কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করে অনেক কিছুই লেখা যায়। এআই বিভিন্ন বই সম্পর্কে যেমন পর্যালোচনা লিখতে পারে, তেমনি বিভিন্ন বিষয়ে লিখতে পারে। লেখালেখি বা সাংবাদিকতায় নানাভাবে এআই ব্যবহার করার মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ইতালীয় একটি সংবাদপত্র এআই ব্যবহার করে নতুন একটি চমক তৈরি করেছে।

ইল ফোগলিও নামের একটি পত্রিকা বিশ্বে প্রথমবারের মতো এআই দিয়ে তৈরি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করছে। এক মাসের জন্য চার পৃষ্ঠার একটি দৈনিক ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে পত্রিকাটি। ক্রোড়পত্র পুরোটাই এআই দিয়ে লেখা। সাধারণ সংবাদপত্রের অংশ হিসেবে বিক্রি করা হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হলেও বেশ সাফল্য পেয়েছে পত্রিকাটি। এআই দিয়ে ক্রোড়পত্র তৈরি করে ছাপানো সংবাদপত্র বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। পত্রিকার সম্পাদক ক্লাউদিও সেরাসার ভাষ্য থেকে জানা যায়, এখন থেকে ছাপা পত্রিকার সঙ্গে এআই দিয়ে লিখিত একটি আলাদা বিভাগ সপ্তাহে একবার প্রকাশ করা হবে। ইল ফোগলিও পত্রিকায় এখন ২২ জন কর্মী কাজ করছেন। আকারে ছোট রক্ষণশীল সংবাদপত্রে জ্যোতির্বিদ্যা বিষয় নিবন্ধের মতো যেসব ক্ষেত্রে সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের দক্ষতা নেই, সেসব বিষয়ে মাঝেমধ্যে নিবন্ধ লিখতে এআই ব্যবহার করা হবে।

পত্রিকার সম্পাদক জানিয়েছেন, এআই প্রোগ্রাম চালু করলেও নিউজরুমে কোনো সাংবাদিকের চাকরি হারানোর ভয় নেই। সম্পাদক সেরাসা জানান, কিছু প্রকাশক এআইকে কম সাংবাদিক ও বেশি যন্ত্র ব্যবহারের উপায় হিসেবে দেখছেন, যা আসলে বড় ভুল ও আত্মঘাতী। মূল বিষয় হচ্ছে, আপনি এআই দিয়ে বেশি করতে পারেন, তা বোঝা প্রয়োজন। এআই এমন লোকদের জন্য চাকরি তৈরি করবে, যাঁরা সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে ও প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করতে জানেন। এআইয়ের ব্যবহার সাংবাদিকদের আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে ও আরও মৌলিক হতে বাধ্য করে উচ্চ মানের সাংবাদিকতাকেও উৎসাহিত করবে। লেখকদের আরও সৃজনশীল ও লেখার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির জন্য নতুন উপাদান খুঁজে বের করতে বাধ্য করবে এআই।

সেরাসা প্রতিদিন তাঁর এআই প্রোগ্রাম ব্যবহার করতেন। সেরাসা বলেন, সবচেয়ে রহস্যময় জিনিস, সবচেয়ে অবিশ্বাস্য জিনিস হচ্ছে এআইয়ের রসবোধ বেশ ত্বরিত ও খাঁটি। আপনি যদি এটিকে কোনো বিষয়ে ব্যঙ্গাত্মক নিবন্ধ লিখতে বলেন, এআই জানে কীভাবে তা লিখতে হয়। এআই বই পর্যালোচনা তৈরিতেও দক্ষ। ৭০০ পৃষ্ঠার বই বিশ্লেষণ করতে ও কয়েক মিনিটের মধ্যে সমালোচনা তৈরি করতে সক্ষম। যদিও এখনো এআইয়ের চিন্তাভাবনায় কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে বলে সতর্কতার কথা জানিয়েছেন সম্পাদক সেরাসা।

সূত্র: রয়টার্স

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক র ড়পত র স ব দপত র এআই দ য়

এছাড়াও পড়ুন:

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানে এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার এক নতুন ধরনের হুমকি নিয়ে এসেছে। এটি শুধু প্রচলিত কারচুপির পদ্ধতিগুলোকেই আরও সফিসটিকেটেড বা কৌশলী করে তুলবে না; বরং আমাদের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে জনগণের বিশ্বাস, সেটিই নষ্ট করে দিতে পারে।

নির্বাচনে এআইয়ের প্রভাব কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, এটি একটি বাস্তব ঝুঁকি। এআই-চালিত টুলগুলো ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মকর্তাদের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ‘ডিপফেক’ (ভুয়া অডিও, ভিডিও এবং ছবি) তৈরি করা সম্ভব।

এই ডিপফেকগুলো সহজেই মিথ্যা কেলেঙ্কারি ছড়াতে পারে, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই-চালিত বটগুলো সেকেন্ডের মধ্যে এমন সব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, যা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যাপক জনসমর্থনে বা বিরোধিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।

যখন জনগণ দেখতে পাবে, তারা যা দেখছে বা শুনছে, তার মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা বোঝা কঠিন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ এবং পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে সন্দেহ ঢুকে যাবে। এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।

এআই অ্যালগরিদমগুলো বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট ভোটারদের লক্ষ করে তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও দুর্বলতা অনুযায়ী রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে। এই ‘মাইক্রো টার্গেটিং’-এর মাধ্যমে ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ভোটদানের সময় বা স্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখাও সম্ভব।

আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে

এআই শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি নির্বাচনী পরিকাঠামোর ওপর সাইবার হামলাও জোরদার করতে পারে। এআই-চালিত টুলগুলো আরও সফিসটিকেটেড ফিশিং আক্রমণ তৈরি করে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে বা এমন ম্যালওয়্যার তৈরি করতে পারে, যা প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এ ধরনের আক্রমণ ভোটার ডেটাবেজ বা ভোটিং মেশিনকে লক্ষ্য করে করা যেতে পারে। সেটি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন বা পুরো প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপত্তির সমাধান কী? এ প্রশ্নের জবাব হিসেবে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, এই গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে এক্সপ্লেইনেবল এআই (এক্সএআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এআই মডেলের সিদ্ধান্তগুলো মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলে এক্সএআই। এটি এআইয়ের স্বচ্ছতা বাড়ায়।

ডিপফেক শনাক্তকরণ: এক্সএআই ব্যবহার করে এমন টুল তৈরি করা সম্ভব, যা কেবল ডিপফেক শনাক্ত করে না; বরং কেন একটি বিষয়বস্তু জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেয়। এর ফলে মানব ফ্যাক্ট-চেকাররা বিশ্লেষণ যাচাই করতে পারেন এবং জনগণের আস্থা তৈরি হয়।

প্রচারণার নিরীক্ষা: এক্সএআই রাজনৈতিক প্রচারণায় এআই ব্যবহারের নিরীক্ষা করতে পারে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারে, কীভাবে একটি অ্যালগরিদম তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট বা কারসাজিমূলক টার্গেটিং কৌশলগুলো প্রকাশ করতে সাহায্য করে।       

নিরাপত্তা বৃদ্ধি: সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক্সএআই হুমকির শনাক্তকরণ সিস্টেমকে উন্নত করতে পারে। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে, কেন একটি নির্দিষ্ট কার্যকলাপকে ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।

অংশগ্রহণকারীদের করণীয়: এআইয়ের হুমকি মোকাবিলায় সব গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারীকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তাঁরা প্রতারণামূলক এআই জেনারেটেড কনটেন্ট বা ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রচারে জড়িত হবেন না। তাঁদের উচিত এআইয়ের যেকোনো বৈধ ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা এবং এআই জেনারেটেড কনটেন্টে সুস্পষ্ট লেবেল ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রচারে এআই ব্যবহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাদের উচিত এআই-চালিত টুলগুলোতে বিনিয়োগ করা এবং ভোটারদের সচেতন করার জন্য বড় আকারের প্রচার চালানো।

এ ছাড়া একটি যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন দল গঠন করা প্রয়োজন, যারা নির্বাচনের আগপর্যন্ত কমিশনকে এআই এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা দেবে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে এআইয়ের হুমকি সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত মোকাবিলা করার জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রটোকল স্থাপন করা জরুরি। সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের উচিত ফ্যাক্ট-চেকিং এবং জনগণের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।

আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এআইয়ের ক্ষমতা যেমন বিশাল, তেমনি এর অপব্যবহারের বিপদও কম নয়।

জনগণের বিশ্বাস এবং একটি ন্যায্য নির্বাচনের অধিকার নিশ্চিত করতে এখনই আমাদের সবাইকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, বাংলাদেশ সরকারের একটি সম্মিলিত গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দল এআই-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো ক্রমাগত বিশ্লেষণ ও অনুমান করবে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে।

অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন এআইয়ের সাবেক অধ্যাপক, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত এআরআইটিআইয়ের সাবেক পরিচালক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে
  • শিক্ষার্থীদের এআই প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার সুযোগ নিতে হবে
  • এআই দিয়ে তৈরি লেখা চিনবেন যেভাবে
  • এআই নিয়ে শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর গা ছাড়া মনোভাব, বললেন বিজ্ঞানী জিওফ্রি হিন্টন