মোহ কাঠের নৌকা: বাস্তবতার এক প্রতিচ্ছবি
Published: 24th, April 2025 GMT
‘মোহ কাঠের নৌকা’ উপন্যাসে আধুনিক সমাজের জটিলতা, পেশাগত টানাপোড়েন, ব্যক্তিগত সংকট ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় চরিত্র রবীন গ্রাম থেকে শহরে এসে উচ্চশিক্ষা শেষে এক অখ্যাত অনলাইন সংবাদমাধ্যমে যোগ দেয় বড় স্বপ্ন নিয়ে। বাস্তবতা তাকে হতাশ করে তোলে। অফিসের রাজনীতি, অনিয়মিত বেতন ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা তাকে এক ধরনের পেশাগত দুঃখবোধে ফেলে। এ ছাড়া রবীনের জীবনে একের পর এক সংকট আসে– নিজের একাকিত্ব, পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব, সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং সমাজের নানা অসংগতি। একসময় তার পরিচয় হয় জলি নামে এক মেয়ের সঙ্গে, যার বাবা গুমের শিকার। জলি চরিত্রের মাধ্যমে লেখক তুলে ধরেন গুম হওয়া পরিবারের কষ্ট, অনিশ্চয়তা ও অবহেলার যন্ত্রণা। অন্যদিকে, গ্রামের স্মৃতি রবীনের মনে গভীরভাবে গেঁথে থাকলেও বাস্তবতা সেখানে গিয়ে বদলে গেছে। বিদেশের অর্থে বদলে যাওয়া গ্রামীণ সমাজ, পারিবারিক মূল্যবোধে পরিবর্তন এবং দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য তাকে আরও ব্যথিত করে তোলে। রবীনের জীবনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রুবি– এক ব্যাংক কর্মকর্তা, যে নিজেও জীবন সংগ্রামে এগিয়ে এসেছে। রুবির মা চায় রবীনের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে হোক। সম্ভবত রুবিও তা চায়। জীবনের নানা দোলাচলের মধ্যে রুবিই রবীনের জীবনে একমাত্র স্থিরতার প্রতীক হয়ে ওঠে। প্রশ্ন থেকে যায়, রবীন কি পারবে এই ‘মোহ কাঠের নৌকা’য় উঠে জীবনের নিরাপদ তীরে ভিড়তে? নাকি বাস্তবতার ঢেউ সেই নৌকাকে ডুবিয়ে দেবে?
রবীন: রবীন একজন স্বপ্নবান যুবক, যে সাংবাদিকতা দিয়ে সমাজে কিছু পরিবর্তন আনতে চায়। চারপাশের বাস্তবতায় ধীরে ধীরে তার ভেতরের স্বপ্নগুলো নিঃশব্দে ভেঙে পড়ে। রবীনের চরিত্রে দেখা যায় একজন সাধারণ ছেলের ভেতরের গভীর অনুভব, লড়াই আর স্বপ্নভাঙার হতাশা। সে জীবনের কাছে হেরে গিয়েও চুপচাপ বাঁচতে থাকে– যেমনটা করে অসংখ্য বাস্তব মানুষ।
রুবি: রুবি একজন সফল নারী– প্রাইভেট ব্যাংকের কর্মকর্তা। প্রেম, পারিবারিক টানাপোড়েন আর অতীতের জটিল স্মৃতি তাকে সব সময় তাড়া করে। মা অনেক ত্যাগে তাকে গড়েছেন, কিন্তু সেই মাও অসুখী। রুবির চরিত্রে উঠে এসেছে নারীর আত্মত্যাগ, গভীর আবেগ, জীবনের এমন অনিশ্চয়তা; যা মানুষকে ভেতর থেকে ভেঙে দেয়।
মানবসমাজের সহজাত প্রবণতা হলো, আমরা সত্যের মুখোমুখি হতে চাই না। আমরা চোখ ফিরিয়ে নিতে চাই কঠিন বাস্তবতা থেকে। অথচ ‘ মোহ কাঠের নৌকা’ সেই তেতো সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। এই উপন্যাস কেবল একটি গল্প নয়, বরং আমাদের সময়, সমাজ এবং সম্পর্কের এক নির্মোহ আয়না। এদের মধ্য দিয়ে সমাজের মধ্যবিত্ত মানসিকতা, অতিমাত্রায় আত্মমর্যাদা বোধের চাপ এবং সম্পর্কের টানাপোড়েন অত্যন্ত সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। লেখক এই উপন্যাসে একটি সময়কে ধরার চেষ্টা করেছেন যেখানে শহর ও গ্রামের দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থা, আর্থসামাজিক অসংগতি, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ব্যক্তিগত জীবনের অস্থিরতাগুলো একসঙ্গে চিত্রায়িত হয়েছে।
সময়ের এই চলমান প্রবাহে লেখক সম্পর্কের জটিলতা নিয়েও অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি মন্তব্য রেখেছেন– ‘আশ্রয়হীন মানুষরা আশ্রয়ের তিল পরিমাণ সন্ধান পেলেই ভুলে যায়, সব আশ্রয় তার জন্য ইতিবাচক নাও হতে পারে।’
এই বাক্যটিই যেন উপন্যাসের সারকথা হয়ে ওঠে। বাস্তবতা ও অনুভূতির দ্বন্দ্বে মানুষের ভেতরের একাকিত্ব, অস্থিরতা ও টিকে থাকার লড়াই– সবই মূর্ত হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসে। এ ধরনের বাস্তবভিত্তিক উপন্যাস পাঠকের কাছ থেকে কিছুটা ধৈর্য দাবি করে। কারণ– এখানে রোমাঞ্চ নেই, নেই চমকজাগানো মোড়। অনেকটা যেন নিরবধি বয়ে চলা নদীর মতো, যার স্রোতের গভীরতা উপলব্ধি করতে হয় ধীরে ধীরে। মনে হয়েছে, ‘মোহ কাঠের নৌকা’ শুধু উপন্যাস নয়, এটি সমাজের বিবেকের কাছে একটি প্রশ্নপত্র– যেখানে এই সমাজে কি সত্যিই কারও নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার নৌকা আছে, নাকি বাস্তবতার ঢেউয়ে সবকিছুই তলিয়ে যায়?
যারা বাস্তববাদী সাহিত্য, সাংবাদিকতার ভেতরকার জটিলতা কিংবা সমাজের দ্রুত পরিবর্তনের অভিঘাত নিয়ে ভাবতে ভালোবাসেন, তারা এই উপন্যাস পাঠে গভীর আনন্দ পেতে পারেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বই ব স তবত র জট ল রব ন র জ বন র
এছাড়াও পড়ুন:
দারফুরে ধর্ষণ-মুক্তিপণ-হত্যা: আরএসএফের ভয়াবহ নিপীড়নের বর্ণনা দিলেন পালিয়ে আসা মানুষেরা
সুদানের পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর শহরে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ)–এর কাছ থেকে পালিয়ে আসা ক্ষুধার্ত এবং নির্যাতিত মানুষেরা বিভিন্ন সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের কাছে তাঁদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করছেন। তবে তাঁরা পালাতে পারলেও হাজার হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
উত্তর দারফুরের রাজধানী এল-ফাশের শহর ছিল রাজ্যটিতে সুদানি সেনাবাহিনীর সর্বশেষ ঘাঁটি। গত রোববার আরএসএফ বাহিনী এটির দখল নেয়। এরপর থেকে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা স্থানীয় মানুষের পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এরই মধ্যে দারফুরে ধর্ষণ, মুক্তিপণ ও গণহত্যাসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা সামনে আসছে।
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ইসমাইল বলেন, ‘খার্তুমের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন এমন একজন তরুণ সেখানে ছিলেন। তিনি তাঁদের বললেন, “ওকে হত্যা করো না”। এরপর তাঁরা আমার সঙ্গে থাকা সব তরুণ ও আমার বন্ধুদের হত্যা করেন।’
তাবিলা এলাকায় পালিয়ে আসা অন্য নাগরিকেরাও তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তেমনই একজন তাহানি হাসান। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই তাঁরা সেখানে হাজির হলেন। কোথা থেকে এলেন জানি না। ভিন্ন ভিন্ন বয়সী তিন তরুণকে দেখা গেল। তাঁরা আকাশে গুলি ছুড়লেন এবং বললেন, ‘থামো, থামো’। তাঁরা আরএসএফের পোশাকে ছিলেন।’
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। আলখেইর বলেছেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত ব্যক্তি হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।তাহানি হাসান বলেন, ‘এই তরুণেরা আমাদের বেধড়ক মারধর করেছেন। আমাদের পোশাক মাটিতে ছুড়ে ফেলেছেন। এমনকি আমি একজন নারী হওয়ার পরও আমাকে তল্লাশি করা হয়েছে। হামলাকারীরা সম্ভবত বয়সে আমার মেয়ের চেয়েও ছোট হবে।’
ফাতিমা আবদুলরহিম তাঁর নাতি–নাতনিদের সঙ্গে তাবিলাতে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, পাঁচ দিন ধরে অনেক কষ্ট করে হেঁটে তাবিলাতে পৌঁছাতে পেরেছেন।
ফাতিমা বলেন, ‘তাঁরা (আরএসএফের সদস্যরা) ছেলেশিশুগুলোকে মারলেন এবং আমাদের সব সম্পদ কেড়ে নিলেন। আমাদের কিছুই রাখা হলো না। আমরা এখানে পৌঁছানোর পর জানতে পারলাম, আমাদের পর যেসব মেয়ে এসেছে, তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। তবে আমাদের মেয়েরা বেঁচে গেছে।’
পালিয়ে আসা তরুণী রাওয়া আবদাল্লা বলেছেন, তাঁর বাবা নিখোঁজ।
গত বুধবার রাতে দেওয়া এক বক্তৃতায় আরএসএফের প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালো বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তাঁর যোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। হামদান ‘হেমেদতি’ নামেও পরিচিত।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানি সেনাদের সঙ্গে আরএসএফ সদস্যদের লড়াই চলছে। গত বৃহস্পতিবার আরএসএফ দাবি করে, নির্যাতনের অভিযোগে বেশ কয়েকজন যোদ্ধাকে আটক করেছে তারা।
তবে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার সাধারণ নাগরিকদের ওপর আরএসএফ সদস্যদের নিপীড়নের অভিযোগ তদন্তে বাহিনীটির দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরএসএফের একজন উচ্চপদস্থ কমান্ডার এই ঘটনাগুলো ‘গণমাধ্যমের অতিরঞ্জন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর দাবি, এল–ফাশেরে নিজেদের পরাজয় ও ক্ষয়ক্ষতি আড়াল করতে সেনাবাহিনী এবং তাদের মিত্ররা এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, এ সংঘাত চলাকালে আরএসএফ ও সেনাবাহিনী—দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে। সংঘাতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। সংঘাতকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। বিরাজ করছে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের অবস্থা। পাশাপাশি কলেরা ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগের সংক্রমণ বাড়ছে।
দারফুর থেকে পালিয়ে আসা লোকজন তাবিলা এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। ২৯ অক্টোবর, ২০২৫