মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘স্বাধীনতা দিবসের’ শুল্ক আরোপের একটি স্পষ্ট চিত্র এখন আমাদের কাছে আছে। এটি কীভাবে অন্যান্য বাণিজ্যিক অংশীদারের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রকেও প্রভাবিত করবে, তাও বুঝতে পারছি। 

মার্কিন প্রশাসন দাবি করছে, আমদানির ওপর এই শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমাবে এবং যেগুলোকে তারা অন্যায্য এবং একতরফা বাণিজ্য অনুশীলন হিসেবে মনে করে, তা মোকাবিলা করবে। ট্রাম্প বলেছেন, এই দিনটি চিরকাল মনে রাখা হবে। কারণ এটি ছিল সেই দিন, যখন আমেরিকান শিল্প পুনর্জন্ম লাভ করেছিল এবং আমেরিকার ভাগ্য পুনরুদ্ধার হয়েছিল। 

এই ‘পাল্টা’ শুল্ক এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যা দেশগুলো মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক, মুদ্রা কারসাজি ও শুল্কবহির্ভূত প্রতিবন্ধকতার মাধ্যমে যে ক্ষতি করছে, তার অর্ধেকের সমান। দেশগুলোর ওপর আরোপিত শুল্ক বেশির ভাগ পণ্যের ওপর প্রযোজ্য হবে। কিছু উল্লেখযোগ্য খাত যেমন– ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও গাড়ি ইতোমধ্যে নতুন শুল্কের আওতাভুক্ত। প্রতিটি দেশের ওপর ১০ শতাংশ হারে আরোপিত শুল্ককে সর্বজনীন ভিত্তি 

হিসেবে ধরা হয়েছে। উচ্চমাত্রার শুল্কের কবলে পড়েছে ভিয়েতনাম (৪৬ শতাংশ), থাইল্যান্ড (৩৬ শতাংশ), চীন (৩৪ শতাংশ), ইন্দোনেশিয়া (৩২ শতাংশ), তাইওয়ান (৩২ শতাংশ), সুইজারল্যান্ডসহ (৩১ শতাংশ) বিভিন্ন দেশ। চীনের এই শুল্ক বিদ্যমান ২০ শতাংশ শুল্কের অতিরিক্ত। তাই চীনা পণ্য আমদানিতে মোট ৫৪ শতাংশ শুল্ক প্রযোজ্য হবে। ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপিত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য। আপাতত কানাডা ও মেক্সিকোর নাম বুধবারের ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়নি। এর আগে নির্বাহী আদেশে ট্রাম্প দেশ দুটির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলেন। 

যদিও কিছু দেশ মার্কিন পণ্যের ওপর যে শুল্ক আরোপ করে, তা যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্কের চেয়ে বেশি। ‘স্বাধীনতা দিবসের’ ঘোষণায় দাবি করা হয়েছে, এটি দেশগুলোর আরোপিত শুল্কের অর্ধেক। এর পেছনের হিসাবগুলো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। যেমন– একটি সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, শুল্কবহির্ভূত ব্যবস্থাগুলো অনুমান করা খুবই কঠিন এবং অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। 

জিডিপিতে পাল্টা শুল্কের প্রভাব 
প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেশগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির ওপর প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করতে পারে। এরই মধ্যে কানাডা (মার্কিন রপ্তানির বৃহত্তম গন্তব্য), ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীন জানিয়েছে, তারা এ ধরনের পদক্ষেপের জবাব দেবে।

এই পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য সংঘাতের প্রভাব অনুমান করতে আমি পণ্য ও সেবার উৎপাদন, বাণিজ্য এবং ভোগের ওপর ভিত্তি করে একটি বিশ্বব্যাপী মডেল ব্যবহার করেছি। এটি এমন ধরনের টুলস, যেগুলোকে ‘কম্পিউটেবল জেনারেল ইকুইলিব্রিয়াম মডেলস’ বলা হয়। এগুলো সরকার, একাডেমিক ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে নীতি পরিবর্তন মূল্যায়ন করতে ব্যবহার করে। 

প্রথম মডেলটি এমন একটি পরিস্থিতি অনুমান করে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র যত শুল্ক আরোপ করে, অন্যান্য দেশও মার্কিন পণ্যের ওপর সমতুল্য শুল্ক আরোপ করে। পাল্টাপাল্টি এ পদক্ষেপের কারণে মার্কিন জিডিপি ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ (৪৩ হাজার ৮৪০ কোটি ডলার) সংকুচিত হয়। এটি দেশের ১২ কোটি ৬০ লাখ পরিবারের মধ্যে ভাগ করলে দেখা যায়, প্রতিটি পরিবারের বার্ষিক ৩ হাজার ৪৮৭ ডলার হারাচ্ছে। এটি অন্য যে কোনো দেশের অনুরূপ সংকোচনের চেয়ে বেশি। 

যদিও আনুপাতিক জিডিপি সবচেয়ে বেশি কমে মেক্সিকো (২ দশমিক ২৪ শতাংশ) ও কানাডার (১ দশমিক ৬৫ শতাংশ)। কারণ এই দেশগুলো তাদের মোট রপ্তানির ৭৫ শতাংশেরও বেশি যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়। মেক্সিকান পরিবারগুলো বছরে ১ হাজার ১৯২ ডলার এবং কানাডীয় পরিবারগুলো ২ হাজার ৪৬৭ ডলার হারায়। জিডিপি সংকোচনের তালিকায় অন্যান্য দেশের মধ্যে রয়েছে ভিয়েতনাম (দশমিক ৯৯ শতাংশ) এবং সুইজারল্যান্ড (দশমিক ৩২ শতাংশ)। 

আবার তুলনামূলকভাবে কম মার্কিন শুল্কের সম্মুখীন হওয়া দেশগুলো বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে লাভবানও হয়। যেমন নিউজিল্যান্ডের দশমিক ২৯ শতাংশ এবং ব্রাজিলের জিডিপি দশমিক ২৮ শতাংশ বাড়ছে। নিউজিল্যান্ডের পরিবারগুলো প্রতি বছর ৩৯৭ ডলার লাভবান হয়। আর বিশ্বের বাকি অংশের (যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া সব দেশ) মোট জিডিপি ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার কমে। এ ছাড়া বৈশ্বিক জিডিপি ৫০ হাজার কোটি ডলার বা দশমিক ৪৩ শতাংশ কমছে। এই ফলাফল নিশ্চিত করে, বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে সংকুচিত করে। 

প্রতিশোধ ছাড়া জিডিপিতে প্রভাব
দ্বিতীয় পরিস্থিতিতে মডেলিংটি চিত্রিত করে, অন্যান্য দেশ মার্কিন শুল্কের প্রতিক্রিয়া না জানালে কী হবে। এ ক্ষেত্রে যেসব দেশ তুলনামূলকভাবে উচ্চ মার্কিন শুল্কের মুখোমুখি হয় এবং যারা রপ্তানির একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়, তাদের জিডিপিতে আনুপাতিকভাবে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর মধ্যে রয়েছে কানাডা, মেক্সিকো, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন। আর যেসব দেশ তুলনামূলকভাবে কম নতুন শুল্কের মুখোমুখি হয়, তারা লাভবান হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে যুক্তরাজ্য। 

এই শুল্ক মার্কিন জিডিপি দশমিক ৪৯ শতাংশ বা ১৪ হাজার ৯০০ কোটি ডলার কমিয়ে দেয়। কারণ এই শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন খরচ এবং ভোক্তা মূল্য বাড়িয়ে দেয়। বিশ্বের বাকি অংশের মোট জিডিপি ১৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলার কমিয়ে দেয়, যা প্রতিশোধ নেওয়ার সময় একই হ্রাসের দ্বিগুণেরও বেশি। এটি ইঙ্গিত দেয়, প্রতিশোধমূলক শুল্কারোপের মাধ্যমে বিশ্বের বাকি অংশ ক্ষতি কমাতে পারে। একই সময়ে প্রতিশোধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরও খারাপ ফলাফলের দিকে নিয়ে যায়। 

ট্রাম্প প্রশাসনের পূর্ববর্তী শুল্ক ঘোষণা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের চাকা থামিয়ে দিয়েছিল। পাল্টা শুল্কগুলো সেই চাকার মধ্যে আরও সমস্যা সৃষ্টি করেছে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। 

লেখক: অকল্যান্ড প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক 
দ্য কনভারসেশন থেকে অনূদিত

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প আর প ত শ ল ক এই শ ল ক অন য ন য পর ব র দশম ক

এছাড়াও পড়ুন:

ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ

এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।

ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।

‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।

ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।

খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।

এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী

ডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।

প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।

পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।

ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।

নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউব

ইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।

ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।

ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।

২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।

মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ