‘মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষায় জাতীয় ঐক্য এখন সময়ের দাবি’
Published: 2nd, June 2025 GMT
মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দলীয়করণ, পারিবারিকীকরণ ও ব্যক্তিকরণের ফলে বিচ্যুতি-বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারিনি। তার মানে এই নয় যে, পাকিস্তান ভালো ছিল। ভোটারবিহীন ও রাজনৈতিক দলসমূহের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন ও লুটপাটের মতো একটি অরাজক পরিস্থিতি থেকে জুলাই আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে দেশের মানুষ একটি পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিল। নানান ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে, তার মানে এই নয় আগে ভালো ছিলাম। ছাত্র-জনতার স্বপ্ন পূরণে তাই মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষায় জাতীয় ঐক্য এখন সময়ের দাবি।
গত শনিবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কে জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খান স্মৃতি পরিষদের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ও আলোচকবৃন্দ এই মতামত ব্যক্ত করেন। ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন ও প্রবাসীদের দাবি দাওয়া আদায়ে সোচ্চার হোন’ স্লোগানে নিউইয়র্কের জামাইকার হিলসাইডের স্টার কাবাব’র হল রুমে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সিরাজুল আলম খান ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান ও দৈনিক সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ খান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আবু সাঈদ খান বলেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ছাত্রদের একার আন্দোলন ছিল না। ছাত্ররা নেতৃত্ব দিয়েছে কিন্তু আপামর জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল এই গণঅভ্যুত্থানে। জনগণের ধূমায়িত ক্ষোভ-অসন্তোষ কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবি, ৩২ নম্বরে হামলা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধকে লক্ষ্য করে যা কিছু ঘটেছে তা দুঃখজনক। যুদ্ধাপরাধকে আড়াল করতে ছাত্রদের ঘাড়ে পা রেখে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ফায়দা লুটছে।
তিনি বলেন, দেশের মানুষ গণতন্ত্র মানে মনে করে ভোটতন্ত্র। তারা ভোটের মাধ্যমে নিজের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতে চায়। আজকে যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে সিরাজুল আলম খান রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠায় সেই রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব করেছিলেন ৪৫ বছর পূর্বে। ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উন্নীত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন সিরাজুল আলম খান। তার চিন্তা-দর্শন নিয়ে ভিন্নমত থাকতে পারে, সেটি নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভা পরিচালনা করেন সিরাজুল আলম খান স্মৃতি পরিষদের সদস্য সচিব শাহাব উদ্দীন। বক্তব্য রাখেন সিরাজুল আলম খান স্মৃতি পরিষদের অন্যতম নেতা অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান, লিগ্যাল কনসালটেন্ট মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন খান, সাংবাদিক হাকিকুল ইসলাম খোকন, মুজাহিদ আনসারি, জামান তপন, নজরুল ইসলাম, প্রোগ্রেসিভ ফোরামের নেতা জাকির হোসেন বাচ্চু ,আবুল হোসেন, সৈয়দ জুয়েল প্রমুখ।
প্রসঙ্গত, সিরাজুল আলম খানের জীবন-দর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা, স্বাধীনতা সংগ্রামে অনবদ্য ভূমিকা ও নতুন প্রজন্মের কাছে সিরাজুল আলম খানকে পরিচয় করিয়ে দিতে তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আগামী ২২ জুন বিকাল ৬টায় নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের জুইস সেন্টারে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স র জ ল আলম খ ন ন উইয র ক ন স র জ ল আলম খ ন গণঅভ য ত থ ন
এছাড়াও পড়ুন:
চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে অস্থিরতা: চোখ বুজে থাকবেন না
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা বন্ধ থাকায় সাধারণ রোগীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ স্পষ্ট। বিশেষায়িত এ হাসপাতালটি যেখানে ২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা দিয়ে আসছে, সেখানে পাঁচ দিন ধরে সেবা বন্ধ থাকার ঘটনা বিরল ও বিস্ময়কর। এ পরিস্থিতি উদ্ভবের কারণ হাসপাতালটির চিকিৎসক ও কর্মচারীদের সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের সংঘর্ষের ঘটনা। স্বাস্থ্য প্রশাসনের বিজ্ঞপ্তিতে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি উঠে এসেছে, যেখানে সেবা কবে চালু হবে সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। প্রশ্ন হলো, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে আহতদের সঙ্গে চক্ষু হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মচারীদের সম্পর্ক মারামারির পর্যায়ে গেল কীভাবে?
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আহতদের ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কারণ তাদের সব দাবি-দাওয়া এখনও পূরণ হয়নি। চিকিৎসাসহ সামগ্রিক বিষয় আহতদের সংক্ষুব্ধ হওয়ার বিষয়টি বড় আকারে সামনে আসে গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝিতে। ওই সময় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের হাসপাতালে দেখতে গিয়ে ক্ষোভের শিকার হয়েছিলেন। গভীর রাতে তখন চার উপদেষ্টার আশ্বাসে আহতরা হাসতালে ফিরে গিয়েছিলেন। এর পর আহতরা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন। সেখানেও তাদের দাবি পূরণে আশ্বাস দেওয়া হয়। এর পর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ৫৫ জনের মধ্যে ৪ জন বিষপান করেন ২৫ মে। জরুরি চিকিৎসা দিয়ে তাদের শঙ্কামুক্ত করা হলেও আহতদের ক্ষোভ যে কমেনি, ২৮ মে চক্ষু হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীদের মধ্যকার সংঘর্ষই তার প্রমাণ।
চিকিৎসকরা নিশ্চয় তাদের সাধ্যের মধ্যে চিকিৎসা দিচ্ছেন। কিন্তু বাকি সুযোগ-সুবিধা তো তাদের হাতে নেই। এখানে আহত ও চিকিৎসকদের মাঝখানে কাউকে থাকতে হবে, যারা সরকারের সঙ্গে মধ্যস্থতা করবেন। আহত কোনো চিকিৎসক থাকলে তাদের দিয়ে এটি সহজেই করা যেত। আমরা দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধের পর যারা আহত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাদের চিকিৎসা নিয়েও এক ধরনের সংকট দেখা দিলে তাদের জন্য আলাদা একটা হাসপাতালই তৈরি করা হয়। সেটাই আজকের পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)। তখন মুক্তিযুদ্ধে আহত চিকিৎসক কিংবা শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখনও মধ্যস্থতায় সেভাবে দায়িত্ব দিতে পারলে হয়তো পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সহজ। আহত ও চিকিৎসকদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তো কোনো সমাধান নয়। বরং সমস্যা যে বেড়েছে– চক্ষু হাসপাতাল বন্ধের ঘটনাই তার প্রমাণ।
এ সমস্যা যে কেবল চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে হচ্ছে, তা নয়। বরং নিটোর, নিউরোসায়েন্সেসসহ অন্য হাসপাতাল, যেখানেই আহতরা আছেন, সেখানেই সমস্যা হচ্ছে। নভেম্বরে যখন আহতরা প্রথম বিক্ষোভ করেছিলেন, তখনই আমি সমকালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছি, গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় আলাদা দপ্তর গঠন জরুরি। অর্থাৎ যাতে তারা সবকিছুর ‘ওয়ানস্টপ’ সমাধান পান। কারণ সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকে। ফলে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম অস্থায়ী কর্তৃপক্ষ করলে পরিবর্তন আসতে পারত। পরে শুনেছিলাম, আহতদের জন্য ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ বর্তমানে যেটি বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের আহত ছাত্র-জনতার চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা এমনই ছিল। এটা জরুরি ছিল। যেহেতু ‘মাল্টি ডিসিপ্লিনারি’ হাসপাতাল, সেখানে সব ধরনের চিকিৎসাই একসঙ্গে পাওয়া সম্ভব হতো। আহতদের চিকিৎসা-পরবর্তী পুনর্বাসনে সেখানে ফিজিওথেরাপি যুক্ত হওয়ার কথাও বলা হয়। এর পরও কেন আহতদের চিকিৎসা সেখানে হলো না, আমরা জানি না। এ পরিকল্পনা কেন বাস্তবায়ন হলো না, তা জানা দরকার। সরকারই তো সেখানে অর্থায়ন করত। সব আহতকে সেখানে ট্রান্সফার করে চিকিৎসা ও সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করলে নিশ্চয় আজকের এ পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসকরা সেবা দেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছেন। তার মানে, বিষয়টি আর সাধারণ পর্যায়ে নেই। তারা প্রয়োজনে অন্যত্র বদলি করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এমনকি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছেন অনেকে। এটাই প্রমাণ করে– তাদের মধ্যকার তিক্ততা কোন পর্যায়ে গেছে। অর্থাৎ তারা ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন। দু’পক্ষকে বসিয়ে এর সমাধানের পর্যায়ে আর বিষয়টি নেই। চিকিৎসকদের সেবা প্রদানের জন্য আস্থায় আনতে হলে এখন ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে বসতে হবে। তার আগে হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীদের ক্ষোভের কারণগুলোর বিস্তারিত যেমন জানতে হবে, তেমনি জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আহতদের দাবিগুলোও শুনতে হবে। যারা সমাধানের চেষ্টা করবেন তাদের উভয় পক্ষকেই আস্থায় আনতে হবে। শুধু প্রতিশ্রুতিতেই যেন তা সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং কার্যকরও জরুরি। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন যদিও বলছে, অচলাবস্থা নিরসনে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিনিধি পাঠিয়েছে, যারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ অন্য সেবাদানকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। অতিদ্রুত এটি ফলপ্রসূ হওয়া দরকার। ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়ে চিকিৎসার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আর কার্যকর সমাধান হিসেবে আমি আহতদের বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েই চিকিৎসার কথা বলব।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল যেহেতু চক্ষু চিকিৎসার সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল, সে জন্য সারাদেশ থেকেই রোগীরা এখানে সেবা নিতে আসেন। তাদের আর ফেরানো ঠিক হবে না। তাদের যদিও কাছের কোনো হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু চক্ষুর বিশেষায়িত সেবাগুলো সব হাসপাতালে সেভাবে নাও থাকতে পারে। এভাবে সেবা বন্ধ রাখা মন্দ নজির হয়ে থাকবে। সে জন্য সব পক্ষের আন্তরিকতার মাধ্যমে দ্রুত সমাধানে আসতেই হবে। যুদ্ধ অবস্থায়ও তো এভাবে বিশেষায়িত হাসপাতালের জরুরি সেবা বন্ধ থাকে না। তাহলে এই সময়ে কেন চোখ বুজে থাকা!
ডা. মুশতাক হোসেন: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ