আলজাজিরার বিশ্লেষণ: ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের বৈশ্বিক প্রভাব
Published: 17th, June 2025 GMT
ইসরায়েল ও ইরান চতুর্থ দিনের মতো পাল্টাপাল্টি প্রাণঘাতী হামলায় জড়ানোর ফলে বিশ্বব্যাপী অন্যতম প্রধান তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী অঞ্চলে এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। শুক্রবার ইসরায়েলের আচমকা হামলার পর শেয়ারবাজারে প্রথমে ধস নামলেও এখন তা কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে।
শুক্রবার (১৩ জুন) ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা এবং কিছু পারমাণবিক স্থাপনায় ক্ষতির এক দিন পর শনিবার ইসরায়েল ইরানের জ্বালানিখাতে হামলা চালায়।
ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে বলা হয়, সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্রে আগুন ধরে গেছে। ইরানি কর্তৃপক্ষের বরাতে হতাহতের সংখ্যা প্রায় ৩০০, যাদের মধ্যে ১০০ জনের কাছাকাছি নারী ও শিশু রয়েছে।
আরো পড়ুন:
ইউক্রেনের রাজধানীতে রাশিয়ার ভয়াবহ হামলা
প্যারিস এয়ার শো-তে ইসরায়েলি অস্ত্র নির্মাতারা নিষিদ্ধ
ইরান পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়, যার একটি ছোট অংশ ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করে অন্তত ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটায়; অবশ্য সংখ্যাটি ক্রমেই বাড়ছে।
নিজের ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরানকে সতর্ক করে বলেন, “আগামী হামলাগুলো, যেগুলো ইতোমধ্যে পরিকল্পিত, আরো ভয়াবহ হবে।”
“ইরানের উচিত পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে চুক্তি করা, নইলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না,” যোগ করেন তিনি।
সর্বশেষ সোমবার ট্রাম্পের ‘তেহরান খালি করার আহ্বান’ উত্তেজনায় ঘি ঢেলেছে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত পরিস্থিতি বৈশ্বিক পর্যায়ে কোন মাত্রায় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি সামরিক শক্তির মধ্যে এই সংঘাত যখন পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে পরিণত হওয়ার দিকে যাচ্ছে, তখন এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আর্থিক বাজার ও বিমান চলাচল খাতে।
বিশ্লেষকরা তেলের দামের গতিপথ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তবে বিদ্যমান অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বিকল্প হিসেবে স্বর্ণের দিকে ঝুঁকছেন।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ পরিস্থিতি বৈশ্বিক অর্থনীতিকে আরো খারাপ, এমনকি অনেক বেশি খারাপ করে তুলতে পারে।
তেলের দামে কী পরিবর্তন এসেছে?
সোমবার সকালেই বৈশ্বিক মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ দশমিক ৬০ ডলারে। এই মূল্যবৃদ্ধি প্রায় ৭ শতাংশ।
বিশ্বের বিপুল পরিমাণ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্য মধ্যপ্রাচ্যের ব্যস্ত সমুদ্রপথ দিয়ে পরিবাহিত হয়, যার মধ্যে অন্যতম হলো হরমুজ প্রণালি।
এই প্রণালিটি একটি সরু জলপথ, যা ইরানকে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো থেকে আলাদা করে এবং আরব সাগরকে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করে। এটি বিশ্ব জ্বালানি বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত কৌশলগত ও গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ।
বিশ্বের সমুদ্রপথে পরিবাহিত মোট তেলের এক-তৃতীয়াংশই হরমুজ প্রণালির মধ্য দিয়ে যায়, যার পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল।
এই জলপথটির সবচেয়ে সরু অংশ মাত্র ৩৩ কিলোমিটার (২১ মাইল) প্রশস্ত। এর মধ্যে চলাচলের নির্দিষ্ট পথ আরো সরু, যা একে হামলার জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
ইসরায়েল-ইরান সংঘাত হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার প্রশ্নটিকে আবার সামনে এনেছে, যা ইরান অনেক বছর ধরেই রাজনৈতিকভাবে ইঙ্গিত দিয়ে আসছে। এই প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে তেলের দামে ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটতে পারে।
ইরানের রক্ষণশীল শীর্ষ আইনপ্রণেতা এসমাইল কোসারির বরাত দিয়ে ইরানি বার্তা সংস্থা আইআরআইএনএন জানিয়েছে, ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত তীব্র হওয়ায় তেহরান এখন হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়টি বিবেচনা করছে।
গোল্ডম্যান স্যাসের মতে, যদি প্রণালি অবরুদ্ধ হয়, তবে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারের ওপরে চলে যেতে পারে। তবে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধেও হরমুজ প্রণালি পুরোপুরি কখনো বন্ধ হয়নি, যদিও দুই পক্ষই উপসাগরে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে লক্ষ্য করেছিল।
হরমুজ প্রণালি বন্ধের যেকোনো প্রচেষ্টা ইরানের নিজস্ব তেল রপ্তানিও বাধাগ্রস্ত করবে, বিশেষ করে চীনের মতো বড় গ্রাহকদের কাছে; ফলে তাদের রাজস্ব ক্ষতির মুখে পড়বে।
টিএস ল্যামবার্ডের অর্থনৈতিক বিশ্লেষক হামজাহ আল গাওদ বলেন, “এই প্রণালি বন্ধের প্রভাব ইরানের ওপরই সবচেয়ে বেশি পড়বে।”
বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতিতে কী প্রভাব পড়েছে?
তেলের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপর পড়ে, বিশেষত যেসব পণ্য শক্তিনির্ভর, যেমন খাদ্য, পোশাক ও রাসায়নিক দ্রব্য।
যেসব দেশ তেল আমদানি করে, তারা যদি এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে আরো বেশি মুদ্রাস্ফীতি এবং ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মুখে পড়তে পারে।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, এতে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নীতিনির্ধারণের সুযোগ কমে যাবে; মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়ে পড়বে।
টিএস ল্যামবার্ডের আল গাওদ আলজাজিরাকে বলেন, “জি-৭ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বর্তমানে সুদের হার কমানোর পথে রয়েছে। এ অবস্থায় হঠাৎ করে জ্বালানির দামে বড় ধরনের ঝাঁকুনি তাদের জন্য উদ্বেগের কারণ।”
এদিকে, যুক্তরাজ্যের ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সম্প্রতি তাদের সুদের হার কমিয়ে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে এনেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ এখনো সুদহার কমায়নি, কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানুয়ারিতে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে প্রায় সব দেশের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছেন।
বাজারে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে?
ওয়াল স্ট্রিটে বড় ধাক্কা লেগেছে। শুক্রবার মার্কিন শেয়ারবাজারের দুই প্রধান সূচক এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ও নাসদাক কম্পোজিট যথাক্রমে ১ দশমিক ১ শতাংশ এবং ১ দশমিক ৩ শতাংশ কমে গেছে।
মধ্যপ্রাচ্যেও বাজারে ব্যাপক পতন দেখা গেছে। রবিবার (১৫ জুন) মিসরের ইজিএক্স-৩০ সূচক এক দিনেই ৭ দশমিক ৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
ইসরায়েলের তেলআবিব স্টক এক্সচেঞ্জের টিএ-৩৫ সূচকও ১ দশমিক ৫ শতাংশ পড়ে গেছে।
এই পতনগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে এবং তারা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ থেকে সরে এসে নিরাপদ বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন।
ইউরোপীয় বাজারেও পতন, তবে প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি খাতে উত্থান
ইসরায়েলের হামলার খবরে ইউরোপীয় শেয়ারবাজারেও পতনের ধারা দেখা গেছে। জার্মানির ডিএএক্স ও ফ্রান্সের সিএসি ৪০ গত সপ্তাহের শেষে ১ দশমিক ১ শতাংশের একটু বেশি হারিয়েছে। যুক্তরাজ্যের এফটিএসই ১০০ সূচক শুক্রবার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কমে শুক্রবারে বন্ধ হয়ে যায়।
তবু যুক্তরাজ্যের কিছু কোম্পানি উল্টো বেড়েছে। বিএই সিস্টেটেমস একটি প্রতিরক্ষা ঠিকাদার কোম্পানি, যেটির দাম বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রেও প্রতিরক্ষা সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে লকহিড মার্টিন, নর্থরোপ গ্রুম্যান ও আরটিএস্কের শেয়ারদর বেড়েছে।
তেল কোম্পানিগুলোরও শেয়ার মূল্য বেড়েছে। বিপির দাম প্রায় ২ শতাংশ, শেলের দাম ১ শতাংশের একটু বেশি বেড়েছে।
স্বর্ণের দাম শুক্রবারে ১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪২৬ ডলার প্রতি আউন্সে, যা এপ্রিলের রেকর্ড ৩ হাজার ৫০০ ডলারের কাছাকাছি।
সোমবারের পরিস্থিতি কিছুটা স্থির
সোমবার (১৬ জুন) বিনিয়োগকারীরা কিছুটা ঝুঁকি হ্রাসের অবস্থান থেকে সরে আসে। তেল ও স্বর্ণের দাম কিছুটা কমেছে। শেয়ারবাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
টিএস ল্যামবার্ডের বিশ্লেষক হামজাহ আল গাওদ বলেন, “বাজার এখনো মনে করছে এই সংঘাত তুলনামূলকভাবে সীমিত থাকবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ইরান এখনো যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ করেনি।”
বিমান চলাচলে কী প্রভাব পড়েছে?
মধ্যপ্রাচ্যে আকাশপথ বন্ধ এবং যুদ্ধাবস্থা বৃদ্ধির ফলে বিমান চলাচলে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। অনেক এয়ারলাইন্স ফ্লাইট স্থগিত বা বাতিল করেছে এবং কয়েকটি দেশ তাদের আকাশসীমা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে।
আমিরাত এয়ারলাইন্সের ইরাক, জর্ডান, লেবানন ও ইরানের সব গন্তব্যে ৩০ জুন পর্যন্ত ফ্লাইট স্থগিত রাখা হয়েছে।
আবুধাবিভিত্তিক ইতিহাদ এয়ারওয়েসের আবুধাবি-তেলআবিব রুটের সব ফ্লাইট বন্ধ রাখা হয়েছে। একাধিক রুটে ফ্লাইট রিশিডিউল করা হয়েছে; যাত্রীদের ফ্লাইট অবস্থা জানতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কাতার এয়ারওয়েজের ইরান, ইরাক ও সিরিয়াগামী সব ফ্লাইট সাময়িকভাবে বাতিল করা হয়েছে। যাত্রীদের যাত্রার আগে ফ্লাইট অবস্থা যাচাই করতে বলা হয়েছে।
আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা
ইরানের সরকারি সংবাদ সংস্থা আইআরএনএ জানায়, ইরানি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করেছে।
ইরাক তাদের আকাশসীমা বন্ধ ও সব বিমানবন্দর কার্যক্রম স্থগিত করেছে। পূর্ব ইরাক বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত আকাশপথ, যেখানে একসঙ্গে বহু ফ্লাইট চলাচল করে; বিশেষত এশিয়া থেকে ইউরোপগামী বিমানগুলো।
জর্ডানের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ‘আঞ্চলিক উত্তেজনার কারণে সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায়’ তারা সাময়িকভাবে আকাশসীমা বন্ধ করেছে।
পর্যটন ও আর্থিক বাজারে প্রভাব
বিশ্লেষক হামজাহ আল গাওদ বলেছেন, “মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটন খাতে কিছু স্বল্পমেয়াদি বিঘ্ন ঘটবে, তবে সেটা এক মাসের বেশি স্থায়ী হবে না। পর্যটন আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমার ধারণা।”
আর্থিক বাজার নিয়েও তিনি আশাবাদী। হামজাহ আল গাওদ বলেছেন, “যতক্ষণ সংঘাত সীমিত পর্যায়ে থাকে, ততক্ষণ আমি মনে করি শেয়ারবাজার গত সপ্তাহের ধস থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে।”
ঢাকা/রাসেল
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইসর য় ল য ক তর ষ ট র শ য় রব জ র ইসর য় ল র শ ক রব র এই স ঘ ত ১ দশম ক বন ধ র র জন য স মব র ফ ল ইট অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল, থেমে নেই ইরানও
ইরানে সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এসব হামলার নিশানা করা হচ্ছে ইরানের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, পারমাণবিক স্থাপনা ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনকেন্দ্র। গতকাল মঙ্গলবারও ইরানের সামরিক বাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে হত্যার দাবি করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলের হামলার পাল্টা জবাব দিয়ে যাচ্ছে ইরানও।
গতকাল সংঘাতের পঞ্চম দিনেও দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের একটি সামরিক গোয়েন্দা কেন্দ্র ও গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের অপারেশন পরিকল্পনা কেন্দ্রে হামলার দাবি করেছে ইরান। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে দেশটির হার্জলিয়া শহরের একটি ‘স্পর্শকাতর’ স্থানে হামলার কথা জানিয়েছে ইসরায়েলি গণমাধ্যম।
গতকাল ইরানের যে সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার দাবি করা হয়েছে, তাঁর নাম আলী সাদমানি। তিনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোরের (আইআরজিসি) খাতাম আল-আনিবিয়া শাখার প্রধান। সাদমানি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ বলে জানিয়েছে দেশটির সামরিক বাহিনী।
এ নিয়ে পাঁচ দিনে ইরানের সেনাপ্রধান ও আইআরজিসির প্রধানসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার দাবি করেছে ইসরায়েল। ইরানের কয়েকজন পরমাণুবিজ্ঞানীকেও হত্যা করা হয়েছে। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনা। দেশটির আরও ১০টি পারমাণবিক লক্ষ্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বলে গতকাল জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ।
ইসরায়েলের হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থাগুলোতেও। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, তারা ইরানের তিন ভাগের এক ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে। এর পাশাপাশি ইরানের সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন কার্যালয়, গ্যাসক্ষেত্র, জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার, বিমানবন্দর ও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। হামলা হয়েছে ইরানের বেসরকারি স্থাপনাতে। ইসরায়েলি হামলায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাই বেসামরিক নাগরিক।
আয়াতুল্লাহ খামেনিকেও হত্যার হুমকি দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাৎজ। তিনি বলেছেন, ‘ইরানের প্রতিবেশী দেশের স্বৈরশাসকের সঙ্গে কী হয়েছিল, তা স্মরণ করতে পারেন খামেনি।’ এই স্বৈরশাসক বলতে ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন কাৎজ। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর অভিযানে ক্ষমতাচ্যুত হন সাদ্দাম। ২০০৬ সালে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
একের পর এক বিস্ফোরণ
গতকাল সারা দিন ও রাতে ইরানের রাজধানী তেহরানে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। রাতে হামলা হয় ইস্পাহান প্রদেশেও। আগের দিন সোমবার মধ্যরাতে তেহরানের পূর্বাঞ্চলে বিস্ফোরণের পর ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। এ সময় শহরটি থেকে ৩২০ কিলোমিটার দূরে নাতাঞ্জ পরমাণু স্থাপনায় আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে।
সোমবার ভোরে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে সে সময় পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ২২৪ জন নিহত হন। তবে গতকাল ইরানের কাশান শহরে আরও তিনজন নিহত ও চারজন আহত হন বলে জানায় দেশটির সংবাদমাধ্যম নুর নিউজ। এ ছাড়া ইরানের লোরেস্তান প্রদেশে ২১ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন খোররামাবাদ শহরের মেয়র রেজা সেপাহবান্দ।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম আইআরআইবির ভবনে সোমবার রাতে হামলার পর সেখানেও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ওই ভবনে থাকা আইআরআইবির তিনজন কর্মী নিহত হয়েছেন। ক্রমেই হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ছুটিতে থাকা সব চিকিৎসক ও নার্সকে নিজেদের কর্মস্থলে ফিরতে বলেছেন ইরানের স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী সায়েদ সাজ্জাদ রাজাভি।
এরই মধ্যে গতকাল রাতে ইরানের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় তারা ‘শত্রুপক্ষের ২৮টি আকাশযান’ ধ্বংস করেছে। সেগুলোর মধ্যে একটি গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকারী ড্রোনও রয়েছে। এর আগের ইসরায়েলের কয়েকটি যুদ্ধবিমান ধ্বংসের দাবি করেছিল তেহরান।
পাঁচ দিন ধরে চলা তেহরানে হামলায় শহরটির বাসিন্দারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। শহরটিতে ইসরায়েলের হামলার লক্ষ্যবস্তুগুলোর আশপাশের এলাকাগুলো থেকে সাধারণ লোকজনকে সরে যেতে বলেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এরই মধ্যে আবার সোমবার তেহরানের বাসিন্দাদের শহরটি ছাড়তে বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমন পরিস্থিতিতে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অনেকে। তেহরানের এক বাসিন্দা বিবিসিকে বলেন, তিনি তেহরান ছেড়ে যাচ্ছেন। শহরটি এখন ফাঁকা লাগছে। শুধু যাঁদের যাওয়ার জায়গা নেই, তাঁরাই রয়ে গেছেন।
তেল আবিব–জেরুজালেমে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত
ইরান গতকাল ও আগের দিন রাতে ইসরায়েলের চারটি স্থানে হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট। সোমবার রাতভর ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে বাজছিল সাইরেন। তেল আবিব, জেরুজালেম ও হার্জলিয়া শহরে আঘাত হানে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র। এ সময় একাধিকবার আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যান হাজার হাজার ইসরায়েলি।
গতকাল হার্জলিয়া শহরে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র সামনে আসে। এদিন এ শহরেই ‘স্পর্শকাতর’ স্থাপনায় হামলার খবর জানিয়েছিল ইসরায়েল। হামলায় হার্জলিয়ার আটতলা একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে আগুন ধরে যায় একটি বাসে। গতকাল রাতেও তেল আবিবে হামলা হয় বলে জানিয়েছে ইসরায়েল বাহিনী। তাদের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলে নিহত হয়েছেন ২৪ জন।
আল-জাজিরার খবর অনুযায়ী, ইরানের সঙ্গে সংঘাত শুরুর পর এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের অর্থ মন্ত্রণালয়ে ক্ষতিপূরণ চেয়ে ১৪ হাজার আবেদন পড়েছে। ইরানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা এ আবেদন করেছেন। এ ছাড়া গত কয়েক দিনে ইরানের হামলায় ইসরায়েলে জ্বালানি তেল পরিশোধনকেন্দ্র, বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনায়ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ট্রাম্পের সঙ্গে দেনদরবারের আহ্বান
ইরানের সঙ্গে সংঘাত শুরুর পর থেকে হামলা থামানোর বিষয়ে এখনো কোনো ইঙ্গিত দেয়নি ইসরায়েল। তবে আগের তুলনায় আলোচনায় ফেরার বিষয়ে ইরান কিছুটা নমনীয়। সোমবার ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছিলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের পরিধি বাড়াতে চায় না তাঁর দেশ। পরে গতকাল ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, ইরান কূটনীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এ ছাড়া আলাদা পাঁচটি সূত্রের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে যেন ডোনাল্ড ট্রাম্প অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে চাপ দেন, সে জন্য দেনদরবার করতে ওমান, কাতার ও সৌদি আরবের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তেহরান। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় আরও ছাড় দেবে ইরান।
সংঘাত থামাতে তৎপরতা দেখাচ্ছে বিভিন্ন দেশও। গতকাল দোহায় এক সংবাদ সম্মেলনে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানান কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাজেদ আল-আনসারি। তিনি বলেন, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতির জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাবেন তাঁরা। সংঘাত কমানোর আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে শিল্পোন্নত সাত দেশের জোট জি-৭।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত বন্ধে রাশিয়া মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত বলে গতকালও জানিয়েছে ক্রেমলিন। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এমন ইচ্ছার কথা জানান। এদিকে সংঘাত শুরুর পর গতকাল প্রথমবারের মতো মুখ খুলেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় অবস্থানকালে তিনি বলেন, সব পক্ষকে দ্রুত এ সংঘাত প্রশমনে কাজ করতে হবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইরান–ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের ‘সত্যিকারের অবসান’ চান তিনি, যা যুদ্ধবিরতির চেয়েও কার্যকর হবে। এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে গতকাল ট্রাম্প বলেন, ইরানের সঙ্গে আলোচনার জন্য তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকে পাঠাতে পারেন।
মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে সেখানে মার্কিন বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস কার্ল ভিনসন রয়েছে। বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস নিমিটজও মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে। এর বাইরে আরব সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা রয়েছে। এসব জাহাজ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম।
এদিকে মার্কিন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বসার কথা ট্রাম্পের। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ জানিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্যে বাড়তি সামরিক শক্তি মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাম্প।
তবে এ সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো সরাসরি জড়াতে চায় না বলে মনে করেন দোহাভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের বিশ্লেষক আদেল আবদেল। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘সংঘাত বাড়তে পারে। আমি মনে করি, এতে ট্রাম্প যোগ দেবেন না এবং সংঘাত হয়তো কমাতে চাইবেন। কারণ, সংঘাতের কারণে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়বে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে স্বার্থ ট্রাম্পের রয়েছে, তা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো যুদ্ধের মাধ্যমে পূরণ হবে না।’