সেলিম মাহমুদসহ রবিনটেক্সের গ্রেপ্তার শ্রমিকদের মুক্তি দাবি
Published: 18th, April 2025 GMT
গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক সেলিম মাহমুদসহ রবিনটেক্সের গ্রেপ্তারকৃত শ্রমিকদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে। মামলা প্রত্যাহারের দাবিও জানানো হয়েছে।
শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এ দাবি জানানো হয়।
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতনের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব বুলবুলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সহ-সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক, শাহজাহান তালুকদার, সহ-সম্পাদক নবকুমার কর্মকার, ইমাম হোসেন খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেকুজ্জামান লিপন, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জুলফিকার আলী, অর্থ সম্পাদক আবু নাঈম খান বিপ্লব, কৃষি শ্রমিক সম্পাদক সাইফুজ্জামান টুটুল প্রমুখ।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, “১৫ এপ্রিল দিবাগত রাত দেড়টায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার নিজ বাসা থেকে দরজা ভেঙে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাংস্কৃতিক সম্পাদক এবং গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক সেলিম মাহমুদকে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই তুলে নিয়ে রুপগঞ্জ থানায় সোপর্দ করে ওই এলাকায় দায়িত্ব পালনকারী সেনাবাহিনীর সদস্যরা। গ্রেপ্তারের সময় সেলিম মাহমুদের পরিবারের সদস্যদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়, যা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। সেলিম মাহমুদকে রবিনটেক্স ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের এবং পুলিশের দায়ের করা দুটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১২ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। যার একটি মামলা বিশেষ ক্ষমতা আইনের ধারা যুক্ত করা হয়েছে।”
নেতৃবৃন্দ বলেন, “৮ এপ্রিল শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে রবিনটেক্স শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে দমন করার উদ্দেশ্যে ৭৮ জন শ্রমিকের নাম উল্ল্যেখসহ কয়েকশ শ্রমিককে অজ্ঞাত আসামি করে দায়ের করা এই মামলায় ইতিপূর্বে রবিনটেক্স শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সীমা আক্তারসহ ২২ জন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দায়ের করা মামলায় সেলিম মাহমুদের নাম ছিলো না। শুধুমাত্র রবিনটেক্স কর্তৃপক্ষের অসৎ শ্রম আচরণ ও শ্রমিক নিপীড়নের প্রতিবাদে শ্রমিকদের চলমান আন্দোলনে সংহতি জানানো এবং নিপীড়িত শ্রমিকদের আইনি সহযোগিতার ব্যবস্থা করায় সেলিম মাহমুদকে গ্রেপ্তার করে ওই মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে তারা পূর্বের ফ্যাসিষ্ট সরকারের লুটপাটকারী মালিকদের পক্ষ নিয়ে শ্রমিক অধিকারহরণের নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে চায়।”
নেতৃবৃন্দ বলেন, “দায়েরকৃত মামলার এজাহারে উল্লেখ রয়েছে যে, রবিনটেক্স কর্তৃপক্ষ ২৯ মার্চ ১৬ জন শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করে অথচ ১৩ মার্চ শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে ঈদের আগে কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা যাবেনা। এমনকি ৮ এপ্রিল শ্রম সচিব হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন ঈদের পরে শ্রমিক ছাঁটাই করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফলে, ঈদের আগে রবিনটেক্স কর্তৃপক্ষ কর্তৃক শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করা সরাসরি শ্রম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের লঙ্ঘন। তাছাড়া, শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার বাধাগ্রস্ত করতে ইউনিয়ন নিবন্ধন প্রক্রিয়া অনিষ্পন্ন থাকা অবস্থায় শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করার চেষ্টা শ্রম আইনেরও লঙ্ঘন। এখনো রবিনটেক্স শ্রমিকদের ইউনিয়ন নিবন্ধনের আবেদন বিচারাধীন অথচ সেই ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদককে ৪ মাস যাবত কারখানায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছেনা আর সভাপতিসহ ইউনিয়নের সদস্যদের মামলা দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করা হচ্ছে।”
নেতৃবৃন্দ সাবধানবানী উচ্চারণ করে বলেন, “অবিলম্বে সেলিম মাহমুদসহ রবিনটেক্সের গ্রেপ্তারকৃত শ্রমিকদের মুক্তি দেওয়া, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহালসহ উদ্ভুত শিল্প বিরোধের সম্মানজনক সমাধানের পদক্ষেপ না নিলে সারাদেশে, প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকল স্থানে মালিক এবং প্রশাসনের অসৎ শ্রম আচরণ এবং নিপিড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে।”
ঢাকা/এম/টি
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর চ কর চ য ত কর
এছাড়াও পড়ুন:
শারীরিক শাস্তি শিশুর বিকাশে বড় বাধা, বিলোপ জরুরি
শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রচলিত এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য সহিংসতা। ইউনিসেফ জানাচ্ছে, বিশ্বে প্রতিবছর ১ থেকে ১৭ বছর বয়সী ১ কোটি ৬০ লাখের বেশি শিশু শারীরিক শাস্তির শিকার হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৮৯ শতাংশ শিশু জরিপ–পূর্ববর্তী এক মাসের মধ্যে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে।
জরিপে আরও দেখা যায়, ৩৫ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, শিশুকে শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাস্তি নিষিদ্ধ করতে ২০১১ সালে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
তারপরও শিশুরা শিক্ষকদের হাতে মারধর ও অপমানের শিকার হচ্ছে। তা ছাড়া বাড়ি, প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদিতেও শিশুদের শাস্তি দেওয়া হয়।
শারীরিক শাস্তি বলতে এমন শাস্তিকে বোঝায়, যেখানে কোনো না কোনো মাত্রার ব্যথা বা অস্বস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে শারীরিক বল প্রয়োগ করা হয়। নিষ্ঠুর ও অবমাননাকর আচরণ এ ধরনের শাস্তির অন্তর্ভুক্ত। শাস্তি শিশুর মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে এবং নিঃসন্দেহে শিশু অধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন।
শাস্তির নামে নিত্যদিনের সহিংসতা প্রতিবছর হাজার হাজার শিশুর আঘাত ও মৃত্যুর কারণ হয়। শাস্তির ব্যাপক সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে, শিশু প্রতিপালনে কিছুটা সহিংসতা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটি সমাজে শিশুদের অধস্তন অবস্থান তুলে ধরে এবং অন্যান্য ধরনের সহিংসতার পথ তৈরি করে দেয়। সমাজের সবচেয়ে ছোট ও সবচেয়ে অরক্ষিত সদস্য হিসেবে শিশুদের নির্যাতন থেকে কম নয়; বরং বেশি সুরক্ষা পাওয়া উচিত।
শারীরিক ও মানসিক শাস্তির কুফলগ্লোবাল পার্টনারশিপ টু অ্যান্ড ভায়োলেন্স এগেইনস্ট চিলড্রেন প্রকাশিত ‘করপোরাল পানিশমেন্ট অব চিলড্রেন: সামারি অব রিসার্চ অন ইটজ ইমপ্যাক্ট অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনস’ (অক্টোবর, ২০২১) জানাচ্ছে, ৩০০টির বেশি গবেষণা শাস্তির সঙ্গে অসংখ্য নেতিবাচক ফলের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করেছে। কোনো গবেষণায় শাস্তির কোনো সুফল পাওয়া যায়নি।
শাস্তি শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামগ্রিক বিকাশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শৈশবের এই দৈনন্দিন সহিংসতা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে আক্রমণাত্মক মনোভাব, অপরাধপ্রবণতা ও অসামাজিক আচরণের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।
শাস্তি নিয়ে ভ্রান্ত ধারণাবাংলাদেশের মা-বাবা, শিক্ষকসহ অনেকের মধ্যেই ভুল ধারণা রয়েছে যে শাস্তি শিশুদের সঠিক আচরণ করতে শেখায়। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। বড়রা যখন শিশুদের কিছু শেখানোর নামে মারধর অথবা বকাবকি করেন, তখন শিশুরা শুধু শাস্তি এড়ানোর জন্যই কোনো আচরণ করতে শেখে। কিন্তু তারা এর কারণ উপলব্ধি করে না। এর ফলে পরবর্তী সময়ে তারা পুনরায় একই আচরণ করে। শেখানোর কৌশল হিসেবে শাস্তি একটি অকার্যকর পদ্ধতি।
গবেষণায় প্রমাণিত যে শিশুদের বেড়ে ওঠায় শাস্তি নয়, প্রয়োজন ভালোবাসা এবং বয়স অনুযায়ী নির্দেশনা।
সমাজে সহিংসতার চক্র ভাঙতে হলে শাস্তি বিলোপ করতে হবেমা-বাবা এবং শিক্ষকদের শিশুরা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। তাঁরা যখন শাস্তি দেন, তখন শিশুরা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে নির্যাতনকে স্বাভাবিক মনে করে, মেনে নিতে শেখে। শাস্তি পাওয়া শিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর নিজেরাও নির্যাতন করবে অথবা নির্যাতনের শিকার হবে—এমন আশঙ্কা বেড়ে যায়। আমরা যদি শিশুদের শাস্তি দেওয়া বন্ধ না করি, তাহলে সমাজে সহিংসতার চক্র ভাঙা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
৬৮টি দেশ সব ক্ষেত্রে শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করেছে৪০ বছর আগে শুধু সুইডেন ও ফিনল্যান্ড শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন পাস করেছিল, কিন্তু আজ ৬৮টি রাষ্ট্র শিশুদের সুরক্ষায় এবং তাদের অধিকার সমুন্নত রাখতে সব ক্ষেত্রে (বাড়ি, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, বিকল্প শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন করেছে। বাংলাদেশ এখনো এ তালিকায় নেই।
যখন আইন বাস্তবায়িত হয়, তখন সমাজে শারীরিক শাস্তির গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যবহার এবং অন্যান্য ধরনের সহিংসতা ক্রমাগত হ্রাস পায়। সুইডেন এর একটি উদাহরণ।
চাই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনপ্রায়ই শোনা যায় যে মা-বাবা ও শিক্ষক কর্তৃক শাস্তি প্রদান আমাদের সমাজে বহুদিন ধরেই চলে আসছে এবং এটি এখানে সাধারণ চর্চা। অনেকে এমনও দাবি করেন যে তাঁরা আজ যে অবস্থানে আছেন, শাস্তি না দিলে তাঁরা সে জায়গায় আসতে পারতেন না! মা-বাবা তাঁদের শাস্তি না দিলে তাঁরা কেমন মানুষ হয়ে বেড়ে উঠতেন, সেটা কিন্তু কেউ জানে না।
আগে প্রচলিত ছিল বলেই আমরা কোনো আচরণ অব্যাহত রাখব, তা হতে পারে না, বিশেষত যখন জানি যে সেটা শিশুদের জন্য ক্ষতিকর।
সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলেই চোখের সামনে শিশুদের শাস্তি পেতে দেখলেও কেউ কিছু বলেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ‘ঠাট্টা’ করে শিশুদের শাস্তি দেওয়ার কথা কোনো মা-বাবা পোস্ট করেন। যাঁরা অন্য অনেক বিষয়ে সংবেদনশীল এবং নানা ধরনের অধিকার আদায়ে আন্দোলন করেন, তাঁদেরও শিশুদের শাস্তি নিয়ে অসংবেদনশীল আচরণ করতে দেখা যায়।
শিশুদের শাস্তি বিলোপে সুপারিশপ্রাপ্তবয়স্কদের মতো শিশুদেরও আইনের দ্বারা সহিংসতা থেকে সুরক্ষিত থাকার সমান অধিকার রয়েছে এবং এর মধ্যে শাস্তি থেকে সুরক্ষাও অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের সব দেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ১৬.২-এ শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
শিশুদের প্রতি শাস্তি বিলোপে বাংলাদেশে যা করণীয়সব ক্ষেত্রে (বাড়ি, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, বিকল্প শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান) শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করে একটি নতুন আইন প্রণয়ন; নীতিমালা, কর্মসূচি ও জনসচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে আইনি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা এবং এর বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাস্তি নিষিদ্ধকরণে সরকার যে পরিপত্র জারি করেছে, তার বাস্তবায়ন ও মনিটরিং; শাস্তি না দিয়ে ইতিবাচকভাবে শিশুদের বড় করা ও শিক্ষা প্রদান সম্পর্কে মা-বাবা এবং শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানো; জাতীয় পর্যায়ে এসডিজি সূচক ১৬.২.১ অন্তর্ভুক্ত করে অগ্রগতি পরিমাপ করা; শিশুদের মতামতকে সম্মান প্রদর্শন করা এবং শাস্তি বন্ধের প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে শিশুদের কথা শোনা।
লায়লা খন্দকার: উন্নয়নকর্মী