন্তু তার চূড়ান্ত পরিণতি দিয়েছেন অতুলনীয় দেশপ্রেমিক সাহসী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অবিচল নেতৃত্বেই প্রায় দুই দশকব্যাপী স্বাধিকারের আন্দোলন স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধে উত্তীর্ণ হতে পেরেছিল।
এ কোনো আবেগের কথা নয়, এ হচ্ছে ইতিহাসের সত্য। দুর্ভাগ্য যে ইতিহাসের এই অনির্বাণ সত্যকেও বিতর্কিত করার অপচেষ্টা ১৯৭৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশে জারি আছে। যে শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই গণমুখী চেতনা থেকেও এ দেশের রাজনীতি বহু দূরে সরে যায়। পাকিস্তানি স্টাইলে স্বাধীন বাংলাদেশেও মুজিব হত্যার পর সামরিক শাসনের অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে। তার পরবর্তী ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। ইতিহাসের এই ঘটনা প্রবাহ স্মৃতিতে উদ্ভাসিত হলো এ কারণে যে, আজ সম্পূর্ণ ভিন্নতারা প্রেক্ষাপটে আমরা আমাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছি।
আজ ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩তম বার্ষিকী বা ৫৪তম স্বাধীনতা দিবসে যখন পেছনে ফিরে তাকাই তখন নানা চড়াই-উৎরাই এর দৃশ্যাবলী চোখের সামনে চলচ্চিত্রের পর্দার মতো জীবন্ত হয়ে ওঠে। একটা পরাধীন জাতি, ৪৭-এ স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েও চরম দারিদ্র্যে জর্জরিত, অশিক্ষা কুসংস্কারে নিমজ্জিত! এমনকি অন্ন, বস্ত্র শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদাও তার পূরণ হয় না, সে জাতিই আজ তৃতীয় বিশ্বের এক উদীয়মান বিপুল সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশ। শিক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, চিকিৎসা, যোগাযোগসহ সকল ক্ষেত্রেই যার ঘটে গেছে অভাবিত বৈপ্লবিক পরিবর্তন! পরাধীন পূর্ব বাংলার আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ আকাশ পাতাল ব্যবধান!
স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল বলেই আজ ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে অর্থবিত্তের জৌলুস। পাকিস্তান আমলে যেখানে সমস্ত শিল্পকারখানার মালিক ছিল অবাঙালি পাকিস্তানিরা, যেখানে এ দেশে কোটিপতি তো দূরের কথা, লাখপতি বাঙালিও হাতে গুনে বের করার অবস্থা ছিল না, সেই দেশেই আজ হাজার হাজার কোটিপতি শিল্পোদ্যোক্তা, বড় বড় ব্যবসায়ী, বড় বড় সামরিক বেসামরিক আমলা যা পাকিস্তান আমলে ছিল কল্পনারও অতীত।
অনেকে বলবেন স্বাধীন দেশে ধনী আরও ধনী হয়েছে। এখনো চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য আছে। গরিব ধনীর ভেদাভেদ আছে— একথা সত্য কিন্তু তারপরেও অনাহারে মানুষ মারা যাচ্ছে না এই স্বাধীন দেশে। ধনী আরো ধনী হয়েছে এবং হচ্ছে কিন্তু গরিব আরো গরিব হয়নি। দরিদ্র অতি দরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। এর সবই সম্ভব হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাঙালি জাতির আত্মপ্রকাশের কারণে। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এই কৃতজ্ঞতাবোধ দিন দিন কমে আসছে। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়েও বিভ্রান্ত। তাদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পঁচাত্তর পরবর্তী কালে রাজনৈতিক হীন স্বার্থে ইতিহাস বিকৃতির এই চরম অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ২৭ শে মার্চ থেকে হঠাৎ করে যেন শুরু হয়ে গেছে —ভাবটা এরকম! ৬৬ সালে শেখ মুজিব উপস্থাপিত বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা , আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের সম্ভাবনা এবং তা জেনারেল ইহাহিয়া, ভুট্টোদের চক্রান্তে নস্যাৎ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র— এর কোনো কিছুই তাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নেই!
এমনকি ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১ মার্চ হঠাৎ বেতার ঘোষণার মাধ্যমে জেনারেল ইয়াহিয়া খান বন্ধ করে দেয়ার পর পূর্ব বাংলায় যে গণ- অসন্তোষের দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল তারও কিছু ইতিহাসে নেই তাদের। তাদের ইতিহাসে নেই মার্চের ২ তারিখ থেকে অসহযোগ আন্দোলন, ৭ই মার্চ শেখ মুজিবের রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণ, যার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইহাহিয়ার ঢাকায় আগমন এবং শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করে জাহাজের পর জাহাজ ভর্তি সেনা সদস্য, মারণাস্ত্র গোলাবারুদ পূর্ব বাংলায় এনে গণহত্যার নীল নকশা প্রণয়নের তথ্যও। এমনকি তারা ভুলেও উচ্চারণ করে না মানব-ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা পঁচিশে মার্চের কাল রাত্রির বয়ান। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির বিভ্রান্তি নিয়েই একাধিক প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে এই দেশে। একাত্তরের বাঙালি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ জাতি দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেছে স্বাধীনতা বিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে।
প্রজন্মের মধ্যে ছড়ানো সেই বিভ্রান্তি সম্প্রতি এত তীব্র আকার ধারণ করেছে যে, ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তি চরম আস্ফালন দেখাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে তরুণসমাজ অতীতের মতো এখন আর রুখে দাঁড়াতে পারছে না। ১৯৭১ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ এক সময় ছিল শুধু স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আল বদর আর জামাত-শিবিরের মধ্যেই বিব্রতকর একটি উপসর্গ। এখন তরুণ প্রজন্মেরও একটি বিস্তৃত অংশ স্বাধীনতাবিরোধীদের দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে কিংবা বলা যায় তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। পক্ষান্তরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান করেছিলেন যারা, সেই রাজনীতিবিদরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরি করতে পারেননি সেভাবে।
আমরা যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী এবং অংশগ্রহণকারী তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ৭ই মার্চের সেই উত্তাল জনসভায় শেখ মুজিবের উদাত্ত আহ্বান। শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে এখনো ধনী প্রতিধ্বনিত হয় ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মশিউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই ছাত্র তরুণদের স্বাধীন বাংলার ইশতেহার পাঠ, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা— এসব ছবি চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের প্রজন্মের মধ্যে। সেদিন আমরা যারা কিশোর তরুণ যুবক ছিলাম তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মার্চ চিরজীবিত।
সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে মার্চ একটি ইংরেজি সাধারণ মাস। কিন্তু আমাদের কাছে যারা মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্বাস করি তাদের কাছে মার্চ এক ঐতিহাসিক গৌরবের মাস। অতুলনীয় আনন্দ বেদনার মহাকাব্য তুল্য একটি মাস। তাই মার্চ আমাদের চেতনায় সেই অগ্নিগর্ভ দিনগুলির ভয়াবহ স্মৃতি ফিরিয়ে আনে—যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাকিস্তানের এই অংশ একটি প্রদেশের উপর হিংস্র নেতৃত্বেও ভয়ঙ্কর হিংস্রতায় তার নাগরিকদের উপর মেশিনগান কামান ট্যাংক নিয়ে নেমে পড়ে রাতের অন্ধকারে!
মার্চ আমাদের চেতনায় এবং স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনে সেই সব দুঃস্বপ্নের মতো ভয়াল দিনরাত্রি—যেখানে হাজার হাজার মানুষ প্রাণের ভয়ে ঘরবাড়ি ফেলে সীমান্তে পৌঁছাতে প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে। সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়েও পথে পথে প্রাণ হারায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর এদেশে তাদের অনুচর ঘাতক-দালালদের আক্রমণে। মা-বোনেরা হারায় তাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ সম্ভ্রম এবং জীবন। তারপর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ঢোকার পরেও শত শত মানুষ শরণার্থী শিবিরে মারা যায় কলেরায়, অপুষ্টিতে অর্ধাহারে অনাহারে।
অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, শিশুখাদ্য নেই, ওষুধ নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, এমন বাস্তবতার মধ্যেও বাংলার আপামর জনগণ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সশস্ত্র হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী বাহিনী ইপিআর, আনসারসহ বাঙালি সৈনিকরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে যে যার অবস্থান থেকে। তারা তাদের পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে বাংলার আপামর জনসাধারণকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়েছে দেশের অভ্যন্তরে। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বারবার।
কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের আম্রকাননে তথা মুজিবনগরে গঠিত ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের অসামান্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন, সেই অবিস্মরণীয় দিন-রাত্রির স্মৃতি এখনো আমাদের চেতনায় জীবন্ত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে লেখা নাটক জল্লাদের দরবার, এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ শোনা সেইসব দিনরাত্রি কী করে ভুলবো আমরা! আমাদের স্মৃতিতে তা এখনো প্রতিধ্বনিময়।
দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না, এটাই ইতিহাসের চিরন্তন সত্য। স্বাধীনতার বিধি মূলে যারা আত্মদান করেছেন সেই লক্ষ লক্ষ বীর শহীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি আজ স্বাধীনতার সূর্যকরোজ্জ্বল দিনে।
লেখক: বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ব ধ নত স ব ধ নত র র স ব ধ নত র পরবর ত প রজন ম পর প র অব ঙ ল জন ম র পর ধ ন র জন ত র স মন সরক র আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস
বাবা সন্তানের ওপর ছায়ার মতো স্নেহময় এক উপস্থিতি। নিঃশর্ত ভরসার প্রতীক। সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনের প্রয়োজনে নিজের বর্তমান, এমনকি নিজের স্বপ্নও নীরবে উৎসর্গ করে দিতে পারেন যিনি– আজ তাদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর দিন। বাবা দিবস উপলক্ষে সমতা’র বিশেষ আয়োজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা বৃহত্তর বরিশালে। এখন সেই জায়গাটা পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি পৌরসভার সমুদয়কাঠি গ্রাম। তখনকার সামাজিক পরিসরে আমাদের পরিবারের অবস্থা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভালো ছিল। আমার বাবা বিজয় কুমার আইচ তখন পিরোজপুরে কাজ করতেন। তাঁর রেশনের দোকান ছিল। প্রতি শনিবার বাড়ি আসতেন। আমরা বাবার আশায় বসে থাকতাম। এটি ছিল আমাদের জন্য একরকম আশীর্বাদের মতো।
বাবার একটি ব্যবসাও ছিল। এ থেকে মূলত আমাদের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের চেয়ে সম্ভবত বাবার জ্ঞান বা বোধ উন্নততর ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য দশ গ্রামের লোকজন তাঁকে মানত। গ্রামে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকত। বাবার সঙ্গে কথা না বলে কেউ থানা-পুলিশ করতে যেত না। বাবা সবাইকে খুব বুঝিয়ে বলত– মামলা করলে কে জিতবে, কে হারবে– এটি অনেক পরের কথা। মামলা নিয়ে বরিশাল-পিরোজপুরে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে দুই পক্ষই নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তারচেয়ে বরং তোমরা নিজেরা মিটমাট করে ফেল।
গ্রামের পণ্ডিতরা তখন তালপাতায় অ-আ-ক-খ শেখাতেন হাত ধরে ধরে। আমার সেটি একদম পছন্দ হতো না। বাবা কী করলেন, তিনি একটা স্লেট ও পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। অ-আ-ক-খ দিয়ে যত ছবি আঁকা হয়, তা শেখাতেন। এর মধ্যে আমার যে ছবিটা পছন্দ হতো, সেটি আমি মনের মধ্যে গেঁথে নিতাম। যার ফলে বাবার মাধ্যমে অত্যন্ত আনন্দদায়ক এক শিক্ষা পেয়েছি আমি।
আমার বাবারা ছিলেন ৪ ভাই। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দু’জন পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আমার বাবা ও এক কাকা বাড়ি ছেড়ে যাননি। আমরা ছিলাম ৬ ভাই ৩ বোন। কাকাতো ভাই ৪ জন, বোন একজন। মোট ১৪ ভাইবোন। কাকা কম বয়সেই গত হন। বিলাসী জীবন আমাদের ছিল না। তবে গ্রামের মানুষের কাছে আমরা ছিলাম বড়লোক। পরিবারে অনেক সদস্য থাকলেও খাবারের অভাব হতো না কখনোই। এমনকি দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থায়ও খাবারের কষ্ট করতে হয়নি। আমাদের একটা গুদামঘর ছিল। সেখানে বাবা পাশের বন্দর কাউখালী থেকে সারা বছরের চাল, ডাল, পাউডার দুধ, চিনি, লবণ, গুড় এনে ড্রামে ভরে রাখতেন। বাইরে যত সংকটই থাকুক না কেন, বছরজুড়ে খাবারের অভাব হতো না। সমস্যা হতো ঝড়ের সময়। উপকূলীয় অঞ্চলে এমন ঝড় মাঝে মাঝেই আসত। কখনও ঘরের চাল উড়ে গেলে আমরা সমস্যায় পড়ে যেতাম।
অন্যদের সামনে বাবা নিজের অবস্থানের জন্যই বেশি হাসি-তামাশা করতেন না। যখন আমাদের সঙ্গে থাকতেন, তখন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো হাসি-খুশি থাকতেন। তখনকার বাবাদের আমরা মারধর করতে দেখেছি, এমনকি খড়ম দিয়ে পেটাতে দেখেছি। বাবা আমার গালে জীবনেও একটা চড় মারেনি। কোনো ভাইবোনকেও মারধর করতে দেখিনি। তখন হয়তো আরও এমন বাবা ছিলেন। তবে গ্রামে আমি এমন বাবা আর দেখিনি। সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলেও তিনি কখনও জিজ্ঞেস করতেন না, কেন দেরি করে ঘরে ফিরেছি।