নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার খাজুরা দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে তালা দেওয়ার ঘটনায় সেনাবাহিনীর হাতে আটক বিএনপি নেতা-কর্মীদের আপস-মীমাংসার কথা বলে মুক্তি দেওয়া হয়। প্রায় ১২ ঘণ্টা পর আবার তাঁদের ডেকে এনে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আদালতে পাঠানো হয়েছে। বাদীর কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে নতুন এজাহার।

গতকাল সোমবার দুপুরে খাজুরা দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেনকে বের করে দিয়ে কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি হযরত আলী ও তাঁর সহযোগীরা। হযরত আলী খাজুরা ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

নলডাঙ্গা থানা সূত্রে জানা যায়, গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি হযরত আলীসহ কয়েকজন অভিভাবক সদস্য প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ে গিয়ে পর্ষদের সভা করার কথা বলেন। তখন তিনি তাঁদের শিক্ষা বোর্ডের প্রজ্ঞাপন অনুসারে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার কথা জানান। এতে তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে কার্যালয়ের আলমারি থেকে জরুরি কাগজপত্র বের করে নেন এবং শিক্ষকদের বের করে কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে যান। এ নিয়ে সভাপতিসহ পর্ষদের ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে নলডাঙ্গা থানায় লিখিত অভিযোগ দেন প্রধান শিক্ষক।

ঘটনাটি জানার পর নাটোর সেনা ক্যাম্পের সদস্যরা অভিযান চালিয়ে সন্ধ্যায় সভাপতি হযরত আলী এবং তাঁর সহযোগী অভিভাবক সদস্য রুস্তম আলী, ওহিদুর রহমান ও মিজানুর রহমানকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যান। রাত আটটার দিকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে তাঁদের নলডাঙ্গা থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, পর্ষদের সদস্যদের আটকের পর বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে ঘটনাটি মীমাংসা করে নিতে চাপ দেওয়া হয়। স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের নেতারা প্রধান শিক্ষককে ডেকে নিয়ে থানায় যান। দীর্ঘ আলোচনার পর আপস-মীমাংসার ভিত্তিতে পুলিশ রাত দুইটার দিকে মুচলেকা নিয়ে আসামিদের মুক্ত করে দেয়। খবর জানাজানির পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা আজ বিদ্যালয়ে যান। খোঁজখবর নিয়ে তাঁরা ঘটনার সত্যতা পান এবং প্রধান শিক্ষককে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থানায় এজাহার দেওয়ার নির্দেশনা দেন। নির্দেশনার বিষয়টি পুলিশকে জানালে তারা পর্ষদের সভাপতিসহ চারজনকে থানায় ডেকে নেন। নতুন এজাহারটি মামলা হিসেবে নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে তাঁদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।

প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতে স্থানীয় লোকজনের অনুরোধে তিনি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে আপস-মীমাংসা করে নিয়েছিলেন। তবে আজ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তিনি আবার নতুন করে এজাহার জমা দেন।

নলডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শিক্ষক-অভিভাবকেরা আপস-মীমাংসা করে অভিযোগ প্রত্যাহার করায় গতকাল রাতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রধান শিক্ষক আজ আবার নতুন এজাহার দেওয়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে নলডাঙ্গা আমলি আদালতে পাঠানো হয়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত আপস ম ম নলড ঙ গ গতক ল সদস য ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ