যুবকদের স্থানীয় মসজিদে নিয়মিত ধরে রাখা চ্যালেঞ্জিং। কিশোর বা তরুণ সন্তানদের নামাজে যেতে মাতাপিতাকে অনেক সময় বাধ্য করতে হয়। কলেজজীবন শুরু হলে অনেক তরুণ মসজিদে যাওয়া একেবারে বন্ধ করে দেন। তবে কিছু অনুপ্রেরণাদায়ী উদাহরণও আছে, যেখানে যুবকেরা শৈশব থেকেই মসজিদে সক্রিয় থাকেন।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, পিতামাতা বা সমাজের নামাজিরা কী করতে পারেন, যাতে তাঁদের সন্তানেরা মসজিদের সঙ্গে নিয়মিত যুক্ত থাকে? এখানে পাঁচটি ব্যবহারিক উপায় উপস্থাপন করা হলো।
মাতাপিতা ও নামাজিদের উচিত মসজিদকে যুবকদের জন্য আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা। যেন মসজিদ তাদের ভালোলাগার স্থান হয়।১.মসজিদকে আকর্ষণীয় স্থান বানান
যুবকদের প্রতি সহানুভূতি ও তাঁদের দৃষ্টিকোণ বোঝার জন্য মাতাপিতা, শিক্ষক বা যুব পরামর্শদাতাদের উচিত নিজেদের শৈশবের অভিজ্ঞতা স্মরণ করা। যদি আপনি চান যুবকেরা ভালো সাহিত্য পড়ুক, তাহলে ভাবুন, আপনার শৈশবে কী আপনাকে তা পড়তে উৎসাহিত করেছিল? কোনো বই বা পত্রিকা আপনার পছন্দ ছিল?
একইভাবে ভাবুন, শিশুকালে আপনি মসজিদে গিয়ে কী উপভোগ করতেন? যদি আপনি মসজিদে না যেতেন, তাহলে কোন জায়গায় মাতাপিতার সঙ্গে যেতে আপনার ভালো লাগত?
মাতাপিতা ও নামাজিদের উচিত মসজিদকে যুবকদের জন্য আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা। যেন মসজিদ তাদের ভালোলাগার স্থান হয়।
কাউকে মসজিদে যেতে অভ্যস্ত করার জন্য শৈশবই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। শিশুকে নিয়মিত মসজিদে নিয়ে যাওয়া সহজ।২. শৈশব থেকে শুরু করুনকাউকে মসজিদে যেতে অভ্যস্ত করার জন্য শৈশবই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। শিশুকে নিয়মিত মসজিদে নিয়ে যাওয়া সহজ। তবে পাশাপাশি তাদের মসজিদের শিষ্টাচার শেখানোও জরুরি।
ছোট বয়সে প্রশিক্ষণ দেওয়া সহজ। মসজিদে শিশুদের জন্য বিশেষ সুবিধা চালু করা উচিত। যেমন, শিশুদের জন্য পৃথক ওয়াশরুম ও অজুর জায়গা, মসজিদ প্রাঙ্গণে ক্যাফেটেরিয়া রাখা, ছোট শিশুদের জন্য খেলার জায়গা বানানো।
এইসব সুবিধা চালু করতে আর্থিক বিনিয়োগ এবং সমাজের প্রবীণদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। তবে এটা করা গেলে শিশুরা শৈশব থেকেই মসজিদে যেতে আনন্দ পাবে।
ওমরাহ থেকে ফিরে অনেক যুবক বদলে যান এবং ভালো মুসলিম হিসেবে ফিরে আসেন। তাঁদের ইমান ও নেক আমলের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।আরও পড়ুনসন্তানের সুশিক্ষায় ইসলাম যা বলে১৯ মার্চ ২০২৪৩. যুবকদেরমসজিদের কাজে যুক্ত করুনমসজিদে যুবকদের জন্য কিছু অ্যাকটিভিটি রাখা জরুরি। এতে তাঁরা সমাজের দায়িত্ববান ব্যক্তি হিসেবে নিজেদের উপলব্ধি করতে পারবেন। তাঁদের কিছু দাতব্য কাজের দায়িত্ব দেওয়া যায় বা ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বলা যায়।
কিংবা তাঁদের মাধ্যমে কোনো লিফলেট প্রকাশ করানো যায়। এই কাজগুলো যুবকদের মসজিদে সম্পৃক্ততা বাড়াবে এবং তাঁদের অবদানের মূল্যায়ন করবেন।
৪. বয়স্কদের আচরণে পরিবর্তন আনুনমসজিদে সক্রিয় প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমদের নিজেদের আচরণ, ব্যক্তিত্ব ও শিষ্টাচারের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে। যুবকেরা মসজিদে প্রাপ্তবয়স্কদের আচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং তাঁদের সঙ্গে মসজিদের বাইরে দেখা মুসলিমদের আচরণের তুলনা করেন।
যদি মসজিদের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ব্যবহার ভালো না হয়, তাহলে তাঁরা মসজিদে আসতে অনীহা প্রকাশ করতে পারেন। তাঁরা ভাববেন, ‘আমি এমন মানুষদের মতো হতে চাই না।’
মসজিদে যুবকদের জন্য কিছু অ্যাকটিভিটি রাখা জরুরি। এতে তাঁরা সমাজের দায়িত্ববান ব্যক্তি হিসেবে নিজেদের উপলব্ধি করতে পারবেন।আরও পড়ুনউমর (রা.)-এর নেতৃত্বের ৪ অনন্য গুণ০১ জুন ২০২৫৫. সন্তানদের নিয়ে ওমরাহ পালন করুনসন্তানদের হজ ও ওমরাহ পালন করা উচিত। মাতাপিতার উচিত সন্তানদের কলেজ শিক্ষার জন্য টাকা জমানোর মতো হজ ও ওমরাহর জন্য আর্থিক পরিকল্পনা করা।
হজ ও ওমরাহ থেকে ফিরে অনেক যুবক বদলে যান এবং ভালো মুসলিম হিসেবে ফিরে আসেন। তাঁদের ইমান ও নেক আমলের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। পবিত্র কাবা দেখা এবং মক্কা-মদিনার হারামাইন মসজিদে নামাজ পড়ার অভিজ্ঞতা যুবকদের ধর্মীয় উৎসাহ বাড়ায় এবং তাঁদের ওপর দীর্ঘস্থায়ী আধ্যাত্মিক প্রভাব ফেলবে, ইনশা আল্লাহ।
এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে যুবকেরা মসজিদকে কেবল নামাজের জায়গা নয়, বরং তাঁদের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনের কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করবেন, ইনশা আল্লাহ।
সূত্র: অ্যাবাউট ইসলাম ডটনেট
আরও পড়ুনসন্তান প্রতিপালনে ধর্মের দাবি১৯ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র আচরণ দ র জন য মসজ দ র ত মসজ দ য বক র ওমর হ
এছাড়াও পড়ুন:
টিনএজ সিনড্রোম: ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এক নীরব সংকট
এক সময় ছিল, যখন সন্তানের আবেগ, দুষ্টুমি বা হঠাৎ রাগ দেখে বাবা-মা মুচকি হেসে বলতেন—“বয়স হয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে।” কিন্তু আজ, সেই দুষ্টুমি পরিণত হয়েছে এমন আচরণে, যা অনেক সময় বাবা-মা পর্যন্ত চেনেন না। সন্তান চোখে চোখ রাখে না, ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়, কথা বললে রাগে ফেটে পড়ে। এই চিত্র এখন বিশ্বব্যাপী। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন—আমরা এক ‘Adolescent Syndrome’ বা ‘Teenage Behavioral Crisis’-এর মুখোমুখি, যা বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে।
আচরণগত বিপর্যয়ের পেছনে বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিনএজ সিনড্রোমের প্রধান কারণ তিনটি:
হরমোনের দোলাচল: ইস্ট্রোজেন ও টেস্টোস্টেরনের ওঠানামা টিনএজারদের আচরণে গভীর প্রভাব ফেলে। মেয়েদের ক্ষেত্রে এই হরমোনাল পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী ও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে, যা আচরণে অতিরিক্ত আবেগ ও বিদ্রোহের জন্ম দেয়।
মস্তিষ্কের অসম্পূর্ণ বিকাশ: ১৩-১৯ বছর বয়সে মস্তিষ্কের যুক্তিবোধ ও নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত অংশ (prefrontal cortex) এখনও গঠনের পর্যায়ে থাকে। ফলে তারা আবেগে সিদ্ধান্ত নেয়, ঝুঁকি নেয়, এবং কখন কী বলতে হবে—তা বোঝে না।
প্রযুক্তির নীরব আগ্রাসন: TikTok, Instagram, Snapchat—এসব প্ল্যাটফর্মে মেয়েরা দিনে গড়ে ৬–৮ ঘণ্টা সময় কাটায়। সোশ্যাল মিডিয়ার ভুয়া সৌন্দর্য ধারণা, জনপ্রিয়তার চাপ, ফিল্টার সংস্কৃতি তাদের আত্মপরিচয়কে বিকৃত করে তুলছে।
কেন বেশি দেখা যায় মেয়েদের মধ্যে?
Emotional Sensitivity: মেয়েরা আত্মপরিচয় ও আত্মমূল্যায়নে বেশি স্পর্শকাতর।
Beauty Pressure: সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের শরীর, ত্বক, স্টাইল—সবকিছু নিয়েই এক অনিয়ন্ত্রিত চাপ কাজ করে।
Hormonal Impact: মাসিক চক্র ও হরমোন ওঠানামা তাদের মুড, আবেগ ও আচরণে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
বাবা-মা কি আগের তুলনায় বেশি সমস্যায়?
হ্যাঁ, এবং এর পেছনে রয়েছে পরিবারে সংলাপের ঘাটতি। অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সারদের আধিপত্য। পিতামাতার নিজের মানসিক চাপ। বিকৃত প্রতিযোগিতামূলক সমাজব্যবস্থা। আজ অনেক অভিভাবক জানেন না—কীভাবে সন্তানের কাছে পৌঁছাতে হয়। তারা নিজেরাই কর্মব্যস্ত, ক্লান্ত, মানসিকভাবে নিঃশেষ।
বিশ্বের অবস্থা কী বলছে?
জাপানে টিনএজ আত্মহত্যার হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সুইডেনে, গত ১০ বছরে কিশোরীদের বিষণ্ণতা বেড়েছে ৪৭%। যুক্তরাষ্ট্রে, CDC বলছে—“Teenage girls are experiencing record levels of sadness, violence, and suicidal thoughts.” বাংলাদেশে, শহরাঞ্চলে স্কুলগামী কিশোরীদের মধ্যে বিষণ্ণতা বেড়েছে প্রায় ৫০% (মনোরোগ ইনস্টিটিউট, ২০২৩)।
তাহলে বাবা-মা কী করবেন?
শুনুন, শাসন নয় – সন্তানকে সময় দিন, তার কথার পেছনে আবেগ বুঝুন।
প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ করুন – নিজেরাও মডেল হোন প্রযুক্তি ব্যবহারে।
কাউন্সেলিংয়ে ভীতি নয় – প্রয়োজনে পেশাদার সহায়তা নিন।
নিজের মানসিক স্বাস্থ্যও রক্ষা করুন – সন্তানকে বোঝাতে গেলে নিজের ভেতরে শান্তি থাকা জরুরি।
একটি প্রজন্ম যেন না হারিয়ে যায়। এই সংকট নিছক পারিবারিক নয়—এটি এক সামাজিক দায়। টিনএজারদের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণা বোঝা না গেলে, আমরা এক ‘চুপ করে থাকা বিষণ্ণ প্রজন্ম’ হারিয়ে ফেলব। সন্তান যখন বিদ্রোহ করে, সে আসলে জানিয়ে দেয়— ‘আমি ভালোবাসা চাই, বোঝার মানুষ চাই।’ আমাদের দায়িত্ব তাদের ভাষা বুঝে নেওয়া।
তারা//