চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক জোটের কর্মসূচিতে যেইভাবে হামলার ঘটনা ঘটিয়াছে, আমরা উহার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আমরা মনে করি, সাংবিধানিকভাবে যে কোনো নাগরিকের সমবেত হইবার ও মতপ্রকাশের অধিকার রহিয়াছে এবং কাহারও উপর শারীরিক হামলা স্পষ্টতই ফৌজদারি অপরাধ। বিশেষত নারীর উপর হামলা আরও গুরুতর; বাংলাদেশ কিংবা বৈশ্বিক সংস্কৃতিতেই এইরূপ হামলা কোনো অজুহাতেই গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশগ্রহণকারী একজন নারীকে যেভাবে পদাঘাত করা হইয়াছে, উহা অভিযুক্ত ব্যক্তির অন্তর্গত পৈশাচিকতাই স্পষ্ট করিয়াছে।
বস্তুত এই ঘটনার সূচনা হইয়াছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের মুক্তিকে কেন্দ্র করিয়া। মঙ্গলবার দেশের সর্বোচ্চ আদালত পূর্বেকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় বাতিল করিয়া তাঁহাকে খালাস দিবার পরই দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলি প্রতিবাদ জানাইয়াছিল। চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এহেন প্রতিবাদ সমাবেশে হামলার ঘটনা ঘটিয়াছে। বস্তুত বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলির মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের নেতাকর্মীর উপর হামলার প্রতিবাদেই চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সম্মুখে বুধবার সমাবেশ আহ্বান করা হইয়াছিল। সেই সমাবেশেও এক দল যুবকের হামলা শান্তিকামী নাগরিকগণকে বিক্ষুব্ধ না করিয়া পারে না।
মন্দের ভালো, চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক জোটের কর্মসূচিতে হামলার ঘটনায় ইতোমধ্যে পুলিশ দুইজনকে গ্রেপ্তার করিয়াছে। প্রশ্ন হইল, হামলার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোথায় ছিল? এমনকি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও মাজারসহ বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনা ঘটিয়াছে। সেই সকল হামলার অঘটন দেশব্যাপী সমালোচনার জন্ম দিলেও সরকার সেইগুলি প্রতিরোধ করিতে পারে নাই। আমরা দেখিয়াছি, বিগত আওয়ামী লীগের সময়েও বিরোধী গোষ্ঠীর কর্মসূচিতে হামলার ঘটনা ঘটিত। এখনও এহেন ঘটনা অব্যাহত থাকিবার বিষয় অগ্রহণযোগ্য।
চট্টগ্রামে হামলার জন্য গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট ছাত্রশিবিরকে দায়ী করিলেও বিবৃতি দিয়া ছাত্র সংগঠনটি তাহাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করিয়াছে। আমরা মনে করি, কেবল বিবৃতি দিয়া দায়িত্ব সম্পাদনের সুযোগ সামান্যই। বিশেষত যখন দলটি স্বীকার করিয়াছে, হামলাকারী একদা ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সহিত সংশ্লিষ্ট ছিল। বিবৃতিতে যথায় দলটি উল্লেখ করিয়াছে, নারীর প্রতি সহিংসতা তাহাদের আদর্শ ও নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থি, তথায় তাহাদের সাবেক কর্মী কীভাবে এহেন হামলার দুঃসাহস দেখাইয়াছে! আমরা চাহি, হামলার পুরো ঘটনার নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত করিয়া দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হউক।
দুঃখজনক হইলেও সত্য, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে দেশের ছাত্র সংগঠনগুলির মধ্যকার যেই ঐক্য আমরা প্রত্যক্ষ করিয়াছি, অভ্যুত্থানের পর হইতেই সেই ঐক্যে বৃহৎ ফাটল ধরিয়াছে। বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র সংগঠনগুলির মধ্যে সংহতি নাই বলিলেই চলে। এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে হুমকি ও বিদ্বেষপূর্ণ স্লোগান বিনিময় করিতেছে। শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা এবং নারীর প্রতি নৃশংসতা যাহারা চালাইতেছে, এই অনৈক্যের দায় তাহাদের অধিক।
বুধবার সমকালে প্রকাশিত এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা উল্লেখ করিয়াছি, জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম মুক্তি পাইয়াছেন বটে, কিন্তু একাত্তরে যাহাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হইয়াছিল, তাহাদের ন্যায়বিচারের কী হইবে? উপরন্তু ঐ রায়ের প্রতিবাদে সমাবেশে হামলা ক্ষোভ বৃদ্ধি বৈ হ্রাস করিবে না। যেই কোনো পরিস্থিতিতেই বিপরীত মতাদর্শের উপর হামলা, নিপীড়ন এমনকি তাহাদের নিশ্চিহ্নকরণের মানসিকতা অত্যন্ত ভয়াবহ। চট্টগ্রামে হামলার ঘটনা তাহারই ইঙ্গিত দিতেছে। আমরা প্রত্যাশা করি, শিক্ষাঙ্গনগুলিতে সহাবস্থান নিশ্চিত করা হইবে; ছাত্র সংগঠনগুলির মধ্যে সেই সহনশীলতা থাকিতে হইবে, যাহাতে প্রত্যেকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করিতে পারে। তৎসহিত যেই কোনো হামলা বন্ধে প্রশাসনকেও আগাম তৎপর হইতে হইবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ছ ত র স গঠনগ ল র ম গণত ন ত র ক কর য় ছ র কর য় হইয় ছ অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
রাকসু নির্বাচনে বামদের প্যানেলে নারী একজন, শক্তি ‘ধারাবাহিক লড়াই’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে বাম সংগঠনগুলোর একটা বড় অংশ এক ছাতার নিচে এসেছে। তারা যে প্যানেল দিয়েছে, তাতে জায়গা পেয়েছেন মূলত জোটে থাকা সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারাই। নারী আছেন মাত্র একজন। তবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দুজনকে প্রার্থী করা হয়েছে। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিতি তৈরি হওয়াকে এই প্যানেলের ‘বড় শক্তি’ বলে মনে করা হচ্ছে।
রাকসুর ২৩ পদের বিপরীতে ১৬টিতে প্রার্থী দিয়েছে বাম সংগঠনগুলোর মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট। তাদের প্যানেলের নাম ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’। এই প্যানেলে আছেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র গণমঞ্চ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র যুব আন্দোলন, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা-কর্মীরা। রাজনৈতিক–সংশ্লিষ্টতা নেই, এমন শিক্ষার্থী আছেন দুজন। তবে প্যানেলে থাকা দুজন সদস্য সরে দাঁড়িয়েছেন।
এই প্যানেল থেকে সহসভাপতি (ভিপি) পদে লড়বেন ছাত্র ফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) কোষাধ্যক্ষ কাউছার আহম্মেদ এবং সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে প্রার্থী করা হয়েছে ছাত্র গণমঞ্চের আহ্বায়ক নাসিম সরকারকে।
বাম জোটের নেতারা বলছেন, ক্যাম্পাসে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে আসছেন তাঁরা। এর মাধ্যমেই তাঁরা শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত। শিক্ষার্থীদের ‘প্রধান কণ্ঠস্বর’ হিসেবে কাজ করেছেন, করছেন। তাঁদের দাবি, এটাই তাঁদের বড় শক্তি।
প্রার্থীদের প্রায় সবাই জোটের নেতাবামদের এই প্যানেলে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে লড়বেন বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের আহ্বায়ক তারেক আশরাফ। মহিলাবিষয়ক সহসম্পাদক পদে ছাত্র ফ্রন্টের শ্রেয়সী রায়, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক পদে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর হাসান শাহরিয়ার খন্দকার আলিফ এবং তথ্য ও গবেষণা সহসম্পাদক পদে লড়বেন ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মো. সজীব আলী।
এ ছাড়া সহবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক পদে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক রিসার্চ চাকমা এবং সহপরিবেশ ও সমাজসেবা সম্পাদক পদে একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শামীন ত্রিপুরাকে প্রার্থী করা হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক পদে ছাত্র ফ্রন্টের সদস্য মুনতাসির তাসিন, পরিবেশ ও সমাজসেবা–বিষয়ক সম্পাদক পদে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আজমাইন আতিক ও নির্বাহী সদস্য পদে লড়বেন ছাত্র ইউনিয়নের দপ্তর সম্পাদক আহমেদ ইমতিয়াজ।
এই প্যানেল থেকে জোটের বাইরে দুজনকে প্রার্থী করা হয়েছে। তাঁরা হলেন সহমিডিয়া ও প্রকাশনা সম্পাদক প্রার্থী ফাহিম মুনতাসির এবং নির্বাহী সদস্য পদে লড়বেন আসাদ সাদিক।
দাবি আদায়ের মাঠে থাকা ‘বড় শক্তি’শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়ার আন্দোলনে বাম সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সব সময় মাঠে দেখা গেছে। বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতেও তাঁরা তৎপর থেকেছেন। সংখ্যায় কম থাকলেও আন্দোলনের জায়গায় পিছিয়ে ছিলেন না। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাত্রলীগের বিভিন্ন অপকর্ম ও শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিরুদ্ধেও বাম নেতারা ছিলেন সোচ্চার।
শিক্ষার্থীদের আবাসন, খাদ্য, পরিবহনসংকট, ফি কমানো, নারীদের নিরাপত্তাসহ নানা ইস্যুতে আন্দোলন করে আসছে বাম সংগঠনগুলো। জুলাই আন্দোলনেও সক্রিয় ছিল তারা। এই প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ফুয়াদ রাতুল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কদের একজন।
বাম নেতারা বলছেন, নব্বই–পরবর্তী বাম রাজনীতির ক্রান্তিকাল চলছে। এর পর থেকে আত্মকেন্দ্রিকতা বেড়ে গেছে। সেই ছায়া পড়েছে প্রগতিশীল রাজনীতিতে। অন্য সংগঠনগুলোতে ব্যক্তিগত স্বার্থ বা লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাম রাজনীতি করলে সেই সুবিধা পাওয়া যায় না। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে বাম সংগঠনগুলো যে সব সময় সক্রিয় থেকেছে, এটাকেই রাকসু নির্বাচনে একটা বড় শক্তি মনে করছেন তাঁরা।
বামদের প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ও ছাত্র ফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের পক্ষে আন্দোলন করায় আমরা ক্যাম্পাসে পরিচিত। সে হিসেবে আমরা শিক্ষার্থীদের কাছে পরীক্ষিত। বিগত দিনে আমরা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের প্রধান কণ্ঠ ছিলাম। আমাদের তারা মূল্যায়ন করবে। আমাদের এই লড়াই–ই বড় শক্তি।’