১৮ আগস্ট ২০২০। চারপাশে করোনা। যমুনা নদীতে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় এক বন্ধুর সমাধিকাজে যোগ দিতে সিরাজগঞ্জের পথে ছিলাম। নদীর ঢেউগুলো তখন উত্তাল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। হঠাৎই খবর এল নারী আলোকচিত্রীর অনুপ্রেরণার প্রতীক, এ দেশের প্রথম পেশাদার নারী আলোকচিত্রী সাঈদা খানম বিদায় নিয়েছেন। ফটোগ্রাফির ইতিহাসে চিরজীবী এক নাম নেই ভাবতেই কেমন একা লাগল। পাঁচ বছর চলে গেছে।

তাঁর জীবদ্দশায় দেখেছি, তরুণ অনেক আলোকচিত্রী তাঁকে চেনেন না। একটা অপরাধবোধ হতো এতে। তাঁর কাজকে পরিচিত করা আমাদেরই দায় ও দায়িত্ব—সেটা অনুভব করতাম সব সময়। সেই তাড়নায় তাঁর সঙ্গে নানা আয়োজনে যুক্ত হতাম, তাঁর কাজ পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতাম। তিনি নিজেও অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে অনুজদের ডাকে সাড়া দিতেন। মিলিত হতেন যেকোনো প্রদর্শনী আলাপ-আড্ডায়। তাঁর বাসায়ও তরুণ-প্রবীণ নারীদের আড্ডা বসত।

জন্ম ১৯৩৭। মৃত্যুর সময় বয়স ৮২। এরপর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছবি মেলা ‘শূন্য’তে তাঁর তোলা অনেক অদেখা ছবি দেখি। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বইয়ের দোকানে পাই ‘একজন সাঈদা খানম’। বইটি পেয়ে স্বস্তি হয়। মনে হয় লেখক-আলোকচিত্রী সাহাদাত পারভেজ আমাদের কাঁধে চাপা দায় মেটাতে ভূমিকা রেখে আমাদের ঋণী করলেন। অত্যন্ত যত্ন এবং সাঈদা খানমের জানাবোঝার আন্তরিক আগ্রহ ও গবেষণামূলক দৃষ্টির ছাপ আছে বইটিতে। প্রচ্ছদে তরুণ সাঈদা খানমের ছবি। হাতে ক্যামেরা। বইটা পেয়ে মনে হলো তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন। 

পৃষ্ঠা ওলটালে ৪৩টি শিরোনামে পরিচয় হয় পেশাদার আলোকচিত্রী, শক্তিশালী পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফার, একই সঙ্গে একজন ফটোসাংবাদিকের সঙ্গে। জানতে পারি কৈশোর-শৈশবে পদ্মা ও ইছামতী নদীর পারে নানাবাড়ি পাবনা জেলায় প্রাণপ্রকৃতির মাঝে তাঁর বেড়ে ওঠার গল্প।

প্রগতিশীল-সংস্কৃতিমনা পরিবারে বেড়ে ওঠার সুবাদে তিনি নিজের আগ্রহের কাজ আজীবন করে গেছেন। তাঁর কবি খালা মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা তাঁকে বাদল নাম দিয়েছিলেন। বাদলের পৈতৃক নিবাস ফরিদপুরে। বাবা আবদুস সামাদ খাঁ ছিলেন সরকারি স্কুল পরিদর্শক। নানা ছিলেন নারীশিক্ষার অগ্রণী ব্যক্তি। তাঁর মা হাসিনা খাতুন স্বদেশি আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। তিনি বই পড়তে, থিয়েটার দেখতে ভালোবাসতেন। ছয় ভাই-বোন সবাই ছিলেন গুণীজন। বিস্তৃত পরিসরে তাঁর কাজ নিয়ে পাঠক জানতে পারবেন সাহাদাত পারভেজের এ বইয়ে।

১২ বছর বয়সে ক্যামেরা হাতে তুলে নিয়েছিলেন দুরন্ত সাঈদা খানম। তখন দেশে নারীদের কাজ সহজ ছিল না। ঘোড়ার গাড়ির বন্ধ ঘেরাটোপে স্কুলে যেত মেয়েরা। সাঈদা খানমকেও প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়। কিন্তু তিনি থেমে যাননি।

‘ক্যামেরায় সর্পিত ছিল তাঁর সমস্ত জীবন কিংবা তিনি অনেক আলোকচিত্রীর অনুপ্রেরণা; এই কথাগুলো সবারই জানা। কিন্তু এর আড়ালে তার আরও একটা বিশাল জগৎ আছে। তিনি যে একজন শক্তিমান গল্পকার ও ঔপন্যাসিক—এ বিষয়টি এখন তেমনভাবে উচ্চারিত হয় না।’ এভাবে সাহাদাত পারভেজ তাঁর গ্রন্থে সাঈদা খানমের লেখক প্রতিভার সঙ্গেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। ‘ধুলোমাটি’, ‘স্মৃতির পথ বেয়ে’, ‘আমার চোখে সত্যজিৎ রায়’ তাঁর উল্লেখযোগ্য বই।

‘একজন সাঈদা খানম’ বইটিতে তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ-বিস্তৃত কাজের সঙ্গে পরিচয় ঘটবে পাঠকের। বইয়ের শেষ অংশে তাঁর জীবনের নানা মুহূর্তের ছবি, ব্যক্তিগত চিঠি, নিজ আঁকা স্কেচ প্রভৃতি একান্তে পাবেন পাঠক।

ছবি তোলার সঙ্গে পড়াশোনায়ও মনোযোগী ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৮ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ও ১৯৭২ সালে লাইব্রেরি সায়েন্সে মাস্টার ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ সাল বাংলা বিভাগে লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আলোকচিত্র সাংবাদিকের কাজ শুরু করেন ১৯৫৬ সালে বেগম পত্রিকার আলোকচিত্রী হিসেবে। বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর কাজ ছাপা হতো তখন। তাঁর সংগ্রহে জমে একুশে পদকসহ আন্তর্জাতিক নানা স্বীকৃতি।

সাঈদা খানম ছবি তুলতেন ফিল্ম ক্যামেরায়। অস্ত্র হাতে আজিমপুরে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন নারীরা—ছবিটি পরিচিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে এটি তোলেন। এরপর ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের উল্লাস-ভয় মেশানো মুহূর্তে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তাঁর উপস্থিতি ছিল। যুদ্ধের পরে ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে যুদ্ধাহতদের সাহায্যে এগিয়ে যান ও ছবি তোলেন। 

সবাইকে আপন করে নেওয়ার বৈশিষ্ট্যে তিনি বিখ্যাত-গুণী মানুষদের সাহচর্য এবং তাঁদের ছবি তোলার সুযোগ পান। তাঁদের মধ্যে ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান। ছবি তোলেন বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রানি এলিজাবেথ, মাদার তেরেসা, মার্শাল টিটো ও অড্রে হেপবার্নের। এমনকি চন্দ্রবিজয়ী নীল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্সেরও। 

১৯৫৬ থেকে ২০২০ অব্দি ক্যামেরা-কলমে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ আলোকচিত্রী সাঈদা খানমের যাত্রাকে গভীরভাবে জানতে এ বই পথ দেখাবে।

একজন সাইদা খানম
সাহাদাত পারভেজ
প্রকাশক: পাঠক সমাবেশ
প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৪
মূল্য: ৬৯৫, পৃষ্ঠা: ১৯৩

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

বনানীতে সিসা বারে যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা, জড়িত ৫ জন শনাক্ত

রাজধানী ঢাকার বনানী এলাকায় ‘৩৬০ ডিগ্রি’ নামের একটি সিসা বারে রাহাত হোসেন রাব্বি (৩১) নামের এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত রাহাত ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসা করতেন। পুলিশের ধারণা, আর্থিক লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে রাহাতকে হত্যা করা হয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে রাহাত হত্যার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম–পরিচয় পাওয়া গেছে।

বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাসেল সারোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, সিসা বারের দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে রাহাতের পায়ে ছুরিকাঘাত করেন তাঁর পূর্বপরিচিত কয়েকজন যুবক। গুরুতর আহত অবস্থায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

ওসি রাসেল সারোয়ার আরও বলেন, রাহাত তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে সিসা বারে ছিলেন। কথা-কাটাকাটির জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা রাহাতের পূর্বপরিচিত এবং তাঁরা প্রায়ই এই সিসা বারে আসতেন। ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি।

রাহাতের ওপর হামলার দৃশ্য ধারণ হয়েছে সিসা বারের একাধিক সিসি ক্যামেরায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, রাহাত সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় প্রথমে তিনজন তাঁকে ঘিরে ধরেন। এর মধ্যেই তাঁর ঊরুতে ছুরিকাঘাত করা হয়। এক যুবক রাহাতের ওপর হামলা ঠেকাতে চাইলে তাঁকেও মারধর করা হয়। একপর্যায় রাহাত সিঁড়ি থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় ভবনের লিফটের কাছে আসেন। হামলাকারীদের একজন রাহাতকে কিছু একটা দিয়ে পেটান। সবশেষে আরেকজন এসে রাহাতের ডান হাতের কনুইতে ছুরিকাঘাত করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান।

নিহত যুবকের চাচাতো ভাই শাকিল শাজাহান ও ফুফু কাজল আক্তার বলেন, রাহাত ইন্টারনেট ব্যবসায়ী ছিলেন। মহাখালী এলাকার রবিউল আলম হাজারীর দুই ছেলের মধ্যে তিনি বড়। রাতে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বের হয়ে আর বাসায় ফেরেননি। ভোরে তাঁর মুঠোফোন থেকে এক বন্ধু জানান, রাহাত ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে সিসা নিষিদ্ধ মাদক। তবে অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে প্রভাবশালীরা যোগসাজশ করে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে সিসা বার পরিচালনা করে আসছেন। অনেকটা প্রকাশ্যে ৩৬০ ডিগ্রি নামের একটি সিসা বার ব্যবসা পরিচালনা করলেও সেটা জানতেন না বলে জানিয়েছেন বনানী থানার ওসি রাসেল সারোয়ার।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ৩৬০ ডিগ্রি নামের একটি সিসা বারের নামে আগেও দুটি মামলা করা হয়েছিল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র বলছে, নিয়মিত অভিযান না হওয়ায় এভাবে প্রকাশ্যে চলছে সিসা বার। গুলশান এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক শামসুল কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে ‘অ্যারাবিক কুজি’ নামে সিসা বারটি পরিচালিত হতো। কিছুদিন আগে অভিযান চালিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এখন ৩৬০ ডিগ্রি নতুন নাম দিয়ে একই মালিক ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিপ্লবের এক বছর পর আশা হতাশায় রূপ নিচ্ছে
  • ডাকসু নির্বাচন: চতুর্থ দিনে মনোনয়ন ফরম নিলেন একজন
  • কক্সবাজার সৈকতে গোসলে নেমেছিলেন চার বন্ধু, ঢেউয়ে ভেসে একজনের মৃত্যু
  • ভারত-চীন সম্পর্কের আসলে কতটা উন্নতি হতে পারে
  • সার্কভুক্ত ‘দেশি’ ফুটবলার আশীর্বাদ নাকি শঙ্কা
  • বনানীতে সিসা বারে যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা, জড়িত ৫ জন শনাক্ত
  • দুর্নীতির মামলায় পাপিয়া ও তাঁর স্বামীর সাড়ে তিন বছরের কারাদণ্ড
  • বাগ্‌দান সারলেন টেন্ডুলকারের ছেলে অর্জুন, জেনে নিন বাগ্‌দত্তার পরিচয়
  • পাথর তোলায় রাজনৈতিক দলের ‘ঐকমত্য’, পরে লুট, ঘটল কীভাবে