লিটন আইচ (৫৫) পেশায় ভ্যানচালক। স্ত্রী ও তিন ছেলেকে নিয়ে থাকেন চট্টগ্রাম মহানগরীর ব্যাটারি গলিতে। বাড়তি আয়ের জন্য অলিগলি, ডাস্টবিন বা খালপাড় ঘুরে ঘুরে প্লাস্টিকের বোতল, কাগজ ও ভাঙা খেলনা কুড়ান। দিনে গড়ে দুই কেজির মতো সংগ্রহ করতে পারেন; যা বিক্রি করে কেজিপ্রতি দাম মেলে ২৫-৩০ টাকা।

সমাজে লিটনের মতো এসব প্লাস্টিকজাত বর্জ্য সংগ্রাহকের পরিচিতি ‘টোকাই’ হলেও তাদের হাতেই পরিবেশ রক্ষায় নীরব বিপ্লব ঘটেছে চট্টগ্রামে। গবেষকরা বলছেন, এই মহানগরে উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যের ৭৩ শতাংশই সংগ্রহ করেন তারা। তাদের হাত ঘুরে এসব যায় ভাঙারি দোকানে। সেখান থেকে পুনর্ব্যবহারের (রিসাইক্লিং) জন্য যায় কারখানায়।

গবেষকরা বলছেন, সারাবিশ্বে প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের হার ৯ শতাংশ। অথচ চট্টগ্রামে এই হার ৭৩ শতাংশ। তাদের দাবি, এটিই প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও রিসাইক্লিংয়ে স্থানীয় পর্যায়ে বিশ্বসেরা সাফল্য। যাদের হাত ধরে এই সাফল্য, তাদের নেই প্রশিক্ষণ। নেই নিরাপত্তা সরঞ্জামও। অথচ স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়েই তারা পরিবেশযোদ্ধার ভূমিকা পালন করছেন নীরবে।

বিশ্বব্যাংকের ‘প্লাস্টিক ফ্রি রিভার অ্যান্ড সি ফর সাউথ এশিয়া’ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে গবেষণা কার্যক্রম থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ইউনাইটেড নেশন্স অফিস ফর প্রজেক্ট সার্ভিসেস (ইউএনওপিএস) এবং সাউথ এশিয়া কো-অপারেটিভ এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের তত্ত্বাবধানে গবেষণাটি চলে ২০২৪ সালের জুন থেকে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি বিভাগ ও মার্কেটিং বিভাগের একদল গবেষক এই কাজ পরিচালনা করেন।

৭৩ শতাংশ সংগ্রহ: গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরীর ৫০ লক্ষাধিক বাসিন্দা বছরে উৎপাদন করেন ২ লাখ ৫৭ হাজার ৯১৩ টন প্লাস্টিক বর্জ্য। এর মধ্যে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৭৯ টনই টোকাইরা সংগ্রহ করেন; যা বর্জ্যের প্রায় ৭৩ শতাংশ। এ কাজে জড়িত প্রায় ২০ হাজার ৫০০ ব্যক্তি।

নগরের ৪১ ওয়ার্ডে বর্জ্য সংগ্রহকারী ১৪ হাজার ৩০১ জন। দিনে তারা সংগ্রহ করেন ৫১২ টন প্লাস্টিক বর্জ্য। নগরে ভাঙারি দোকানিসংখ্যা ২ হাজার ৪৩, যারা দিনে কেনেন ৪৩৩ টন বর্জ্য। এসব যায় ২৪৫টি প্রক্রিয়াজাতকারণ কারখানায়। কারখানাগুলোতে ৩ হাজার ৪৩০ জন শ্রমিক বর্জ্য বাছাই, পরিষ্কার, শুকানো, মেশিনে কেটে টুকরো করা (ফ্লেক্স), দানা তৈরি (পেলেটিং) ও মোড়কজাত করেন। দৈনিক প্রক্রিয়াজাত হয় ২৪০ টন বর্জ্য। পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদন করেন আরও ৫২ জন উদ্যোক্তা, যাদের কারখানায় শ্রমিক আছেন ৭২৮ জন। তাদের উৎপাদন দিনে ৩২ টন।

ক্ষতিকর সাত ধরনের প্লাস্টিক: বেশির ভাগ বর্জ্য সংগ্রহকারী বোতল, খেলনা, আসবাব সংগ্রহ করেন। রিসাইক্লিং বাজারে এসবের চাহিদা বেশি। তথ্য অনুযায়ী, সংগ্রহকারীরা সাত ধরনের প্লাস্টিক সংগ্রহ করেন। তারা দিনে পলিথিলিন টেরেফথালেট (পিইটি) সংগ্রহ করেন ১০৬ টন, লো-ডেনসিটি পলিথিলিন (এলডিপিই) ৯৩ দশমিক ৫৮ টন ও হাই-ডেনসিটি পলিথিলিন (এইচডিপিই) সংগ্রহ করেন ৭৮ দশমিক ৫৮ টন। বাকিগুলো পিভিসি, পিপি, পিএস ও মিশ্র প্লাস্টিক।

দিনে সংগৃহীত বর্জ্যের ২৪ শতাংশই পিইটি, এলডিপিই ২১ শতাংশ ও এইচডিপিই সংগৃহীত হয় ১৮ শতাংশ।

খালি হাতেই সংগ্রহ: গবেষণা বলছে, বর্জ্য সংগ্রহকারীদের ৮৩ শতাংশই এসব সংগ্রহ করেন খালি হাতে। ১৩ শতাংশ ব্যক্তি লোহার শিক, ছুরি, হুক ও নিড়ানির মতো দেশীয় সরঞ্জাম ব্যবহার করেন। কিছু মানুষ নৌকা ব্যবহার করেন। গবেষকরা বলছেন, অনেক প্লাস্টিক পণ্যে থাকা বিপজ্জনক উপাদান খোলা জায়গায় পোড়ালে বিষাক্ত রাসায়নিক বের হয়; যা সংগ্রহকারীদের সংস্পর্শে আসে। স্টাইরোফোম জাতীয় প্লাস্টিকে স্টাইরিন ও বেনজিনের মতো বিষাক্ত রাসায়নিক থাকে; যা ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি করে; প্রভাব ফেলে স্নায়ু, ফুসফুস, কিডনি, লিভারের রোগ ও প্রজনন স্বাস্থ্যে।

তাদের অসুখ-বিসুখ: ভোলার বাসিন্দা বানু আক্তার (৬০) থাকেন লালখানবাজারে। স্বামী মারা গেছেন। দুই ছেলেকে নিয়েই সংসার। দিনে ভিক্ষা করেন। রাত ৮টা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত সংগ্রহ করেন প্লাস্টিক। মঙ্গলবার রাতে বানু আক্তারকে পাওয়া যায় কাজীর দেউড়ি এলাকায়। তিনি একটি রেস্তোরাঁর উচ্ছিষ্ট বোতল, কোমল পানীয়ের বোতল ও স্ট্র আলাদা করছিলেন। খালি হাতে এ কাজে সমস্যা হয় কিনা, জানতে চাইলে বানু বলেন, মাঝে নানা অসুখ-বিসুখ হয়। কিছুদিন আগেও চুলকানি হয়েছিল। ওষুধ খাওয়ার পর কমেছে। বোতল বিক্রির টাকায় সংসার চলে না। বাসা ভাড়া দিতেও কষ্ট হয়।

এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের ডিন ড.

মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন। সরেজমিন তথ্য সংগ্রহের পর তা বিশ্লেষণের পর ফল দেখে তারা বিস্মিত হন জানিয়ে ড. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘সবার অজান্তে টোকাই ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পরিবেশের জন্য বিশাল অবদান রাখছে। এটা বিস্ময়কর। স্থানীয় পর্যায়ে এত বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ বিশ্বে আর কোথাও হয় না। তারা এটি না করলে কর্ণফুলী নদী ও চট্টগ্রাম নগরের পরিবেশের অবস্থা আরও ভয়াবহ হতো। সরকারের উচিত যাদের হাত ধরে এই সাফল্য আসছে, তাদের জীবিকা নির্বাহে প্রণোদনা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়া।’

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প ল স ট ক বর জ য বর জ য স গ র স গ রহক র পর ব শ র ব যবহ র নগর র উৎপ দ

এছাড়াও পড়ুন:

মাদারীপুরের সাবেক দুই ডিসিসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান

শিবচরে পদ্মা সেতু রেললাইন সংযোগ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মাদারীপুরের সাবেক দুই জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন ও মো. ওয়াহিদুল ইসলামসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মাদারীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়। 

মঙ্গলবার (২৯ জুলাই)  দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় এ সংক্রান্ত নোটিশ মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, সাবেক দুই জেলা প্রশাসকসহ অভিযুক্তদের কাছে পাঠিয়েছে ।

দুদক সূত্র জানায়, পদ্মা রেললাইন সংযোগ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক দুই জেলা প্রশাসকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন জন্য দুদক মাদারীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আখতারুজ্জামানকে দলনেতা ও উপ-সহকারী পরিচালক মো. সাইদুর রহমান অপুকে সদস্য করে একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। 

আরো পড়ুন:

খুকৃবির সাবেক উপাচার্যসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

কুবির নতুন ক্যাম্পাসের জমি ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ, তথ্য চেয়েছে দুদক

অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ১৯ ধারা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা, ২০০৭ এর বিধি ৮ অনুযায়ী ব্যবস্থাগ্রহণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 

দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য এবং চাহিদাপত্র চেয়ে নোটিশ প্রদান করা হয়েছে তারা হলেন- মাদারীপুর সাবেক জেলা প্রশাসক মো. ওহিদুল ইসলাম, সাবেক জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ ফারুক আহম্মদ, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ঝোটন চন্দ্র, মাদারীপুরের সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. সাইফুদ্দিন গিয়াস।

‎মোহাম্মদ সুমন শিবলী, প্রমথ রঞ্জন ঘটক, ‎আল মামুন, মো. নাজমুল হক সুমন, মাদারীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ‎কানুনগো (ভারপ্রাপ্ত) মো. নাসির উদ্দিন, মো. আবুল হোসেন, রেজাউল হক এবং মাদারীপুর কালেক্টরেট রেকর্ড রুম শাখার রেকর্ড কিপার মানিক চন্দ্র মন্ডল।

দুর্নীতি দমন কমিশন মাদারীপুরের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান বলেন, “মাদারীপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম ও ড. রহিমা খাতুনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে তথ্য ও বিভিন্ন চাহিদাপত্র চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন মাদারীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত নোটিশ অভিযুক্তদের কাছে পাঠানো হয়েছে।”

ঢাকা/বেলাল/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ