নারী আলোকচিত্রীর অনুপ্রেরণার প্রতীক
Published: 16th, August 2025 GMT
১৮ আগস্ট ২০২০। চারপাশে করোনা। যমুনা নদীতে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় এক বন্ধুর সমাধিকাজে যোগ দিতে সিরাজগঞ্জের পথে ছিলাম। নদীর ঢেউগুলো তখন উত্তাল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। হঠাৎই খবর এল নারী আলোকচিত্রীর অনুপ্রেরণার প্রতীক, এ দেশের প্রথম পেশাদার নারী আলোকচিত্রী সাঈদা খানম বিদায় নিয়েছেন। ফটোগ্রাফির ইতিহাসে চিরজীবী এক নাম নেই ভাবতেই কেমন একা লাগল। পাঁচ বছর চলে গেছে।
তাঁর জীবদ্দশায় দেখেছি, তরুণ অনেক আলোকচিত্রী তাঁকে চেনেন না। একটা অপরাধবোধ হতো এতে। তাঁর কাজকে পরিচিত করা আমাদেরই দায় ও দায়িত্ব—সেটা অনুভব করতাম সব সময়। সেই তাড়নায় তাঁর সঙ্গে নানা আয়োজনে যুক্ত হতাম, তাঁর কাজ পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতাম। তিনি নিজেও অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে অনুজদের ডাকে সাড়া দিতেন। মিলিত হতেন যেকোনো প্রদর্শনী আলাপ-আড্ডায়। তাঁর বাসায়ও তরুণ-প্রবীণ নারীদের আড্ডা বসত।
জন্ম ১৯৩৭। মৃত্যুর সময় বয়স ৮২। এরপর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছবি মেলা ‘শূন্য’তে তাঁর তোলা অনেক অদেখা ছবি দেখি। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বইয়ের দোকানে পাই ‘একজন সাঈদা খানম’। বইটি পেয়ে স্বস্তি হয়। মনে হয় লেখক-আলোকচিত্রী সাহাদাত পারভেজ আমাদের কাঁধে চাপা দায় মেটাতে ভূমিকা রেখে আমাদের ঋণী করলেন। অত্যন্ত যত্ন এবং সাঈদা খানমের জানাবোঝার আন্তরিক আগ্রহ ও গবেষণামূলক দৃষ্টির ছাপ আছে বইটিতে। প্রচ্ছদে তরুণ সাঈদা খানমের ছবি। হাতে ক্যামেরা। বইটা পেয়ে মনে হলো তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন।
পৃষ্ঠা ওলটালে ৪৩টি শিরোনামে পরিচয় হয় পেশাদার আলোকচিত্রী, শক্তিশালী পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফার, একই সঙ্গে একজন ফটোসাংবাদিকের সঙ্গে। জানতে পারি কৈশোর-শৈশবে পদ্মা ও ইছামতী নদীর পারে নানাবাড়ি পাবনা জেলায় প্রাণপ্রকৃতির মাঝে তাঁর বেড়ে ওঠার গল্প।
প্রগতিশীল-সংস্কৃতিমনা পরিবারে বেড়ে ওঠার সুবাদে তিনি নিজের আগ্রহের কাজ আজীবন করে গেছেন। তাঁর কবি খালা মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা তাঁকে বাদল নাম দিয়েছিলেন। বাদলের পৈতৃক নিবাস ফরিদপুরে। বাবা আবদুস সামাদ খাঁ ছিলেন সরকারি স্কুল পরিদর্শক। নানা ছিলেন নারীশিক্ষার অগ্রণী ব্যক্তি। তাঁর মা হাসিনা খাতুন স্বদেশি আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। তিনি বই পড়তে, থিয়েটার দেখতে ভালোবাসতেন। ছয় ভাই-বোন সবাই ছিলেন গুণীজন। বিস্তৃত পরিসরে তাঁর কাজ নিয়ে পাঠক জানতে পারবেন সাহাদাত পারভেজের এ বইয়ে।
১২ বছর বয়সে ক্যামেরা হাতে তুলে নিয়েছিলেন দুরন্ত সাঈদা খানম। তখন দেশে নারীদের কাজ সহজ ছিল না। ঘোড়ার গাড়ির বন্ধ ঘেরাটোপে স্কুলে যেত মেয়েরা। সাঈদা খানমকেও প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়। কিন্তু তিনি থেমে যাননি।
‘ক্যামেরায় সর্পিত ছিল তাঁর সমস্ত জীবন কিংবা তিনি অনেক আলোকচিত্রীর অনুপ্রেরণা; এই কথাগুলো সবারই জানা। কিন্তু এর আড়ালে তার আরও একটা বিশাল জগৎ আছে। তিনি যে একজন শক্তিমান গল্পকার ও ঔপন্যাসিক—এ বিষয়টি এখন তেমনভাবে উচ্চারিত হয় না।’ এভাবে সাহাদাত পারভেজ তাঁর গ্রন্থে সাঈদা খানমের লেখক প্রতিভার সঙ্গেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। ‘ধুলোমাটি’, ‘স্মৃতির পথ বেয়ে’, ‘আমার চোখে সত্যজিৎ রায়’ তাঁর উল্লেখযোগ্য বই।
‘একজন সাঈদা খানম’ বইটিতে তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ-বিস্তৃত কাজের সঙ্গে পরিচয় ঘটবে পাঠকের। বইয়ের শেষ অংশে তাঁর জীবনের নানা মুহূর্তের ছবি, ব্যক্তিগত চিঠি, নিজ আঁকা স্কেচ প্রভৃতি একান্তে পাবেন পাঠক।
ছবি তোলার সঙ্গে পড়াশোনায়ও মনোযোগী ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৮ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ও ১৯৭২ সালে লাইব্রেরি সায়েন্সে মাস্টার ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ সাল বাংলা বিভাগে লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আলোকচিত্র সাংবাদিকের কাজ শুরু করেন ১৯৫৬ সালে বেগম পত্রিকার আলোকচিত্রী হিসেবে। বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর কাজ ছাপা হতো তখন। তাঁর সংগ্রহে জমে একুশে পদকসহ আন্তর্জাতিক নানা স্বীকৃতি।
সাঈদা খানম ছবি তুলতেন ফিল্ম ক্যামেরায়। অস্ত্র হাতে আজিমপুরে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন নারীরা—ছবিটি পরিচিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে এটি তোলেন। এরপর ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের উল্লাস-ভয় মেশানো মুহূর্তে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তাঁর উপস্থিতি ছিল। যুদ্ধের পরে ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে যুদ্ধাহতদের সাহায্যে এগিয়ে যান ও ছবি তোলেন।
সবাইকে আপন করে নেওয়ার বৈশিষ্ট্যে তিনি বিখ্যাত-গুণী মানুষদের সাহচর্য এবং তাঁদের ছবি তোলার সুযোগ পান। তাঁদের মধ্যে ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান। ছবি তোলেন বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রানি এলিজাবেথ, মাদার তেরেসা, মার্শাল টিটো ও অড্রে হেপবার্নের। এমনকি চন্দ্রবিজয়ী নীল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্সেরও।
১৯৫৬ থেকে ২০২০ অব্দি ক্যামেরা-কলমে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ আলোকচিত্রী সাঈদা খানমের যাত্রাকে গভীরভাবে জানতে এ বই পথ দেখাবে।
একজন সাইদা খানম
সাহাদাত পারভেজ
প্রকাশক: পাঠক সমাবেশ
প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৪
মূল্য: ৬৯৫, পৃষ্ঠা: ১৯৩
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
ফিলিপাইনে ৬ দশমিক ৯ তীব্রতার ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৬৯
ফিলিপাইনের মধ্যাঞ্চলে ৬ দশমিক ৯ তীব্রতার শক্তিশালী ভূমিকম্পে নিহত হওয়ার সংখ্যা বেড়ে ৬৯ জন হয়েছে। দেশটির দুর্যোগ-সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা আজ বুধবার এ খবর জানান। বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা ও পানি-বিদ্যুতের সংযোগ আবার চালু করার চেষ্টা করছে ফিলিপাইন সরকার।
দেশটির সিভিল ডিফেন্স কর্মকর্তা রাফি আলেজান্দ্রো সাংবাদিকদের বলেন, স্থানীয় সময় গতকাল মঙ্গলবার রাত ১০টার আগে সেবু প্রদেশের উত্তরে বোগো শহরের কাছে ভূমিকম্পটির উৎপত্তি হয়। স্থানীয় হাসপাতালগুলো আহত মানুষের ভিড়ে রীতিমতো উপচে পড়ছে।
আঞ্চলিক সিভিল ডিফেন্স দপ্তরের তথ্য কর্মকর্তা জেন আবাপো বলেন, সেবুর প্রাদেশিক দুর্যোগ দপ্তরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পে নিহত হওয়ার সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৬৯ জন। অন্য একজন কর্মকর্তা জানান, আহত হয়েছেন ১৫০ জনের বেশি।
দেশটির প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের দ্রুত সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি জানান, মন্ত্রিপরিষদ সচিবেরা ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। প্রিয়জন হারানো ব্যক্তিদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন তিনি।
সেবু ফিলিপাইনের জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যগুলোর একটি। সেখানে প্রায় ৩৪ লাখ মানুষের বসবাস। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ম্যাকতান-সেবু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্যক্রম চালু রয়েছে। এটা ফিলিপাইনের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর।
ভূমিকম্পে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সান রেমিগিও শহরটিও। উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে সহায়তার জন্য এ শহরে ‘দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা’ ঘোষণা করা হয়েছে। শহরের ভাইস মেয়র আলফি রেইনেস বলেন, উদ্ধারকর্মীদের জন্য খাবার ও পানি, সেই সঙ্গে ভারী সরঞ্জাম প্রয়োজন।
স্থানীয় ডিজেডএমএম রেডিওকে আলফি রেইনেস বলেন, ‘ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ নেই। আমাদের সত্যিই সহায়তা দরকার। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে পানির তীব্র সংকট রয়েছে। ভূমিকম্পে সেখানে সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
আরও পড়ুনফিলিপাইনে শক্তিশালী ভূমিকম্পে নিহত অন্তত ২৬, চলছে উদ্ধারকাজ৫ ঘণ্টা আগে