হঠাৎ বাঁধ ভেঙে আশাশুনিতে ডুবছে একের পর এক গ্রাম
Published: 1st, April 2025 GMT
বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় সাতক্ষীরা আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নবাসীর ঈদের দিন রাত কেটেছে নির্ঘুম। খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে জোয়ারের তোড়ে গতকাল সোমবার রাতে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ইউনিয়নের ২০ হাজারের বেশি মানুষ। ভেসে গেছে চার শতাধিক মৎস্যঘের। তলিয়ে গেছে ৫০০ বিঘা বোরো ধান। ঘরবাড়ি ছেড়ে তিন শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে অন্যত্র। অনেকেই ঘরবাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা ঠেকাতে গত ৩০ ঘণ্টাও বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু করা যায়নি। দ্রুত সংস্কার করা না গেলে শুধু আনুলিয়া ইউনিয়ন নয়, পার্শ্ববর্তী আরও তিনটি ইউনিয়ন পানিতে তলিয়ে অসংখ্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সাতক্ষীরা থেকে আশাশুনি ২৫ কিলোমিটার। সেখান থেকে আরও ২৫ কিলোমিটার গেলে আনুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ। পরিষদের দক্ষিণে আরও তিন কিলোমিটার গেলে বিছট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়–সংলগ্ন খোলপেটুয়া নদীর ভাঙন এলাকা।
আজ মঙ্গলবার সকালে সাড়ে ৯টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, ভাঙনকবলিত এলাকা দিয়ে গ্রামের মধ্যে হু হু করে পানি ঢুকছে। স্থানীয় উদ্যোগে কয়েক শ মানুষ ভাঙন দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করেছেন। আর কয়েক হাজার উৎসুক মানুষ জড়ো হয়ে দূর থেকে ভাঙনকবলিত এলাকা দেখছেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের পক্ষে মাইকিং করে জানানো হচ্ছে আগামীকাল বুধবার সকাল সাতটার মধ্যে প্রতিটি বাড়ির নারীরা বাদে পুরুষদের বাঁধ সংস্কারে অংশ নেওয়ার জন্য।
বিছট উচ্চমাধ্যমিক মডেল হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আবু দাউদ জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিছট গ্রামের যে স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে, ওই স্থান দীর্ঘদিন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। এ ছাড়া স্থানীয় মৎস্যঘেরে পানি তোলার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডর বাঁধ ছিদ্র করে পাইপ বসিয়ে পানি তোলার কারণে হঠাৎ বাঁধটি ধসে যায়। গতকাল সকাল সাড়ে আটটার দিকে ঈদের নামাজ পড়ার সময় গ্রামবাসী জানতে পারেন, হঠাৎ বাঁধটি ধসে গ্রামের মধ্যে পানি ঢুকছে। নামাজ শেষ না করেই কয়েক হাজার মানুষ এক হয়ে বাঁধটি সংস্কারের চেষ্টা করেন। কিন্তু বেলা ১১টার দিকে তাঁদের সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এ কারণে খোলপেটুয়া নদীর পানিতে একের পর এক গ্রামে পানি ঢুকতে শুরু করে।
আবু দাউদ বলেন, তাঁর বিদ্যালয় এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্রে। ১০ এপ্রিল থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু। বাঁধ সংস্থার করা না গেলে তাঁর বিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
আনুলিয়া ইউপির ৪, ৫ ও ৬ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য আকলিমা খাতুন বলেন, গ্রামের পর গ্রাম তলিয়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কীভাবে বাঁধ সংস্কার করা যাবে। ইতিমধ্যে তাঁর ওয়ার্ডের একাধিক কাঁচা বাড়ি ধসে গেছে। বিছট গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার বাড়ি ছেড়েছে।
আনুলিয়া ইউপির চেয়ারম্যান মো.
ইউপির চেয়ারম্যানের দাবি, দ্রুত ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করা না গেলে শুধু আনুলিয়া ইউনিয়ন নয়, পার্শ্ববর্তী খাজরা, বড়দল ও প্রতাপনগরের একাংশ পানিতে প্লাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারি সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলে তিনি এলাকাবাসীর স্বার্থে আগামীকাল সকাল সাতটা থেকে বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু করবেন।
ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে কীভাবে তাড়াতাড়ি বাঁধ সংস্কার করা যায়, এ বিষয়ে চেষ্টা চলছে। এসব বাঁধ তদরকির ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় মৎস্যচাষিরা ইচ্ছেমতো বাঁধ কেটে পাইপ ঢুকিয়ে পানি তুলেছেন। এ কারণে দুর্বল বাঁধ আরও দুর্বল হয়ে ধসে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের খুলনা অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সৈয়দ শহিদুল আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে বলেন, ঈদের কারণে দক্ষ শ্রমিক না পাওয়ায় বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। আশা করছেন, আগামীকাল কাজ শুরু করতে পারবেন। ইতিমধ্যে বাঁধ মেরামতের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ভাঙনকবলিত এলাকায় নিয়ে আসা হয়েছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শত ধ ক
এছাড়াও পড়ুন:
নীতি সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ, কী প্রভাব পড়তে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতে
অবশেষে সুদের হার কমিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের পর এই প্রথম সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে দুর্বলতার লক্ষণ, আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্ব, কর্মঘণ্টা কমে যাওয়া ও নতুন চাকরি সৃষ্টির গতি কমে যাওয়ায় ফেড এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ২৫ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে ৪ থেকে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়ার পর ফেড চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেন, অক্টোবর ও ডিসেম্বর মাসে সুদহার আরও কমতে পারে। তিনি বলেন, শ্রমবাজারের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা এখন তাঁর ও সহকর্মী নীতিনির্ধারকদের প্রধান উদ্বেগ। খবর রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক দিন ধরেই ব্যাপক হারে সুদ কমানোর দাবি তুলছিলেন। তাঁর বক্তব্য, এতে অর্থনীতি চাঙা হবে। তবে ফেডের এ সিদ্ধান্ত তাঁর প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। ফেডের পর্ষদে নতুন গভর্নর স্টিফেন মিরান ছিলেন একমাত্র ভিন্নমতাবলম্বী। তিনি ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট হারে সুদহার কমানোর পক্ষে ছিলেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও বড় কাটছাঁটের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সুদের হার নির্ধারণে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রশ্ন সব সময়ই তোলা হয়। ট্রাম্প সম্প্রতি ফেডের এক গভর্নর লিসা কুককে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও কুক আদালতের লড়াইয়ে আপাতত নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন এবং বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান মিরানকে ফেডের পর্ষদে বসান।
শ্রমবাজারে দুর্বলতাপাওয়েল বলেন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে, তরুণেরা আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছেন। সামগ্রিকভাবে চাকরি সৃষ্টির গতি খুবই কম। শ্রমবাজারকে আর দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না।
পাওয়েল আরও সতর্ক করেন, নতুন চাকরির সংখ্যা এখন বেকারত্বের হার স্থিতিশীল রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে সামান্য ছাঁটাইও বেকারত্ব বাড়িয়ে দিতে পারে।
মূল্যস্ফীতি বনাম কর্মসংস্থানমূল্যস্ফীতি এখনো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে বছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতির হার ৩ শতাংশে উঠবে, যেখানে ফেডের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২ শতাংশ। কিন্তু ফেড মনে করছে, কর্মসংস্থানের ঝুঁকি এখন বেশি গুরুত্ব পাওয়ার মতো বিষয়।
ফেডের নতুন পূর্বাভাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়িয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ করা হতে পারে বলা হয়েছে। বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশেই স্থির থাকবে বলে তারা অনুমান করছে।
রাজনৈতিক টানাপোড়েনএ সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক নাটকও কম ছিল না। ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা থাকলেও ফেডের পর্ষদের অন্য দুই ট্রাম্প-মনোনীত গভর্নর মিশেল বোম্যান ও ক্রিস্টোফার ওয়ালার শেষ পর্যন্ত মূল সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়েছেন। ওয়ালার বরাবরই শ্রমবাজারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলে আসছেন।
পাওয়েল অবশ্য পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘আমাদের সংস্কৃতির মূল বিষয় হলো তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত। আজকের বৈঠকে সুদহার ব্যাপক হারে কমানোর বিষয়ে বিপুল সমর্থন ছিল না।’
বাজারের প্রতিক্রিয়াসুদহার কমানোর ঘোষণার পর ওয়াল স্ট্রিটে প্রথমে শেয়ারের দাম বাড়লেও পরে ওঠানামা করে। শেষমেশ মিশ্র পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন শেষ হয়। ডলার কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে ঠিক, কিন্তু ট্রেজারি বন্ডের সুদ প্রায় অপরিবর্তিত। বাজার এখন প্রায় নিশ্চিত, অক্টোবরের বৈঠকেও সুদ কমানো হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ফেডের সাম্প্রতিক নীতি পরিবর্তনের মানে হলো তারা এখন ধীরে ধীরে ‘নিরপক্ষে’ অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সাময়িকভাবে কিছুটা বাড়লেও ২০২৬ সালের মধ্যে স্থিতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নীতিসুদ কীকেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদহারে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ দেয়, সেটাই নীতি সুদহার। ইংরেজিতে একে বলে রেপো রেট। রেপোর বাংলা হচ্ছে পুনঃক্রয় চুক্তি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে এটি পরিচিত। অর্থনীতিতে নগদ তারল্যের জোগান দিতে বা অন্যভাবে বলতে গেলে ব্যাংকগুলোর জরুরি প্রয়োজনে অর্থ সরবরাহ করতে মুদ্রানীতির এ হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ হাতিয়ার ব্যবহার করে।
কোভিডের পর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তখন ফেডারেল রিজার্ভ বাজারে মুদ্রার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে দফায় দফায় নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। ফলে নীতি সুদহার গত দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২৫ থেকে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশে উঠে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহারের প্রভাববিশ্ব অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিসুদের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। ফেডের নীতিসুদের হার বাড়লে ট্রেজারি বন্ডের দাম কমে এবং সুদহার কমলে ট্রেজারি বন্ডের দাম বাড়ে। এর কারণ হলো বাজারে নতুন ও অধিক সুদের বন্ড আসার পর পুরোনো বন্ডের কুপন (সুদ) কম মনে হয়, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম কমে যায়। আবার যখন সুদের হার কমে, তখন নতুন বন্ডের কুপন কম হওয়ায় পুরোনো বন্ডের উচ্চ কুপনযুক্ত সুদ বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম বেড়ে যায়।
নীতিসুদ কমলেও একই প্রক্রিয়া ঘটে, তবে বিপরীতভাবে। সুদের হার কমলে নতুন বন্ডের কুপনও কমে যায়। এতে আগের উচ্চ সুদের কুপনযুক্ত বন্ডগুলো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বিনিয়োগকারীরা এই পুরোনো বন্ডগুলো কিনতে আগ্রহী হন, ফলে সেগুলোর দাম বেড়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা তখন তুলনামূলক ঝুঁকিপূর্ণ বাজারেও বিনিয়োগ আগ্রহী হন। এতে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়ে এবং ডলারের চাপ কিছুটা কমে।
সে কারণে বাজার নীতি সুদহারের দিকে তাকিয়ে থাকে, সুদ কমলে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়।