দাম কম, বৃষ্টিতে বরজের ক্ষতি, মহেশখালীর পানচাষিদের মাথায় হাত
Published: 18th, June 2025 GMT
দুই মাস ধরে পানের দাম কম। এর মধ্যেই কয়েক দফায় পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে পানের বরজের। এমন পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে পড়েছেন কক্সবাজারের মহেশখালীর পানচাষিরা। চাষিরা জানান, তিন মাস আগে প্রতি বিড়া (৮০টি) পান ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এখন সেই পানের বিড়া বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়।
সাগর আর নদীবেষ্টিত দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর মানুষের আয়ের প্রধান উৎস মাছ ধরা এবং লবণ ও মিষ্টি পান চাষ। দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ পান চাষের ওপর নির্ভরশীল। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে মহেশখালী উপজেলায় ১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪০০ হেক্টর চাষাবাদ হয়েছে পাহাড়ি জমিতে। পানের বরজের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। চাষির সংখ্যা ২৮ হাজারের মতো।
তবে এবার দুই মাস ধরে পানের দাম কমে গেছে। এর মধ্যে মে মাসের শেষ সপ্তাহ এবং চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দুই দফা ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে উপজেলার অন্তত ৫০০ হেক্টর জমির পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।কৃষি কর্মকর্তারা জানান, গত মৌসুমেও প্রতি এক হেক্টর জমিতে পান চাষ করতে চাষিদের খরচ হয়েছে ৪৮ লাখ টাকা। প্রতি হেক্টরে প্রায় ৬০ মেট্রিক টন পান উৎপাদন হয়, যা বিক্রি করে প্রতি হেক্টরে চাষিদের আয় হয় প্রায় ৯৮ লাখ টাকা। এতে খরচ বাদ দিয়েও চাষিদের প্রতি হেক্টরে প্রায় ৪০ লাখ টাকা লাভ হয়। তবে এবার গত দুই মাস ধরে পানের দাম কমে গেছে। এর মধ্যে মে মাসের শেষ সপ্তাহ এবং চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দুই দফা ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে উপজেলার অন্তত ৫০০ হেক্টর জমির পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক যুগ ধরে উপজেলার বড় মহেশখালী, হোয়ানক, কালারমারছড়া, ছোট মহেশখালী ও শাপলাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন পাহাড়ির ঢাল ও কৃষিজমিতে পান চাষ হচ্ছে। পাহাড়ি এলাকায় বছরজুড়েই পান চাষ করা হয়। তবে কৃষিজমিতে হয় বছরে ৯ মাসের মতো। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস থেকে পান চাষ শুরু হয়ে জুন মাসের দিকে শেষ হয়। পানের বরজ থেকে পান তুলে নিয়ে চাষিরা স্থানীয় হাটবাজারে নিয়ে বিক্রি করেন।
গত শুক্রবার উপজেলার পানের হাট জনতা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পান বেচাকেনা করতে শতাধিক চাষি পান নিয়ে বাজারে এসেছেন। কক্সবাজারের চকরিয়া, বান্দরবান, চট্টগ্রামের পটিয়া, বাঁশখালীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা পান কিনতে ভিড় করেছেন বাজারে। আকারভেদে প্রতি বিড়া পান ১০০-১৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
দুই মাস আগেও যে পান ৫০০ টাকায় বিক্রি করেছি, এখন সেই পান বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। এই দামে পান বিক্রি করে খরচের টাকাও উঠবে না।আবদুল হাকিম, মহেশখালীর পানচাষিপানের হাটে কথা হয় কালারমারছড়া ইউনিয়নের ইনুছখালীর বাসিন্দা চাষি আবদুল হাকিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দুই মাস আগেও যে পান ৫০০ টাকায় বিক্রি করেছি, এখন সেই পান বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। এই দামে পান বিক্রি করে চাষাবাদের খরচের টাকাও উঠবে না।’
পটিয়া থেকে পান কিনতে আসা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলম বলেন, সরবরাহ বাড়ায় দুই মাস ধরে আড়তে পানের দাম কম গেছে। তাই তাঁরাও চাষিদের কাছ থেকে আগের চেয়ে কম দামে পান কিনছেন।
শাপলাপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড মনিপুর এলাকার পানচাষি সাইদুল ইসলামের ২০ শতক পানের বরজ রয়েছে। তিনি বলেন, গত বছরের অক্টোবরে পান চাষ শুরু করেন তিনি। চাষাবাদে তাঁর খরচ হয়েছে দুই লাখ টাকা। এখন উৎপাদন প্রায় শেষ পর্যায়ে। এবার পানের যা দাম, লাভ দূরে থাক, লোকসান গুনতে হবে তাঁকে। একই গ্রামের বাসিন্দা ও আরেক পানচাষি নুরুল ইসলাম বলেন, তাঁর ১৫ শতকের পানের বরজটি গত ২৯ ও ৩০ মে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কবলে পড়ে। তাঁর অন্তত এক লাখ টাকার পানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে চাষিরা পান বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন মহেশখালীর জনতা বাজারে। গত শুক্রবার সকালে তোলা.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ন র দ ম কম প ন র বরজ উপজ ল র ১৫০ ট ক বরজ র
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারের নিদ্রাভঙ্গ হউক
বুধবার সন্ধ্যায় পুরান ঢাকায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের ৩ নম্বর ফটকের সম্মুখে যেই বর্বর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়াছে, হয়তো উহা নজিরবিহীন নহে; তবে উহা যে বিশেষত রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি নির্দেশ করিতেছে– এই বিষয়ে কাহারও সংশয় থাকিবার অবকাশ নাই।
তৎসহিত ইহাও প্রমাণিত হইল, সমাজে সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য এখন এতটাই; এহেন বীভৎসতা প্রত্যক্ষ করিয়াও মানুষকে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ জপ করিতে হয়। শুক্রবার সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, যিনি ঐ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হইয়াছেন, তিনি উক্ত এলাকার ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ। ব্যবসায়ের ভাগবাটোয়ারা লইয়া তাঁহারই পূর্বপরিচিত এক দল যুবক সোহাগকে বুধবার মধ্যাহ্নে ডাকিয়া লইয়া সন্ধ্যায় মিটফোর্ড হাসপাতাল চত্বরে প্রহার ও ইষ্টক-প্রস্তরের আঘাতে মস্তক পিষ্ট করিয়া মৃত্যু নিশ্চিত করে। শুধু উহাই নহে; মৃত্যুর পরও সোহাগকে নিষ্কৃতি দেয় নাই সন্ত্রাসীরা। তাহারা একাদিক্রমে মৃতদেহের উপর লম্ফঝম্প করিয়াছে।
ইতোমধ্যে প্রকাশিত সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিওর নির্মম সাক্ষ্য– লোকজন হতবিহ্বল দৃষ্টিতে এই নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করিয়াছে। এমনকি হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার সদস্যদের ক্যাম্পের অবস্থান পার্শ্বে হইলেও তাহাদের কেহই অগ্রসর হইতে সাহসী হন নাই। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, শুধু সোহাগ হত্যা নয়; ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েক মাস ধরিয়া নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিরন্তর চলমান। বৃহস্পতিবারও চট্টগ্রামে এক গৃহবধূকে হত্যার পর লাশ ১১ খণ্ড করা হইয়াছে।
সম্প্রতি গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে কারখানায় চুরির অপবাদ দিয়া হৃদয় নামে এক তরুণ শ্রমিককে প্রহারে হত্যা করা হয়। ১৮ মে রাত্রে রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডে এক যুবককে প্রকাশ্যে কোপানো হয়। ১৬ মে রাজধানীর জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন পাতাম রেস্টুরেন্ট এলাকায় হত্যা করা হয় সামিউর রহমান (আলভি) নামে এক ব্যক্তিকে।
পুলিশ সদরদপ্তরের পরিসংখ্যান বলিতেছে, গত জানুয়ারি হইতে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে রাজধানীতেই খুন হইয়াছেন ১৩৬ জন। সমগ্র দেশে এই সংখ্যা ১২ শতাধিক। অন্যদিকে ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে ঢাকায় এই সংখ্যা ছিল ৫৫; ২০২২ সালে ৫৪; ২০২৩ সালে ৫১ এবং ২০২৪ সালে ৪৭। এই পরিসংখ্যানও বলিতেছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের যেই প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হইয়াছিল, তাহা যতটুকু কাগজে আছে, ততটুকু কার্যকর হয় নাই। বলা হইতে পারে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয়তা এখনও প্রত্যাশিত পর্যায়ে আসে নাই। কিন্তু উহাদেরই যখন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আন্দোলন দমনে যথেষ্ট তৎপর দেখা যায়, তখন ঐ কথার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। উপরন্তু পুলিশের দুর্বলতার কারণেই তো সেনাবাহিনীকে অধ্যাদেশবলে গ্রেপ্তার করিবার ক্ষমতা প্রদান করা হইয়াছে। আমরা মনে করি, যদি সরকার দলমত নির্বিশেষে প্রকৃত অপরাধীদের দমনে মনোযোগ নিবদ্ধ করিত, তাহা হইলে নিঃসন্দেহে পরিস্থিতির উন্নতি হইত। তদুপরি গত বৎসরের আগস্ট হইতে দেশব্যাপী মহলবিশেষ যে ভয়ংকর মব সন্ত্রাস চালাইতেছে, উহার প্রতিও রহস্যজনক কারণে সরকার এক প্রকার নমনীয়তা প্রদর্শন করিতেছে। ইহাও নানা প্রকার ফৌজদারি অপরাধীদের স্বীয় অপকর্ম চালাইয়া যাইতে উৎসাহ (!) জোগাইয়া চলিয়াছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অপারেশন্স) এস এন নজরুল ইসলাম সমকালকে যথার্থই বলিয়াছেন, মানুষের মধ্যে অস্থিরতা ক্রিয়াশীল। তরুণদের একটা অংশ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া যাইতেছে। সমাজে শৃঙ্খলা ও ঐক্য বজায় না থাকিলে বিপদ আরও বৃদ্ধি পাইবে বলিয়া তিনি মনে করেন। কিন্তু অনুরূপ কোনো চিন্তা সরকারের মধ্যে আদৌ আছে বলিয়া উপলব্ধ হয় না। একদিকে ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলির নেতাকর্মী ক্রমশ বেপরোয়া হইয়া উঠিতেছে, অন্যদিকে তাহাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে গুরুতর অপরাধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সক্রিয় হইয়া উঠিয়াছে। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলিকে স্পষ্ট কোনো বার্তা প্রদানের উদ্যোগও সরকারের মধ্যে পরিদৃষ্ট হইতেছে না। তবে আমাদের প্রত্যাশা, আলোচ্য ঘটনার পর সরকারের বোধোদয় ঘটিবে এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গৃহীত হইবে।