গুগলে রোগবালাইয়ের চিকিৎসা খোঁজাও যখন একটি রোগ
Published: 7th, June 2025 GMT
কয়েক দিন ধরে প্রায়ই মাথাটা ব্যথা করছে। মনে হলো, অনেক প্রশ্নের উত্তরই তো গুগলে পাওয়া যায়, এ বিষয়ে একটু সার্চ করে দেখি তো। উপসর্গ লিখে অনুসন্ধান করতেই সব কারণ, লক্ষণ বিশদভাবে তুলে ধরল গুগল। আসতে থাকল একের পর এক রোগের বর্ণনা। মাথাব্যথার একটি অন্যতম কারণ ব্রেন টিউমার—এটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার মাথায় ঢুকে গেল, নিশ্চয় ব্রেন টিউমার হয়েছে। অন্যান্য উপসর্গ পড়তে পড়তে দেখেন, আরে, সব তো মিলে যাচ্ছে। দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে গেল। দুর্বল লাগতে থাকল। আতঙ্কে কোনো কাজ করতে আর ভালো লাগে না, খেতে ইচ্ছে করে না, কোনো কাজে আগ্রহ পাওয়া যায় না। ওজন কমে যাচ্ছে। নতুন সৃষ্ট সমস্যাগুলোকে আরও বেশি ক্যানসারের সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে। জীবন শেষ, এই হতাশা পেয়ে বসল।
তারপর এসব সমস্যা নিয়ে আপনি চিকিৎসকের কাছে গেলেন। চিকিৎসক পরীক্ষা করে টিউমারের কোনো লক্ষণ না পেয়ে আশ্বস্ত করলেন। কিন্তু আপনি আশ্বস্ত হতে পারলেন না। আপনার দৃঢ় বিশ্বাস যে টিউমারই হয়েছে। মাথার সিটিস্ক্যান স্বাভাবিক, তাতে কী, এমআরআই করার জন্য জোর করতে লাগলেন। এমআরআইও স্বাভাবিক, কিন্তু আপনি সন্তুষ্ট নন। নিশ্চয় এই চিকিৎসক ধরতে পারছেন না, আপনি আরেক চিকিৎসকের দ্বারস্থ হলেন। এভাবে একের পর এক চিকিৎসকের কাছে যেতে যেতে আপনার দস্তা দস্তা ফাইল হয়ে গেল, কিন্তু রোগনির্ণয় হয় না। মানসিক চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদিকে বাড়ছে মাথাব্যথার তীব্রতাও। আপনার স্বাভাবিক জীবন লাটে উঠল। আপনি রীতিমতো শয্যাশায়ী। এই যে গোটা জার্নি, এটি নিজেই আসলে এক ধরনের রোগ, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় হাইপোকনড্রিয়াসিস।
হাইপোকনড্রিয়াসিস কীহাইপোকনড্রিয়াসিস হচ্ছে একধরনের মানসিক ব্যাধি, যেখানে রোগীর মনে হতে থাকে তাঁর কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি হয়েছে, কিন্তু যার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। এ সমস্যায় রোগীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের কোনো জটিল রোগে ভুগছেন বলে মনে করতে থাকেন, যেমন ক্যানসার, স্ট্রোক, স্নায়ুরোগ বা হার্টের রোগ। সচরাচর যেসব লক্ষণ দেখা যায়:
১.
২. এই রোগীরা বারবার চিকিৎসকের কাছে সমস্যা নিয়ে যান। বারবার চিকিৎসক পরিবর্তন করেন।
৩. শরীরে নতুন কোনো সমস্যা তৈরি হলো কি না, বারবার তা পর্যবেক্ষণ করেন। যেকোনো সমস্যা বা শারীরিক পরিবর্তনকে তাঁর মনে সৃষ্ট রোগের সঙ্গে মেলাতে থাকেন। যেমন একটু কাশি হলেই মনে করেন, ফুসফুসে ক্যানসার হয়েছে। বুকে সামান্য ব্যথা করলেই মনে হয় হার্টঅ্যাটাক করেছে বা চোখের পাপড়ি, মাংসপেশি একটু কাঁপলেই ভাবেন স্ট্রোক করেছে।
৪. চিকিৎসকেরা আশ্বস্ত করলেও মাথা থেকে দুশ্চিন্তা সরাতে পারেন না বা কিছুদিন আশ্বস্ত হলেও কয়েক দিন পর আবার ফিরে আসে দুশ্চিন্তা।
৫. চিকিৎসকদের কাছে গিয়ে নানা রকমের পরীক্ষা করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন, যেমন সিটিস্ক্যান, এমআরআই, কোলনোস্কপি, এন্ডোস্কোপি। একটা করার পর আরেকটা করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। অনেক সময় চিকিৎসক কথা না শুনলে আরেক চিকিৎসকের কাছে একই অনুরোধ করতে থাকেন।
৬. অনেকেই ওই রোগ বা সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেন ও পড়াশোনা করেন। গুগলে সার্চ করেন। একে-ওকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেন ও তথ্য নিতে চেষ্টা করেন।
৭. চিকিৎসা নেওয়ার চেয়ে রোগনির্ণয়ের ব্যাপারে তাঁরা বেশি আগ্রহী থাকেন। চিকিৎসকেরা তাঁর দুশ্চিন্তা দূর করার উপায় বাতলে দিলেও রোগী তা গ্রহণ করতে আগ্রহী হন না। এই ব্যক্তিরা সব সময় মনে করেন, কোনো না কোনো একটি পরীক্ষা করা বাকি আছে, যা তাঁর রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম হবে। আসল রোগটি এখনো ধরা পড়েনি, তাই ওষুধ খেয়ে লাভ নেই।
গুগলের কারণে আমাদের অনেক কাজ সহজ হয়ে গেছেউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক র ক ছ সমস য আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
গবাদিপশু থেকে মানুষের শরীরে ‘তড়কা’ রোগ, প্রতিরোধে যা করবেন
অ্যানথ্রাক্স রোগটি‘তড়কা’ নামেই বহুল পরিচিত। গ্রীক শব্দ ‘অ্যানথ্রাকিস’ বা কয়লা থেকে উদ্ভূত এই নামটি হয়তো অনেকেই জানেন না। তবে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ ঠিকই অবগত।
অ্যানথ্রাক্স নামের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগটি শুধু বন্য বা গৃহপালিত পশুকে নয়, বরং মানুষের জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে বারবার।
আরো পড়ুন:
১৬ দিন ধরে অচলাবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ বাকৃবি ছাত্রশিবিরের
দ্রুত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালুর দাবি বাকৃবি শিক্ষার্থীদের
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, দেশের অ্যানথ্রাক্স পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক। সাধারণত গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়াকে আক্রান্ত করে এই ব্যাকটেরিয়া। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই রোগে মারা গেছে অন্তত ১ হাজার গবাদিপশু। আর আক্রান্ত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
সম্প্রতি রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্তের রিপোর্ট করেছেন অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ। এরইমধ্যে এ রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন দুইজন, যা নিশ্চিত করেছেন রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০টিরও বেশি মানব অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার সবগুলোই ছিল ত্বকের অ্যানথ্রাক্স। তবে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৬ হাজার ৩৫৪টি পশুর অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯৯৮টি পশুর মৃত্যু হয়েছে। সে হিসাবে মোট মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ১৫.৭ শতাংশে।
গবেষণার তথ্য মতে, বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ১৯৮০ সালে। এরপর থেকে এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বারবার ফিরে এসেছে। বিশেষ করে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও মেহেরপুর জেলাকে ‘অ্যানথ্রাক্স বেল্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে এ রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা ময়মনসিংহ, পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলাকে যথাক্রমে উচ্চ, মাঝারি ও নিম্ন-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে, বিশেষত এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।
অ্যানথ্রাক্সের মূল কারণ হলো- ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামের একটি ব্যাকটেরিয়া, যা সাধারণত মৃত পশুর দেহে পাওয়া যায়। এটি এতই শক্তিশালী যে, জৈবিক অস্ত্র হিসেবেও এর ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে। এই ব্যাকটেরিয়া বাতাসে উড়ন্ত স্পোর তৈরি করতে পারে, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
অ্যানথ্রাক্স নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের স্নাতক রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট অর্ণব সাহা।
তিনি বলেন, “মানুষ তিনভাবে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে— ত্বকের মাধ্যমে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এবং খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে। এর মধ্যে ত্বকের অ্যানথ্রাক্স সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এবং এর সুপ্তিকাল সাধারণত দুই থেকে ছয়দিন।”
অন্যদিকে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংক্রমিত অ্যানথ্রাক্সের সুপ্তিকাল গড়ে চারদিন, যা ১০-১১ দিন পর্যন্তও হতে পারে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট আক্রান্তের ৯১.৩ শতাংশ মানুষই ত্বকের অ্যানথ্রাক্সে ভুগেছে, যেখানে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল এবং উভয় ধরনের সংক্রমণ ছিল যথাক্রমে ৬.৫২ শতাংশ ও ২.৬৬ শতাংশ।
ত্বকীয় অ্যানথ্রাক্সের ক্ষেত্রে চামড়ায় প্রথমে একটি চুলকানিযুক্ত লাল ফোঁড়া দেখা যায়, যা পরবর্তীতে কালো কেন্দ্রযুক্ত ব্যথাহীন ঘা হিসেবে প্রকাশ পায়। উলের কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যাওয়ায় এটি ‘উল-সর্টার্স ডিজিজ’ নামেও পরিচিত।
সবচেয়ে মারাত্মক ধরণ হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের অ্যানথ্রাক্স। ব্যাকটেরিয়ার স্পোর শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে ঠান্ডা, জ্বর ও কাশির মতো উপসর্গ দেখা যায়, যা দ্রুত শ্বাসকষ্ট, শক এবং উচ্চ মৃত্যুহারের দিকে নিয়ে যায়।
অর্ণব বলেন, “প্রাণীদের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স হলে হঠাৎ মৃত্যু সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ। মৃত পশুর নাক, মুখ ও মলদ্বার থেকে কালচে, জমাট না বাঁধা রক্ত বের হয় এবং পেট ফুলে যায়।”
রোগটির প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিষয়ে বাকৃবি মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম কারণ হলো জনসচেতনতার অভাব। অসুস্থ পশু জবাই করে তার মাংস কম দামে বিক্রি করার একটি প্রবণতা আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান। অনেক বিক্রেতা ও সাধারণ মানুষ জানেনই না যে, এই মাংস থেকে মানুষের শরীরেও রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
“পাশাপাশি, মৃত পশুর দেহ সঠিক উপায়ে অপসারণ না করে খোলা মাঠে, নদী, খাল বা বন্যার পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। এর ফলে এই জীবাণু পরিবেশ ও পশুপালনের জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, যা নতুন করে সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করে,” যুক্ত করেন ড. গোলজার।
তিনি বলেন, “অ্যানথ্রাক্সের বিস্তার রোধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ এই রোগের বিস্তার রোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম- জনসচেতনতা বৃদ্ধি। পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধে জনশিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো গবাদি পশুর মধ্যে নিয়মিত এবং ব্যাপক হারে টিকাদান নিশ্চিত করা। সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত টিকাদান কর্মসূচিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে। আমদানি করা ও জবাই করা পশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টাইন করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।”
ড. গোলজার বলেন, “এছাড়া মৃত পশুর দেহ ও দূষিত পদার্থ সঠিকভাবে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে এবং অনুমোদিত মাংস বিক্রেতাদের মাধ্যমে এবং পশু চিকিৎসকের পরীক্ষা করা মাংস বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।”
ঢাকা/মেহেদী