‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও...যেটা ছিল না ছিল না সেটা না পাওয়াই থাক, সব পেলে নষ্ট জীবন...।’ কয়েক দিন থেকেই এই গানটার একটা প্যারোডি মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করছে। সেটা হচ্ছে, ‘আমাকে আমার মতো পাকতে দাও, যেটা পাকেনি পাকেনি সেটা না খাওয়াই ঠিক, সব খেলে নষ্ট জীবন...।’ ১৭ মে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নোন্দাপুর চাত্রাপুকুর এলাকায় ক্ষীরশাপাতি আম পাড়তে দেখা গেছে।
অপরিপক্ব এই আমে ‘টম টম’ নামের একধরনের রাসায়নিক ছিটানো হচ্ছে। আবার উপজেলার কাঁকনহাট পৌর এলাকার সাহাপুর মহল্লায় গোপালভোগ আম পেড়ে একইভাবে হরমোন ছিটাতে দেখা গেছে। চাষিরা বলছেন, এই হরমোন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। আমগুলো একসঙ্গে পাকবে আর সুন্দর একটা রং হবে, পচবে না, সে জন্য তাঁরা এই হরমোন ব্যবহার করছেন। তাঁরা বলছেন, দেশে এই হরমোন অনুমোদিত।
তবে ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার ঘোষণার সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে এই ক্যালেন্ডারের বাইরেও যদি কোনো এলাকায় কোনো আম আগাম পেকে যায়, তাহলে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে আম বাজারজাত করা যাবে। কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এখন পর্যন্ত রাজশাহীর কোনো কৃষক আগাম আম পাড়ার জন্য প্রত্যয়নপত্র নেননি।
এ বিষয়ে ১৯ মে প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে ‘আম পাকাতে ব্যবহৃত হরমোন কি ক্ষতিকর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে সালমা বলছেন, ‘একটি গাছে সব মুকুল একসঙ্গে আসে না। প্রথম মুকুল থেকে শেষ মুকুলটা আসা পর্যন্ত প্রায় ২০ দিন সময় লাগে। তাহলে প্রথম পর্যায়ে আসা মুকুলের আম এবং শেষ পর্যায়ে আসা মুকুলের আম একসঙ্গে পাকে না। কিন্তু যাঁরা বাণিজ্যিকভাবে আম কেনাবেচা করেন, তাঁদের সব আম একসঙ্গে পাকা দরকার। তা ছাড়া তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ জন্য তাঁরা বলে থাকেন গাছ থেকে দু–একটি পাকা আম ঝরে পড়লে তা দিয়েই একটা ধারণা পাওয়া যায় যে আমগুলো পরিপক্ব হয়েছে। সে ক্ষেত্রে পরিপক্ব আমে হরমোন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু অপরিপক্ব আমে অবশ্যই নয়।’
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, গাছের সব আম একসঙ্গে পরিপক্ব হয় না এবং পাকে না।
কৃষিবিদদের কাছ থেকে বরাবরই আমরা জেনে আসছি ‘আম পাকাতে ইথিলিন গ্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে আমের রেস্পিরেশন রেট এবং অভ্যন্তরীণ এনজাইমেটিক রিঅ্যাকশন বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ফলের মধ্যে থাকা স্টার্চ ধীরে ধীরে সুক্রোজে রূপান্তরিত হয়, যা ফলকে মিষ্টতা ও নরম অনুভূতি প্রদান করে। তবে অতিরিক্ত তাপমাত্রা (৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ফল দ্রুত পাকায়। এতে পুষ্টিগুণ, স্বাদ ও রং কমে যেতে পারে।’
এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে আমরা প্রকৃতির দিকে তাকাব, নাকি সব আম একসঙ্গে পাকাব। আর তা করতে মাত্রাতিরিক্ত গরম সৃষ্টির জন্য কার্বাইড ব্যবহার করব, নাকি হরমোন ছিটাব। যদি তা–ই করি, তাহলে আমের স্বাদ আর পুষ্টিমান দুটোই হারাতে হবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা কী?
১৭ মে যখন ক্ষীরশাপতি আমে হরমোন ছিটানো হচ্ছিল, তখন থেকে ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আরও ১৩ দিন পরে এই জাতের আম পরিপক্ব হওয়ার কথা। অর্থাৎ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৩০ মে এই আম বাজারে আসার কথা। তবে আম–গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলছেন, ক্ষীরশাপতি আম ১০ জুনের আগে খেলে তার প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যাবে না। সেই হিসাবে আরও ২৩ দিন পরে এই আম পরিপক্ব হবে।
যেদিন রাজশাহী জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়, সেদিনই আম–গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন যে এখন ব্যবসায়ী ও চাষিরা আম গাছে থাকতেই একসঙ্গে পাকানো ও রং ধরানোর জন্য ওষুধ ব্যবহার করে থাকেন। বিষয়টি তিনি প্রশাসনের নজরে আনার চেষ্টা করেছিলেন।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার একজন আম ব্যবসায়ী সেদিন কথায় কথায় বললেন যে চিটাগাংয়ের ব্যবসায়ীরা তাঁর কাছ থেকে এক শর্তে আম নিতে রাজি আছেন। শর্ত হচ্ছে কার্বাইড দিয়ে সব আম একসঙ্গে পাকিয়ে দিতে হবে। তাঁরা বারবার বলছেন কার্বাইড করেন, কার্বাইড করেন, তা ছাড়া আপনার আম চলবে না।
এই ব্যবসায়ীর বক্তব্য হচ্ছে, তিনি গাছে আম পাকা দেখলে সেই আম পেড়ে অল্প অল্প করে অনলাইনে ভোক্তাদের বিশ্বস্ততার সঙ্গে পাঠিয়ে থাকেন। কিন্তু বেশি লাভের জন্য বড় পার্টি ধরতে গেলে তাঁকে এই অসততার আশ্রয় নিতে হবে। তাঁরা রঙিন আম পাবেন, দেখে মনে হবে ফ্রেশ। সবগুলো একসঙ্গে পাকা পাবেন কিন্তু হয়তো পুষ্টি আর স্বাদটা কম পাবেন।
১৩ মে রাজশাহীর সাহেববাজারে ডালি ভরে গোপালভোগ আম নিয়ে বসে আছেন একজন ব্যবসায়ী। খদ্দেরদের ডেকে বলছেন, ভাই নেন নেন, স্বাদ হবে। ভেতরে রস আছে, কিন্তু রাজশাহীর মানুষ তো আমের স্বাদ বোঝে। একজন ক্রেতা এসে একটা আমের ঘ্রাণ নিয়ে কিচ্ছু না বলে চলে গেলেন। রাজশাহীর গোপালভোগ ২২ মে থেকে বাজারে আসার কথা। আর মাহবুব সিদ্দিকীর হিসাব অনুযায়ী ২৮ মের আগে গোপালভোগ খেলে স্বাদ পাওয়া যাবে না।
রাজশাহীতে ঘোষিত ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ১৫ মে থেকে গুটি জাতের আম ভাঙা হচ্ছে। ২২ মে থেকে গোপালভোগ ও ৩০ মে ক্ষীরশাপাতি বা হিমসাগর আম বাজারজাত করার কথা। তার আগেই গোপালভোগ আমে বাজার ভরে গেছে।
রাজশাহীর আম–গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী ফেসবুকে নিজের মতো একটা ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছেন। তাতে বলেছেন, ‘সরকারিভাবে আমের ক্যালেন্ডার প্রকাশ পেলেও সেটি মোটেই নির্ভুল নয়। দেশের অগণিত আম ভোক্তাগণের সদয় অবগতির জন্য সঠিক সময়ে আম কেনার একটি ক্যালেন্ডার প্রদান করছি। এতে ভোক্তাগণ ঠকবাজ ও প্রতারক আম ব্যবসায়ীর কবলে পড়বেন না।’
তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী, গোপালভোগ মে মাসের ২৮ তারিখ থেকে জুন মাসের ১০ তারিখের মধ্যে, ক্ষীরশাপাতি জুন মাসের ১০ তারিখ থেকে ৩০ জুন অবধি। অন্য আম আরও পরে।
এখন বেচারা আম কী করবে বলুন। কোন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পাকবে। প্রশাসনের, গবেষকের, কৃষকের নাকি ভোক্তার? সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, আমের যদি জবান থাকত, তাহলে সে ওই প্যারোডিটা গাইত, ‘আমাকে আমার মতো পাকতে দাও, যেটা পাকেনি পাকেনি সেটা না খাওয়াই ঠিক, সব খেলে নষ্ট জীবন.
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক য ল ন ড র অন য য় ম হব ব স দ দ ক ব যবহ র কর ব যবস য় আম প ড় র জন য প রক শ হরম ন বলছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
কাভার্ড ভ্যানের পেছনে ধাক্কা দিয়ে দুমড়েমুচড়ে গেল যাত্রীবাহী বাস
খুলনা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল যাত্রীবাহী বাসটি। ভোরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই আসার পর হঠাৎ বাসটি ধাক্কা দেয় একটি কাভার্ড ভ্যানের পেছনে। এতে দুমড়েমুচড়ে যায় বাসটি। দুর্ঘটনায় আহত হন বাসের দুই যাত্রী। আজ মঙ্গলবার ভোর পাঁচটার দিকে খৈয়াছড়া ইউনিয়নের মিরসরাই ফিলিং স্টেশনের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
যাত্রীদের বরাতে ফায়ার সার্ভিস জানায়, ঘুম চোখে গাড়ি চালাচ্ছিলেন বাসচালক। তাই বাসটি নিয়ে কাভার্ড ভ্যানের পেছনে ধাক্কা দেন তিনি। দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের একজন দুমড়েমুচড়ে যাওয়া বাসের সামনের আসনে আটকে ছিলেন। বিভিন্ন সরঞ্জাম ব্যবহার করে প্রায় আধা ঘণ্টার চেষ্টায় তাঁকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।
আহত দুজন হলেন আনোয়ার হোসেন (২৮) ও মো. রায়হান ইসলাম (৩৮)। তাঁদের মধ্যে খুলনার বাসিন্দা আনোয়ারকে মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। মো. রায়হান ইসলাম নৌবাহিনীতে কর্মরত। তাঁকে উপজেলা সদরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে চট্টগ্রাম নগরে নেভি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
দুর্ঘটনার সময় ঘটনাস্থলের পাশের একটি গ্যারেজে কাজ করছিলেন মো. শামসুল আলম। তিনি বলেন, মহাসড়কের পাশে হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে এগিয়ে গিয়ে দেখেন একটি কাভার্ড ভ্যানের পেছনে বাস ধাক্কা দিয়েছে। বাসের ভেতরে যাত্রীরা আতঙ্কে চিৎকার করছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের বাস থেকে নামিয়ে আনেন। আহত একজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে একজন বাসে আটকে থাকায় বাসিন্দাদের পক্ষে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছিল না। পরে ফায়ার সার্ভিস তাঁকে উদ্ধার করে। আহত দুজনই বাসের সামনের দুটি আসনের যাত্রী বলে জানান শামসুল আলম।
দুর্ঘটনাকবলিত বাসটি নিউ বলেশ্বর পরিবহনের বলে জানান উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের মিরসরাই স্টেশনের দলনেতা হায়াতুন্নবী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আটকে পড়া এক যাত্রীকে অনেক কষ্টে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তাঁর ডান পায়ের নিচের অংশ অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আহত অপর ব্যক্তিকে আমরা আসার আগেই স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। যাত্রীরা জানিয়েছেন, চালক চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানোর কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।’
জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘দুর্ঘটনায় আহত যাত্রীদের একজনের অবস্থা গুরুতর। আমরা দুর্ঘটনাকবলিত বাসটি হেফাজতে নিয়েছি। তবে বাসের চালক দুর্ঘটনার পরেই সটকে পড়েছেন। তদন্ত করে এ বিষয়ে পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’