আইরিশ নাবিকের চোখে বাংলার হজযাত্রী
Published: 22nd, May 2025 GMT
১৯৫৪ সালে আইরিশ নাবিক নরম্যান ফ্রিম্যানের লেখা ‘অ্যান আইরিশম্যানস ডায়েরি অন আ পিলগ্রিম শিপ টু জেদ্দা’ প্রবন্ধে বাংলার হজযাত্রীদের একটি প্রাণবন্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। প্রবন্ধটি ‘আইরিশ টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ সারধানাতে ফ্রিম্যানের অভিজ্ঞতার বিবরণ পাওয়া যায়। এই জাহাজে তিনি চাকরিরত অবস্থায় ১ হাজার ৫০০ হজযাত্রীকে জেদ্দা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার একটি কন্ট্রাক্টে অংশ নেন।
১৯৫৪ সালের আগস্ট মাসে হজ অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় বিমানযাত্রার বিস্তৃতির কারণে জাহাজে হজযাত্রী পরিবহন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছিল। তবে সারধানা জাহাজ এই কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে জেদ্দা থেকে চট্টগ্রামে হজযাত্রী পরিবহনের দায়িত্ব পায়। এটি ফ্রিম্যান ও তাঁর ক্রুদের জন্য একটি অনন্য অভিজ্ঞতা ছিল, কারণ তাদের কোম্পানির অন্যান্য জাহাজ অতীতে হাজার হাজার হজযাত্রী পরিবহন করলেও এ ধরনের কাজ তখন বিরল হয়ে পড়েছিল।
হজযাত্রীদের দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা এবং হজ পালনের ক্লান্তি, সৌদি আরবের প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া ও ভিড়ের কারণে অনেকে দুর্বল বা অসুস্থ হতে পারেন—এই সম্ভাবনা বিবেচনা করে জাহাজে একজন ডাক্তার, তিনজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং তিনজন নার্স নিয়োগ করা হয়। জাহাজের ভারতীয় ক্রুরা দরিদ্র হজযাত্রীদের জন্য লোয়ার ডেকে বাংক, দড়ির ঝুলন্ত বিছানা এবং কাঠের মেঝেতে ম্যাটের ব্যবস্থা করে। প্রস্তুতি সম্পন্ন করে খালি জাহাজটি করাচি থেকে জেদ্দার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। পথে আপার ডেকে ইউরোপীয় ক্রুরা টেবিল টেনিস খেলে সময় কাটাত। তবে ভারত মহাসাগর থেকে আরব সাগরে প্রবেশের সময় জাহাজের রোলিং সামলাতে ক্যাপ্টেন ও ক্রুদের দক্ষতার প্রয়োজন হতো।
আরও পড়ুনবিরে শিফা: একটি অলৌকিক কুয়ার গল্প০৫ মে ২০২৫জেদ্দা বন্দরে পৌঁছে ফ্রিম্যান ও তাঁর ক্রুরা এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সম্মুখীন হন। সৌদি পুলিশ হজযাত্রীদের ইহরামের কাপড়ে খোলা আকাশের নিচে প্রচণ্ড গরমে গাদাগাদি করে রেখেছিল। অনেক হজযাত্রী দুর্বল, এমনকি কঙ্কালসার অবস্থায় ছিলেন। এই দৃশ্য ক্রুদের মনে গভীর বেদনার সৃষ্টি করে। গ্যাংওয়ে (জাহাজে ওঠার সিঁড়ি) নামানোর পর হজযাত্রীরা ধীরে ধীরে জাহাজে উঠতে শুরু করেন। শারীরিক দুর্বলতার কারণে অনেককে সাহায্য করতে হয়। সব হজযাত্রী জাহাজে উঠতে অনেক সময় লাগে। অবশেষে গ্যাংওয়ে উঠিয়ে দীর্ঘ হর্ন বাজিয়ে সাদা রঙের সারধানা জাহাজ চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।
জাহাজে একজন ইমাম ছিলেন, যিনি চমৎকার গলায় আজান দিতেন। প্রতিদিন নামাজের সময় তিনি জাহাজের পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে আজান দিতেন এবং হজযাত্রীরা জাহাজের সামনের ডেকে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করতেন। ডেকের কাঠের মেঝেতে নামাজের জন্য লাইন ধরে জায়নামাজ সাজানো থাকত।
অপুষ্টি ও ক্লান্তির কারণে অনেক হজযাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। জাহাজের মেডিকেল স্টাফ সাধ্যমতো তাঁদের সেবা দিলেও চারজন হজযাত্রী মারা যান। তবে ফ্রিম্যান উল্লেখ করেন, নিয়মিত জাহাজের তুলনায় এই সংখ্যা ছিল অনেক কম। আরব সাগর ও ভারত মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় ইমামের নেতৃত্বে জানাজা পড়ে মৃত হজযাত্রীদের ইহরামের কাপড়ে কাফন পরিয়ে, ক্যানভাসে মুড়ে এবং ভারী সিসা বেঁধে ভারত মহাসাগরে সমাধিস্থ করা হয়।
দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। ক্লান্ত হজযাত্রীরা তাঁদের সামান্য মালপত্র নিয়ে ধীরে ধীরে জাহাজ থেকে নামেন। হজ পালনের কঠিন ও কষ্টকর পরিশ্রম তাঁদের ফ্রিম্যান এবং জাহাজের ক্রুদের কাছে এক অনন্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে।
(সূত্র: পুণ্যপথের যাত্রীরা: হজ হজযাত্রী ও পথ,মুহাম্মদ সাঈদ হাসান শিকদার, প্রথমা প্রকাশন)
আরও পড়ুনবদর যুদ্ধক্ষেত্রে একটি দিন২০ জুলাই ২০২৩.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: হজয ত র দ র র হজয ত র আইর শ
এছাড়াও পড়ুন:
সিলেটে বিএনপি নেতার ফোনে আ.লীগের সাবেক মেয়রের ‘কল’, ফেসবুকে সমালোচনা
সিলেট মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরীর মুঠোফোনে সিলেট সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর ‘কল’ এসেছে—এমন অভিযোগ তুলে ইমদাদের বিপক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা শুরু করেছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের একটি অংশ।
তবে বিএনপি নেতা ইমদাদ হোসেন চৌধুরী সংবাদ সম্মেলন করে ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নগরের বারুতখানা এলাকায় বিএনপির নেতাদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একটি মতবিনিময় সভা ছিল। সভার একপর্যায়ে মাগরিবের নামাজে যান ইমদাদ। তখন তাঁর মুঠোফোনটি অন্য একজনের কাছে ছিল। তখন ইমদাদের মুঠোফোনে একটি কল আসে এবং ডিসপ্লেতে দেখা যায়, ‘আনোয়ারুজ্জামান ইউকে’। এ দৃশ্য সেখানে থাকা কয়েকজন তাঁদের মুঠোফোনে ধারণ করেন। সভা শেষে সন্ধ্যায় ফেসবুকে এর স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই ইমদাদের মুঠোফোনে লন্ডনে অবস্থানরত সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামানের কল দেওয়া নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে আলোচনা–সমালোচনা শুরু হয়।
এ নিয়ে গতকাল রাত ১১টার দিকে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে নিজের ব্যাখ্যা দেন ইমদাদ হোসেন চৌধুরী। এ সময় তিনি দাবি করেন, অনুষ্ঠানের ছবি তোলার জন্য আখতার নামের একজনের কাছে তাঁর মুঠোফোনটি ছিল। সভা শেষে নামাজ সেরে নাশতা খেয়ে ওই স্থান থেকে বের হওয়ার পর একজন তাঁকে কল করে জানান, তাঁর (ইমদাদ) ফোনে নাকি আনোয়ারুজ্জামানের কল এসেছে। তখন তিনি কললিস্ট ঘেঁটে দেখতে পান, ৬টা ৫১ মিনিটে ‘আনোয়ারুজ্জামান ইউকে’ লেখা একটি নম্বর থেকে কল এসেছে।
ইমদাদ হোসেন চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কল এসেছে দেখতে পেয়ে তিনি আখতারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করেন। তখন আখতার তাঁকে জানান, তাঁর (আখতার) কাছে ফোন থাকাকালে বিএনপির সিলেট বিমানবন্দর থানা শাখার সদস্যসচিব সৈয়দ সারোয়ার রেজা ও মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদীর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) ইমন কিছুক্ষণের জন্য আখতারকে নিয়ে আলাদা একটি টেবিলে বসেন এবং ওই সময় ইমদাদের ফোনের ডিসপ্লের ছবি সরোয়ার-ইমন তুলেছেন। এর বেশি কিছু আখতার জানেন না।
মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, ‘যে আনোয়ারুজ্জামানের কারণে সিলেটের রাজনীতি কলুষিত হয়েছে, যাঁর আদেশে নগরে জুলাইয়ে আমাদের দলীয় নেতা-কর্মীরা হামলার শিকার হয়েছে। সেই ডেভিল আনোয়ারুজ্জামানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকার প্রশ্নই আসে না। যাঁরা ফোনের ছবি তুলেছেন, তাঁরাই ষড়যন্ত্র করে আমার ইমেজকে নষ্ট করার চেষ্টা করছেন। আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁরা এমনটা করেছেন।’
ইমদাদ হোসেন চৌধুরী দাবি করেন, যুক্তরাজ্যে থাকা অবস্থায় ৮ থেকে ১০ বছর আগে আনোয়ারুজ্জামানের মুঠোফোন নম্বর তাঁর মুঠোফোনে স্টোর হয়ে থাকতে পারে। তবে কখনো আনোয়ারুজ্জামানের সঙ্গে তাঁর কথা হয়নি।
আজ বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে যোগাযোগ করলে ইমদাদ হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যিনি আমার জনপ্রিয়তায় অ্যাফেকটেড, তিনিই এ ষড়যন্ত্র করেছেন। তিনিই পিএস দিয়ে এমন ষড়যন্ত্র করেছেন। কারণ, তখন আমার হাতে ফোনটি ছিল না। কোনো প্রযুক্তি দিয়েই হোক কিংবা কাউকে দিয়ে আনোয়ারুজ্জামানের ফোন থেকে হোক, ঠিক জানি না, কীভাবে এ কল করিয়েছে। মোটকথা আনোয়ারুজ্জামান আমাকে কল করার কথা নয়।’
এ ঘটনার নেপথ্যে মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী সম্পৃক্ত আছেন বলে ইমদাদ হোসেন প্রথম আলোর এ প্রতিবেদককে ইঙ্গিত দেন।
তবে ইমদাদের অভিযোগ প্রসঙ্গে রেজাউল হাসান কয়েস লোদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কোনো পিএসই নেই। এ ছাড়া এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক নেতা বলেন, গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান লন্ডনে চলে যান। তিনি কেন মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদককে কল করবেন? নিশ্চয়ই তাঁর (ইমদাদ) সঙ্গে আনোয়ারুজ্জামানের সখ্য, আঁতাত কিংবা যোগাযোগ আছে। এ বিষয়টির সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। নতুবা দলের তৃণমূলে ভুল বার্তা যাবে।
স্থানীয় বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়নে নির্বাচন করতে মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী দীর্ঘদিন ধরে নগরে কাজ করছেন। মেয়র পদে ইমদাদ হোসেনও দলীয় মনোনয়নে নির্বাচন করতে আগ্রহী। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে ভেতরে ভেতরে দূরত্বও আছে। তবে লোদী-ইমদাদ ছাড়াও মেয়র পদে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ্ সিদ্দিকীর নামও জোরেশোরে আলোচনায় আছে।