কিছু দল অতীতের ত্রুটিপূর্ণ ক্ষমতাকাঠামোয় গিয়ে ‘ম্যানিপুলেট’ করার কথা ভাবছে: হাসনাত আবদুল্লাহ
Published: 19th, June 2025 GMT
কিছু দল অতীতের ত্রুটিপূর্ণ ক্ষমতাকাঠামোয় গিয়ে ‘ম্যানিপুলেট’ (নিজ উদ্দেশ্য সাধনে কাজে লাগানো) করার কথা ভাবছে বলে অভিযোগ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শেষে এ কথা বলেন তিনি।
আলোচনায় কিছু রাজনৈতিক দল পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে না মন্তব্য করে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘অতীতে রাষ্ট্রকাঠামোয় ত্রুটি থাকার ফলেই আমাদের এই পরিস্থিতিতে বসতে হচ্ছে। অতীতের কাঠামো সঠিক থাকলে গণ–অভ্যুত্থান হতো না। কাজেই যাঁরা আলোচনায় অনড় অবস্থান ধরে রাখতে চান, তাঁরা পরিস্থিতিকে আমলে নিচ্ছে না।’
এ প্রসঙ্গে হাসনাত আবদুল্লাহ আরও বলেন, ‘আমরা বলতে চাই, জনগণবিবর্জিত ক্ষমতাকাঠামো কখনো স্থায়ী নয়।’ আলোচনা সমাপ্ত হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতীয় নাগরিক পার্টি ইলেকটোরাল কলেজের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুইবারের বেশি হলে ক্ষমতা এককেন্দ্রিক হয়ে যায় উল্লেখ করে এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘আমরা ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়েছি। কারণ, একই ব্যক্তি বারবার প্রধানমন্ত্রী হলে ক্ষমতা ফ্যাসিবাদী কাঠামোর দিকে যায়। এই পদ্ধতিতে যেকোনো দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক কাঠামোও ভেঙে যায়।’
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজের ভোট গোপন ব্যালটে গ্রহণের পক্ষে মত দিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘সংসদের নিম্নকক্ষে মোট ভোটের আনুপাতিক হারে উচ্চকক্ষে আসন বরাদ্দের পক্ষে এনসিপি মতামত দিয়েছে।’
এ ছাড়া রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে ফ্যাসিবাদের বিভিন্ন সহযোগী ব্যক্তি ও উপাদান আবার সক্রিয় হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এর দায় অন্তর্বর্তী সরকারের।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
নারী আসন নিয়ে পুরুষদের এত আপত্তি কেন
সব সম্ভবের বাংলাদেশ। এখানে যাঁরা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে উচ্চকণ্ঠ, তাঁদের সঙ্গে প্রকৃত শ্রমিকদের সম্পর্ক ক্ষীণ। যাঁরা কৃষকের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, তাঁরা কৃষকের সমস্যাটাই জানেন না। শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে তাঁরাই মাঠ গরম করেন, যাঁদের ছাত্রত্ব অনেক আগেই শেষ হয়েছে।
চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে যে নারী সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, রাষ্ট্র সংস্কারে তারাই সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হলো। সরকার গঠিত ১১টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে নারী অধিকারসংক্রান্ত কমিশন ছাড়া কোনোটির প্রধান পদে নারী ছিলেন না। অন্যান্য কমিটিতে নারী বা সংখ্যালঘু ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নারীর অধিকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ম্যারাথন আলোচনা করলেও কমিশনে কোনো নারী প্রতিনিধি ছিলেন না। এ ছাড়া তারা যেসব দলের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের মধ্যেও নারী প্রতিনিধি ছিলেন খুবই কম। অর্থাৎ জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আলোচনাটি হয়েছে কার্যত নারীকে বাদ দিয়ে। আর এত দীর্ঘ আলোচনার পর জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে যে সিদ্ধান্ত হলো, তা পর্বতের মূষিক প্রসব ছাড়া আর কিছু নয়।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, নারী আসন ১০০ করা ও সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করা। বর্তমানে সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত আসন আছে, যা দলীয় আসনের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভায় রাজনৈতিক দলগুলো আসন বাড়ানোর বিষয়ে একমত হলেও ভোটের পদ্ধতি নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি। এদের মধ্যে এমন দলও আছে, যারা নারীর প্রতিনিধিত্বেই বিশ্বাস করে না।
কিছু রাজনৈতিক দল ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে অতিরিক্ত ১০০ আসনে সরাসরি ভোট করার পক্ষে ছিল, যা অনেকটা মহিলা পরিষদের দেওয়া প্রস্তাবের কাছাকাছি। মহিলা পরিষদ বিদ্যমান ৩০০ আসনের মধ্যে ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে সরাসরি ভোটের প্রস্তাব দিয়েছিল। সংবিধান সংস্কার কমিশন আসন বাড়িয়ে ৪০০ করার কথা বলেছে। বিএনপিসহ বেশ কিছু দল এই প্রস্তাব নাকচ করে এই যুক্তিতে যে নতুন করে আসনবিন্যাস করতে হলে নির্বাচন পিছিয়ে যাবে।
শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিদ্যমান ৫০ আসনের পাশাপাশি ৫ শতাংশ হারে নারী প্রার্থী বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়, যা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো খুব আপত্তি করেনি। নারী সংগঠনগুলোর মূল আপত্তিই ছিল সংরক্ষিত আসনব্যবস্থায়; যেখানে জনগণের ভোট নয়, দলীয় নেতৃত্বের কৃপায় এমপি হতে হয়।
নারী সংগঠনগুলোর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জবাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ কমিশনের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, সংসদে নারীদের জন্য আসন বাড়ানো ও সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া হলেও তারা তা শোনেননি। দলগুলো ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে।
এই অভিযোগ ও আর্তি কেবল ফাতেমা খানমের নয়। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ নেওয়া অনেক নারী নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছেন, হতাশা ব্যক্ত করেছেন। অনেকে সামাজিকভাবে হেনস্তারও শিকার হয়েছেন। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারক কিংবা আন্দোলনের পুরুষ সহযাত্রীরা তাদের পাশ দাঁড়িয়েছেন, এ রকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। বরং আমরা দেখছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সভাসমাবেশে একশ্রেণির লোক নারীদের হেনস্তা ও অসম্মান করতে পারলেই পুলকিত হন।তাঁর ভাষ্য থেকে আমরা আরও জানতে পারি, ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন ১০০ আসন বাড়িয়ে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এটাকে নতুনভাবে নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ করে নির্বাচন পেছানোর অজুহাত বলা শুরু করে। আমরা এমনও বলেছি, সংরক্ষিত আসন বাতিল করে দেন। দল থেকে ৩৩ শতাংশ নারীকে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়ন দেন। তাতেও দলগুলো রাজি হয়নি।’
আসলে রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের সংস্কার না হলে নারীর ক্ষমতায়ন যে সম্ভব নয়, তা আবারও তারা প্রমাণ করল। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তে নারী সংগঠনগুলো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। শনিবার ব্র্যাক সেন্টারে ‘নারীকে বাদ দিয়ে নারীর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় নারী অধিকারকর্মীরা কমিশনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের কোনো সুপারিশ জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গ্রহণ করেনি। নারী অধিকারকর্মীদের দেওয়া প্রস্তাবও উপেক্ষা করা হয়েছে।’
তাঁদের মতে, নারী অধিকারকর্মী ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা বাড়িয়ে সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচন করার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন এই সুপারিশ গ্রহণ করেনি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী নারী হলেও ঐকমত্য কমিশনে নারীর কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। কমিশন নারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। তারা শুধু রাজনৈতিক দলের কথায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রশ্ন আসে সরকার যদি নারীদের ক্ষমতায়নে এত দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, তাহলে ঢাকঢোল পিটিয়ে কমিশন গঠন করল কেন? সংসদে নারীদের জন্য আসন বাড়িয়ে ১০০ করে সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছিল নারীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন সংসদের আসন বাড়িয়ে ৬০০ করে ৩০০টি আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রেখে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছিল।
ঐকমত্য কমিশন যেসব দলের সঙ্গে আলোচনা করেছে, সেসব দল নারীর প্রতিনিধিত্ব করে কি না, সে প্রশ্ন তুলেছেন নারী সংগঠনের প্রতিনিধিরা। তারা বলেছেন, ‘যেসব রাজনৈতিক দল সেখানে আলোচনা করেছে, তারা কোনোভাবে নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে না। নারীদের বাদ দিয়ে সংস্কার হলে আগামী নির্বাচনে নারীরা ভোট দেবেন না।’
অন্যদিকে মহিলা পরিষদ এক বিবৃতিতে ২০৪৩ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদে মনোনয়নের মাধ্যমে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন বহাল রাখার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তকে ‘পশ্চাৎপদ’ বলে অভিহিত করে।
জাতীয় সংসদে নারীর আসনসংখ্যা ও নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে যখন বিতর্ক চলছে, তখন চট্টগ্রাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রামের সাবেক মুখপাত্র ফাতেমা খানমের ফেসবুকে দেওয়া বার্তাটি চোখে পড়ল। তিনি বলেছেন, ‘চট্টগ্রামে যাঁদের সঙ্গে জুলাই আন্দোলন করেছি, তাঁরাই আজ নারীদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বয়ান (ন্যারেটিভ) তৈরির চেষ্টা করছেন। নারীদের ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন। এগুলো নেওয়া যায় না।’
গত শুক্রবার রাত ১০টা ৪৪ মিনিটে নিজের ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে আসেন ফাতেমা খানম। এ সময় তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের কিছুসংখ্যক মানুষের স্বার্থের কাছে, তাঁদের চাওয়া-পাওয়ার কাছে আমাদের রাজনীতি হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছেন আন্দোলনের সম্মুখসারিতে থাকা অনেকে। এখন বলতে গেলে কেউই নেই। এই সবকিছুর জন্য কিছুসংখ্যক ভাই-ব্রাদার দায়ী। তাঁরা কেন্দ্রের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চট্টগ্রামে একটার পর এক কোরাম বানিয়েছেন। এর দায় আপনাদের নিতে হবে।’
এই অভিযোগ ও আর্তি কেবল ফাতেমা খানমের নয়। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ নেওয়া অনেক নারী নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছেন, হতাশা ব্যক্ত করেছেন। অনেকে সামাজিকভাবে হেনস্তারও শিকার হয়েছেন। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারক কিংবা আন্দোলনের পুরুষ সহযাত্রীরা তাদের পাশ দাঁড়িয়েছেন, এ রকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। বরং আমরা দেখছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সভাসমাবেশে একশ্রেণির লোক নারীদের হেনস্তা ও অসম্মান করতে পারলেই পুলকিত হন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংসদে নারীর আসন ও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে যে উপসংহারে এল, তা কোনোভাবে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
সোহরাব হাসান, কবি ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
মতামত লেখকের নিজস্ব