বন্দর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার স্বৈরতন্ত্রের ভাষায় কথা বলছে
Published: 13th, June 2025 GMT
লেখক ও গবেষক আনু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। বর্তমানে ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ও যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ মঞ্চে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক (১৯৮৪-৯৩) এবং তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব (২০০৫-২০) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের সহসম্পাদক ইফতেখারুল ইসলাম।
সমকাল: সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড, সিঙ্গাপুরের পিসিএ ও ডেনমার্কের মার্স কোম্পানিকে দেওয়ার কথা উঠেছে।
আনু মুহাম্মদ: পুরো বিষয়টি বর্তমান সরকারের যে ম্যান্ডেট বা দায়িত্ব রয়েছে, তার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। মানে এই সরকারের যে তিনটি প্রধান ম্যান্ডেট– যা প্রধান উপদেষ্টা কয়েকদিন আগে তাঁর ভাষণেও বলেছেন, সেগুলোর মধ্যে এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি আসে না। অথচ আসল তিনটি কাজেই নানা রকম অবহেলা আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিংবা যেটি হওয়া উচিত ছিল, সেটি হয়নি।
সমকাল: ম্যান্ডেট তিনটি কী?
আনু মুহাম্মদ: বিচার করা, প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো সম্পন্ন করা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা। চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যাপারে যে কথাটি উঠেছে, এটি শুরু হয়েছিল শেখ হাসিনার আমলে। বর্তমান সরকার এসে সেটিই বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। প্রধান উপদেষ্টার ভাষা থেকে মনে হয়, এই কোম্পানি বিশ্বের সেরা– এ ব্যাপারে তিনি সুনিশ্চিত। এটি কোনো গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নয় যে, যিনি রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্বে থাকবেন তিনি যেটি সেরা মনে করবেন, সেটিই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। এটি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া হলো না। গত সরকারের সময়ও এই সমস্যা ছিল। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেটি ভালো মনে করবেন সেটিই ভালো; কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার দরকার পড়ে না– এটিই তখন বলা হতো।
সমকাল: বন্দরবিষয়ক বিতর্কে প্রধান সমস্যা কী?
আনু মুহাম্মদ: চট্টগ্রাম বন্দরে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থানের প্রধান সমস্যাটি হলো, বর্তমানে যে এটি লাভজনকভাবে কাজ করছে, সেটি আড়াল করে পাইকারি বদনাম করা। এবং তার মাধ্যমে টেন্ডার ছাড়াই বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর একটি বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার আয়োজন করা। প্রধান উপদেষ্টা মনে করছেন, তিনি বা তারা যেটিকে ভালো মনে করছেন, সেটিই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভালো। এভাবে মনে করলে হবে না। সুনির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া আছে, টেন্ডারের ব্যাপার আছে, বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতির গতি যার সঙ্গে সম্পর্কিত সে রকম চুক্তি বিষয়ে দেশের রাজনৈতিক দল ও জনগণের জানার অধিকার আছে। এগুলোর মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। সেই পথে না গিয়ে জোরজবরদস্তির পথে যাওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
সমকাল: কেন জোরজবরদস্তি বলছেন?
আনু মুহাম্মদ: যেমন প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যারা যাবেন, তাদের প্রতিহত করতে হবে। এগুলো জোরজবরদস্তির ভাষা। স্বৈরতন্ত্রের ভাষা। বন্দর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার স্বৈরতন্ত্রের ভাষায় কথা বলছে। যারা বিরোধিতা করছেন, সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে। সেখানে যুক্তি তুলে ধরতে পারে, কেন টেন্ডার ছাড়া করতে হচ্ছে। সরকার কীভাবে বুঝল কোম্পানিটি সেরা এবং কেন বিদেশি কোম্পানিকে দিতেই হবে, জাতীয় সক্ষমতা কেন বাড়ানো যাবে না এবং আমাদের তরুণদের এ বিষয়ে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিদেশি কোম্পানির হাতেই ইজারা কেন দিতে হবে– এসব বিষয়ে জবাবদিহি করা সরকারের দায়িত্ব।
সমকাল: বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দিলে সমস্যা কোথায়?
আনু মুহাম্মদ: যে কোম্পানিকে ইজারা দেওয়ার কথা উঠেছে কিংবা আরও যারা আগ্রহ দেখাচ্ছে– এগুলোও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দক্ষতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেন দক্ষতা অর্জন করা যাবে না? সমুদ্রবন্দর একটি দেশের জন্য কৌশলগত প্রতিষ্ঠান, সেখানে জাতীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটি আমরা বহু দেশের উদাহরণ থেকে বুঝতে পারি।
ক’বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র এই ডিপি ওয়ার্ল্ডকে সেখানকার বন্দরে অনুমতি দেয়নি। কারণ দেশটির কংগ্রেসের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য তাতে আপত্তি জানিয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলে। চীনা কোম্পানি সব নিয়মকানুন মেনে বন্দর নিতে অগ্রসর হলেও মার্কিন সরকার জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তি তুলে তা হতে দেয়নি। কেননা তাদের মনে হয়েছে, এতে সার্বভৌমত্বের ক্ষতি হবে। এই উদাহরণগুলো আমাদের সামনেই স্পষ্ট। এরপরও সেগুলো সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে, জনগণকে ধমক দিয়ে, সেই কোম্পানির হাতে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর তুলে দেওয়া কেন গ্রহণযোগ্য হবে?
সমকাল: বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার পেছনে বিদেশি কোম্পানির অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও দক্ষতা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের যুক্তি বাংলাদেশের জন্য কতটা ইতিবাচক?
আনু মুহাম্মদ: মালিকানা একটি বিষয়, দক্ষতা বৃদ্ধি আরেকটি ভিন্ন ব্যাপার। একটি বিদেশি কোম্পানিকে মালিকানা দিলেই যে দক্ষতা বাড়বে, সেটি বলা যায় না। এসব যুক্তি অন্যান্য ক্ষেত্রে আগের বিভিন্ন সরকারের আমলেও অনেক শুনেছি। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে এসব যুক্তি দিয়েই দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয় টেনে আনা হয়েছে। বিদেশি কোম্পানির হাতে বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে, জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। প্রযুক্তি বা কর্মসংস্থানেও কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। যেমন সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্পে গত সরকার এ রকম অনেক কথা বলেছিল। আমরা দেখেছি বাজে প্রযুক্তি তো বটেই, এমনকি কর্মসংস্থানে ব্যবস্থাপক, প্রকৌশলী থেকে শ্রমিক পর্যন্ত ভারত থেকে আনা হয়েছে, পায়রায় দেখেছি চীন থেকেও এ রকম শ্রমিক আনা হয়েছে। রূপপুরে দেখছি সব পর্যায়ে রুশ কর্মকর্তা-কর্মচারী। আবার তাদের দায়মুক্তিও দেওয়া হচ্ছে। তার মানে ক্ষতি হলে তারা দায় নেবে না, পুরো বোঝা জনগণের ওপরই পড়বে। সুতরাং বিদেশি কোম্পানি এলেই জাতীয় দক্ষতা বাড়বে এ রকম প্রমাণ পাওয়া যায় না। আধুনিক প্রযুক্তির যুক্ততা বাড়বে তারও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
সমকাল: এর কারণ কী মনে করেন?
আনু মুহাম্মদ: কারণ হচ্ছে, বিদেশি কোম্পানি যখন দেশে কাজ করতে আসে, তখন তারা খরচ কমানোর চেষ্টা করে, মুনাফা বাড়ানোর চেষ্টাই প্রধান থাকে। আর যখন যে দেশে সরকারের ভূমিকা তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে, তখন তারা এসব ক্ষেত্রে কোনো মনোযোগই দেয় না। অন্যদিকে সারাবিশ্বের উদাহরণ বলে– যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া কিংবা লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ– যে দেশগুলো জাতীয় কর্তৃত্বে এসব প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বিকাশের পথে গেছে তারাই দেশের মধ্যেও দক্ষতা বাড়াতে পেরেছে। যারা এভাবে বিদেশি কোম্পানির হাতে ইজারা দেওয়ার পথ ধরেছে, সেটি আফ্রিকার দেশগুলো বেশি প্রত্যক্ষ করেছে, সেখানে এ জাতীয় সক্ষমতা বাড়েনি। চট্টগ্রাম বন্দরে যদি সক্ষমতা বাড়াতে হয়, তাহলে ড.
সমকাল: আপনি কী ধরনের প্রস্তাব করছেন?
আনু মুহাম্মদ: দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তরুণদের প্রশিক্ষণ দিতে বিদেশে পাঠানো যায়, বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আনা যায় এবং তরুণদের ওপরই দায়িত্ব দেওয়া যায়। যদি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তরুণরা কাজ করে তখনই তাদের দক্ষতা বাড়বে, সক্ষমতা বাড়বে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়বে। আত্মবিশ্বাস তৈরির জন্যই জাতীয় প্রতিষ্ঠানের বিকাশ দরকার, কিন্তু বর্তমান সরকার তার উল্টো পথে চলছে বলেই আমি দেখতে পাচ্ছি।
সমকাল: একটি পক্ষ বলছে, বিদেশি কোম্পানি দায়িত্ব পেলে দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আপনার কী মত?
আনু মুহাম্মদ: সার্বভৌমত্ব বিস্তৃত একটি ব্যাপার। এটি কার হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। দেশীয় মানুষের হাতেও সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, দেশি পক্ষ না থাকলে বিদেশি কারও পক্ষে এই ভূমিকা নেওয়া সম্ভব না। মূল প্রশ্নটা হলো নীতিগত। বিদ্যুৎ, বন্দর কিংবা অন্যান্য ব্যাপারে কৌশলগত জায়গাগুলো জাতীয় প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় মালিকানায় থাকাটা জাতীয় বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এভাবেই বিশ্বের বহু দেশে বিকাশ ঘটেছে।
সমকাল: যদি একটি উদাহরণ দিতেন?
আনু মুহাম্মদ: যেমন চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি কোম্পানির পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানানোর গল্প বলা হয়। নির্বোধ বা প্রতারকদের পক্ষেই এ রকম তুলনা টানা সম্ভব। দুটি ক্ষেত্রে কোনো তুলনাই হয় না। সিঙ্গাপুর একটি ছোট দ্বীপরাষ্ট্র, উৎপাদন খুবই কম, বাণিজ্যনির্ভর। তাদের যেসব সমুদ্রবন্দর রয়েছে, সেগুলো গভীর সমুদ্রবন্দর। চট্টগ্রাম বন্দর অগভীর। তারপরেও আজকের সিঙ্গাপুর যে পর্যায়ে গেছে, তার পেছনে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ। সিঙ্গাপুরের বন্দর বিদেশি কোম্পানির হাতে পরিচালিত হয় না। তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানই সেসব বন্দর পরিচালনা করে। তা ছাড়া সিঙ্গাপুর এত ছোট রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও এই দায়িত্ব নেওয়ার কারণে সেটি আজ এ রকম একটি শক্তিশালী অর্থনীতিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর বাংলাদেশ এর তুলনায় কত বড় দেশ, কত মানুষ, কত সম্ভাবনা। সেখানে সব সরকার এসে বলতে থাকে– আমরা পারব না, বিদেশি কোম্পানি লাগবে!
সমকাল: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটি কীভাবে সম্ভব বলে মনে করেন?
আনু মুহাম্মদ: সিঙ্গাপুরের উদাহরণ মানলে অবশ্যই বাংলাদেশে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে এসব ক্ষেত্রে বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। সেটি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ জাতীয় প্রতিষ্ঠান বিকাশের মাধ্যমে আমাদের এসব খাতে সক্ষমতা ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তাহলেই এ ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে এগোনো সম্ভব। এটি নিশ্চিত করা গেলে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমের জায়গাটি সুরক্ষিত থাকে। বন্দর যদি অরক্ষিত থাকে কিংবা জাতীয় কর্তৃত্ব বা সক্ষমতা যদি না দাঁড়ায়, তাহলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কীভাবে রক্ষিত হবে?
সমকাল: আমরা জানি, বন্দরে নানা অব্যবস্থাপনা রয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বড় সমস্যা হলো দুর্নীতি। বিদেশিদের দায়িত্ব দিলে কি অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি নিরসন হবে মনে করেন?
আনু মুহাম্মদ: বিদেশিদের দায়িত্ব দিলে যদি অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি নিরসন হতো তাহলে আফ্রিকা মহাদেশ তার বিশাল সম্পদ নিয়ে সবচেয়ে উন্নত থাকত। উল্টো হয়েছে। আসলে একটি দেশে সরকার যদি জাতীয় সক্ষমতার প্রতি অমনোযোগী হয়, তাহলে সেখানে কোনো ক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানি দিয়েও সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব নয়। একটি দেশে জাতীয় প্রতিষ্ঠান, জাতীয় কর্তৃত্বের প্রতি সরকার নিজেই যদি অবহেলা করে তাহলে সরকারের দায়িত্ব কী? সরকার যদি বলে, দেশের প্রতিষ্ঠান দিয়ে কাজ হবে না, তাহলে সেখানে বিদেশি কোম্পানি দিয়েও কাজ হবে না। কারণ আপনি বিদেশি কোম্পানি দিয়ে কাজ করাতে গেলেও দক্ষ তদারকি লাগবে, ভালো সক্ষমতা লাগবে। আপনার যদি সেটিও না থাকে, তাহলে আপনি বিদেশি কোম্পানি দিয়ে কী করবেন? বিদেশি কোম্পানিগুলো যা খুশি তা করবে, তাহলে এগুলো কে তত্ত্বাবধান করবে? আপনার তো সক্ষমতা বা সেই দায়িত্ববোধই নেই।
সুতরাং যেসব দেশে জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ ঘটে, তারা প্রয়োজনে মাঝে মাঝে কোনো কোনো কাজে বিদেশি কোম্পানি নিয়োগ করতে পারে, সুফলও পেতে পারে। যেসব দেশে নিজেদের আত্মবিশ্বাসই তৈরি হয় না, জাতীয় প্রতিষ্ঠান বিকাশে কোনো নীতিমালাই থাকে না, সেখানে সরকার সব সময় বিদেশি কোম্পানি আর লবিস্টদের ওপর নির্ভরশীল থাকে কিংবা কমিশনভোগীরা রাজত্ব করে, সেখানে বিদেশি কোম্পানির দক্ষতা কিংবা প্রয়োজনীয় বিনিয়োগও ঠিকঠাকমতো কাজ করবে না। সেখানে সংকট তৈরি হবেই।
সমকাল: অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো চট্টগ্রাম বন্দরেও সংস্কার জরুরি নয় কি? সেটি কীভাবে সম্ভব?
আনু মুহাম্মদ: আমরা ১৯৯৭ সাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার কথা শুনছি। তখন ছিল আওয়ামী লীগ আমল। বিশ্বব্যাংক, মার্কিন দূতাবাস, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ সবাই একসুরে বলতে থাকল যে এটি মার্কিন কোম্পানিকে দিতেই হবে। পরে সরকার পরিবর্তন হয়ে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলো। তাদের সময়ও এই ধারা চলতেই থাকল। তখন আমরা জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে লংমার্চ করলাম, আন্দোলন চালিয়ে গেলাম, বিষয়টি আদালতে গেল এবং তার অনুসন্ধান হলো।
সমকাল: অনুসন্ধানে কী পাওয়া গেল?
আনু মুহাম্মদ: সেখানে দেখা গেল, পুরো কোম্পানি ও প্রকল্পটি হলো একটি জালিয়াতি। আদালতের ওই মামলা পরিচালনা করেছিলেন ড. কামাল হোসেন। রায়ে দেখা গেল, যে মার্কিন কোম্পানির কথা বলা হয়েছে তার ব্যাপারে অনেক ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে, প্রতারণা করা হয়েছে। চিন্তা করেন, এই জালিয়াতি প্রকল্পের পক্ষেই আমলা, মন্ত্রী, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, মার্কিন দূতাবাস সবাই সামষ্টিকভাবে জোট বেঁধেছিল। দুইশ বছরের জন্য ওই কোম্পানিকে চট্টগ্রাম বন্দর ইজারা দেওয়ার জন্য জোর চেষ্টা হয়। আদালতের রায় ও জনপ্রতিরোধের কারণে তা বাতিল হয়, কিন্তু সেই চেষ্টা থামেনি। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও অব্যাহত ছিল, দেশের প্রাইভেট কোম্পানিকে দিয়েও বিভিন্নভাবে কার্যকর করা হয়েছে। মূল দৃষ্টিভঙ্গি হলো, আরও ব্যাপক হারে প্রাইভেটাইজেশন বাড়ানো, ব্যক্তিমালিকানা বিস্তৃত করা, বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া। এই দৃষ্টিভঙ্গিই অব্যাহত আছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সময়েও এই ধারা ছিল। এখন অন্তর্বর্তী সরকার যেখানে জনবিরোধী ব্যবস্থা থেকে মানুষকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটাবে, সেই সরকারের আমলেও আগের সেই ধারাই অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এর বদল হতে হবে। উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রয়োজনীয় মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দরের ব্যবস্থাপনার উন্নতি এবং সক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
সমকাল: প্রয়োজনীয় মৌলিক পরিবর্তন বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
আনু মুহাম্মদ: প্রয়োজনীয় মৌলিক পরিবর্তন করতে গেলে প্রশ্ন করতে হবে– বাংলাদেশে এত বিশ্ববিদ্যালয় আছে, এত উদ্যমী তরুণ, এত সম্ভাবনা, সেখানে একটি অগভীর বন্দর চালানোর জন্য বিশ্বমানের জাতীয় সক্ষমতা কেন গড়ে উঠবে না? কেন সমুদ্রের তেল, গ্যাস বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠান অনুসন্ধান ও উত্তোলন করতে পারবে না? এই কাজগুলো বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশের তরুণরা, গবেষকরা যদি করতে না পারেন তাহলে এত বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান থাকার কী প্রয়োজন? আসলে এর সবই সম্ভব। শতভাগ মালিকানায় আমাদের কৌশলগত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগাতে হবে, শিক্ষা গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে অবশ্যই চট্টগ্রাম বন্দরকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব, অব্যবস্থাপনা দূর করা সম্ভব এবং সক্ষমতা বাড়ানোও সম্ভব।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আনু মুহাম্মদ: সমকালকেও ধন্যবাদ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ ত য় কর ত ত ব ব ড় ন র জন য দ শ র জন য প রক র য় ম হ ম মদ ন সরক র সরক র র পর চ ল আম দ র ক জ কর করছ ন সমস য এ রকম ক ষমত করব ন সমক ল ন করত
এছাড়াও পড়ুন:
‘পয়েন্ট অফ অর্ডার’ নিয়ে ফিরছেন কাজী জেসিন
শুরু হতে যাচ্ছে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বন্ধ হওয়া রাজনৈতিক টকশো ‘পয়েন্ট অফ অর্ডার’। এই শোয়ের মাধ্যমে আবারও উপস্থাপনায় ফিরছেন কাজী জেসিন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাংবাদিকতার ইতিহাসে অন্যতম সাহসী কণ্ঠস্বর কাজী জেসিন এক দশক আগে স্বৈরাচারী শাসনের চাপে বন্ধ হওয়া তার জনপ্রিয় রাজনৈতিক টকশো ‘পয়েন্ট অফ অর্ডার’ নিয়ে আবারও ফিরছেন বাংলাভিশন-এ। অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হবে প্রতি শনিবার থেকে মঙ্গলবার, রাত সাড়ে ১১ টায়।
যখন দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছিল, তখন কাজী জেসিন প্রথম টেলিভিশনের পর্দায় দাঁড়িয়ে ক্ষমতার মুখোমুখি প্রশ্ন তোলার সাহস দেখান। তার সঞ্চালিত ‘পয়েন্ট অফ অর্ডার’ ছিল বাংলাদেশে প্রথম রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, যা শেখ হাসিনার দমনমূলক শাসনের সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এই অনুষ্ঠান বন্ধের পেছনে ছিল রাষ্ট্রীয় হুমকি, সেন্সরশিপ এবং রাজনৈতিক চাপ— সেন্সরশিপ মেনে না নেয়ায় হুমকির মুখে পড়েন কাজী জেসিন।
প্রায় পনেরো বছর পর আবারও এই অনুষ্ঠান শুরু প্রসঙ্গে কাজী জেসিন বলেন, “এই শো’টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার নিপীড়নের গল্প, অনেক কিছু হারিয়েছি আমি- শুধু মাত্র সাংবাদিক হিসেবে নীতিপ্রশ্নে কম্প্রোমাইজ না করায়, সততার প্রশ্নে অটুট থাকায় আমি হারিয়েছি কর্মময় জীবনের একটা যুগ, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছি কর্মহীনভাবে, আতংকে।”
তিনি আরও বলেন, “পয়েন্ট অফ অর্ডার’ শুধু কোনো রাজনৈতিক শো না- এটা অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি, নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছিল প্রতিবাদের স্মারক, জনগণের কণ্ঠস্বর। ঠিক সেই প্রত্যয় থেকেই এই কাজ করে যেতে চাই।”