Prothomalo:
2025-05-01@04:53:28 GMT

মুক্তির যুদ্ধ শেষ হয়নি

Published: 26th, March 2025 GMT

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস খোয়াবনামা লেখার পর ১৯৭১ সালকে ধরে একটা উপন্যাস দাঁড় করানোর প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। তাঁর এ পরিকল্পনায় বগুড়ার একটা পীরের পরিবার ছিল কেন্দ্রে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ‘পীরবাড়ি’ বলে পরিচিত বাড়ির সাতজন ছেলেকে এক রাতে খুন করেছিল। ধর্মের নামে এ রকম অসংখ্য বর্বর হত্যাকাণ্ড করেছে তারা এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীরা। ইলিয়াসের পরিকল্পনা ছিল মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলের পুরো জগৎ, সমাজ, ইতিহাস, চৈতন্য আর পরম্পরাকে আবিষ্কার করা। সেভাবেই তিনি কাজ করছিলেন। এর জন্য পাহাড়ি এলাকাসহ বহু স্থানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ক্যানসারের জন্য ইলিয়াসের পা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে তখন। মহাশ্বেতা দেবীর কাছে সেই সময়ে তাঁর লেখা এক চিঠিতে তিনি যা লিখেছেন—আমাদেরও যা বলতেন—তা মোটামুটি এ রকম, ‘আমার তো পা নাই। তা-ও দেখি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কতটা পাহাড়ে উঠতে পারি, কাজ করতে পারি। সে জন্য নিজের কলেজের সিঁড়ি ভেঙে প্র্যাকটিস করছি!’

প্রশ্ন হলো, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ওপর উপন্যাস লিখতে গিয়ে এত পেছনের মানুষদের কেন দেখতে চাইলেন ইলিয়াস? কেন এত পুরোনোকালের মানুষের লড়াই নিয়ে কাজ করতে হবে তাঁকে? কৈবর্ত বিদ্রোহের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কী সম্পর্ক? অতীতের বিদ্রোহ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মানুষের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে? পারে আসলে। একটা অঞ্চলে, একটা জনগোষ্ঠীতে যে লড়াইগুলো হয়, তা মানুষকে তার স্বপ্নের সমান বড় করে তোলে। তার স্মৃতি থেকেই যায়, ধারাবাহিকতায়, পরম্পরায়, অচেতনে—নিঃশেষ হয়ে যায় না। ফুলবাড়ী গণ-অভ্যুত্থানের অঞ্চলে যেমন সন্ধান পাই তেভাগা আন্দোলনের লড়াই, যা মানুষকে এখনো শক্তি দেয়। ইলিয়াসের খোয়াবনামায় তাই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের শহীদ মজনু শাহ পাকুড়গাছে বসে এ সময়ের মানুষদের চৈতন্যকে নাড়া দিতে থাকে। অনেক ব্যর্থতার ওপরেই আসলে সাফল্য দাঁড়ায়। রোজা লুক্সেমবুর্গের একটা কথা মনে পড়ে, ‘ইউ লস, ইউ লস, ইউ লস, ইউ উইন।’ হারতে হারতে হারতে তারপরে বিজয় অর্জন করা যায়।

বাংলাদেশের মানুষ কী করে, কোন সাহসে, কোন বলে, কোন চৈতন্যে, কোন স্বপ্নের জোরে কিংবা ঘোরে একটা ভয়ংকর, প্রশিক্ষিত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সংগঠিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করতে পারল? আসলে একটা জনগোষ্ঠীর সাহস বা শক্তি একটা নির্দিষ্ট সময়ে তৈরি হয় না। জাগরণে–স্বপ্নে–চেতনে-অচেতনে তার সুতা বাঁধা থাকে নানা কালে নানা উত্থানের সঙ্গে। ১৯৭১ সালে যখন কাদাপানি, খাল-নদী, গ্রাম-শহরে আমাদের মরণপণ যুদ্ধ হচ্ছে, আমরা তখন মানুষের মুখে ক্ষুদিরামের গান শুনি কিংবা প্রীতিলতা-সূর্য সেনের গল্প শুনি। ব্রিটিশবিরোধী লড়াই, ফকির-সন্ন্যাসী-সিপাহি-সাঁওতাল বিদ্রোহ, টঙ্ক-নানকার-তেভাগা আন্দোলন আমাদের শক্তি জোগায়, ভাষা আন্দোলনের সালাম-বরকত ডাক দেয়, রোকেয়ার কথা আসে। শুধু দেশের অতীত থেকে ডাক শুনি তা নয়, কাছাকাছি সময়ের সীমান্তের বাইরের ভিয়েতনামের গল্প আসে, চীন বিপ্লবের গল্প আসে, কিউবার বিপ্লবীরা আসে, ব্রিটিশবিরোধী ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের যাঁরা স্মরণীয় তাঁদের কথা আসে, গল্প আসে, উপন্যাস আসে, এমনকি প্রাচীনকালের দাসবিদ্রোহ থেকে শুরু করে ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব—সবকিছুই আমাদের কোনো না কোনোভাবে উৎসাহিত করে, শক্তি দেয়। জানা-অজানা এ যোগই আমাদের বড় করে তোলে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে তাই বিশাল ঐতিহাসিক ক্যানভাসের মধ্য দিয়েই দেখতে হবে। এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ সময়ের মুক্তির যে যুদ্ধ, তার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সাল, যা সেই বছরে শেষও হয়নি। ধারাবাহিকতায় তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন পর্ব। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানেও তাই তার উপস্থিতি পাই, অপূর্ণ প্রত্যাশার পুনরুচ্চারণ দেখি, পুনরুজ্জীবন দেখি। এ সময়ে আবার একাত্তরের গান কিংবা স্লোগান উদ্বুদ্ধ করে তরুণদের। সে কারণেই ১৯৭১ বা মুক্তিযুদ্ধ শুধু অতীতের বিষয় নয়, খুবই বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের বিষয়।

এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ সময়ের মুক্তির যে যুদ্ধ, তার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সাল, যা সেই বছরে শেষও হয়নি। ধারাবাহিকতায় তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন পর্ব। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানেও তাই তার উপস্থিতি পাই, অপূর্ণ প্রত্যাশার পুনরুচ্চারণ দেখি, পুনরুজ্জীবন দেখি। এ সময়ে আবার একাত্তরের গান কিংবা স্লোগান উদ্বুদ্ধ করে তরুণদের। সে কারণেই ১৯৭১ বা মুক্তিযুদ্ধ শুধু অতীতের বিষয় নয়, খুবই বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের বিষয়।

আমাদের ইতিহাসে সামরিক শাসনসহ নানা বর্ণের স্বৈরশাসন দেখেছি বারবার। পাকিস্তানকালে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন শুরু হলো। সেই সামরিক শাসন ১৯৬০-এর দশকজুড়ে বাংলাদেশ শুধু নয়, সারা পাকিস্তানের জনগণের ওপর নিপীড়ন-আধিপত্যের পাথর হয়ে থাকল। ওই দশকে একদিকে বহু দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক শাসনের বর্বরতা চলছে, আবার সেই সময়েই বিভিন্ন দেশে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম চলছে, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনও ব্যাপকতা লাভ করছে। প্রবল পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলা করে কিউবার অবিরাম এগিয়ে যাওয়া, ভিয়েতনামের অপুষ্ট দুর্বল মানুষদের প্রবল লড়াই বাংলাদেশের মানুষকেও অসীম সাহস জোগায় তখন।

ওই একই দশকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, টঙ্গীসহ সব জায়গায় আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, বৈষম্য ও জুলুমের বিরুদ্ধে কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র আন্দোলন ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মতো শক্তিশালী উত্থানপর্ব তৈরি করেছে। শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা আন্দোলনের কারণে এবং পরে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র আওতায় বন্দী ছিলেন। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিপুল জনপ্রিয় নেতা হিসেবে তিনি মুক্তি পেলেন। ওই দশকে শিক্ষার্থী, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনে বামপন্থীদের প্রাধান্য ছিল, যা বিভিন্ন কারণে দ্রুত কমতে থাকে এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারা প্রধান ধারায় পরিণত হয়।

১৯৭০ সালের শেষ দিকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। একটি ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাস, অন্যটি পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। সেই জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় অঞ্চলের কত মানুষ মারা গেছেন, তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট জানা যায়নি, তবে তা ১০ লাখের কম নয়। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের কোনো মনোযোগ দেখা যায়নি। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী, বৃহৎ বুর্জোয়াশ্রেণি, আমলাতন্ত্র ও বৈষম্যবাদী রাজনীতিবিদেরা নির্বাচন হজমের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছিলেন, কিন্তু কাজ হয়নি। পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির জুলুম, অবহেলা, অপমানসহ জাতিগত ও আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে।

সামরিক শাসনের আইনগত কাঠামোর অধীন সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তাতে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সম্ভাবনায় পাকিস্তানের শাসনভিত্তি আতঙ্কিত হলো এবং কোনো সমাধানের পথে না গিয়ে আলোচনার নামে প্রতারণা চালিয়ে ২৫ মার্চ শুরু করল অভাবিত মাত্রায় নৃশংস গণহত্যা। সে রাতেই বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানকে চূড়ান্ত বিদায় জানিয়ে শুরু করেছে সর্বাত্মক বিদ্রোহ। পরের কয় মাসে দেশের সব প্রান্তে ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ, লুটপাট, ধর্ষণসহ দোজখি সব জুলুম চলেছে মানুষের ওপর। বিপরীতে সর্বস্তরের মানুষের জনযুদ্ধ দেশের সব প্রান্তে গড়ে তুলেছে অসাধারণ সশস্ত্র প্রতিরোধ।

শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হলেন ২৫ মার্চ রাতে। তিনি পুরো যুদ্ধেই অনুপস্থিত ছিলেন। তবে তাঁর অনুপস্থিতির মধ্যেও তিনিই ১৯৭১ সালের যুদ্ধের নেতা ছিলেন। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ পুরো যুদ্ধকালে অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিল। দেশের মানুষ যুদ্ধের পাশাপাশি তাঁর মুক্তির জন্য দোয়া-প্রার্থনা করেছেন, মুসলিম নারী-পুরুষ রোজা রেখেছেন। আবার এই শেখ মুজিবের শাসনকালই এ দেশে স্বৈরশাসনের সূচনা করেছিল। খুন, নৈরাজ্য, দুর্ভিক্ষ, বিরোধী মতের মানুষদের ওপর অত্যাচার ইত্যাদি মানুষের বিশাল প্রত্যাশাকে চুপসে দিয়েছিল। কিন্তু এর আগের ইতিহাসে তিনি ছিলেন অতুলনীয় জনপ্রিয় নেতা। শ্রমিক-কৃষক, শিক্ষাথী, নারী-পুরুষের পাশাপাশি সামরিক, আধা সামরিক বাহিনী পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনীর মধ্যে জিয়ার নাম বেশি আসে ‘প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের পক্ষে’ তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য, যা হতবিহ্বল মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জিয়ার রাজনীতি নিয়েও প্রশ্ন আছে, তিনিও দেশের শাসকশ্রেণির অংশ। সামরিকীকরণ, সামরিক বাহিনীর ভেতরে অনেক হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি অনেক বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধের এক বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন, যা ঐতিহাসিক সত্য।

একাত্তরের যুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, যেখানে কতিপয় অপরাধী ছাড়া সমাজের সব অংশ সর্বাত্মক অংশগ্রহণ করেছে। একটি চেতনাই তখন প্রধান হয়ে উঠেছিল যে আমরা এমন এক দেশ বানাব, যা পাকিস্তানের মতো হবে না, যেখানে ধর্মকে জালেমরা জুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে না, যে দেশে পাকিস্তানের মতো জাতি-বর্ণ-ধর্ম-শ্রেণিগত বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা থাকবে না, যেখানে সব সম্পদ কতিপয়ের হাতে কেন্দ্রীভূত হবে না। নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু শ্রেণি, লিঙ্গ, ধর্ম ও জাতিগত বৈষম্য থেকে মুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যে রাষ্ট্র এখন দেখছি, সেটির জন্য বাংলাদেশের মানুষ লড়াই করেনি।

মুক্তিযুদ্ধের দুর্বলতা সম্পর্কে, তার নেতৃত্বের শ্রেণিচরিত্র সম্পর্কে, নেতৃত্বের ভূমিকা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার নিশ্চয়ই যুক্তি আছে। এটা বলারও যুক্তি আছে যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যথার্থ মুক্তির যুদ্ধ হিসেবে বিকশিত হতে পারেনি। হলে দেশ আজ এ রকম অবনত, দারিদ্র্য, বৈষম্য ও নিপীড়নে জর্জরিত থাকত না। কিন্তু তাতে মানুষের লড়াইয়ের বিশালত্ব খর্ব হয় না।

মানুষের মুক্তির চেতনার ধার নষ্ট করার জন্য, স্বপ্নযাত্রা থেকে দেশকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক রকম চেষ্টা করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে শ্রেণিমৈত্রী গড়ে তুলেছে মুক্তিযুদ্ধের তথাকথিত সপক্ষ শক্তি। নতুন শ্রেণিশক্তির আধিপত্য বৈষম্য বাড়িয়েছে। শাসকশ্রেণির নানা গোষ্ঠী একদিকে মুক্তিযুদ্ধ, অন্যদিকে ধর্মকে জনবিরোধী রাজনীতির বর্ম হিসেবে অবাধে ব্যবহার করে দেশে স্বৈরশাসন ও দুর্নীতি-দখল-লুণ্ঠন-সম্পদ পাচারের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছে।

সে জন্যই মুক্তির যুদ্ধ আমাদের শেষ হয়নি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান এই লড়াইকেই আবারও স্পষ্টভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। শোষণ-পীড়ন থেকে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির লড়াই, সাম্রাজ্যবাদসহ সব রকম আধিপত্য কিংবা লুণ্ঠন পাচারবিরোধী লড়াই, গণতন্ত্রের লড়াই, নারীর লড়াই, ধর্ম–লিঙ্গ ও জাতিগত বৈষম্যবিরোধী লড়াই, নতুন সমাজের লড়াই—সবই মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতার অংশ। এটাই আমাদের বর্তমান এবং তৈরি করছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ধ র ব হ কত য় ১৯৭১ স ল র আম দ র কর ছ ল র জন য সময় র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যে বাস্তবতা ভোলা যাবে না

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এই ২৪ বছর ধরে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানকে তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যেভাবে ‘অভ্যন্তরীণ কলোনি’ হিসেবে লুণ্ঠন, শোষণ, বঞ্চনা, পুঁজি পাচার ও অমানুষিক নিপীড়নের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিল, সে সম্পর্কে নিচে কয়েকটি নজির উপস্থাপন করছি। এগুলো জানার পর বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কারোরই পাকিস্তানপ্রেমী হওয়া অযৌক্তিক। কেউ যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবিরোধী হয়, সেটাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করলে দোষণীয় নয়। কিন্তু পাকিস্তান তো এখনো বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। 

১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ ছিল পাকিস্তানের জনগণের ৫৬ শতাংশ, কিন্তু উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্তগুলো প্রমাণ করছে, কত নির্মমভাবে পাকিস্তানের শাসকমহল পূর্ব পাকিস্তানকে (‘পূর্ব বাংলা’ থেকে যার নাম ১৯৫৫ সালে হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’) বঞ্চনা, শোষণ, লুণ্ঠন, পুঁজি-পাচার ও বৈষম্যের শিকার করেছিল—

১. প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের ৭৫-৭৭ শতাংশই আসত পূর্ব বাংলার রপ্তানি পণ্য থেকে। ওই রপ্তানি আয়ের প্রায় পুরোটাই ১৯৪৭-৪৮ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার দখলে নিতে শুরু করেছিল। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন যখন জোরদার হতে শুরু করেছিল, তখন বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ পূর্ব পাকিস্তানে বরাদ্দ করা হলেও ১৯৪৭-১৯৭১ এই ২৪ বছরের শেষে এসেও কখনোই বছরে রপ্তানি আয়ের এক-পঞ্চমাংশও পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের ভাগে পায়নি, এই ২৪ বছরের গড় বার্ষিক হিস্যা ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ।

২. ইঙ্গ-মার্কিন বলয়ে অবস্থান গ্রহণের কারণে পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন দাতাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার পেয়েছিল। ২৪ বছরে ওই বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ১৭ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতার পর ওই ১৭ শতাংশ ঋণের দায়ভার বাংলাদেশ গ্রহণ করার পরই কেবল দাতাদেশ ও সংস্থাগুলো নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশকে ঋণ ও অনুদান দিতে রাজি হয়েছিল।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি

৩. পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২৪ বছরে পাকিস্তানের ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছিল, তার মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের ঋণগ্রহীতারা পেয়েছে, বাকি ৯২ শতাংশই পাকিস্তানের সরকার ও শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা কবজা করে নিয়েছেন।

৪. ওই ২৪ বছরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারি বাজেটের মাত্র ২৮ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত হয়েছিল, বাকি ৭২ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে।

৫. ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত পাকিস্তানের তিনটি পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় বরাদ্দের মাত্র ২৯ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে।

৬. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানিদের অনুপাত কখনোই ৭ শতাংশ অতিক্রম করেনি। সশস্ত্র বাহিনীগুলোর অফিসারদের মধ্যে বাঙালিদের অনুপাত এমনকি ৫ শতাংশেও পৌঁছায়নি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।

৭. ১৯৭০ সালে খোদ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত প্রাইভেট খাতের শিল্পকারখানার মাত্র ১১ শতাংশের মালিক ছিল বাঙালিরা, বাকি ৮৯ শতাংশের মালিক ছিল হয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা নয়তো অবাঙালিরা। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত একটি শিল্পকারখানার মালিকও বাঙালি ছিল না।

৮. মুক্তিযুদ্ধের সময় ডিসেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব ব্যাংকের ভল্ট খালি করে অর্থ পাচার করে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের রিজার্ভের সব সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছিল পাকিস্তানে।

৯. ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল প্রশাসনে বাঙালি ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ, আর বাকি ৮৪ শতাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ও অবাঙালিরা।

১০. যখন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকা নৌবাহিনীর জাহাজ, বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টারের একাংশ এবং পিআইএর বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ বার্মার সহায়তায় পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পেরেছিল পাকিস্তান সরকার।

১১. পাকিস্তানের তিনটা রাজধানী করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদের বিপুল নির্মাণ ব্যয়ের সিংহভাগই বহন করেছিল পূর্ব পাকিস্তান।

১২. ২৪ বছরে পাকিস্তান সিন্ধু নদ ও এর শাখাগুলোতে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচব্যবস্থা গড়ে তুলেছে বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে। এ কারণে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের ৬৫ শতাংশ কৃষিজমি ১৯৭০ সালে সেচের আওতায় এসেছিল। এর বিপরীতে ওই ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র ২২ শতাংশ কৃষিজমি সেচের আওতায় আনা হয়েছিল। উপরন্তু আর্থিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যার সমাধানে অর্থায়ন করতে বারবার অস্বীকার করেছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার।

স্বাধীনতা-উত্তর ৫৪ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন বারবার বিঘ্নিত হলেও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২০২৫ সালে ২ হাজার ৭৫০ ডলার ছাড়িয়েছে, অথচ পাকিস্তানের মাত্র ১ হাজার ৫৪৭ ডলার। এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য কতখানি যৌক্তিক ছিল।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার সরকারের মতো ভারতের কাছে নতজানু হবে না, সেটাই যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের সীমানার প্রায় তিন পাশ ঘিরে থাকা বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় না রাখলে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি।

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যে বাস্তবতা ভোলা যাবে না