ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকাকে নরক বানিয়েছে দখলদার ইসরায়েল। একদিকে বোমা হামলা, অন্যদিকে খাদ্যের কৃত্রিম সংকট গাজাবাসীকে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। খাদ্য বিতরণের নামে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র মিলে সৃষ্টি করেছে মৃত্যুফাঁদ। প্রতি ২০ মিনিটে গাজায় একটি শিশু নিহত বা আহত হচ্ছে। গত দুই সপ্তাহে পাঠানো ত্রাণের ট্রাকগুলো মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ পূরণ করেছে। জাতিসংঘ এই পরিস্থিতিকে ‘গণবিপর্যয়ের প্রতি উপহাস’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। খাদ্য সংকটে দুর্ভিক্ষের মুখে উপত্যকার বাসিন্দারা। এর মধ্যেই তারা ভারী বোমাবর্ষণ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। ২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।   

খাদ্য অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত মাইকেল ফাখরি বলেছেন, ইসরায়েল ‘মানুষ আটকানোর টোপ’ হিসেবে খাদ্য কর্মসূচি চালু করেছে। 

বিবিসি জানায়, গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) পরিচালিত নতুন ত্রাণ বিতরণ প্রকল্প বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। খাদ্যবিতরণ কর্মসূচিতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। শুক্রবার দেখা যায়, একটি সরু গলিতে খাবারের জন্য আটকে রাখা হয়েছে গাজার বাসিন্দাদের। পাশেই উঁচু স্থানে কড়া নজরদারিতে রয়েছে ইসরায়েলি সেনা। খাদ্য বিতরণের মধ্যেই গুলি করা হচ্ছে। কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, গুলির শব্দে মানুষ কাঁপতে কাঁপকে খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে পড়ছে। আতঙ্কে পদদলিত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।     
 
ত্রাণ বিতরণ প্রকল্প কেন্দ্রগুলো পাহারা দিচ্ছে সশস্ত্র আমেরিকান নিরাপত্তা ঠিকাদাররা। তাদের লক্ষ্য, গাজায় প্রধান সরবরাহকারী জাতিসংঘের সংস্থা যেন তাদের কার্যক্রম না চালাতে পারে। ইসরায়েল দাবি করেছে, হামাস যাতে খাবার চুরি না করতে পারে, সেজন্য বিকল্প খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। হামাস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।   

জিএইচএফ চারটি কেন্দ্রের মাধ্যমে বিতর্কিত খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। তারা প্রথম সপ্তাহে ১০ লাখ গাজাবাসীকে খাবার বিতরণের পরিকল্পনা নেয়। শুক্রবার ছিল চতুর্থ দিনের কার্যক্রম। 

বৃহস্পতিবার নুসেইরাতের কাছে জিএইচএফের উত্তরাঞ্চলীয় সাইটে ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়,  জিএইচএফের দায়িত্বে থাকা দখলদার সেনারা ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়িতেও হামলা করছে। বিকট বিস্ফোরণে বাসিন্দারা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। 

ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য গঠিত জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর প্রধান ফিলিপ লাজ্জারিনি মনে করেন, কেবল রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তিই গাজার দুর্ভিক্ষ থামাতে পারে। চলতি বছরের শুরুতে জাতিসংঘ প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৮০০ ট্রাক ত্রাণ পাঠাত। ইসরায়েল এখন স্বল্প খাদ্য সরবরাহ করে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার কৌশল নিয়েছে। 

তিনি বলেন, ফিলিস্তিনিদের জন্য যারা মানবিক সহযোগী হিসেবে কাজ করছে, তাদের কার্যক্রম কঠিন করে তোলা হচ্ছে। আমরা অভাবীদের সাহায্য ও তাদের মর্যাদা রক্ষা করতে চাই। আমরা অসম্ভব কিছু চাচ্ছি না। 

এদিকে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ সতর্ক করেছে, উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা দিন দিন বাড়ছে। এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার সবচেয়ে বেশি মূল্য দিচ্ছে শিশুরা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে এ পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি শিশু হতাহত হয়েছে। গত ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৩০৯ শিশু নিহত ও ৩ হাজার ৭৩৮ শিশু আহত হয়েছে। 

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত যুদ্ধের সময় গাজায় ৫৪ হাজার ৩৮১ জন নিহত ও ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৪ জন আহত হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ৬০ ফিলিস্তিনির লাশ ও আহত ২৮৪ জনকে গাজার হাসপাতালে আনা হয়।  

 
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল খ দ য ব তরণ জ এইচএফ ব তরণ র ইসর য় ল ব তরণ ক

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল

যখন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, তখন তা শুধু ক্ষুধার নয়, বরং সমাজের ভাঙনেরও প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এ অবস্থায় মানুষ আবর্জনার স্তূপ থেকে খাবার খুঁজে আনে। কেউ গোপনে রান্না করে; কেউ আত্মীয়দের থেকে খাবার লুকিয়ে রাখে, কোনো পরিবার হয়তো খাবারের জন্য তাদের দাদিমার গয়না বিক্রি করে দেয়।

দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মুখে কোনো অনুভূতি থাকে না। তাদের চোখে থাকে ফাঁপা দৃষ্টি। মানুষ পশুর মতো খাবারের জন্য লড়াই করে। এটিই হলো সামাজিক অবক্ষয় ও অপমানের চরম রূপ। এটিই হলো মানবিক মর্যাদার বিলোপ। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজকের গাজাবাসী যাচ্ছে। 

গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ নামে একটি নতুন সংস্থা (যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে মে মাসে যাত্রা শুরু করে) নিজেদের কার্যক্রমকে একুশ শতকের আধুনিক ও সহানুভূতিশীল সংস্থা বলে দাবি করছে। তারা বলছে, তাদের চারটি ‘নিরাপদ বিতরণ কেন্দ্র’ থেকে তারা প্রতিদিন ২০ লাখের বেশি প্যাকেট খাবার বিতরণ করছে। সেখানকার ছবিতে দেখা যায়, বাচ্চাদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন সংস্থার কর্মীরা।

আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি। 

ইসরায়েলি মুখপাত্ররা বলছেন, জাতিসংঘের ট্রাকগুলো গাজার সীমানার ভেতরে আছে কিন্তু জাতিসংঘ নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বিতরণ করছে না। কিন্তু এ বক্তব্য খুব সহজ বিশ্লেষণেই ভেঙে পড়ে। 

প্রথমত, সংখ্যা ঠিক মিলছে না। গত এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা হিসাব করে জানায়, ১৮ মাসের অবরোধ ও যুদ্ধের পর এবং দুই মাসের পূর্ণ ইসরায়েলি অবরোধের ফলে মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে গাজায় জীবন বাঁচানোর জন্য যে পরিমাণ খাবার দরকার, তার অর্ধেকের নিচে নেমে যাবে। অর্থাৎ গাজার সব মানুষের খাদ্যের পুরো চাহিদা পূরণ করতে হবে এই ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিদিনের ২০ লাখ প্যাকেট খাবার গাজার প্রয়োজনের অর্ধেকও নয়। 

আরও পড়ুনইসরায়েল কেন গাজায় অস্ত্রধারী গুন্ডা পোষে ১১ জুন ২০২৫

দ্বিতীয়ত, শুধু সংখ্যায় খাবার পৌঁছালেই দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয় না; দুর্ভিক্ষ আঘাত করে সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোর ওপর। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, যখন ২০ শতাংশ পরিবার মারাত্মক খাদ্যসংকটে পড়ে, তখন সেটিকে ‘দুর্ভিক্ষ’ বলা যায়। এ অবস্থায় নারীরা, বিশেষ করে যাঁদের স্বামী নেই এবং যাঁদের অনেক শিশু বা বয়স্ক অভিভাবক আছেন, তাঁরাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন। সেসব পরিবারকে চিনে ত্রাণ পৌঁছানোই আসল কাজ। 

জিএইচএফ গাজায় চারটি বিতরণ কেন্দ্র চালায়—তিনটি রাফার ধ্বংসস্তূপে, আরেকটি গাজার মাঝখানে। সব কটিই সামরিক এলাকায়। এরা খুব অল্প সময়ের জন্য এবং খাবার বিতরণের খুব অল্প আগে সবাইকে জানিয়ে খোলে। মানুষ ধ্বংসস্তূপে শিবির করে বসে থাকে, কখন দরজা খুলবে সেই আশায়। তারা জানে, ইসরায়েলি সেনারা ভিড় সামলাতে গুলি চালাতে দ্বিধা করে না। যেসব দুর্বল মা, বয়স্ক মানুষ বা প্রতিবন্ধী এই দৌড়ে অংশ নিতে পারেন না, তাঁরা কীভাবে খাবার পাবেন? 

আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫

তৃতীয়ত, মানুষের বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়া দরকার। যেমন অপুষ্ট শিশুদের জন্য দরকার বিশেষ ধরনের খাবার (যেমন ‘প্লাম্পিনাট’, যা সাধারণ খাবার খেতে না পারা শিশুর জন্য তৈরি) দেওয়া দরকার। কিন্তু জিএইচএফের বক্সে থাকে ময়দা, পাস্তা, তেল, চাল, ডাল, তাহিনি (তিলবীজ থেকে তৈরি একধরনের মাখনবিশেষ)। জিএইচএফের ত্রাণের মধ্যে কোনো শিশুখাদ্য বা প্লাম্পিনাট নেই। কোনো প্রশিক্ষিত নার্স বা পুষ্টিবিদও নেই, যাঁরা অপুষ্ট শিশুদের সেবা দিতে পারেন। 

আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি। 

অ্যালেক্স ডি ওয়াল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক

দ্য গার্ডিয়ান, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল
  • ইসরায়েল বলছে তারা গাজায় ত্রাণ দিচ্ছে, তাহলে ফিলিস্তিনিরা না খেয়ে মরছে কেন