‘দেখিতে দেখিতে স্থানটি লোকারণ্যে পরিণত হয়। বেলা দশটার পর মল্লগণ (বলী) আসরে অবতীর্ণ হইতে থাকে। ...বেলা দশটার পর হইতে জনতার ভিড় এত বাড়িতে থাকে যেন তখন রাস্তা দিয়ে গাড়ি ঘোড়া চলাচলও প্রায় বন্ধ হইয়া যায়। খেলা আরম্ভ হইলে মল্লগণ রঙ্গস্থলে অবতীর্ণ হইয়া বাদ্যের তালে তালে নৃত্য করিতে থাকে। মল্লগণের মধ্যে একজন অন্যজনকে “চিৎপট্কন” দিতে পারিলেই তাহার জিত হইল।’

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলীখেলার এই বর্ণনা আজ থেকে ১১০ বছর আগের। ১৩২২ বঙ্গাব্দের (১৯১৫ সাল) অনুষ্ঠিত বলীখেলা ঘিরে মেলা ও শহরের মানুষের উন্মাদনা-আগ্রহ নিয়ে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতবর্ষের মাসিক সাহিত্য সাময়িকী প্রবাসী–এর আষাঢ় মাসের সংখ্যায়। এই লেখার লেখক ছিলেন মোহিনীমোহন দাস। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হওয়া কমল চৌধুরী সম্পাদিত ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থে লেখাটি সংকলিত করা হয়।

আবদুল জব্বারের বলীখেলার মূল পর্ব ১২ বৈশাখ তথা আজ শুক্রবার অনুষ্ঠিত হবে। তিন দিনব্যাপী মেলার শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকে। চলবে শনিবার পর্যন্ত।

চট্টগ্রামের বকশিরহাটের আবদুল জব্বার সওদাগর ১৯০৯ সালে এই বলীখেলার প্রবর্তন করেছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তরুণ ও যুবকদের উদ্বুদ্ধ করতে কুস্তি বা বলীখেলা শুরু করেছিলেন লালদীঘি মাঠে। কালের বিবর্তনে এই বলীখেলা এই অঞ্চলের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। হয়েছে এখানকার বাসিন্দাদের আবেগের অংশ। রূপ লাভ করেছে প্রাণের মেলায়।

শত বছর পার হয়ে গেলেও বলীখেলা নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের আবেগ একটুও কমেনি। এখনো এই বলীখেলা নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষের আগ্রহ ও উত্তেজনার কমতি নেই। এই শহরের ধনী-গরিবসহ প্রায় সবাই অপেক্ষায় থাকেন বলীখেলা এবং একে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হওয়া লোকজ মেলার জন্য।

প্রবাসী পত্রিকায় মোহিনীমোহন দাস লিখেছেন, ‘“গাজনের ঢাকে” কাঠি পড়িলে যেমন পূর্বকালে চড়কের সন্ন্যাসীদের পিঠ সুড়সুড় করিত, চৈত্র মাসে চট্টগ্রামের বলীদের মধ্যেও তেমনি একটি উন্মাদনা পরিলক্ষিত হয়। এজন্য সম্পন্ন হিন্দু ও মুসলমানগণের মধ্যে অনেকেই রাশি রাশি অর্থ ব্যয় করিয়া থাকেন। সমস্ত জিলা ব্যাপিয়া কতগুলি “বলীখেলা” হয় তাহার সংখ্যা করা দুরূহ। এক চট্টগ্রাম নিজ সহরেই ১৫/২০টি খেলার “থলা” (স্থল) হইয়া থাকে। তাহাতে দেশের নানা স্থান হইতে বলীগণ আসিয়া নিজ নিজ দক্ষতা দেখাইয়া যথাযোগ্য পারিতোষিক লাভ করিয়া থাকে।’

বিভিন্ন স্থানে বলীখেলার আয়োজন করা হলেও সবগুলোর মধ্যে আবদুল জব্বারের বলীখেলা সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মত দিয়েছিলেন মোহিনীমোহন দাস। তাঁর মতে, ‘সুবে বাংলার অন্যান্য জিলায় এরূপ সমারোহে মল্লক্রীড়া অনুষ্ঠিত হয় কি না তাহা জানি না। বাল্যকালে বঙ্গদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ নগরী কলিকাতায় এবং যৌবনে ঢাকায় বাসকালে ২/১টি পশ্চিমী পালোয়ানের কুস্তী-ক্রীড়ার অভিনয় দর্শন করিয়াছি, কিন্তু এত সমারোহ ও এত আড়ম্বর তাহাতে দেখি নাই। এবং সেখানে মল্লক্রীড়া এরূপ কৌলিক “বারমাসে তের পার্বণের” পর্যায়ভুক্ত নহে। এখানকার মল্লক্রীড়ার (বলীখেলার) অনুষ্ঠাতারা প্রত্যেক বৎসর নির্দিষ্ট দিনে এই ব্যাপারের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। পিতার অনুষ্ঠান পুত্রে রক্ষা করিয়া আসিতেছে।’

শুরু থেকে প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ১২ তারিখ বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। যদিও লেখক উল্লেখ করেছেন, ১৩২২ বঙ্গাব্দে মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৩ বৈশাখ। ‘চট্টগ্রাম শহরের ঠিক বক্ষঃস্থলে পুরাতন কাছারির ইমারাতের নিম্নস্থ ময়দানে এই খেলার স্থান করা হইয়া থাকে। খেলার মূল মঞ্চের পাশে নিমন্ত্রিত দর্শকদের জন্য সামিয়ানা খাটাইয়া বসার ব্যবস্থা করা হতো’ বলে লেখায় উল্লেখ করেছিলেন মোহিনীমোহন দাস। আর অন্য দর্শকেরা চারপাশে দাঁড়িয়ে, বসে, গাছে-ছাদে চড়ে বলীখেলা দেখতেন।

বলীখেলা ঘিরে দিনভর কী কী হতো তার বিবরণ দিয়েছিলেন ওই লেখায়। শহরে তখন সব আলাপ-আলোচনা বলীখেলা ঘিরে। বলীদের নিয়ে তুমুল আগ্রহ থাকে শহরের লোকজনের। এমনকি অফিস-আদালত দুপুরের পর ছুটি হয়ে যেত। তিনি লিখেছেন, ‘খেলার দিন রাত্রি প্রভাতের পূর্ব হইতে চট্টগ্রামের স্থানীয় ডোম বাদ্যকরগণের ঢোল কাড়া সানাইয়ের মিশ্রিত একঘেয়ে আওয়াজে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইয়া উঠিতে থাকে। এবং ঘন ঘন বোমের আওয়াজ হইতে থাকে।

‘.

..কোন বলী বড়, কাহার “তাকত” বেশি, কাহার সঙ্গে কাহার কুস্তী হইবার সম্ভাবনা, কে কাহাকে হারাইবে, ইত্যাকার কোলাহলে শহর মুখরিত হইয়া উঠে।’

এখন যে রকম খেলার সময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা ধরনের পণ্যের পসরা নিয়ে আসেন দোকানিরা। ১১০ বছর আগে অনুষ্ঠিত মেলায়ও নানা স্থান থেকে দোকানিরা এসে মেলার উপযোগী দোকান সাজাতে আরম্ভ করতেন বলে লেখায় উল্লেখ করেছিলেন মোহিনীমোহন দাস। মেলায় “নাগরদোলা”, “রাধাচক্র”, এমনকি ছোটখাটো সার্কাসের দলও আসে।

বলীখেলা উপলক্ষে বসে তিন দিনের মেলা। এতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পণ্যের পসরা নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ছ ল ন ম হ ন ম হন দ স কর ছ ল ন অন ষ ঠ ত বল খ ল র শহর র

এছাড়াও পড়ুন:

লাকসামে অস্ত্রের মুখে এতিমখানার ৫ গরু লুট, আহত ৮

কুমিল্লার লাকসামে একটি এতিমখানার খামার থেকে গত শুক্রবার পাঁচটি গরু লুট করে নিয়ে গেছে ডাকাত দল। এ সময় তাদের হামলায় মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ আটজন আহত হন। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ থানায় মামলা করেছে।

গত শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) ভোরে উপজেলার আজগরা ইউনিয়নের বড়বাম আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদরাসা ও এর সংলগ্ন এতিমখানার খামারে ঘটনাটি ঘটে। তিন মাস আগেও এই খামারের সাতটি গরু লুট করেছিল ডাকাতরা।

আরো পড়ুন:

খুলনায় বিএনপি নেতার অফিসে বোমা-গুলি, শিক্ষক নিহত

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতিপক্ষের হামলা: গুলিবিদ্ধ যুবকের মৃত্যু

সোমবার (৩ নভেম্বর) সকালে ঘটনাটি জানাজানি হয়।

এলাকাবাসী জানান, মাদরাসার আয় এই খামারের মাধ্যমে হয়। তিন মাসের ব্যবধানে দুই দফা ডাকাতি হওয়ায় শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। খামারের বড় গরুগুলো লুট হয়ে যাওয়ায় এক পাশ ফাঁকা পড়ে আছে। বর্তমানে খামারে ১১টি গরু অবশিষ্ট রয়েছে।

খামারের সামনে পড়ে আছে ডাকাত দলের ব্যবহৃত তুষের বস্তা, যা দিয়ে গরুগুলো পিকআপ ভ্যানে তোলে তারা। গরু উদ্ধার এবং ডাকাত দলের সদস্যদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

মামলার বাদী এবং মাদরাসার শিক্ষক ইমরান হোসাইন জানান, গত শুক্রবার ভোরে একদল ডাকাত দুটি পিকআপ ভ্যান নিয়ে এসে অস্ত্রের মুখে মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে। শিক্ষকদের মারধর করে তাদের মোবাইল ফোন নিয়ে যায় ডাকাতরা। তারা খামারে ঢুকে কেয়ারটেকার উৎসব হোসেনকে বেঁধে একে একে পাঁচটি গরু পিকআপ ভ্যানে তুলে নেয়। শিক্ষক ও ছাত্রদের চিৎকারে স্থানীয়রা ছুটে আসলে ডাকাতরা পালিয়ে যায়।

মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা শরীফুল আলম খন্দকার জানান, খামারের আয়ের ওপর ভিত্তি করে মাদরাসার কার্যক্রম চলে। তিন মাস আগেও এই খামারের সাতটি গরু নিয়ে যায় ডাকাতরা।

লাকসাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাজনীন সুলতানা বলেন, “লুট হওয়া গরু উদ্ধার এবং ডাকাতদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। মাদরাসার শিক্ষক ইমরান হোসাইন বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন।”

ঢাকা/রুবেল/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ