মহানবী (সা.) কীভাবে ভুল সংশোধন করতেন
Published: 19th, June 2025 GMT
ভুল মানবজীবনের একটি স্বাভাবিক অংশ। এটি আমাদের তওবা করতে, শিখতে ও জ্ঞানী হতে সাহায্য করে। মহানবী (সা.) ভুলকে লজ্জার কারণ নয়, বরং শিক্ষণীয় মুহূর্ত হিসেবে বিবেচনা করতেন। সাহাবিরা কখনো ছোট, কখনো গুরুতর ভুল করতেন। নবীজি এই ভুলগুলো উপযুক্ত আচরণের মধ্য দিয়ে সংশোধন করতেন। মহানবী (সা.) ভুল সংশোধনের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
১.
ভুলের সমাধান করা
মহানবী (সা.) ভুলকে সমাধান ছাড়া রেখে দিতেন না। তিনি ব্যক্তির সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা করে কখনো গোপনে, কখনো সুবিধামতো সময়ে ভুল সংশোধন করতেন। কখনো তাঁর আচরণই সাহাবিদের বুঝিয়ে দিত কিছু ভুল হয়েছে। গুরুতর ভুলের ক্ষেত্রে তিনি জোর দিয়ে বারবার কথা বলতেন।
তারা তাদের ভাইয়ের মাংস খেয়েছে, যা তাদের দাঁতের মাঝে দেখা যাচ্ছে। তারা নবীজির কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি বলেন, তাদের ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে।’সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৮৮০উসামা ইবন জায়েদ (রা.) একবার একজন শত্রু সৈনিককে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার পরও তাঁর ওপর তরবারি চালিয়ে দেন। এটি শুনে নবীর মুখভঙ্গি বদলে যায়। তিনি বারবার বলতে থাকেন, ‘তুমি তাকে কীভাবে হত্যা করলে, যখন সে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলেছিল?’ এই পুনরাবৃত্তির কারণে উসামা এতটাই অনুতপ্ত হন যে তিনি বলেন, তার মনে হয়, তিনি আজই মুসলিম হলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪,২৬৯; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৬)
আরও পড়ুনমহানবী (সা.) কীভাবে প্রতিরোধ করেছিলেন১০ মে ২০২৫মক্কা বিজয়ের পর আবু মাহজুরা নামের এক কিশোর ও তার বন্ধুরা বিলাল (রা.)-এর আজানের সময় তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা করে। নবীজি তাকে ডেকে পাঠান। ভয়ে কাঁপতে থাকা কিশোরকে তিনি তিরস্কার করেননি।২. সৌজন্য বজায় রাখা
নবীজি সাহাবিদের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন। তিনি ভুল সংশোধনের সময়ও সৌজন্যবোধ হারাতেন না।
একবার এক বেদুইন মসজিদে প্রথমবার প্রবেশ করেন। তিনি উচ্চস্বরে দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ, আমাকে ও মুহাম্মদকে ক্ষমা করো, কিন্তু অন্য কাউকে ক্ষমা করো না।’ নবীজি (সা.) হাসেন ও সৌজন্যের সঙ্গে বলেন, ‘তুমি একটি বিশাল জিনিসকে সীমিত করছো।’
সেই লোকই বা অন্য কোনো লোক মসজিদের মেঝেতে প্রস্রাব করেন। নবীজি বিচলিত সাহাবিদের শান্ত করেন এবং লোকটিকে একা ছেড়ে দিতে বলেন। বেদুইন পরে বলেন, ‘আমার মা-বাবা তাঁর জন্য উৎসর্গ হোক। তিনি আমাকে তিরস্কার বা অপমান করেননি।’ তিনি কেবল বলেছেন, ‘এই মসজিদে প্রস্রাব করা যায় না, এটি নামাজ ও আল্লাহর স্মরণের স্থান। তারপর তিনি এক বালতি পানি এনে মেঝেতে ঢেলে দিতে বলেন।’ (সুনানে ইবন মাজাহ, হাদিস: ৫২৯)
৩. কৌশলী হওয়া
নবীজি অগ্রাধিকার বিবেচনা করতেন, সমস্যার সমাধান দিতেন এবং জানতেন কখন কঠোর বা নরম হতে হবে। তিনি বুঝতেন, কখন কেউ ভুলের পরিণতি বহন করতে পারবে।
মক্কা বিজয়ের পর আবু মাহজুরা নামের এক কিশোর ও তার বন্ধুরা বিলাল (রা.)-এর আজানের সময় তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা করে। নবীজি তাকে ডেকে পাঠান। ভয়ে কাঁপতে থাকা কিশোরকে তিনি তিরস্কার করেননি। তিনি তার কণ্ঠ পরখ করেন, আজানের শব্দগুলো তাকে শেখান এবং তার বুকে হাত রেখে দোয়া করেন। আবু মাহজুরা পরে মক্কার মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পান। (সুনানে ইবন মাজাহ, হাদিস: ৭১৫)
৪. অযথা কঠোরতা প্রয়োগ না করা
কখনো কখনো কঠোরতা ব্যক্তিগত সংশোধনের জন্য জরুরি। তিনি জানতেন কখন কঠোর বা নরম হতে হবে।
যখন দুজন সাহাবি পরনিন্দা করছিলেন, নবীজি কঠোর শব্দে বলেন, ‘তারা তাদের ভাইয়ের মাংস খেয়েছে, যা তাদের দাঁতের মাঝে দেখা যাচ্ছে। তারা নবীজির কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি বলেন, তাদের ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৮৮০)
আরেকবার তরুণ ফজল ইবন আল-আব্বাস (রা.) নবীজির সঙ্গে সওয়ার ছিলেন। এক সুন্দরী নারী প্রশ্ন করতে এলে ফজল তাকিয়ে থাকেন। নবীজি তাঁর চিবুক ধরে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,২২৮)
আবু লুবাবা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারেন তিনি নবীর বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন। তিনি মসজিদে গিয়ে নিজেকে গাছের সঙ্গে বেঁধে শপথ করেন, আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত তিনি নড়বেন না।আরও পড়ুনমহানবী (সা.) যেভাবে সমালোচনা মোকাবেলা করতেন০৯ মে ২০২৫৫. মানুষের মর্যাদা রক্ষা করা
নবীজি ভুলের সমালোচনা করতেন, ব্যক্তিকে নিন্দা করতেন না।
একবার কিছু লোক মদ্যপানে মাতাল এক ব্যক্তিকে অভিশাপ দিচ্ছিলেন। নবীজি বলেন, ‘তাকে অভিশাপ দিয়ো না… আমি জানি, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৭৮০)
এক যুবক রাতের নামাজ অবহেলা করছিলেন। নবীজি তাঁকে উৎসাহিত করে বলেন, ‘আবদুল্লাহ কত চমৎকার মানুষ, যদি সে রাতে নামাজ পড়ত…’ এরপর আবদুল্লাহ কখনো রাতের নামাজ ত্যাগ করেননি। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৪৭০)
তাকে অভিশাপ দিয়ো না… আমি জানি, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৭৮০৬. দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা
আবার আবু লুবাবা (রা.) বনু কুরাইজার কাছে দূত হিসেবে গিয়ে এমন ভঙ্গি করেন, যা মুসলিমদের পরিকল্পনা প্রকাশ করতে পারত। তিনি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারেন তিনি নবীর বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন। তিনি মসজিদে গিয়ে নিজেকে গাছের সঙ্গে বেঁধে শপথ করেন, আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত তিনি নড়বেন না। অবশেষে তাঁর ক্ষমার আয়াত নাজিল হয়। নবীজি নিজ হাতে তাঁকে খুলে দেন। (তাফসির ইবন কাসির, সুরা তাওবা, আয়াত: ১০২)
তাবুকের যুদ্ধে তিনজন সাহাবি নবীজির সঙ্গে যাননি। মুনাফিকরা মিথ্যা অজুহাত দেখালে নবী তাঁদের ক্ষমা করেন, কিন্তু এই তিনজন সত্য স্বীকার করেন যে তাঁদের কোনো যথাযথ অজুহাত নেই। তাঁদের এক মাসের বেশি সময় সবাই বর্জন করেন, যা ছিল তাঁদের জন্য কঠিন পরীক্ষা।
তবে এই প্রক্রিয়া তাঁদের পবিত্র করে এবং আল্লাহ তাঁদের ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে আয়াত নাজিল করেন। নবীজি বলেন, ‘সকল মানুষ প্রায়ই ভুল করে। যারা প্রায়ই ভুল করে, তাদের মধ্যে সর্বোত্তম তারা, যারা আল্লাহর কাছে তওবা করে।’ (সুনান তিরমিজি, হাদিস: ২,৩৩৯)
সূত্র: মুসলিম ম্যাটার্স
আরও পড়ুনকঠিন সময়ে মহানবী (সা.)-এর জয়ের কৌশল১১ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সহ হ ব খ র আল ল হ মসজ দ ন করত করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
সরবরাহ পর্যাপ্ত, দামও নাগালে
‘হিমসাগর আমের কেজি ৮০’, ‘পেয়ারার কেজি নেন ৫০’– হ্যান্ডমাইকে রেকর্ড করা এমন প্রচারণা চালিয়ে ভ্যানগাড়িতে ফল বিক্রি করছেন শাহ আলম নামের এক বিক্রেতা। বুধবার বিকেলে ফার্মগেট এলাকায় তাঁকে ঘিরে দেখা গেল ক্রেতার ভিড়। কেউ আম কিনছেন, কেউ কিনছেন জাম কিংবা পেয়ারা।
শাহ আলমের মতো আরও কয়েকজন ব্যবসায়ীকে সেখানে ভ্যানগাড়িতে করে বিভিন্ন দেশি মৌসুমি ফল বিক্রি করতে দেখা যায়। প্রত্যেকের ভ্যানে রয়েছে হ্যান্ডমাইক। দাম কত? ক্রেতার এমন প্রশ্নের বারবার জবাব দেওয়ার বিকল্প হিসেবে তারা এই মাইক ব্যবহার করছেন।
শুধু ফার্মগেট নয়, রাজধানীর সব বাজার এখন ভরপুর বিভিন্ন মৌসুমি ফলে। কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট ও শান্তিনগর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দেশি ফলের দাপট বেশি। প্রতিটি দোকান থরে থরে সাজানো আম, জাম, লিচু, কাঁঠালসহ নানা মৌসুমি ফলে। দাম নাগালে থাকায় ক্রেতারাও কিনছেন চাহিদামতো।
বিভিন্ন জাতের আমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হচ্ছে আম্রপালি। খুচরা পর্যায়ে আকারভেদে এ জাতের আমের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১১০ টাকায়। এ ছাড়া প্রতি কেজি হাঁড়িভাঙা আম ৭০ থেকে ৮০, হিমসাগর ৯০ থেকে ৯৫ ও ল্যাংড়া আমের কেজি ৭৫ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বোম্বে, চায়না, জিরান নামের কয়েক ধরনের লিচু যাওয়া যাচ্ছে বাজারে।
প্রতি একশটি বোম্বে লিচু ৪০০ থেকে ৪৫৫ ও জিরান লিচু ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। কালো জামের দামও বেশি নয়। প্রতি কেজি কেনা যাচ্ছে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায়। লটকনের কেজি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। পেয়ারার দর আরও কম। প্রতি কেজি পাওয়া যাচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়।
বিক্রেতারা বলছেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার দেশি ফলের উৎপাদন ভালো হয়েছে। দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে, বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সাতক্ষীরা এলাকা থেকে প্রতিদিন ট্রাকে করে হাজার হাজার মণ আম আসছে ঢাকায়। দিনাজপুর, রাজশাহী, যশোর ও নরসিংদী অঞ্চল থেকে আসছে লিচু। এভাবে অন্যান্য জেলা থেকেও নানা ফল আসছে ঢাকায়। তবে প্রায় কাছাকাছি সময়ে সব ফল চলে আসার কারণে দাম কমে গেছে বলে জানা তারা।
কারওয়ান বাজারের খুচরা ফল বিক্রেতা মামুন হোসেন সমকালকে বলেন, প্রতিদিন রাতে ট্রাক ভরে প্রচুর পরিমাণে ফল আসছে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। আম, জাম, লিচু, ড্রাগন সব একসঙ্গে আসছে। এ কারণে দাম পড়ে গেছে। তবে আম বেশি আসছে বলে জানান এই ফল বিক্রেতা।
কথা হয় পাইকারি ফল ব্যবসায়ী সাইফুল আলমের সঙ্গে। আম বিক্রি করা এই ব্যবসায়ী বলেন, এবার উত্তরাঞ্চল থেকে এত বেশি ফল আসছে যে বিক্রি করে শেষ করা যাচ্ছে না। ফল পাকলে বেশি সময় রাখা যায় না, পচে যায়। তাই দাম কম হলেও তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়। পাইকারিতে জাত ও আকারভেদে আমের কেজি ৫০ থেকে ৭০ টাকা করে বিক্রি করেন বলে জানান তিনি।
দাম নিয়ে ক্রেতার অনেকেই খুশি। ফার্মগেটে ভ্যানগাড়ি থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে হাঁড়িভাঙা জাতের পাঁচ কেজি আম কিনেছেন গৃহিণী সায়েরা আলম। একই সঙ্গে ১৫০ টাকা দরে ড্রাগন ফল কিনেছেন দুই কেজি। দামের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, ‘ঈদের আগে আমের কেজি কিনেছি ৯০ টাকা, ড্রাগন কিনেছি আড়াইশ টাকায়। সেই তুলনায় দাম এখন মোটামুটি অনেক কম।’
তবে দাম নিয়ে অসন্তোষও রয়েছে কারও কারও মধ্যে। কারওয়ান বাজার থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে এক পাল্লা (৫ কেজি) আম্রপালি কিনেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী আমির হোসেন। কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে সমকালকে তিনি বলেন, ‘খবরে শুনতেছি ২০-৩০ টাকা কেজি দরে আম বিক্রি করছেন চাষিরা। তাদের খরচও উঠছে না। কিন্তু ঢাকায় কিনলাম ১০০ টাকায়। তাহলে আমাদের লাভ হইল কই! বেশি দামেই কিনতে হইল।’